কুয়েত থেকে হুইলচেয়ারে ফিরছেন কর্মক্ষমতা হারানো প্রবাসীরা
Published: 7th, August 2025 GMT
পরিবার ও নিজের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে বছরের পর বছর প্রবাসে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন অসংখ্য বাংলাদেশি। কিন্তু অনেক সময়ই কঠোর পরিশ্রম আর অসাবধানতার কারণে তাদের ভাগ্যের চাকা উল্টো পথে ঘুরতে শুরু করে
শারীরিক অসুস্থতা তাদের জীবনের গতি থামিয়ে দেয়। তখন তাদের সামনে দেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
সম্প্রতি কুয়েত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের চেক-ইন কাউন্টারে এমন করুণ দৃশ্যই দেখা গেছে। একই ফ্লাইটে অন্তত ১০ জন বাংলাদেশি প্রবাসী হুইল চেয়ারে করে দেশে ফিরছেন। তাদের কেউ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, কেউ স্ট্রোকের শিকার হয়েছেন, আবার কেউ দীর্ঘদিনের অসুস্থতায় একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
আরো পড়ুন:
নীলফামারীতে ৫ রেমিট্যান্স প্রেরণকারীকে সম্মাননা
জুলাইয়ের ৩০ দিনে রেমিট্যান্স ২৩৬ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে
কুয়েতে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা তুলনামূলক কম পারিশ্রমিকে কাজ করেন। অসুস্থ হলে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় অনেকে ছোটখাটো অসুস্থতা এড়িয়ে যান।
জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন কুয়েতের সভাপতি আব্দুল হাই মামুন জানান, এই উপেক্ষা একসময় বড় আকার ধারণ করে, যা তাদের একেবারেই কর্মহীন করে দেয়। তখন তাদের দেশে ফেরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এই অসুস্থতার কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়া প্রবাসীরা শুধু যে উপার্জনের পথ হারান তা-ই নয়, জমানো টাকাও চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়ে যায়।
নরসিংদীর হাসান উল্লাহ প্রায় অন্ধ হয়েই কুয়েত ছেড়েছেন। আর টাঙ্গাইলের ইয়ার হোসেন স্ট্রোক করে দেশে ফিরছেন। ১৩ বছর প্রবাসজীবন শেষে অসুস্থ শরীরে দেশে ফিরছেন কুমিল্লার নাহিদ ইসলাম। এই প্রবাসীরা দেশে ফিরে সুস্থ জীবনের স্বপ্ন দেখলেও, তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক।
বিমানবন্দরের নিয়ম অনুযায়ী, শারীরিকভাবে অসুস্থ কোনো যাত্রীর সঙ্গে একজন সহযোগী থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে হুইল চেয়ারে ফেরা এসব প্রবাসীর পক্ষে তা সম্ভব হয় না। এমন পরিস্থিতিতে কুয়েতে বাংলাদেশ বিমানের স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ শাহজাহান একজন দৃষ্টিহীন প্রবাসী যাত্রীকে ঢাকা যাওয়ার সুযোগ করে দেন।
প্রবাসী হাসান উল্লাহ একেবারেই চোখে দেখতে না পাওয়ায় তার ফ্লাইটে ওঠা নিয়ে একটি জটিলতা তৈরি হয়েছিল। বিমান কর্তৃপক্ষের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন কোনো যাত্রীকে একা ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয় না। কারণ এতে তার নিরাপত্তা ও ফ্লাইটের অন্যান্য যাত্রীদের জন্য কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে।
মোহাম্মদ শাহজাহান এই নিয়ম সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং হাসান উল্লাহকে ফ্লাইটে যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানানো হয়। তবে তিনি শুধু নিয়মের গণ্ডিতে আটকে থাকেননি। মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি একটি সমাধান খুঁজে বের করেন।
তিনি ঢাকা যাচ্ছেন এমন একজন যাত্রীকে খুঁজে বের করেন। ওই যাত্রী স্বেচ্ছায় হাসান উল্লাহকে সহযোগিতা করতে রাজি হন। এই সহযাত্রীর সহায়তায় হাসান উল্লাহ নিরাপদে ঢাকা যাওয়ার সুযোগ পান।
মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং সিভিল অ্যাভিয়েশনের নিয়ম-বহির্ভূত কোনো কাজ করতে পারেন না। কিন্তু অনেক সময় মানবিক দিক বিবেচনা করে তারা সাধ্যমতো বাংলাদেশি নাগরিকদের সহযোগিতা করে থাকেন।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ বিমানের চেক-ইন কাউন্টারের প্রতিনিধি পলাশ মোহাম্মদ মানবিক কারণে অনেক অসুস্থ প্রবাসীকে অন্য যাত্রীর সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন।
পলাশ মোহাম্মদ জানান, প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৭ জন বাংলাদেশি হুইলচেয়ারে করে কুয়েত ছাড়েন। এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সেবা দিতে পেরে তিনি নিজেকে গর্বিত মনে করেন।
আমিরাত এয়ারলাইন্সের কুয়েত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বোর্ডিং গেট ও চেক-ইন কাউন্টারের জুনিয়র কর্মকর্তা সেলিম মিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি যাত্রীদের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, আমিরাত এয়ারলাইন্স এর চেক-ইন কাউন্টার দিয়ে হুইল চেয়ার ব্যবহার করে কুয়েত ত্যাগ করছেন এমন প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়ছে।
সেলিম মিয়া ব্যক্তিগতভাবে অসুস্থ যাত্রীদের সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকেন। তার মতে, প্রবাসীদের নিজেদের শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি আরো সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। যদি এ বিষয়ে সচেতনতা না বাড়ে, তাহলে ভবিষ্যতে হুইল চেয়ার ব্যবহার করে দেশে ফিরে যাওয়া যাত্রীর সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করে। এই বোর্ডের কাছে অসুস্থ হয়ে দেশে ফেরা প্রবাসীদের জন্য আর্থিক সহায়তার দাবি উঠেছে।
জনপ্রিয় সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট আব্দুস ছালেহ দাবি করেন, সরকার যেন এই অসুস্থ প্রবাসীদের কমপক্ষে ১ লাখ টাকা চিকিৎসা সহায়তা দেয়।
সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক মহসিন পারভেজ জানান, তিনি নিজের খরচে অনেক অসুস্থ প্রবাসীকে দেশে পাঠিয়েছেন। অসুস্থ প্রবাসীদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার সরকারের বহন করা উচিত।
কুয়েত থেকে দেশে ফেরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের বর্তমান চিত্র খুবই উদ্বেগজনক। কুয়েতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার উইং, কুয়েত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের চেক-ইন কাউন্টার এবং বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব কুয়েতের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৩ জন প্রবাসী বাংলাদেশি লাশ হয়ে দেশে ফিরছেন।
এই পরিসংখ্যান আরো করুণ হয়ে দাঁড়ায়, যখন দেখা যায় প্রতি মাসে গড়ে ১০০ জন প্রবাসী কর্মী কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে নিঃস্ব হাতে দেশে ফিরছেন। শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা, কাজের সময় দুর্ঘটনা অথবা অন্যান্য অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে তারা তাদের উপার্জনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন। তাদের কুয়েতে থাকার কোনো উপায় না থাকায়, নিরুপায় হয়ে শূন্য হাতে তাদের প্রিয়জনদের কাছে ফিরে আসতে হচ্ছে।
ঢাকা/হাসান/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রব স হ স ন উল ল হ প রব স দ র ন প রব স ম হ ম মদ প রব স র ফ ল ইট ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
মাগুরায় ‘রেডি টু কুক ফিশ’ প্রযুক্তিতে সফল উদ্যোক্তা লিজা
মাগুরা সদরের পারনান্দুয়ালী বেপারী পাড়ার গৃহবধূ লিজা এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) অর্থায়নে এবং অলটারনেটিভ ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (এডিআই) বাস্তবায়নে মাগুরায় প্রথমবারের মতো তিনি চালু করেছেন ‘রেডি টু কুক ফিশ’ প্রযুক্তিভিত্তিক মাছ প্রক্রিয়াজাত ও বিক্রয় কার্যক্রম।
২০২৪ সালের ২৮ জুন শুরু হওয়া এই ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগের আওতায় লিজা পেয়েছেন ডিপ ফ্রিজ, দোকান উন্নয়ন খাতে নগদ সহায়তা, মাছ সংগ্রহে অর্থ সহায়তা, প্রচারের জন্য লিফলেট ও সাইনবোর্ড। ঘরের পাশে ছোট দোকানে বসেই তিনি এই কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তার স্বামী জাকির হোসেনও তাকে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছেন।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে নদী, সাগর, ঘের ও পুকুরের দেশি ও সামুদ্রিক মাছ সংগ্রহ করে সেগুলোকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ধুয়ে, কেটে, বেছে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে ভোক্তারা অফলাইনে দোকান থেকে এবং অনলাইনে ঘরে বসেই পাচ্ছেন ঝামেলাহীন, পরিচ্ছন্ন ও রান্নার জন্য প্রস্তুত মাছ।
আরো পড়ুন:
কাপ্তাই হ্রদ: মৎস্য আহরণের প্রথম দিন রাজস্ব আয় ২০ লাখ টাকা
‘অ্যান্টিবায়োটিক গুরুতর হুমকি হয়ে উঠছে’
‘রেডি টু কুক ফিশ’ সেবাটি শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তারা অল্প দামে অল্প পরিমাণে মাছ কিনে ঘরে বসে রান্না করতে পারছেন, যা সময় ও পরিশ্রম- দুটোই বাঁচাচ্ছে।
মাগুরা ওয়ার্ল্ড নার্সিং কলেজে শিক্ষার্থী সুফিয়া খাতুন বলেন, “আমি একজন শিক্ষার্থী। আমি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করি। বেশিরভাগ সময় আমাকে কলেজ ও পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এ কারণে বাজারে যাওয়া এবং বাজার থেকে মাছ কিনে এনে কেটে রান্না করা খুবই কষ্টসাধ্য। হঠাৎ সন্ধান পেলাম রেডি টু কুক ফিশ অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। এরপর থেকে আমি প্রয়োজন অনুযায়ী অনলাইনে অর্ডার দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা মাছ ক্রয় করে রান্না করি। এতে করে আমার সময় বেঁচে যাচ্ছে এবং আমিষের চাহিদা পূর্ণ হচ্ছে।”
স্কুল শিক্ষিকা মারুফা সুওলতানা বলেন, “আমি একজন কর্মজীবী নারী। দিনের বেশিরভাগ সময় আমাকে অফিসে থাকতে হয়। কাটাকাটির ঝামেলায় মাছ খাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল আমাদের পরিবারে। কিন্তু বর্তমানে রেডি টু কুক ফিশ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে দিনে-রাতে যেকোনো সময় অর্ডার দিয়ে সহজেই পরিবারের মাছের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।”
লিজার ব্যবসার মাধ্যমে ইতোমধ্যে দুজন নারীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন তারা মাছ পরিষ্কার, কাটা এবং প্যাকেটজাত করার কাজ করেন। এভাবে একজন নারী হিসেবে লিজা নিজে স্বাবলম্বী হয়ে অন্য নারীদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছেন।
মাছ প্রক্রিয়াজাত কাজে যুক্ত থাকা সকিনা খাতুন বলেন, “আগে শুধু নিজের ঘরে কাজ করেই সময় পার করতাম। কিন্তু বর্তমানে লিজা আপুর প্রতিষ্ঠানে মাছ কাটা, ধোয়া এবং প্যাকেট জাতের কাজ করি। এতে করে আমার মাসে আয় হচ্ছে প্রায় ৪-৫ হাজার টাকা। এই টাকায় আমার সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালাতে সুবিধা হচ্ছে।”
লিজা অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও তার পণ্য বিক্রি করছেন। ধীরে ধীরে তৈরি করেছেন একটি নিজস্ব গ্রাহকভিত্তি। তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ছিল। সংসারের চাপে সেটা সম্ভব হয়নি। অনেক চিন্তা করে মাথায় এল, মাছ ধোয়া, কাটা, বাছাইয়ের ঝামেলা থেকে মানুষকে মুক্তি দিলে ভালো সাড়া পাওয়া যাবে। আমি সেটাই করলাম, আর মানুষ সেটা গ্রহণ করেছে। পরিবার ও স্বামীর সহযোগিতায় আমি আমার ব্যবসা বড় করতে চাই। একদিন আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হব, আশা করি।”
এডিআই এর মৎস্য কর্মকর্তা সামিউর রহমান বলেন, “লিজার মতো উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে আমরা চাই, নারীরা প্রযুক্তি নির্ভর উদ্যোগে এগিয়ে আসুক। এ উদ্যোগটি মডেল হিসেবে কাজ করবে।”
সম্প্রতি মাগুরা সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম শাহজাহান সিরাজ সরেজমিনে লিজার দোকান পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, “এডিআই এর এই উদ্যোগ শুধু একজন নারীকে নয়, পুরো সমাজকে উপকারে আনবে। আমরা এ ধরনের কাজের পাশে আছি।”
ঢাকা/শাহীন/মেহেদী