পিসার হেলানো টাওয়ার কেন হেলে পড়েছে
Published: 12th, June 2025 GMT
হাজার বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ ইউরোপের বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্যনির্ভর দেশ ইতালি। সেখানকার পিসা শহরে অবস্থিত এক টাওয়ারের স্থানীয় নাম ‘টরে পেনডেন্টে দ্য পিসা।’ প্রায় ৮৫০ বছরের পুরোনো এই স্থাপনাকে আমরা চিনি পিসার হেলানো টাওয়ার নামে। পিসা ক্যাথেড্রালের ঘণ্টাযুক্ত এ টাওয়ারটি হেলে থাকার জন্য বিখ্যাত। একদিকে ৫৫ দশমিক ৮৬ মিটার, অন্যদিকে ৫৫ দশমিক ৬৭ মিটার উচ্চতার এই ভবন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের কৌতূহলের বড় এক নিদর্শন। ভূমির সঙ্গে প্রায় ৪ ডিগ্রি হেলানো এ ভবনকে কেবল স্থাপত্যের দারুণ নিদর্শন বলা হয় না; ভূমি প্রকৌশল, পদার্থবিজ্ঞান ও স্থাপত্যের পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের ল্যাব বলা হয়। এই ভবন নির্মাণ শেষ করতে তিনবারে ১৯৯ বছরের বেশি সময় লেগে যায়। এর ওজন প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার টন। টাওয়ারে ২৯৪ থেকে ২৯৬টি সিঁড়ি আছে।
১৫৮৯ থেকে ১৫৯২ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় এই টাওয়ারে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পরিচালনা করেন বলে জানা যায়। গ্যালিলিওর বিখ্যাত পড়ন্ত বস্তুর সূত্র পরীক্ষা করেন এই টাওয়ারে। বাধাহীন পথে পড়ন্ত সব বস্তু সমান সময়ে সমান পথ অতিক্রম করে বলে প্রমাণ করেন তিনি।
বছরে ৫০ লাখ দর্শনার্থী এখন এই টাওয়ার দেখতে আসেন। পিসার হেলানো টাওয়ারের শুরুতে কোনো ইচ্ছাকৃত ভুল বা স্থাপত্যনির্ভর কোনো কৌশল ছিল না। বলা হয়, স্থাপত্যগত ভুল ও ভবন নির্মাণ এলাকার ভূমির অপ্রত্যাশিত আচরণের ফল হিসেবে একটি সোজা ভবন হেলে যায়। ১১৭৩ সালের ৯ আগস্ট টাওয়ারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই ভবনের স্থপতি কে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বনানো পিসানো বা ডিওটিসালভি নামের স্থপতি এই টাওয়ারের নকশা করেন। স্থপতিরা নির্মাণের সময় ভিত্তি হিসেবে মাত্র তিন মিটার গভীর একটি অগভীর বৃত্তাকার ভিত্তি বেছে নেন। সেখান থেকেই হেলে যাওয়ার সমস্যা শুরু হয়। নির্মাণ শুরুর পরে ১১৭৮ সালে তৃতীয় তলা তৈরির পরেই টাওয়ারটি হেলতে শুরু করে।
সাধারণভাবে পিসা শহরটি আরনো নদীর পলিমাটি ও কাদামাটির ওপরে অবস্থিত। মাটি অত্যন্ত নরম। পিসা টাওয়ারের ভিত্তির নিচে মাটির তিনটি প্রধান স্তর রয়েছে। ওপরের স্তরে নদীর পলি ও বালুর মিশ্রণ, মধ্যবর্তী স্তরে সামুদ্রিক কাদামাটি আর সবচেয়ে নিচের স্তরে বালু। দ্বিতীয় স্তরে সামুদ্রিক কাদামাটি রয়েছে বলে এলাকাটি বেশি অস্থিতিশীল।
টাওয়ারের তৃতীয় তলার কাজ শেষ হওয়ার আগেই মাটির ওপরের অংশ অসমভাবে সংকুচিত হয়ে যায়। তখন টাওয়ারের দক্ষিণ দিকের মাটি বেশি দেবে যায়। এদিকের মাটি দুর্বল বলে টাওয়ার দক্ষিণ দিকে হেলতে শুরু করে। প্রকৌশলীরা এই সমস্যা সমাধানের জন্য তৃতীয় থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত নির্মাণ করার সময় টাওয়ারের উত্তর দিকের উচ্চতা দক্ষিণ দিকের চেয়ে বেশি রাখেন। তাঁরা কলাম ও খিলানের উচ্চতায় সামান্য পরিবর্তন আনেন। এতে টাওয়ারটি সোজা হওয়ার পরিবর্তে আরও বেশি হেলতে শুরু করে। অসম ওজনের কারণে মাটির ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে টাওয়ারটি উল্টো উত্তর দিকে সামান্য বেঁকে যায়। টাওয়ারটি এখন উত্তর দিকে সামান্য বাঁকা হলেও সামগ্রিকভাবে হেলানো দক্ষিণ দিকেই।
হেলানো টাওয়ারটি কেন্দ্র করে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের একটি জনপ্রিয় সমস্যার বাস্তব চিত্র দেখা যায়। বস্তুর ভরকেন্দ্র তার ভিত্তির বাইরে চলে গেলে তার উল্টে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। পিসার টাওয়ারের ক্ষেত্রে হেলে যাওয়া বা উল্টে যাওয়ার প্রবণতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেড়েছে। টাওয়ারটি নির্মাণের পর থেকে ক্রমাগত হেলতে থাকে বলে ভরকেন্দ্র ধীরে ধীরে তার ভিত্তির বাইরে সরে আসে। প্রতিবছর টাওয়ারটি প্রায় এক থেকে দুই মিলিমিটার হেলে যায়। টাওয়ারটিতে নির্মাণের সময় ক্যালকারিয়াস মার্বেল ও লাইম মর্টার ব্যবহার করা হয়। এদের উচ্চশক্তি ও স্থায়িত্ব টাওয়ারকে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। টাওয়ারের ভিত্তির নিচে থাকা নরম মাটির স্তর বিশেষ ধরনের ড্যাম্পিং প্রভাব তৈরি করেছে। এতে ভূমিকম্পের সময় নরম মাটি কম্পন শোষণ করে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পিসার হেলানো টাওয়ারের হেলানোর মাত্রা বিপজ্জনক হিসেবে দাঁড়ায়। সর্বোচ্চ হেলানো কোণে প্রায় ৫ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে টাওয়ারটি পৌঁছে যায়। ধসে পড়ার ঝুঁকি দেখা গেলে ১৯৯০ সালে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি কাজ শুরু করে। তখন টাওয়ারের দক্ষিণ দিকে সিসার বিশাল ওজন কাঠামো স্থাপন করা হয়েছিল কিছুটা সোজা করার জন্য। চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে টাওয়ারের উত্তর দিকের মাটি থেকে প্রায় ৩৮ ঘনমিটার মাটি অপসারণ করা হয়। আন্ডার-এক্সকাভেশন নামের এ পদ্ধতির জন্য টাওয়ারের উত্তর দিকটি ধীরে ধীরে দেবে যায়। তখন টাওয়ারটি দক্ষিণ দিক থেকে কিছুটা সোজা হয়।
প্রকৌশলীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে টাওয়ারটি ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে প্রায় ৪৪ সেন্টিমিটার সোজা হয়। ১৮৩০ সালের দিকে এমনভাবেই হেলানো ছিল টাওয়ারটি। বর্তমানে ৪ ডিগ্রি হেলে আছে।
পিসার টাওয়ারের স্থিতিশীলতা মাটি ছাড়াও তাপমাত্রা ও ভূকম্পনের ওপর নির্ভর করে। টাওয়ারের একদিকে সূর্যের আলো পড়লে এবং অন্যদিকে ছায়া থাকলে জটিলতা দেখা যায়। টাওয়ারের পাথরের তাপমাত্রা তখন ভিন্ন হয় বলে তাপীয় প্রসারণ ও সংকোচন দেখা যায়। তখন টাওয়ারের হেলানো অবস্থায় সামান্য পরিবর্তন দেখা যায়। পিসা শহরটি বেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। যে নরম মাটির কারণে টাওয়ারটি হেলে আছে সেই নরম মাটিই ভূমিকম্পের সময় টাওয়ারকে রক্ষা করে।
সূত্র: ব্রিটানিকা
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: নরম ম ট র জন য শত ব দ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
শেফালি আর দীপ্তিতে নতুন মুম্বাইয়ে নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত
নাবি মুম্বাই। নয়া মুম্বাই। নতুন সেই মুম্বাইয়ে কাল নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পেল মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারত।
দীপ্তি শর্মার করা ৪৬তম ওভারের তৃতীয় বলে নাদিন ডি ক্লার্কের তোলা ক্যাচটি এক্সট্রা কাভারে ভারত অধিনায়ক হারমানপ্রীত কৌরের হাতে জমা হতেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের আনন্দে মাতল পুরো ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকা ২৪৬ রানে অলআউট, ভারত ৫২ রানে জয়ী।
ভারতের জয়ের উৎসব অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছিল পাঁচ ওভার আগেই। লরা ভলভার্টকে ফিরিয়ে পথের কাঁটা উপড়ে ফেলেই উদ্যাপন শুরু করেছিল ভারতীয়রা। অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করে দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক চোখ রাঙাছিলেন ভারতের উৎসব ভন্ডুল করার। কিন্তু সেঞ্চুরি করার পরপরই ক্যাচ তুললেন ভলভার্ট। আর সেই ক্যাচ নিতে গিয়ে আমানজোত কৌর ভারতের প্রায় শত কোটি মানুষের হৃৎস্পন্দন প্রায় থামিয়ে দিয়েছিলেন। একবার নয়, দুবার নয়, তৃতীয়বারের চেষ্টাতেই ক্যাচ নিতে পারেন আমানজোত। এবারও বোলার সেই অফ স্পিনার দীপ্তি শর্মা।
৯৮ বলে ১০১ রান করে ভলভার্ট যখন ফিরলেন দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর ৪১.১ ওভারে ২২০/৭। এরপর শুধু আনুষ্ঠানিকতাই ছেড়েছে ভারত। দীপ্তি আরও ২টি উইকেট নিয়ে পেয়ে গেছেন ৫ উইকেট। আর ভারত হয়ে গেছে চ্যাম্পিয়ন। এর আগে ব্যাট হাতেও ৫৮ বলে ৫৮ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেছেন দীপ্তি।
ব্যাট হাতে ৮৭ রান করা শেফালি বর্মা বল হাতে নিয়েছেন ২ উইকেট