স্নাতকোত্তর করে কয়েক বছর চাকরির চেষ্টা করেও কিছু হলো না। শেষে কুলপদ্দী বাজারে আমার বাবার মুদিদোকানে সময় দিতে শুরু করলাম। পড়াশোনা করেও জীবনটা এভাবে আটকে যাবে, মেনে নিতে পারতাম না। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো না। বড় ছেলে হিসেবে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার স্বপ্ন দেখতাম। আমাদের এলাকার অনেকেই বিদেশ থাকে। আমিও ওয়ার্ক পারমিট জোগাড়ের চেষ্টায় নেমে পড়লাম। কোনোভাবেই যখন পারলাম না, তখন আমার এক মামার মাধ্যমে দালাল বোম্বাই রিপনের (সরদার) সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি মরক্কোর ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দিলেন। সে দেশে কিছুদিন থেকে সুযোগ বুঝে ইউরোপের স্পেন বা ইতালিতে পাড়ি জমাতে পারব।

আমার সঙ্গে এলাকার আজাদ হোসেনও যোগ দিল। আমরা দুজন সমবয়সী। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। মামার মাধ্যমে আমরা দুজন দালালের সঙ্গে চুক্তি করলাম। ১৭ লাখ টাকায় স্পেন বা ইতালি পৌঁছে দেবে। কথামতো পাসপোর্টসহ যাবতীয় কাগজ তাঁর লোকজনকে দেওয়া হলো। নগদ অর্থ নিল সাড়ে চার লাখ। দিনকয়েক পর আমাদের যাত্রার তারিখ জানানো হলো।

মিসরের বিমানবন্দরে ২৩ ঘণ্টা

২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর আমাদের যাত্রার দিন। ঢাকায় আমাদের হাতে শ্রীলঙ্কার টিকিট আর কিছু ডলার ধরিয়ে দিয়ে রিপন জানালেন, সব বিমানবন্দরে তাঁর লোকজন আছে। আমাদের কোনো চিন্তা নেই।

ঢাকা থেকে প্রথমে ভারতের চেন্নাইয়ে নিল। সেখানে ১৬ ঘণ্টার ট্রানজিট শেষে পরদিন পৌঁছালাম শ্রীলঙ্কা। একদিন শ্রীলঙ্কায় রাখল। তারপর দুবাই হয়ে গেলাম মিসর। এখান থেকে সরাসরি মরক্কো যাওয়ার কথা। মিসরের বিমানবন্দরে আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হলো। ভাবলাম, ভিসা করার জন্য নিয়েছে। সেখানে আমাদের মতো আরও ৪০-৫০ জন বাংলাদেশিকে পেলাম। তাদেরও বিভিন্ন দেশে যাওয়ার কথা। ২৩ ঘণ্টা পর পাসপোর্ট হাতে পেয়েই বুঝতে পারলাম, প্রতারণার শিকার হয়েছি। কারণ, আমাদের লিবিয়ার ভিসা দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই দেশে আমাদের যাওয়ারই কথা না। দালালদের একজন আমাদের কাছে এসে জানাল, চিন্তার কিছু নেই, আমাদের লিবিয়া থেকে আলজেরিয়া হয়ে মরক্কোতে নেওয়া হবে।

বাধ্য হয়ে লিবিয়ার বিমানে চড়ে বসলাম।

গামছা আর লুঙ্গি দিয়ে চোখ, নাক, মুখ বেঁধে উলঙ্গ করে পেটাল একদিন। সেই দৃশ্য ভিডিও করে বাড়িতে পাঠাল। শারীরিকভাবে যত নির্যাতন করা যায়, সবই তারা করতে থাকল। কোনো কোনো দিন মনে হতো বোধ হয় মরেই যাব।

দফায় দফায় বিক্রি

লিবিয়ার বেনগাজিতে দালালের স্থানীয় লোকজন ছিল। তাদের সঙ্গে ত্রিপোলি পৌঁছালাম ১৯ অক্টোবর। তত দিনে আমাদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন আরও দুজন। তাঁদের বাড়িও মাদারীপুর। সবাইকে ৫ কি ৬ দিন ত্রিপোলির একটা রুমে রাখল তারা। তারপর একদিন সকালে আমাদের একটা গাড়িতে তোলা হলো। এই গাড়িই আলজেরিয়ার সীমান্তে পৌঁছে দেবে। এক অজানা শঙ্কা নিয়ে চলতে থাকলাম। ৪-৫ ঘণ্টা পর একটা জায়গায় গাড়ি থামল। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে যেতেই কিছু পুলিশ এসে আমাদের ধরল। সবার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিল। কাছাকাছি একটি পুলিশ ফাঁড়িতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। বুঝতে পারলাম, দালাল চক্র আমাদের পুলিশের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। একদিন পর পুলিশের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে মামাকে কল দিলাম। উচ্ছ্বাস নিয়ে তাঁর প্রশ্ন, ‘কেমন আছস, মামা? মরক্কোতে পৌঁছে গেছস?’

রাগে-ক্ষোভে তাঁকে গালিগালাজ করতে লাগলাম। বললাম, আমরা পুলিশের কাছে বন্দী। তাঁর সঙ্গে কথা বলা শেষ করে বাড়িতে কল দিয়ে জানলাম, দালাল চক্র জানিয়েছে, আমরা মরক্কো যাচ্ছি তাই মোবাইল সঙ্গে নেই। চুক্তি অনুযায়ী বাদবাকি টাকাও তারা নিয়ে গেছে।

দালাল চক্রের সঙ্গে কথা হলো। তারা জানাল, এক হাজার ডলার দিলে পুলিশ ছেড়ে দেবে। দালাল চক্রকে দেওয়া হলো সেই টাকা। পুলিশ এবার আমাদের লিবিয়ার মাফিয়াদের হাতে তুলে দিল। জেলখানার মতো জায়গায় আমাদের রাখা হলো। রুমে রুমে আমাদের মতো ৬০ জনের বেশি মানুষ। সবাই বাংলাদেশি। পাঁচ দিন সেখানেই কেটে গেল। আমাদের মাধ্যমে পরিবারের কাছে জনপ্রতি ৫ হাজার ডলার মুক্তিপণ দাবি করল তারা। এত টাকা কীভাবে দেবে আমার পরিবার?

আমাদের ওপর নির্যাতন শুরু হলো। গামছা আর লুঙ্গি দিয়ে চোখ, নাক, মুখ বেঁধে উলঙ্গ করে পেটাল একদিন। সেই দৃশ্য ভিডিও করে বাড়িতে পাঠাল। শারীরিকভাবে যত নির্যাতন করা যায়, সবই তারা করতে থাকল। কোনো কোনো দিন মনে হতো বোধ হয় মরেই যাব। এ সময় দুপুরে অল্প একটু নুডলস খেতে দিত। রাতে দিত এক পিস রুটি বা সামান্য নুডলস। এই খেয়ে কি পেট ভরে? খাবারের জন্য কিছু বললে আরও বেশি বেশি মারত।

অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে কয়েক দিন পর তাদের কাছ থেকে মুক্তি পাই। পরে বাড়িতে কথা বলে জানতে পারি, এর মধ্যে আরেকজন দালালের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে। জনপ্রতি ৮ লাখ টাকা করে দিয়ে আমাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৮ কি ১৯ নভেম্বর থেকে ফরহাদ নামের সেই দালালের তত্ত্বাবধানেই দিন কাটতে থাকে।

স্থানীয় থানায় জিডি করা হয়। বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আমাদের দেশে ফেরার প্রস্তুতি চলতে থাকে। এর মধ্যেই একদিন ফরহাদ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তওবা কেটে বললাম, আমরা দেশে ফিরতে চাই।

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে গত ২৬ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসি আমরা।

পরিবার সর্বস্ব হারিয়েছে

পরিবারে আমার মা–বাবাসহ ছোট দুই ভাই ও স্ত্রী। সবাইকে ভালো রাখতেই এই পথে পা বাড়িয়েছিলাম। আমাকে বাঁচাতে আমার পরিবার জমিজমা, সোনাদানা, হালের গরু-ছাগল বিক্রি করে দিয়েছে। বাড়িটাও বন্ধক রেখে সুদে টাকা নিয়েছে। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের থেকেও টাকা ধার নিয়েছে। আমাকে ছাড়িয়ে আনতে ধাপে ধাপে সব মিলিয়ে ৩৩ লাখ টাকা গেছে। এত ধার-দেনা এখন কীভাবে শোধ করব, জানি না।

আপাতত বাবার মুদিদোকানে সময় দিচ্ছি। ওখানে যে আয়রোজগার হয় তা দিয়ে পুরো পরিবারটা চলে না। নতুন করে নিজে কিছু করব, তারও উপায় নেই। পরিবারের জন্য এখন একটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছি। নতুন করে আর কোনো কিছুই ভাবতে পারছি না। স্বপ্নগুলো এখন দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র আম দ র পর ব র র মরক ক একদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

বিগ-বির মাধ্যমে জাপানের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী বাংলাদেশ

এক দশক আগে বঙ্গোপসাগর ঘিরে বাংলাদেশের জন্য বিগ-বি নামে পরিচিত বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট গ্রহণ করেছিল জাপান। বঙ্গোপসাগরীয় শিল্প প্রবৃদ্ধির ওই উদ্যোগে রয়েছে মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ প্রকল্প আর আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার বিকাশ। মে মাসের শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জাপান সফরে বিগ–বির মাধ্যমে সহযোগিতা জোরদারের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। তাঁর জাপান সফরের আগে টোকিওতে ১৫ মে অনুষ্ঠেয় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকেও বিষয়টিতে প্রাধান্য দেবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে জাপানের আলোচনায় কোন কোন বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার থাকবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

১৫ মে টোকিওতে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে জসীম উদ্দিন বাংলাদেশের এবং জাপানের জ্যেষ্ঠ উপমন্ত্রী আকাহোরি তাকেশি তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।  
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে কোন কোন বিষয়গুলো ১৫ মের আলোচনায় প্রাধান্য পেতে পাবে, তা নিয়ে মতামত নেওয়া হয়। পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরসহ সচিব পর্যায়ের সফর নিয়ে আলোচনা হয়।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিগ–বিতে সহযোগিতা জোরদারের পাশাপাশি ব্যবসা, বিনিয়োগ, নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ খাতভিত্তিক সহযোগিতা জোরদারের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নানা বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফর নিয়ে আলোচনা হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, টোকিওতে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকটি দুই ভাগে বিভক্ত থাকবে। প্রথম ভাগে থাকবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা বিষয়। আর দ্বিতীয় ভাগে থাকবে আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি।

আঞ্চলিক বিষয়াদিতে জাপানের বিগ–বি নিয়ে আলোচনা হবে। এ সময় ঢাকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের বাস্তবতা তুলে ধরা হবে। সেই সঙ্গে এ প্রকল্প সামনে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও বলা হবে। পরে ভারত যদি এর সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, তবে তার ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হবে।

বিগ–বির সঙ্গে ২০২৩ সালে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলকে যুক্ত করে জাপান। কিন্তু ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে চরম টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক। এমন এক প্রেক্ষাপটে বিগ–বিকে বিশেষ করে সংযুক্তিকে বাংলাদেশের পরিমণ্ডলে নেওয়ার পরিকল্পনায় আপাতত একটা ধাক্কা এসেছে। এ নিয়ে জাপান নানাভাবে নিজেদের অস্বস্তির বিষয়টি বাংলাদেশকে জানিয়েছে। বিগ–বি জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের অগ্রাধিকার প্রস্তাব হওয়ায় এটিতে বিশেষ গুরুত্ব আছে টোকিওর। তাই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আগ্রহী জাপান।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং প্রধান উপদেষ্টার টোকিও সফরে জাপান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিবিড় করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কাছ থেকে সমরাস্ত্র বিক্রির ওপর কয়েক বছর ধরে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে জাপান।

বাংলাদেশকে ২০২৩ সালে জাপানের সরকারি নিরাপত্তা সহায়তায় (ওএসএ) যুক্ত করা হয়েছে। মূলত জাপান নিজের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে এই কাঠামো তৈরি করেছে। ওএসএর মাধ্যমে জাপান বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর করার এবং ওই দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা দিয়ে থাকে। ওএসএর মাধ্যমে জাপান একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে ঋণের পরিবর্তে অনুদান দিয়ে থাকে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ