হাজার বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ ইউরোপের বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্যনির্ভর দেশ ইতালি। সেখানকার পিসা শহরে অবস্থিত এক টাওয়ারের স্থানীয় নাম ‘টরে পেনডেন্টে দ্য পিসা।’ প্রায় ৮৫০ বছরের পুরোনো এই স্থাপনাকে আমরা চিনি পিসার হেলানো টাওয়ার নামে। পিসা ক্যাথেড্রালের ঘণ্টাযুক্ত এ টাওয়ারটি হেলে থাকার জন্য বিখ্যাত। একদিকে ৫৫ দশমিক ৮৬ মিটার, অন্যদিকে ৫৫ দশমিক ৬৭ মিটার উচ্চতার এই ভবন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের কৌতূহলের বড় এক নিদর্শন। ভূমির সঙ্গে প্রায় ৪ ডিগ্রি হেলানো এ ভবনকে কেবল স্থাপত্যের দারুণ নিদর্শন বলা হয় না; ভূমি প্রকৌশল, পদার্থবিজ্ঞান ও স্থাপত্যের পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের ল্যাব বলা হয়। এই ভবন নির্মাণ শেষ করতে তিনবারে ১৯৯ বছরের বেশি সময় লেগে যায়। এর ওজন প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার টন। টাওয়ারে ২৯৪ থেকে ২৯৬টি সিঁড়ি আছে।

১৫৮৯ থেকে ১৫৯২ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় এই টাওয়ারে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পরিচালনা করেন বলে জানা যায়। গ্যালিলিওর বিখ্যাত পড়ন্ত বস্তুর সূত্র পরীক্ষা করেন এই টাওয়ারে। বাধাহীন পথে পড়ন্ত সব বস্তু সমান সময়ে সমান পথ অতিক্রম করে বলে প্রমাণ করেন তিনি।

বছরে ৫০ লাখ দর্শনার্থী এখন এই টাওয়ার দেখতে আসেন। পিসার হেলানো টাওয়ারের শুরুতে কোনো ইচ্ছাকৃত ভুল বা স্থাপত্যনির্ভর কোনো কৌশল ছিল না। বলা হয়, স্থাপত্যগত ভুল ও ভবন নির্মাণ এলাকার ভূমির অপ্রত্যাশিত আচরণের ফল হিসেবে একটি সোজা ভবন হেলে যায়। ১১৭৩ সালের ৯ আগস্ট টাওয়ারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই ভবনের স্থপতি কে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বনানো পিসানো বা ডিওটিসালভি নামের স্থপতি এই টাওয়ারের নকশা করেন। স্থপতিরা নির্মাণের সময় ভিত্তি হিসেবে মাত্র তিন মিটার গভীর একটি অগভীর বৃত্তাকার ভিত্তি বেছে নেন। সেখান থেকেই হেলে যাওয়ার সমস্যা শুরু হয়। নির্মাণ শুরুর পরে ১১৭৮ সালে তৃতীয় তলা তৈরির পরেই টাওয়ারটি হেলতে শুরু করে।

সাধারণভাবে পিসা শহরটি আরনো নদীর পলিমাটি ও কাদামাটির ওপরে অবস্থিত। মাটি অত্যন্ত নরম। পিসা টাওয়ারের ভিত্তির নিচে মাটির তিনটি প্রধান স্তর রয়েছে। ওপরের স্তরে নদীর পলি ও বালুর মিশ্রণ, মধ্যবর্তী স্তরে সামুদ্রিক কাদামাটি আর সবচেয়ে নিচের স্তরে বালু। দ্বিতীয় স্তরে সামুদ্রিক কাদামাটি রয়েছে বলে এলাকাটি বেশি অস্থিতিশীল।

টাওয়ারের তৃতীয় তলার কাজ শেষ হওয়ার আগেই মাটির ওপরের অংশ অসমভাবে সংকুচিত হয়ে যায়। তখন টাওয়ারের দক্ষিণ দিকের মাটি বেশি দেবে যায়। এদিকের মাটি দুর্বল বলে টাওয়ার দক্ষিণ দিকে হেলতে শুরু করে। প্রকৌশলীরা এই সমস্যা সমাধানের জন্য তৃতীয় থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত নির্মাণ করার সময় টাওয়ারের উত্তর দিকের উচ্চতা দক্ষিণ দিকের চেয়ে বেশি রাখেন। তাঁরা কলাম ও খিলানের উচ্চতায় সামান্য পরিবর্তন আনেন। এতে টাওয়ারটি সোজা হওয়ার পরিবর্তে আরও বেশি হেলতে শুরু করে। অসম ওজনের কারণে মাটির ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে টাওয়ারটি উল্টো উত্তর দিকে সামান্য বেঁকে যায়। টাওয়ারটি এখন উত্তর দিকে সামান্য বাঁকা হলেও সামগ্রিকভাবে হেলানো দক্ষিণ দিকেই।

হেলানো টাওয়ারটি কেন্দ্র করে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের একটি জনপ্রিয় সমস্যার বাস্তব চিত্র দেখা যায়। বস্তুর ভরকেন্দ্র তার ভিত্তির বাইরে চলে গেলে তার উল্টে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। পিসার টাওয়ারের ক্ষেত্রে হেলে যাওয়া বা উল্টে যাওয়ার প্রবণতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেড়েছে। টাওয়ারটি নির্মাণের পর থেকে ক্রমাগত হেলতে থাকে বলে ভরকেন্দ্র ধীরে ধীরে তার ভিত্তির বাইরে সরে আসে। প্রতিবছর টাওয়ারটি প্রায় এক থেকে দুই মিলিমিটার হেলে যায়। টাওয়ারটিতে নির্মাণের সময় ক্যালকারিয়াস মার্বেল ও লাইম মর্টার ব্যবহার করা হয়। এদের উচ্চশক্তি ও স্থায়িত্ব টাওয়ারকে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। টাওয়ারের ভিত্তির নিচে থাকা নরম মাটির স্তর বিশেষ ধরনের ড্যাম্পিং প্রভাব তৈরি করেছে। এতে ভূমিকম্পের সময় নরম মাটি কম্পন শোষণ করে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পিসার হেলানো টাওয়ারের হেলানোর মাত্রা বিপজ্জনক হিসেবে দাঁড়ায়। সর্বোচ্চ হেলানো কোণে প্রায় ৫ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে টাওয়ারটি পৌঁছে যায়। ধসে পড়ার ঝুঁকি দেখা গেলে ১৯৯০ সালে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি কাজ শুরু করে। তখন টাওয়ারের দক্ষিণ দিকে সিসার বিশাল ওজন কাঠামো স্থাপন করা হয়েছিল কিছুটা সোজা করার জন্য। চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে টাওয়ারের উত্তর দিকের মাটি থেকে প্রায় ৩৮ ঘনমিটার মাটি অপসারণ করা হয়। আন্ডার-এক্সকাভেশন নামের এ পদ্ধতির জন্য টাওয়ারের উত্তর দিকটি ধীরে ধীরে দেবে যায়। তখন টাওয়ারটি দক্ষিণ দিক থেকে কিছুটা সোজা হয়।

প্রকৌশলীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে টাওয়ারটি ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে প্রায় ৪৪ সেন্টিমিটার সোজা হয়। ১৮৩০ সালের দিকে এমনভাবেই হেলানো ছিল টাওয়ারটি। বর্তমানে ৪ ডিগ্রি হেলে আছে।

পিসার টাওয়ারের স্থিতিশীলতা মাটি ছাড়াও তাপমাত্রা ও ভূকম্পনের ওপর নির্ভর করে। টাওয়ারের একদিকে সূর্যের আলো পড়লে এবং অন্যদিকে ছায়া থাকলে জটিলতা দেখা যায়। টাওয়ারের পাথরের তাপমাত্রা তখন ভিন্ন হয় বলে তাপীয় প্রসারণ ও সংকোচন দেখা যায়। তখন টাওয়ারের হেলানো অবস্থায় সামান্য পরিবর্তন দেখা যায়। পিসা শহরটি বেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। যে নরম মাটির কারণে টাওয়ারটি হেলে আছে সেই নরম মাটিই ভূমিকম্পের সময় টাওয়ারকে রক্ষা করে।

সূত্র: ব্রিটানিকা

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: নরম ম ট র জন য শত ব দ র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

মাদারীপুরের সাবেক দুই ডিসিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান

শিবচরে পদ্মা সেতু রেললাইন সংযোগ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মাদারীপুরের সাবেক দুই জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন ও মো. ওয়াহিদুল ইসলামসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মাদারীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়। 

মঙ্গলবার (২৯ জুলাই)  দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় এ সংক্রান্ত নোটিশ মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, সাবেক দুই জেলা প্রশাসকসহ অভিযুক্তদের কাছে পাঠিয়েছে ।

দুদক সূত্র জানায়, পদ্মা রেললাইন সংযোগ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক দুই জেলা প্রশাসকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন জন্য দুদক মাদারীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আখতারুজ্জামানকে দলনেতা ও উপ-সহকারী পরিচালক মো. সাইদুর রহমান অপুকে সদস্য করে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। 

আরো পড়ুন:

খুকৃবির সাবেক উপাচার্যসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

কুবির নতুন ক্যাম্পাসের জমি ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ, তথ্য চেয়েছে দুদক

অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ১৯ ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭ এর বিধি ৮ অনুযায়ী ব্যবস্থাগ্রহণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য এবং চাহিদাপত্র চেয়ে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে তারা হলেন- মাদারীপুর সাবেক জেলা প্রশাসক মো. ওহিদুল ইসলাম, সাবেক জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ ফারুক আহম্মদ, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ঝোটন চন্দ্র, মাদারীপুরের সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. সাইফুদ্দিন গিয়াস।

‎মোহাম্মদ সুমন শিবলী, প্রমথ রঞ্জন ঘটক, ‎আল মামুন, মো. নাজমুল হক সুমন, মাদারীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ‎কানুনগো (ভারপ্রাপ্ত) মো. নাসির উদ্দিন, মো. আবুল হোসেন, রেজাউল হক এবং মাদারীপুর কালেক্টরেট রেকর্ড রুম শাখার রেকর্ড কিপার মানিক চন্দ্র মন্ডল।

দুর্নীতি দমন কমিশন মাদারীপুরের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান বলেন, “মাদারীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম ও ড. রহিমা খাতুনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে তথ্য ও বিভিন্ন চাহিদাপত্র চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন মাদারীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত নোটিশ অভিযুক্তদের কাছে পাঠানো হয়েছে।”

ঢাকা/বেলাল/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ