সমালোচনামূলক ইতিহাসের জনক থুসিডিডিস সম্পর্কে যা কিছু জানা যায়, তার সবকিছু তিনি নিজেই বলে গেছেন আমাদের; তবে তা নেহাতই অল্প। খুবই অবাক করা বিষয় হলো, যেসব গ্রিক মনীষী অমরত্ব লাভ করেছেন, তাঁদের মধ্যে থুসিডিডিসের অসংখ্য অনুকরণকারী থাকলেও জীবনীকার নেই একজনও।

এই বিখ্যাত এথেনীয়র জন্ম ৪৭০ থেকে ৪৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে, সাহিত্য, শিল্প আর চিন্তার স্বর্ণযুগে—ইস্কিলাস, সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, অ্যারিস্টোফেনিস, হেরোডোটাস আর সক্রেটিসের শতাব্দীতে। কিন্তু তারপরেও, যে বইটি থুসিডিডিসকে গ্রিক বিদ্বজ্জনদের প্যান্থিয়নে চিরস্থায়ী আসনে বসিয়েছে, সেই ‘পেলোপোনেসীয় যুদ্ধের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে তাঁর এই মহৎ সমসাময়িকদের কারও উল্লেখ নেই। কারণ, থুসিডিডিস নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের বর্ণনা দেওয়ার কাজে, যে নগররাষ্ট্রগুলো আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে অনেকটাই ছোট। লন্ডনের অসংখ্য শহরতলির কোনোটির চেয়ে বড় হবে না, এমন অল্প কিছু নগরের ভাগ্য ও নেতার দিকেই তিনি পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছিলেন।

থুসিডিডিসের পাণ্ডুলপি.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় মুক্তি মিলছে না তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের

আধুনিক সমাজ ব্যবস্থাতেও প্রতিনিয়ত অপমান, লাঞ্ছনা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন। স্থানীয়ভাবে ‘হিজড়া’ হিসেবে পরিচিত এই মানুষদের জীবনমান উন্নয়ন বা মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রায় নেই। ফলে, নারী-পুরুষের বাইরের লিঙ্গ পরিচয় সমাজ এখনো সহজে মেনে নিতে পারছে না। এ কারণেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা শৈশবেই পরিবার ও সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন নিজেদের কমিউনিটিতে। মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা নির্দিষ্ট কিছু পেশায় সীমাবদ্ধ থাকেন এবং উৎপাদনমুখী কাজে আগ্রহ হারিয়ে গোষ্ঠীটি জনশক্তির পরিবর্তে সমাজের বোঝায় পরিণত হন।  

সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রের উদাসীনতা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়ায় এই জনগোষ্ঠী এগোতে পারছে না। তাদের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির জন্য দরকার রাষ্ট্রের এগিয়ে আসা এর পাশাপাশি দরকার তাদের মাঝে আত্মমর্যাদা বোধ এবং নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা।

জেলা পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বগুড়া জেলায় ৩৩৪ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের বাস। তারা শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং উপজেলায় গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বসবাস করছেন।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর মূল পেশা বিয়েবাড়িতে নাচ-গান করে থেকে বকশিশ নেয়া, বাচ্চা নাচানো, হাট-বাজারের দোকানে ভিক্ষা করা।

কথা হয় বগুড়া শহরে বসবাসরত হিজড়া জনগোষ্ঠির প্রীতির সঙ্গে। প্রীতির বয়স ২১ বছর। তিনি বগুড়া শহরের মালগ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও বাইনারি লিঙ্গ নিয়ে জন্ম না নেওয়ায় পরিবারের সদস্যসহ এলাকার সব বয়সী নারী-পুরুষদের কাছে তাচ্ছিল্যের শিকার হয়ে বর্তমানে বসবাস করছেন হাড্ডিপট্টিতে। বগুড়ার হিজড়াদের গুরুমা সুমির আশ্রয়ে আছেন তিনি।

প্রীতি এ প্রতিবেদককে বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা  নিয়ে কোনো শিশু জন্ম নিলে তার প্রতি বাবা-মা এবং পরিবারের সদস্যদের যত্ন আলাদা রকমের হয়। বাবা-মা সব সময় এসব প্রতিবন্ধী ছেলে অথবা মেয়েকে আগলে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু, যৌনপ্রতিবন্ধিতা (তৃতীয় লিঙ্গ) নিয়ে কোনো শিশু জন্ম নিলে তার পরিবারই প্রথম তার প্রতি অমানবিক আচরণ শুরু করে। বিশেষ করে, ওই শিশুর বাবা এবং ভাইয়েরা। পরিবারের চাপে পড়ে মায়েরও কিছু করার থাকে না। সমাজ এবং সমাজের লোকজনের কারণে একসময় শিশুটিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। অথবা অনবরত দুর্ব্যবহার আর বৈষম্যমূলক আচরণে কারণে তারা নিজেরাই বাড়ি ছেড়ে, এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।

তিনি বলেন, আমার ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটেছে।  আমরা ৪ ভাই-বোন ছিলাম। এর মধ্যে আমি ত্রুটিযুক্ত লিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করি। তাই আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হতো না। বাড়িতে কেউ আসলে আমাকে অন্য ঘরে আটকে রাখা হতো। তাদের সামনে যেতে দেওয়া হতো না। আমার বাবা সবাইকে পরিচয় দিতেন তার ৩ ছেলে-মেয়ে। আমাকে মাইনাস রেখেই তিনি সব সময় কথাবার্তা বলতেন। আমার প্রতি তার আচরণও ছিল তেমনই। ভাইয়েরাও অন্যায় আচরণও করত। আসলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কারণেই তাদের এরকম মানসিকতা ছিল। এখনো ওই মানসিকতাই তারা লালন করেন। ওই সময় বাড়ির বাইরে যদি কখনো যেতাম পাড়ার ছেলেরা বা বড়রাও আমাকে হিজড়া হিজড়া বলে বিরক্ত করত। আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। আমি তো তখনো অনেক ছোট। ওই সময় বাড়ির বাইরে গেলে এরকম কথা শুনতে হতো। আবার বাড়িতেও বাবা এবং ভাইদের অনেক কথা, বকাঝকা। বাড়ি থেকে চলে যেতে বলা। আমি মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আমি খুব কান্না করতাম। আমার জন্য মাও কান্না করতেন। কিন্তু, তিনি তো নিরুপায়। আমার বয়স যখন এগারো-বারো, তখন আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় বাবা। আমি নানির বাসায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হই।

স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রীতি বলেন, আমি তাপসী রাবেয়া স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। প্রথমে আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে নিতে চায়নি। কিন্তু, নানি অনেক অনুরোধ করে আমাকে সেখানে ভর্তি করিয়ে দেয়। আমি আলাদা ধরনের, তাই আমার সঙ্গে কেউ এক বেঞ্চে বসতে চাইত না। আমার বন্ধু কেউ হয়নি স্কুলে। স্যারেরা ক্লাসে না থাকলে আমার সহপাঠীরা আমাকে দেখে হাসাহাসি করত। মজা নিত। তবে, স্কুলের ম্যাডামরা আমার সাথে খুব ভালো আচরণ করতেন। অনেকটা মায়ের মতো। নানি বাড়িতে থাকা এবং স্কুল জীবন পর্যন্ত প্রতিবন্ধী হিসেবে সহানুভূতির বদলে এরকম নির্যাতন, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা পেয়েছি। তবে, যেদিন থেকে আমাদের কমিউনিটিতে এসেছি। সেদিন থেকে খারাপ লাগার পরিমাণ কিছুটা কমেছে। কারণ, এখানে আমার মতো আরো অনেকেই আছে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প একই রকম। কমিউনিটিতে আসার পর নানি আমাকে মাঝে মধ্যে দেখতে আসে। মা আসে অনেক দিন পর। শেষ কবে দেখেছি মনে নেই।

প্রীতি হিজড়া বলেন, পরিবার যদি আমাদের আগলে রাখত, তাহলে আমাদের জীবন এমন হতো না। আমরা লেখাপড়া করে শিক্ষিত হতে পারতাম। ভালো কাজ-কর্ম করতে পারতাম। পরিবারের কারণেই আমাদের লাঞ্ছনা আর বঞ্চনার জীবন কাটাতে হচ্ছে। 

সমাজকে দায়ী করে তিনি বলেন, রাস্তায় বের হলেই একটা আতঙ্ক কাজ করে আমাদের মধ্যে। এখনই বুঝি কেউ গালি দেবে। হিজড়া হিজড়া বলে হাসাহাসি করবে। আসলে আমরা এখনো মানুষ হিসেবে গণ্য নই সকলের কাছে।

জন্মের দুই মাস পরই মাকে হারিয়ে সৎ মায়ের নির্যাতনের মধ্যে বড় হয়েছেন লিপি (পারিবারিক নাম লিটন)। হিজড়া পরিচয়ের কারণে প্রাথমিক শিক্ষাও শেষ করতে পারেননি তিনি।

লিপি জানান, শিশুকাল থেকে ঝিয়ের কাজ করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। পরিবারের কেউ কখনো খোঁজ নেয়নি। বর্তমানে তার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। তিনি নিজে উপার্জন করে কয়েক শতক জায়গা কিনেছেন, যেখানে তিনি একটি ছোট ঘর বানিয়ে গরু ও ছাগল পালন করে বাকি জীবন কাটাতে চান। এখন তিনি বিয়েবাড়ি, দোকান, বাসসহ বিভিন্ন জায়গায় হাত পেতে উপার্জন করেন। তবে, বেশি সময় কাটান ভারতে। বিয়ের অনুষ্ঠানে নাচ-গান করে উপার্জন কনেন। পূজার সময় বকশিশ পান। দুই মাস আগে বগুড়ায় ফিরেছেন তিনি।

লিপি রাইজিংবিডিকে জানান, ভারতে তাদের সম্মান দেওয়া হয়। রাস্তার মানুষ খোঁজ নেয়; বলে, মাসি কী খাবে? তারা খাবার কিনে দেয়, প্রণাম করে, দোয়া চায়। কিন্তু, বাংলাদেশে অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা আর উপহাসের শিকার হতে হয়। 

তিনি বলেন, এখানে সমাজে আমাদের জায়গা নেই। এমনকি সুইপারদের যেটুকু সম্মান থাকে, সেটুকুও আমাদের ভাগ্যে জোটে না।

বগুড়ার হিজড়াদের গুরুমা সুমি বলেন, বগুড়া জেলায় তিনি শতাধিক হিজড়া আছে। যাদের প্রধান কাজ শিশু নাচানো, বিয়ের বাড়িতে নাচ-গান করে বকশিশ নেওয়া এবং হাট-বাজারের দোকান ৫-১০ টাকা করে ওঠানো। কিছু হিজড়া শিক্ষিত হলেও অধিকাংশই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গুরুমার সান্নিধ্যে যাওয়ার পর তাদের শিক্ষার সুযোগ থাকে না। কারণ, সেই সামর্থ তাদের নেই। এছাড়া, সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের ভর্তিতে বাধা ও বৈষম্যের কারণে তারা সেখানে মানিয়ে নিতে পারে না।  

তিনি বলেন, সমাজে আমরা সব সময় উপহাস ও অবজ্ঞার শিকার হই। রাস্তায় বের হলেই কটু কথা শুনতে হয়। সরকার যদি সম্মানজনকভাবে বাঁচার সুযোগ করে দেয়, আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, তাহলে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। তবে, ড্রাইভিং বা কারখানার মতো উৎপাদনশীল কাজে আগ্রহী নই। সেগুলো পুরুষদের কাজ।

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) হুসাইন মুহাম্মদ রায়হান বলেছেন, আমাদের কাছে হিজড়াদের বিরুদ্ধে সাধারণত অভিযোগ আসে না। সাধারণ নাগরিক যেভাবে আইনি সহায়তা পায়, হিজড়ারা ও তেমনটিই পাবেন। তবে, হিজড়ারা হয়রানির শিকার হয়েছেন, এরকম কোনো অভিযোগ আমরা পাই না। বরং, তাদের দ্বারাই হয়রানির অভিযোগ মাঝে মাঝে আসে।

লাইট হাউজ এনজিও দীর্ঘদিন ধরে হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রধান হারুন অর রশিদ বলেছেন, হিজড়াদের সচেতনতা ‍বৃদ্ধি, আচরণ উন্নয়ন, চাঁদাবাজি থেকে বিরত রাখা এবং ব্যবসা বা প্রশিক্ষণে যুক্ত করতে সরকার ও হিজড়াদের সঙ্গে একযোগে কাজ করছি আমরা। প্রায় ১ হাজার ১২২ জনকে ছয় মাস মেয়াদী ভোকেশনাল ট্রেনিং ও সেলাই মেশিন দিয়েছি। তবে, সেলাই মেশিন অনেকেই কাজে না লাগিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, হিজড়াদের মধ্যে ভবিষ্যতের চিন্তা নেই। এটিই তাদের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকার তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি ও ভাতা দিলেও অনেকেই তা গ্রহণ করতে আগ্রহ দেখান না। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও ডাক্তাররা সেবা দিতে প্রস্তুত থাকলেও হিজড়ারা নিজেরাই আগ্রহ দেখান না। তাদের জীবনমান উন্নয়নে তাদের নিজেদেরও সচেতন হয়ে এগিয়ে আসা দরকার।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে জেলা প্রশাসনের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মেজবাউল করিম জানান, সরাসরি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কোনো কার্যক্রম নেই। তবে, সমাজসেবা দপ্তর তাদের নিয়ে কাজ করে। তারা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করেই কাজ করে।  

বগুড়া সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আতোয়ার রহমান বলেছেন, বগুড়া জেলায় ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তির আওতাধীন হিজড়া জনগোষ্ঠীর ২৩৯ জন সদস্য রয়েছেন। বছরে ৪ বার করে তারা এই ভাতা পেয়ে থাকেন। এর মধ্যে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ভাতা বাবদ তারা ৬৫০ টাকা করে পান। শিক্ষা উপবৃত্তি দেওয়া হয় প্রাথমিক স্তরে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিকে ৮০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিকে ১ হাজার টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ১ হাজার ২০০ টাকা। এই দুই ভাতার বাইরে তাদের নিয়ে সমাজসেবার আপাতত কোনো কার্যক্রম নেই।

বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোস্তফা কামাল বলেন, হিজড়াদের আসলে কেউই কোনোভাবেই গ্রহণ করতে চায় না। কোনো পরিবারে হিজড়া সন্তান জন্ম নিলে সেখানে কিন্তু তার অভিভাবকরা তাকে রাখতে চায় না। বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এটা কিন্তু খুবই অমানবিক। সে হিজড়া হয়ে জন্ম নিয়েছে, এটা তো তার দোষ না। যদি দোষ হয়, তবে সেটা বাবা-মা‘র হবে। হিজড়ারা কিন্তু নিরীহ প্রকৃতির হয়ে থাকে। তারপরও হিজড়ারা পুরুষদের বা উঠতি বয়সী ছেলেদের সেক্সুয়ালি হ্যারাজ করতে পারে বা তাদের দ্বারা পরিবেশ নষ্ট হতে পারে, এরকম একটা চিন্তা থেকে সমাজের মানুষদের তাদের প্রতি একটা নিষিদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। এ কারণে তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ খুব বেশি গ্রো করে না। সমাজে স্বীকৃতি বা ক্ষমতায়নের জন্য তাদের লেখাপড়ার মধ্যে যেকোনোভাবে নিয়ে আসতে হবে। এটা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। যেহেতু পরিবারে, সমাজে তাদের নিয়ে একটা ট্যাবু আছে—পরিবারে রাখা যাবে না, মানুষের সাথে মিশতে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্র তাদেরকে এ দেশের নাগরিক হিসেবে অন্য নাগরিকের মতোই সম্মান দিয়ে সমঅধিকারের ভিত্তিতে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে, তাদের জন্য প্রয়োজনে আলাদা স্কুল করতে পারে বা ইনক্লুসিভ সোসাইটি তৈরি করার ক্ষেত্রে সকল হিজড়াকে এক স্কুলে না দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করতে পারে। আমার কাছে মনে হয়, রাষ্ট্র যদি তাদের শিক্ষায় মনোনিবেশ করাতে পারে, পড়াশোনা করাতে পারে, তাহলে কিন্তু একসময় তাদের ক্ষমতায়ন হবে। তার যোগ্যতার বিকাশ হবে। মানুষ তখন বুঝবে, এরাও যোগ্যতাসম্পন্ন। রাষ্ট্রের যে জায়গাগুলোতে মানুষ থাকলে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়; সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক—এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা যেন নিজস্ব যোগ্যতা, শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। সেভাবে যদি আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে পারি, তাহলে তাদের ব্যাপারে আমাদের যে একটা ধারণা, সেটা কিন্তু আস্তে আস্তে দূর হয়ে যাবে। আমাদের বাংলাদেশের লোকজন যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করে। 

হিজড়াদের শিক্ষা নিয়ে কী ধরনের সমস্যা, বর্তমানে বিদ্যমান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওদের তো আসলে অভিভাবক নেই। যেমন: ছিন্নমূল পথশিশু যারা রয়েছে, তাদেরও তো লেখাপড়া হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? কারণ, তাদের অভিভাবক নেই। আর্থিক সামর্থ নেই। এদের ক্ষেত্রেও তাই। তো এদের লেখাপড়ার দায়িত্ব রাষ্ট্র না নেওয়া পর্যন্ত তো নিশ্চিত হবে না।  

বগুড়ার দলিত (নিম্নবর্গীয়) গবেষক নজরুল ইসলাম বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠী তো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের মূলধারায় ফেরাতে হলে তাদের নিজেদের আগে মানবিক মর্যাদাবোধ জাগ্রত করতে হবে। তাদের মাঝে আত্মমর্যাদাবোধ জাগাতে হবে। তারা যে মানুষ সমাজে তাদের ভূমিকা আছে, এ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির অধিকার আছে এই বিষয়গুলো তাদের মাঝে পুশ করতে হবে। এসব বিষয়ে তাদের সচেতন করতে পারলেই তারা সমাজের মূলধারার সাথে যুক্ত হতে পারবে। সেক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ আসবে, সেগুলো রাষ্ট্রকেই সমাধান করতে হবে। রাষ্ট্র তো বুর্জোয়া শ্রেণির রাষ্ট্র। প্রতিনিধিও নির্বাচিত হয় তাদের মধ্যে থেকেই। এই নিম্নবর্গীয় মানুষেরা বহুকাল থেকে অবহেলিত। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রই তাদের মর্যাদা ও অধিকার সেটা দেয়নি। রাষ্ট্রও তাদের অবহেলার দৃষ্টিতে দেখছে। অধিকাংশ দেশেই এমনটা করা হচ্ছে। লোক দেখানো কর্মসূচি পালন করলেও তাদের প্রকৃত মুক্তির কথা বলা হয়নি। সাম্য সমাজ ছাড়া কখনোই এই নিম্নবর্গীয় শ্রেণির মানুষগুলোর মুক্তি সম্ভব না।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে বগুড়ার সিভিল সার্জন মো. খুরশীদ আলম বলেন, যেহেতু, তারা ছেলেও না মেয়েও না; সেহেতু তাদের মধ্যে বেশকিছু হরমোন ব্যবহারের একটা প্রবণতা থাকে। অতিরিক্ত হরমোন নেওয়ার কারণে তাদের একই সাথে লিভার এবং কিডনিতে বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হয়। যেহেতু, তারা হোমোসেক্সুয়াল, সেহেতু তাদের মধ্যে এইচআইভি এইডস এবং সিফিলিস হওয়ার প্রবণতা থাকে। এছাড়া, এদের মধ্যে অনেকে ট্রান্সজেন্ডার কারেকশনের জন্য সার্জারিতে যায়। এটা অনেক জটিল একটা প্রক্রিয়া। এ কারণে অনেকেই সার্জিক্যাল ইনফেকশন এবং সার্জিক্যাল কমপ্লিকেশনের কারণে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং মৃত্যুও ঘটে। মানসিক স্বাস্থ্যের যে বিষয়টি, সেটা সরাসরি সামাজিকতার সাথে যুক্ত। এই জনগোষ্ঠীর অনেকেই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে অনেক বেশি মানসিক স্ট্রেসে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এইচআইভি এইডস এসটিডি নামে একটা প্রোগ্রাম চালু আছে। এই প্রোগ্রামের আওতায় তাদের গ্রামীণ পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা এবং জেলা পর্যায়েও চিকিৎসা ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এজন্য বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে আলাদা কর্নার আছে। সরকার সম্প্রতি এই জনগোষ্ঠীকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। তাদের চিকিৎকার বিষয়ে বলা হয়েছে, তারা চিকিৎসা নিতে এসে যেন বঞ্চনা বা বৈষম্যের শিকার না হন। তাদেরকে যেন প্রাপ্য চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।

ঢাকা/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ