খাল–নালায় পড়ে মৃত্যুর দায় নেয় না, তদন্তও করে না
Published: 21st, April 2025 GMT
চট্টগ্রাম নগরের অরক্ষিত নালা ও খালে পড়ে গত ৬ বছরে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এভাবে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও তা তদন্তে কোনো কমিটি গঠন করেনি নালা ও খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এতে কী কারণে এবং কাদের গাফিলতি ও অবহেলায় এ ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে, তা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।
মৃত্যুর ঘটনার মতো তদন্তের দায়িত্বও পরস্পরের কাঁধে চাপিয়ে নীরব আছে দুটি সংস্থা। এ কারণে দায়িত্বে গাফিলতির সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বারবার আড়ালে থেকে যাচ্ছেন।
গত শুক্রবার রাত আটটার দিকে মায়ের কোলে থাকা ছয় মাস বয়সী শিশু সেহরিশসহ তিনজনকে নিয়ে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নগরের হিজড়া খালে পড়ে যায়। রিকশায় থাকা শিশুটির মা ও দাদি খাল থেকে উঠে এলেও শিশুটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। ১৪ ঘণ্টা পরে পরদিন শনিবার সকালে নগরের চাক্তাই খাল থেকে শিশুটির নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনার তিন দিন পার হলেও গতকাল রোববার পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি চসিক ও সিডিএ। শুধু এ ঘটনাই নয়, এর আগের ১৩ মৃত্যুর ঘটনায়ও তদন্তের ব্যাপারে নীরব ছিল সংস্থা দুটি।
চট্টগ্রাম নগরের নালা ও খালগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং তত্ত্বাবধানের দায়ভার চসিক ও সিডিএর। সংস্থা দুটির হাতে নগরের ৫৭টি খাল এবং ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার নালার দায়িত্ব।
এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত ছিল বলে স্বীকার করেন চসিক ও সিডিএর দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তবে কেন গঠন করা হয়নি, তার দায় নিতে রাজি হননি তাঁরা।
আরও পড়ুনঅটোরিকশা উল্টে পড়ল খালে, নিখোঁজ ছয় মাসের শিশু১৮ এপ্রিল ২০২৫তদন্তে অনীহা দুই সংস্থার
গত ৬ বছরে নগরে খাল-নালায় পড়ে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ২ জন, ২০২১ সালে ৫, ২০২৩ সালে ৩, ২০২৪ সালে ৩ এবং চলতি বছর ১ জন।
খাল ও নালায় পড়ে মারা যাওয়া ১৪ জনের মধ্যে ৬টিই শিশু। তাদের একজনের বয়স মাত্র ছয় মাস। নারী মারা গেছেন পাঁচজন, আর পুরুষ তিনজন। তাঁদের মধ্যে একজনের মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি।
এই ১৪ জনের মধ্যে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে নগরের চশমা খালে পড়ে। মহেশ খালে পড়ে মারা গেছেন তিনজন। চাক্তাই, কলাবাগিচা, নাসির খাল ও হিজড়া খালে একজন করে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বাকি তিনজনের মৃত্যু হয়েছে নালায় পড়ে।
যে খালগুলোতে পড়ে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে, সবগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে সিডিএ। সেখানে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করছে সংস্থাটি। ২০১৮ সালে নগরের ৩৬টি খাল ও বড় নালাগুলোতে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ শুরু করে সিডিএ, এ কাজ এখনো চলমান। আর যেসব নালায় পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, সেগুলো সিটি করপোরেশনের আওতাধীন।
মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও কেন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি, জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নালা ও খালে পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় অবশ্যই তদন্ত কমিটি হওয়া উচিত। হিজড়া খালে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় চসিক ও সিডিএ যৌথভাবে তদন্ত করতে পারে। চাইলে বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনও করতে পারে। তবে এটি নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।
কাজী হাসান বিন শামস দাবি করেন, মুরাদপুরে চশমা খালে সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদের (৫০) তলিয়ে যাওয়ার ঘটনার পর খালের পাশে স্থায়ী নিরাপত্তাবেষ্টনী নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। বর্তমানে ১৯টি খালে দেওয়া হয়েছে। বাকি খালগুলোতেও কাজ চলছে। আর নগরের আগ্রাবাদে যে নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী মারা গিয়েছিলেন, সেটি ছিল সিটি করপোরেশনের। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি করলে তারা করতে পারত।
আরও পড়ুনচট্টগ্রামে খালে পড়ে নিখোঁজ শিশুর লাশ ১৪ ঘণ্টা পর উদ্ধার১৯ এপ্রিল ২০২৫বৃষ্টি হলে এসব নালা আর সড়ক পানিতে একাকার হয়ে যায়.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ত য র ঘটন য় জন র ম ত য ১৪ জন র ম তদন ত ক গঠন কর ত নজন নগর র
এছাড়াও পড়ুন:
‘অবৈধ’ বলে হকার উচ্ছেদের যৌক্তিকতা কতটুকু
‘অবৈধ’ বলে হকার উচ্ছেদের যৌক্তিকতা কতটুকু, তা নিয়ে লিখেছেন মোশাহিদা সুলতানা
২০০০-এর দশকে পেরুভিয়ান অর্থনীতিবিদ হার্নান্দো দে সোতো ক্যারিশম্যাটিক বক্তা হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন। তিনি মনে করতেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতির পূর্ণাঙ্গ বিকাশ অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলেই উন্নয়নশীল বিশ্বে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ৮০ শতাংশের বেশি। তাই ব্যক্তিমালিকানা নিশ্চিত হলেই উন্নয়ন হবে।
বাংলাদেশেও অনেক মানুষ ব্যক্তিমালিকানাকে বৈধতার মাপকাঠি মনে করেন। যখন দে সোতোকে শ্রোতারা প্রশ্ন করতেন, ভূমিসংকটে নিমজ্জিত শহরে, খাসজমিতে এই যে ভাসমান মানুষ এদিক–সেদিক ছড়িয়ে আছে, রাস্তায় দোকান খুলে বসেছে, তাদের কিসের ভিত্তিতে মালিকানা দেওয়া হবে? তিনি তাদের গল্প শুনিয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দিতেন।
তাঁর গল্পটা ছিল এ রকম: একদিন তিনি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে একটা গ্রামের ধানখেতের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হাঁটার সময় বোঝা যাচ্ছিল না কোন খেতের মালিক কে। তিনি দেখলেন কিছু দূর পরপর ভিন্ন ভিন্ন কুকুর এসে ঘেউ ঘেউ করে, আর চলে যায়। প্রতিটি মালিকের কুকুর জানান দিয়ে যায় তার নিজের সীমানা।
এ গল্পের মাধ্যমে উনি বোঝাতে চাইলেন, দুই রকমের মালিকানা রয়েছে, একটা হলো আইন বা চুক্তি দ্বারা স্বীকৃত অধিকার। আরেকটা হলো বাস্তবভিত্তিক মালিকানা, যা আইন দ্বারা স্বীকৃত না হলেও দখল, নিয়ন্ত্রণ বা অধিকার দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।
হার্নান্দো দে সোতোর ‘বার্কিং ডগ থিওরি’ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া জাগায়। দে সোতোকে শহরের দরিদ্রদের ভূমি মালিকানা বিষয়ে পরামর্শক হিসেবে বিভিন্ন দেশ নিয়োগ করে। কিন্তু বাস্তবে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল, কাজটা বালির গ্রামে কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ের মাধ্যমে মালিকানা শনাক্ত করার মতো সহজ নয়। দরিদ্র মানুষের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল অপ্রাতিষ্ঠানিক সম্পত্তির অধিকার উদ্ধার করা খুবই ব্যয়বহুল ও কঠিন কাজ, যা দে সোতো তাঁর তত্ত্বে গুরুত্ব দেননি বা উপেক্ষা করেছেন।
এ নিয়ে ২০০০-এর দশকজুড়ে উন্নয়ন অর্থনীতিবিদেরা বিভিন্ন সমালোচনা ও তথ্য-উপাত্তভিত্তিক গবেষণা হাজির করেন। যেমন শুয়ান গোল্ডফিঞ্চ দেখান যে আনুষ্ঠানিকীকরণ (ফরমালাইজেশন) দরিদ্র ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বাসিন্দাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কারণ, এটি ধনী ব্যক্তি বা করপোরেশনগুলোর দ্বারা তাদের উচ্ছেদ বা দখলের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। ইংরেজিতে এটাকে বলা হয় ‘ডাউনওয়ার্ড রেইডিং’ বা বাংলায় ‘নিম্নমুখী উচ্ছেদ’। আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা (ফরমাল সিস্টেম) ওই সব গ্রাম্য বা ঐতিহ্যবাহী ভূমির অধিকারকেও অপসারণ করতে পারে, যার ফলে দরিদ্র মানুষের নিরাপত্তা ও ভূমিহীনতার ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।
২.দে সোতোর তত্ত্বের মূল ধারণাগুলোর মধ্যে আরেকটি হলো আনুষ্ঠানিক মালিকানা থাকলে গরিব মানুষেরা সম্পদ জামানত রেখে ঋণের সুবিধা নিতে পারেন। তবে লাতিন আমেরিকা, সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং দে সোতোর নিজের জন্মভূমি পেরুতে একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্ন আয়ের মানুষদের মালিকানা থাকলেই আনুষ্ঠানিক ঋণের প্রাপ্যতা বাড়ার প্রমাণ খুবই কম। ব্যাংকগুলো এখনো আয় প্রত্যয়ন করার জন্য দলিল চায় এবং দরিদ্র অঞ্চলের নিম্নমূল্যের সম্পত্তি বন্ধক রাখতে চায় না।
এই তত্ত্বকে অনেক সময় একক সমাধান বা ‘সিঙ্গেল বুলেট’ হিসেবে দেখা হয়, যেখানে অন্যান্য জরুরি সংস্কারের কথা বিবেচনা করা হয় না। যেমন বিচারব্যবস্থা উন্নত করা, শক্তিশালী আর্থিক বাজার তৈরি, পুঁজির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা, নগর-পরিকল্পনায় ভাসমান মানুষদের অধিকার স্বীকৃতি দেওয়া, ক্ষমতার ভারসাম্য ও বৈষম্য দূর করা—এসব বিষয় উপেক্ষা করা হয়।
দে সোতোর তত্ত্বের এই প্রায়োগিক দিকের বাস্তবতা অনুধাবন করে শহরের খাসজমিতে ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠার বদলে সামষ্টিক মালিকানার অধিকারচর্চাই হয়ে আসছে। যৌথ ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, তার দায়িত্ব সরকারের। জনগণ সামষ্টিকভাবে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, পার্ক, জলাশয়ের মালিক। সরকার সেগুলো নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে। সেখানে সামাজিক চুক্তির বাইরে গিয়ে সামষ্টিক সম্পদ একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করলে সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করে।
নিয়ন্ত্রণ করা বলতে বোঝায় সব ব্যবহারকারীর স্বার্থ চিন্তা করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া। এখানে যদি একজন মানুষের স্বার্থও চরমভাবে বিঘ্নিত হয় যা কোনো কিছু দিয়েই প্রতিস্থাপনযোগ্য না, বা যার বিকল্প নেই, তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। এই নিয়ন্ত্রণ করার ধরন একেক দেশে একেক রকম। কোথাও পারমিট দেওয়া হয়, কোথাও জায়গা বরাদ্দ করে দেওয়া হয়, কোথাও হকারদের স্থানান্তর করার জন্য সরকারি সহায়তাও দেওয়া হয়।
জোরজবরদস্তি বা সহিংসতার মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা মানেই বাস্তবভিত্তিক অদৃশ্য সামাজিক চুক্তি ভঙ্গ করা। সব দেশেই এ ধরনের জোরজবরদস্তি ও সহিংসতাকে অমানবিক হিসেবেই গণ্য করা হয়।
৩.আদিমকালে মানুষ কোনো জমির মালিক ছিল না। পাহাড়, পর্বত, সমতল, নদী, বন, জলাশয়—সবকিছুই পৃথিবীর মানুষ ও জীবের যৌথ সম্পত্তি। মানুষ তার প্রয়োজনে এসব জমি বসবাসের উপযোগী করেছে। জমি কাজে লাগিয়ে খাদ্য উৎপাদন করেছে, গরু চরিয়েছে, নদী থেকে মাছ আহরণ করেছে। অর্থাৎ এই যৌথ সম্পদকে জীবনের তাগিদে মানুষ ব্যবহার করেছে যৌথভাবে।
পুঁজিবাদের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল এই জমিকে ব্যক্তিমালিকানাভুক্ত করে এর ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে। কার্ল মার্ক্স একে বলেছিলেন পুঁজিবাদের আদি পাপ বা মূল পাপ, যার মধ্য দিয়ে যৌথ মালিকানার চর্চা বিলুপ্ত হতে থাকে, বিশেষ করে জমির ওপর। তৈরি হয় অভিজাত ভূমি মালিকশ্রেণি। কতিপয়ের ভূমির মালিকানা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যেই শ্রেণি ভূমিহীন, হয় তারা অর্থ বা ফসলের বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করে হয় খেতমজুর শ্রেণি। ধীরে ধীরে যখন শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে, তখনো শিল্পকারখানায় শ্রম বিক্রি করে উদ্ভব হয় শ্রমিকশ্রেণির।
অর্থনীতি ও পুঁজির যতই বিকাশ হোক, এই যৌথ সম্পদ থাকতেই হবে। কারণ, একটা রাস্তা শুধু একজনের ব্যবহারের জন্য হতে পারে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, ফ্লাইওভার, পার্ক, মাঠ এগুলো যৌথ সম্পদ। দেশের সব প্রাকৃতিক সম্পদও—বন, পর্বত, খালবিল, নদী—যেমন জনগণের সম্পদ। বাংলাদেশে সহিংসতা ও জোরজবরদস্তি করে অন্যের ভূমি দখল চলছে। সেই প্রিমিটিভ অ্যাকুমুলেশন বা আদিম সঞ্চয়ন এখনো চলছে।
জীবিকার জন্য ব্যবহৃত ভূমি বা জায়গা থেকে যখন তাকে উচ্ছেদ করা হয়, তখন মানুষের মজুর হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। মজুরের দরকার চাকরি। চাকরি না পেলে তার দায়িত্বও সরকার নেয় না। কাজেই বাধ্য হয়েই মানুষ হকার হয়। আর এটাই তার জন্য বাস্তব সমাধান। এটাকেই বলা হচ্ছে বাস্তবভিত্তিক মালিকানা। এই মালিকানাকে অবৈধ বলা যাবে না, বলা যায় ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক চর্চা’।
৪.একজন হকার যখন রাস্তার একটা কোনায় একটা ঠেলাগাড়ি নিয়ে বসেন, বা একটা ভ্রাম্যমাণ কাঠামো নিয়ে বসেন, তিনি রাস্তার একাংশ দখল করেন। তাঁকে পণ্য বিক্রি করতে হলে সামনে–পেছনে জায়গা খালি রাখতে হয়, যেন খদ্দের এসে অন্তত দাঁড়াতে পারেন। হাঁটার পথ বাধাগ্রস্ত না করেই তাঁকে তা করতে হয়।
কিন্তু একজন ইটভাটার মালিক যখন নদীপাড়ের জায়গা ব্যবহার করে কালো ধোঁয়া ছড়ান, তখন দূষিত বাতাস নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করেন একজন পথচারীও। একজন চামড়া ব্যবসায়ী যখন বিষাক্ত কেমিক্যাল নদীতে নির্গত করেন, তখনো যৌথ সম্পদ বিনষ্ট হয়। সরকার যখন শহরের পার্কের জমি দখল করে কোনো কোম্পানিকে দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে বানায়, তখনো এক গোষ্ঠীর ব্যবহার বন্ধ করে অন্য গোষ্ঠীর জন্য সুযোগ তৈরি করে।
এখানে চারটা উদাহরণই কিন্তু যৌথ সম্পদের ব্যবহারের। কিন্তু পরের তিনটা উদাহরণে অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। অথচ আমরা দেখছি, বাংলাদেশে নদী, পাহাড়, বন ও পার্ক দখল চলছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই। সেগুলো নিয়ে প্রতিবাদে খুব বেশি মানুষ শামিল হয় না। অন্যদিকে দেশের স্বল্প ক্রয়ক্ষমতার ব্যক্তিরা রাস্তার দোকান থেকে সস্তায় কেনাকাটা করতে পারে বলেই বাজারের প্রয়োজনেই এই হকার শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে, তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাষ্ট্র। চড়াও হয় শুধু হকারের ওপরই।
বুলডোজার দিয়ে ভাঙার পরদিনই আবার কেন ওই একই জায়গায় অন্য হকারদের দেখা যায়—এই প্রশ্ন না করে একশ্রেণির মানুষ ‘অবৈধ’ সংজ্ঞার মধ্যে ফেলে উচ্ছেদের উৎসবে যুক্ত হয়। অবৈধ বলে কিছুদিন না যেতেই বেশি চাঁদা দিতে বাধ্য করে তাকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হয়। তাহলে তাদের অবৈধ বলা কেন?
কার স্বার্থে তাদের অবৈধ বলা হয়—এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। ‘অবৈধ’ আসলে হকার নাকি ‘অবৈধ’ আসলে সেই ব্যবস্থা, যার মধ্য দিয়ে হকারকে চাঁদা দিতে বাধ্য করা হয়? আর এই কাজগুলো যারা করে তাদের সামনে আনা হয় না কেন?
৫.ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠ। এর একটা ইতিহাস আছে। হকাররা এখানে এমনি এমনি আসেন না। তাঁরা যা বিক্রি করেন, তাঁর চাহিদা রয়েছে বলেই আসেন। এখানেও অদৃশ্য সামাজিক চুক্তির মাধ্যমেই একটা বাস্তবভিত্তিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জনগণের।
এখানে কারও একচেটিয়া মালিকানা নেই যে হকারদের সরাতে যে কেউ লাঠি নিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। একমাত্র সরকার পারে সমঝোতার মাধ্যমে বাস্তবসম্মতভাবে জায়গা নির্ধারণ করে দিতে, অনুমতি প্রদান করতে। যেকোনো অনানুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় অনুমোদন ভঙ্গ করে কেউ যদি সহিংসতার আশ্রয় নেয়, সেটাই বরং অন্যায়।
জাতিসংঘের ‘ইউএন হাবিটাট’ বহু বছর ধরে এশিয়ার দেশগুলোতে হকারদের সংকট ও অধিকার নিয়ে কাজ করছে। সংস্থাটির অবস্থান হলো, হকারদের অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে শহর–পরিকল্পনা করতে হবে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে শহরগুলোর উন্নয়নে হকারদের অধিকার রক্ষা অপরিহার্য। কারণ, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার ও স্থায়ী শহর গড়ে তোলার মূল ভিত্তি।
বাংলাদেশ কি জাতিসংঘের পরামর্শ অনুযায়ী নগর-পরিকল্পনা করেছে? হকারদের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেছে? তাদের বসবাসের জন্য কোনো জায়গা নগরীতে বরাদ্দ করেছে? আমাদের নগরগুলোয় হকারদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তাহলে বিকল্পের অভাবে, জীবন ও জীবিকার তাগিদে, কারও অপূরণীয় ক্ষতি না করে, তারা যদি বাস্তবভিত্তিক সমাধানে যায়, তাদের কি ‘অবৈধ’ বলা যায়? দরিদ্র বলেই কি তাদের অপরাধী বানাতে হবে? তাদের জীবিকার উৎসকে ‘অবৈধ’ বলতে হবে?
আমরা প্রায়ই শুনি বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানো হবে। অথচ সিঙ্গাপুর সরকার শহর–পরিকল্পনায় সক্রিয়ভাবে রাস্তার বিক্রেতাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়, যেন প্রকল্পগুলোতে হকার স্টলের সুরক্ষা ও স্থানান্তরের সুযোগ থাকে। শুধু তা–ই নয়, সিঙ্গাপুর সরকার হকার ও রাস্তার খাবারের বিক্রেতাদের সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রতিবছর পুরস্কৃত করে, আর্থিক সাহায্য দিয়ে তাদের উৎসাহিত করা হয়। এই সম্মান তাদের জীবিকার অধিকার রক্ষা করতে সহায়তা করে। অথচ আমরা নাকি হকার পিটিয়ে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানাতে চাই!
ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে স্বৈরাচারের আমলের মেয়র প্রার্থীর মতো কোনো এক মেয়র পদপ্রার্থী হকারের চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে ভোট চাইবেন। গণমাধ্যম আগের মতোই ফলাও করে তা প্রচার করবে, তখন এসব মানুষই ভুলে যাবেন আজকের হকারদের দোকান ভাঙার হাহাকার। তাঁরা ভুলে যাবেন গণমাধ্যমে এই হকারদের ‘অবৈধ’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল।
বৈধ-অবৈধর সংজ্ঞা যে দেশে ভোটের আগে এক রকম আর ভোটের পরে আরেক রকম, সে দেশে হকারদের অবৈধ বলার পেছনে গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি নেই। ভুক্তভোগীকে অপরাধীকরণ করে চাঁদাবাজদের ঘাঁটি শক্তিশালী করাই হকারদের ‘অবৈধ’ বলার মূল কারণ বলে প্রতীয়মান হয়।
ড. মোশাহিদা সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব