ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে চালাতে হবে সাইকেল
Published: 21st, September 2025 GMT
সাইকেল চালানো শরীরের জন্য ভালো। পকেটের ওপরও চাপ কমায়। সম্প্রতি করা এক গবেষণায় সাইকেল চালানোর উপকারিতার তালিকা আরও দীর্ঘ হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, চলাচলের জন্য কেউ যদি গাড়ির বদলে সাইকেল বেছে নেন, তবে তা মস্তিষ্কের বিভিন্ন জটিলতা কমানোর ক্ষেত্রেও বেশ কাজে আসে।
এই গবেষণা করেছে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য গবেষণাবিষয়ক তথ্যের সবচেয়ে বড় ভান্ডার ‘ইউকে বায়োব্যাংক’। সম্প্রতি গবেষণাটি জেএএমএ নেটওয়ার্ক ওপেন সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রাইভেট কার, বাস, ট্রেনে ভ্রমণের চেয়ে সাইকেল ব্যবহার করলে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি ১৯ শতাংশ এবং আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি ২২ শতাংশ পর্যন্ত কমে।
ডিমেনশিয়া বলতে মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি, স্মৃতিশক্তি ও কাজ করার ক্ষমতা হ্রাসকে বোঝায়। বিভিন্ন রোগের কারণে ডিমেনশিয়া হতে পারে। এমন একটি রোগ হলো আলঝেইমার। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার (এনএইচএস) তথ্য অনুযায়ী, মস্তিষ্কের কোষের ভেতরে ও আশপাশে অস্বাভাবিকভাবে প্রোটিন জমলে আলঝেইমার হতে পারে।
এই গবেষণায় ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার মানুষ অংশ নেন। তাঁদের গড় বয়স ছিল সাড়ে ৫৬ বছর। গবেষণায় যাতায়াতের চারটি বিকল্প তুলে ধরা হয়। অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়—বিগত চার সপ্তাহে যাতায়াতের জন্য তাঁরা কোন বিকল্পটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন।
যাতায়াতের ওই বিকল্পগুলোর মধ্যে ছিল—একেবারেই সক্রিয় না থাকা, অর্থাৎ বাস বা ট্রেনে করে যাতায়াত করা। আরেকটি ছিল হেঁটে যাতায়াত। তৃতীয় বিকল্পটি ছিল হাঁটা ও সক্রিয় থাকা লাগে না—এমন সব মাধ্যম ব্যবহার করে যাতায়াত। আর শেষ ধরনটি ছিল সাইকেল চালিয়ে এবং অন্য ধরনগুলো ব্যবহার করে যাতায়াত।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের যাতায়াতের ধরনগুলো নির্বাচন করার ১৩ বছরের বেশি সময় পর দেখা যায়, ৮ হাজার ৮৪৫ জনের মস্তিষ্কে ডিমেনশিয়া দেখা দিয়েছে। আর ৩ হাজার ৯৫৬ জন আলঝেইমারে আক্রান্ত। এ ছাড়া যাঁরা যাতায়াতের ক্ষেত্রে হাঁটাহাঁটির ওপর ভরসা করেন, তাঁদের ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি ৬ শতাংশ কম।
গবেষণায় সাইকেল চালানোর ফলে ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমারের ঝুঁকি কমার প্রমাণও পাওয়া গেছে। এ–ও দেখা গেছে যে মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস নামক অংশের তুলনামূলক বড় আয়তনের সঙ্গে সাইকেল চালানোর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। মস্তিষ্কের এই অংশে স্মৃতি সংরক্ষণ থাকে এবং কোনো কিছু শেখার সঙ্গে জড়িত।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটির স্নায়ুবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জো ভারগেস বলেন, দশকের পর দশক ধরে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যায়াম মস্তিষ্কের জন্য ভালো। সাইকেল চালানো হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখে এবং মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল ও পরিপাকের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে করে হয়তো ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমে। তবে কেউ যদি সাইকেল চালানো শুরু করতে চান, তাহলে আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। দেখে নিতে হবে তিনি এখনই সাইকেল চালানো শুরু করার জন্য যথেষ্ট সুস্থ কি না। নাকি এর জন্য আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ব কল প র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
টেপরির গল্প
আমার ছোট বোন টেপরি যখন জন্ম নিল, তখন বাংলা সিনেমার চিরায়ত সেই দুটি অপশন আমাদের সামনে চলে এল। ‘আম্মা নাকি টেপরি?’ অর্থাৎ সেদিন হাসপাতালে কোনো টেরিবেরি হয়ে গেলে আজ টেপরির জন্মদিনটাই আম্মার নিরস মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিণত হতে পারত।
জন্মের সময় টেপরির নাক প্রচলিত অর্থে বোঁচা ছিল। এই কারণেই আমি এই নাম রেখেছিলাম দুষ্টামি করে। জন্মের পর ওর গায়ের রং শ্যামলা ছিল, চুল ছিল কোঁকড়ানো। এই তথ্য গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর দাদি মরাকান্না জুড়িয়ে দিলেন।
আমরা বুঝতেই পারছিলাম না, দাদির এই কান্নার কারণ কী! তারপর জানা গেল, ‘শ্যামলা মেয়েকে কেউ বিয়ে করে না’; ‘কোঁকড়ানো চুলের মেয়েদের স্বামীকপাল মন্দ হয়’...মূলত এসব ছাইভষ্ম ভেবে দাদি গঙ্গাকে আরও জলবতী করবার ব্রত নিয়েছিলেন।
মেয়ে ‘কালো’ নাকি ফরসা—এই বিষয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ১১৪ নম্বর কেবিনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করা কয়েক শ বছরের এক বৃদ্ধা আয়া আঙুল তুলে বললেন, ‘এই ম্যায়ার চুল পাতলা হইব, মাথার তালু ফরসা, মুখে-চোখে-গতরে কালা দাগগুনি সব প্যাটের ময়লা। ফুটব ফুটব গায়ের রং ফুটব!’
টেপরি বড় হতে থাকল, সেই শতবর্ষী আয়ার কথামতো আজ টেপরির চুলগুলোতে কেমন মিষ্টি অথচ আঁশটে গন্ধ, আর গায়ের রং? ওর গায়ের রং রুই মাছের ডিমের মতো, যখন তা ঢিমে আঁচে রান্না করা হয় সাত–আটটা কাঁচা মরিচের ভাপে।
এসব বাহ্যিক রূপবৈচিত্র্যের বাইরেও ও টেপরি, যে কিনা সকালে দাঁত মাজা বাদ দিয়ে আম্মার পাশে একটা ছোট বঁটি নিয়ে পেঁয়াজের পর পেঁয়াজ, রসুনের পর রসুন দফারফা করে।
এই তো কিছুদিন আগেও, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ পড়ার পর টেপরির সঙ্গে অনেক দিন কথা বলিনি। বলতে পারিনি। আমার ভেতর তখন কী হয়েছিল আমি আজও বুঝিনি। উপন্যাসে ছোট বোন রঞ্জু মারা গিয়েছিল। আর তার ভাই ‘খোকা’ ভেসে গিয়েছিল দেশ নামের একটা পুকুরের অনেক গভীরে। হয়তো এই দেশকে আমারও তখন একটা পুকুর মনে হয়েছিল।
একুশ মে, বারটা এক, একটা ছোট্ট কেক, আমরা চারজন। দেশলাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে মোমবাতিগুলো কেকের ওপর চোখ বন্ধ করে বসে ছিল নাগা সন্ন্যাসীদের মতো। কেকের ওপর আমার দেওয়া ‘টেপরি’ নামটাই লেখার কথা ছিল, কিন্তু সেটা বানান ভুল হয়ে ‘পেটরি’ হয়ে গেছে। এত চ্যুতি–বিচ্যুতির ভেতর আব্বা কেক মুখে নিয়ে বলে, ‘মা, তোমার হাত ধোয়া ছিল তো?’
পরিবারের আত্মীয় নাম্নী লোকেরা টেপরির জন্মদিনের কথা জানে নাকি জানে না, আমি জানি না। খেয়াল করলাম, তেমন কেউই টেপরিকে বারটায় কিংবা বারটা একে, এমনকি তিরিশেও উইশ করল না। এমন সময়ে টেপরির মোবাইলে একটা মেসেজ এল, কিন্তু সেটাও টেলিকম কোম্পানি থেকে। টেপরিও এসব বুঝে যাবে...এদের সবাইকে চিনে যাবে একদিন।
টেপরির ব্যাপারে একটা–দুটো বাক্য বলা অসম্ভব। সে হয়তো সেই বোনটা, যে টেলিফোনের অন্য পাশে বসে তার রাগের মাথায় ঘরছাড়া ভাইকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার জন্য হু হু করে কাঁদে।
অকারণ এই কান্নাপর্ব আমার যাপিত সময়ে সশস্ত্র হামলা করে, দেখি অপু আর দুর্গা কাশবনে ছুটছে, দূরে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে হারিয়ে যাচ্ছে রেলগাড়ি।
টেপরি বড় হয়ে গেল। বিস্ময়কর একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে কিশোরী থেকে তরুণী আর তারপর আরও ধীরে ধীরে ধীরে কোনো এক ‘নারী’ হয়ে উঠল ও।
আমি ওকে দেখি আর ভাবি, বিকেলের পর বিকেল। দেব দেব করে কোনো একটা বড়সড় গিফট আর দেওয়া হয়ে ওঠে না। এই মন ভোলানো ভাবনাগুলোই ওকে গিফট হিসেবে দেওয়া গেলে ভালো হতো।
কিন্তু এসব ভাবতে ভাবতে দাদির দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে টেপরির বিয়েটাও হয়ে গেল। আম্মার শরীর খারাপ থেকে খারাপতর হওয়ায় নিজের বিয়ের কাজও ওকেই করতে হলো।
বিয়ের আগের সময়গুলোতে আমাদের প্রিয় আব্বা হঠাৎ এক–দেড় মাসেই অনেকটুকু বুড়িয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে আমি বুঝলাম, আব্বা ইস্পাত কঠিন হলে এই একটা মাত্র বিষয়ে উনি প্রচণ্ড অসহায়বোধ করেন। বাবা–মেয়ের সম্পর্কটাই হয়তো এমন।
টেপরি এখন দূরে চলে যাবে আমাদের কাছ থেকে। আমাদের বাসাটা ‘পাখিহীন’ হয়ে কীভাবে টিকে থাকবে; আমি অফিসের ফাঁকে, রাস্তার জ্যামে, সিনেমা হলে সিনেমা শেষ হওয়ার পর, নদীর পাড়ের বাতাসে কিংবা মধ্যরাতের ছাদে হঠাৎ-বিঠাৎ সেইটাই ভাবি।