জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন,  “গণঅভ্যুত্থানের পরে যাকে রাষ্ট্রপ্রধান বানানো হয়েছে উনি লন্ডনে গিয়ে সিজদা দিয়ে এসেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা আছে কি না অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান একটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বসে প্রেস কনফারেন্স করছেন। ওইদিনই তিনি লন্ডনে সরকারকে বেচে দিয়ে এসেছেন।”

শনিবার (১৬ আগস্ট) রাজধানীর বাংলামোটরে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণপরিষদ নির্বাচন শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “মিডিয়া এখন রাজনৈতিক দলের কাছে বিক্রি। প্রশাসনে দেখা যায় সচিবালয়ে ৫টায় অফিস শেষ হয়, ৪টা থেকেই গুলশান ও পল্টনে লাইন দেওয়া শুরু হয়। আগে এটা ধানমন্ডি ৩২ আর গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসে হতো। এটি যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে সুখকর বিষয় ব্যাপারটি এমনও নয়।”

আরো পড়ুন:

আ.

লীগের বি-টিম চলে এসেছে, প্রতিহত করা হবে: হাসনাত

জুলাই ঘোষণাপত্রের নীরব প্রতিবাদ জানাতে কক্সবাজার গিয়েছি: হাসনাত

এ সময় চ্যালেঞ্জ করে তিনি বলেন, “একজন রাজনীতিবিদ বলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নাকি আমরা টাকা নিয়েছি। আমি আপনাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বললাম যার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি তাদের কেউ এসে সাক্ষ্য দিক যে তারা আমাদের কাছ থেকে টাকা দিয়েছে। অথবা এটার নথিপত্র থাকবে। একটা প্রমাণ যদি পাওয়া যায় হাসনাত আব্দুল্লাহ বা তার সহযোদ্ধারা দুর্নীতি করেছে আমরা রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিব।”

নির্বাচন নিয়ে হাসনাত বলেন, “আমাদেরকে বলা হয় আমরা নির্বাচন পেছাতে চাই। আরে নির্বাচনের টাইমলাইন নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। নির্বাচন নভেম্বর, ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে হোক আমাদের কোনো সমস্যা নেই কিন্তু রুলস অব গেম চেঞ্জ করে নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচন যখনই হোক অবশ্যই সেটা গণপরিষদ নির্বাচন হতে হবে।”

পুরোনো সংবিধানকে ফ্যাসিবাদের পাঠ্যবই উল্লেখ করে হাসনাত বলেন, “আমাদেরকে অবশ্যই একটা নতুন সংবিধান দিতে হবে। আর যারা মনে করছে নতুন রাজনৈতিক দলকে উঠতে দিবে না তাদের বলতে চাই আসন দিয়ে আমাদের কেউ কিনতে পারবে না। আমরা বিক্রি হতে আসিনি।”

এনসিপির এই নেতা বলেন, “জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের অনেকেই আমাদেরকে শত্রুজ্ঞান করে। কিন্তু কোনো লাভ নেই। কারণ ৫ আগস্টের পর আপনি যদি মনে করেন এই দিনটি যে কারণে হয়েছে সেই কারণগুলোকে বিদ্যমান রেখে আপনি একটা নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে যাবেন তাহলে আপনি আরো একটি গণপ্রতিরোধের শিকার হবেন।”

ঢাকা/এসবি

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ত য় ন গর ক প র ট এনস প আম দ র ক হ সন ত র জন ত

এছাড়াও পড়ুন:

প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি কোথায়

বাংলাদেশে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ শব্দটি সাধারণত ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে ব্যবহার করা হয়। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালি বা মুসলমান। এই জনসংখ্যাগত বাস্তবতাই বেশির ভাগ সময় দেশের রাজনীতিতে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে।

কিন্তু জনগণনার কাগজে সংখ্যার উপস্থিতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা উন্নত জীবনে রূপ নেয় না। মানুষ আসলে কীভাবে বেঁচে আছে, তারা কোন সেবার ওপর নির্ভর করছে, কোন ধরনের বাধার মুখোমুখি হচ্ছে, এগুলো যদি আমরা দেখি, তাহলে এক ভিন্ন ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা চোখে পড়ে।

কিছু পরিসংখ্যানের ভিত্তি করে এটি লেখা হয়েছে। পরিসংখ্যানগুলো সরকারি ও আন্তর্জাতিক বিশ্বস্ত তথ্যসূত্রের ওপর ভিত্তি করে আনুমানিক হিসাব। অনেক ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট ‘সরকারি’ সংখ্যা নেই, তাই বিশ্বাসযোগ্য ডেটা থেকে যুক্তিসংগতভাবে অনুমান করা হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা কিছুটা কমবেশি হতে পারে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

২.

বাংলাদেশের প্রায় ১১ কোটি মানুষ (প্রায় ৬৫ শতাংশ) সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর নির্ভরশীল। তাঁরা কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগী। গ্রামীণ পরিবার, যাদের বেসরকারি চিকিৎসা নেই এবং শহরের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবার, যারা গুরুতর অসুস্থ হলে সরকারি হাসপাতালে যান (বাংলাদেশ হেলথ ফ্যাসিলিটি সার্ভে ২০১৭; বিবিএস আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২)।

১২ কোটি মানুষ (প্রায় ৭০ শতাংশ) যাঁদের শিক্ষাজীবন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। ১ কোটি ৮৬ লাখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী (প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, ২০২৩), প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ সরকারি ও আধা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজের শিক্ষার্থী (বিএএনবিইআইএস ২০২২) এবং প্রায় ৩০ লাখ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী (ইউজিসি বার্ষিক প্রতিবেদন)। পরিবারের গড় আকার ধরে এই শিক্ষানির্ভর জনগোষ্ঠী প্রায় সব জেলায় রয়েছেন।

গণপরিবহন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। সারা দেশে নিবন্ধিত ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ১০ লাখের কম যা মোট যানবাহনের ১ শতাংশের কম (বিআরটিএ ২০২২)। ফলে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ (প্রায় ৮৮ শতাংশ) বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও রিকশার মতো গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল (বিবিএস পরিবহন জরিপ ২০২০)। প্রতিদিন কর্মস্থল ও বিদ্যালয়ে যেতে তাঁরা ভিড়, অব্যবস্থা ও অনিরাপদ অবস্থার মুখোমুখি হন, কারণ, বিকল্প কোনো সাশ্রয়ী পরিবহন নেই।

বাসস্থানের চিত্রও উদ্বেগজনক। ৭ কোটি মানুষ (প্রায় ৪১ শতাংশ) অনিরাপদ বা দুর্যোগপ্রবণ ঘরে বাস করেন। ১ কোটি ৬০ লাখ শহুরে বস্তিবাসী (ইউএন-হ্যাভিটট ২০২০)। সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি গ্রামীণ মানুষ টিন, বাঁশ বা খড়ের ঘরে থাকে (বিবিএস জনশুমারি ২০২২)। প্রায় পাঁচ লাখ গৃহহীন (সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়) এবং চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়)।

বিচারব্যবস্থায় মামলার জট এখনো ভয়াবহ। সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী দেশে প্রায় ৩৭ লাখ মামলা এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। নিম্ন আদালতে বিচারকের সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন; প্রতি ১৮.৮ লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন বিচারক। আইন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, মামলার গড় সময়কাল ও জটের কারণে বিচারপ্রার্থীদের অন্তত ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ সময়মতো রায় পান না। বিশেষত জায়গা–জমি নিয়ে বিবাদ, শ্রমবিরোধ, পারিবারিক মামলা ও ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর বিলম্ব চলতে থাকে।

পরিবেশগত ঝুঁকিও প্রায় সর্বজনীন। ১৬.৫ কোটি মানুষ (প্রায় ৯৭ শতাংশ) এমন বায়ু শ্বাস নেয়, যা নিরাপদ সীমার চেয়ে অনেক বেশি দূষিত (ডব্লিউএইচও ২০২৩; ডিওই ২০২২)। প্লাস্টিক দূষণ প্রভাব ফেলে ১০ কোটি মানুষের (প্রায় ৫৯ শতাংশ) জীবনে (বিশ্বব্যাংক ২০২১; পরিবেশ অধিদপ্তর)। সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ (প্রায় ৩২ শতাংশ) নিরাপদ পানীয় জল পায় না (ডব্লিউএইচও/ইউনিসেফ জেএমপি ২০২২)।

৩.

এই পরিসংখ্যানগুলো স্পষ্ট করে যে বাংলাদেশের প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো সেসব মানুষ, যারা সরকারি সেবা, গণপরিবহন, ন্যায়বিচার, বাসস্থান এবং পরিবেশগত নিরাপত্তার উপর নির্ভরশীল। এরা সেই জনগোষ্ঠী যাদের বেশির ভাগ অনানুষ্ঠানিক শ্রমজীবী বা ক্ষুদ্র স্বনিয়োজিত কর্মজীবী, প্রান্তিক উৎপাদক ও জীবিকানির্ভর পরিবার, বাস্তুচ্যুত, বেকার অথবা সহায়তানির্ভর গোষ্ঠী। এরাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ। এদের জন্য নাই উন্নত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, যোগাযোগ আর নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা। স্বাধীনতার এত বছরেও তাদের জন্য এই মৌলিক সেবাগুলোর অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে রয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিই এই সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য কাজ করত, তাহলে আজ তাদের এই অবস্থা হতো না। বাস্তবতা হলো, তারা ক্ষমতার এজেন্ডায় নেই। দলগুলো বরাবরই কাজ করেছে উচ্চবিত্ত ও সুবিধাভোগী মানুষেরর জন্য, যারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন, বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ে, বিদেশে চিকিৎসা করান এবং নিরাপদ আবাসনে থাকেন। এখানে একটি ক্ষুদ্র মধ্য ও উচ্চ আয়ের মানুষদের ‘উন্নয়ন’ নিশ্চিত করতে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত, অনিরাপদ, এবং সম্পদ থেকে বঞ্চিত।

যেসব দল নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি করে, তারা এই প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি করে না। তারা সংখ্যার রাজনীতি করে, জীবনের রাজনীতি নয়। বিশ্বপুঁজিবাদের আজকের রূপ অনুসরণ করে বাংলাদেশে যে কেবল উন্নয়নহীনতা তৈরি হয়েছে তা নয়; বরং এক নতুন রকমের ‘এক্সক্লুসিভ’ আধুনিকতা নির্মাণ করছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বাইরেই টিকে থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।

এই পুঁজিবাদ তার অন্তর্নিহিত বৈষম্য প্রবণতার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে না; বরং এটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উৎপাদন সম্পর্ক থেকে আলাদা করে একটি বহিষ্কৃত জনগোষ্ঠীতে রূপান্তর করে, যাদের কোনো নিশ্চিত অধিকার, সম্পদ কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। শুধু ভোট দেওয়ার অধিকার নয়, যত দিন এই নির্ভরশীল, বঞ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি ও জাতীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা অর্জন না করবে, তত দিন এই ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ মানুষের জীবন থেকে অবহেলা যাবে না; তাদের সংখ্যা কেবলই ক্ষমতার করিডরে অর্থহীনই থেকে যাবে।

কৌশিক আহমেদ লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। সামাজিক আন্দোলন এবং বিকল্প রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ নিয়ে কাজ করছেন।

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নতুন সংবিধানের দাবি পাশ কাটিয়ে গেছেন অধ্যাপক ইউনূস: আখতার হোসেন
  • আসন দিয়ে এনসিপি নেতাদের কেনা সম্ভব নয়, আমরা বিক্রি হতে আসিনি: হাসনাত আবদুল্লাহ
  • প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি কোথায়
  • নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি নিয়ে এগোবে এনসিপি