‘যাও, আবার নামাজ পড়ো, কারণ তুমি নামাজ পড়োনি’
Published: 18th, October 2025 GMT
নামাজ ইসলামের মূল স্তম্ভ এবং বান্দার সঙ্গে তার রবের মধ্যে সবচেয়ে গভীর সম্পর্কের মাধ্যম। এটি শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং আত্মার শান্তি, হৃদয়ের প্রশান্তি এবং জীবনের সঠিক পথে চলার শক্তির উৎস।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন বান্দার প্রথম যে আমলের হিসাব নেওয়া হবে, তা হলো তার নামাজ। যদি নামাজ সঠিক হয়, তবে সে সফল ও বিজয়ী হবে। আর যদি নামাজ নষ্ট হয়, তবে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৪১৩)
নামাজের গুরুত্ব এতটাই যে, এটি সঠিকভাবে আদায় না করলে পুরো ধর্মই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নামাজে বান্দার সঙ্গে আল্লাহর একটি সংলাপ চলে। এটি কেবল শারীরিক ক্রিয়া নয়, বরং হৃদয় ও আত্মার সঙ্গে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম।হাদিসের ঘটনা: ‘যাও, আবার নামাজ পড়ো’আবু হুরায়রা (রা.
লোকটি তিনবার নামাজ পড়লেন, কিন্তু প্রতিবারই রাসুল (সা.) তাকে একই কথা বললেন।
অবশেষে লোকটি বললেন, ‘যিনি আপনাকে সত্য নিয়ে পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম, আমি এর চেয়ে ভালোভাবে নামাজ পড়তে জানি না। দয়া করে আমাকে শিখিয়ে দিন।’
তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘যখন তুমি নামাজে দাঁড়াও, তখন তাকবির বলো। তারপর কোরআন থেকে যা তোমার জানা আছে, তা পড়ো। তারপর রুকু করো এবং রুকুতে স্থির থাকো। তারপর উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াও। তারপর সিজদা করো এবং সিজদায় স্থির থাকো। তারপর উঠে শান্তভাবে বসো। এভাবে তোমার পুরো নামাজে সম্পন্ন করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৫৭)
এই হাদিসে রাসুল (সা.) নামাজের সঠিক পদ্ধতি শিখিয়েছেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে ভুল সংশোধন করেছেন। তিনি সাধারণত পরোক্ষভাবে উপদেশ দিতেন, কিন্তু এই ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি বলেছেন, ‘তুমি নামাজ পড়োনি,’ যা নামাজের গুরুত্ব এবং এর সঠিক আদায়ের প্রতি তাঁর কঠোর মনোভাব প্রকাশ করে।
আরও পড়ুনজীবনকে ছন্দে ফেরাবে ‘ধীর নামাজ’২৪ মে ২০২৫অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘নামাজে দাঁড়ানোর সময় আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ওজু করো। তারপর তাশাহহুদ পড়ো এবং নামাজ কায়েম করো। যদি কোরআন মুখস্থ থাকে, তবে তা পড়ো; নইলে আল্লাহর প্রশংসা, তাকবির ও তাহলিল পড়ো। তারপর রুকুতে শান্তভাবে থাকো, সোজা হয়ে দাঁড়াও, সিজদায় শান্তভাবে থাকো, বসায় স্থির থাকো, তারপর ওঠো। যদি তুমি এভাবে করো, তবে তোমার নামাজ পূর্ণ হবে। আর যদি এতে কমতি করো, তবে তোমার নামাজও কমতি থাকবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩০২)
এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, নামাজের প্রতিটি অংশে স্থিরতা ও মনোযোগ অপরিহার্য।
নামাজের মর্যাদা ও গুরুত্বনামাজ ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নামাজ রক্ষা করে, সে তার দ্বীন রক্ষা করে। আর যে নামাজ নষ্ট করে, সে তার দ্বীন নষ্ট করে।’
নামাজ বান্দার জীবনে স্থিতিশীলতা ও সংশোধন নিয়ে আসে। যে ব্যক্তি নামাজে অবহেলা করে, তার জীবনে বিশৃঙ্খলা ও আত্মিক শূন্যতা দেখা দেয়, এমনকি তার বাহ্যিক অবস্থা যতই সুন্দর হোক না কেন।
নামাজে বান্দার সঙ্গে আল্লাহর একটি সংলাপ চলে। এটি কেবল শারীরিক ক্রিয়া নয়, বরং হৃদয় ও আত্মার সঙ্গে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে বিলাল, নামাজ কায়েম করো, এর মাধ্যমে আমাদের শান্তি দাও’। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমার চোখের শীতলতা নামাজে নিহিত’। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯৮৫)
যে ব্যক্তি রুকু ও সিজদায় তার পিঠ সোজা না করে, তার নামাজ হয় না।’সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ১৮৮২নামাজের সঠিক পদ্ধতিহাদিসে নামাজের সঠিক পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর মূল উপাদানগুলো হলো:
১. তাকবিরে তাহরিমা: নামাজ শুরু করার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবির বলা।
২. কোরআন তিলাওয়াত: কোরআন থেকে যা মুখস্থ আছে, তা পড়া। যদি কুরআন মুখস্থ না থাকে, তবে আল্লাহর প্রশংসা, তাকবির ও তাহলিল পড়া।
৩. রুকুতে স্থিরতা: রুকুতে গিয়ে শান্তভাবে থাকা, যাতে শরীর স্থির হয়।
৪. সোজা দাঁড়ানো: রুকু থেকে উঠে পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়ানো।
৫. সিজদায় স্থিরতা: সিজদায় গিয়ে শান্তভাবে থাকা।
৬. বসায় স্থিরতা: সিজদার পর বসে শান্তভাবে তাশাহহুদ পড়া।
এই প্রতিটি অংশ ধীরস্থিরভাবে আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধীরস্থিরতা ছাড়া নামাজ পূর্ণ হয় না। আলি ইবনে শায়বান হানাফি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এক ব্যক্তিকে দেখলেন, যিনি রুকু ও সিজদায় পিঠ সোজা করছেন না। তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি রুকু ও সিজদায় তার পিঠ সোজা না করে, তার নামাজ হয় না।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ১৮৮২)
আরও পড়ুনকাজা নামাজ আদায়ের নিয়ম১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫নামাজে ভুল: কেন এবং কীভাবে সংশোধনওপরের হাদিসে দেখা যায়, লোকটির নামাজে ভুল ছিল, যার কারণে রাসুল (সা.) তাকে পুনরায় নামাজ পড়তে বলেছেন। নামাজে ভুলের কারণ হতে পারে অজ্ঞতা, তাড়াহুড়ো বা মনোযোগের অভাব। রাসুল (সা.)-এর শিক্ষা ছিল সরাসরি কিন্তু দয়ালু। তিনি লোকটিকে শুধু ভুল ধরেননি, বরং তাকে সঠিক পদ্ধতি শিখিয়েছেন।
এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, নামাজে ভুল হলে তা সংশোধন করা উচিত। তিরমিজির বর্ণনায় বলা হয়েছে, নামাজে কমতি হলে তা নফল নামাজ দিয়ে পূরণ করা যায়। এটি আল্লাহর রহমতের একটি প্রকাশ, যিনি বান্দার প্রতি সহানুভূতিশীল।
নামাজের প্রভাবনামাজ বান্দার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এটি তার চরিত্র, আচরণ ও দ্বীনকে শক্তিশালী করে। নিয়মিত নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সঙ্গে এগিয়ে যায়। নামাজ তাকে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে এবং আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ককে দৃঢ় করে। যিনি নামাজে অবহেলা করেন, তার জীবনে আত্মিক শূন্যতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
নিয়মিত নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সঙ্গে এগিয়ে যায়। নামাজ তাকে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে এবং আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ককে দৃঢ় করে।একজন সাহাবি বলেছিলেন, ‘আমি যদি নামাজ পড়তাম, তবে শান্তি পেতাম।’ এর জবাবে অন্যরা তাকে সমালোচনা করলে তিনি বললেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘হে বিলাল, নামাজ কায়েম করো, এর মাধ্যমে আমাদের শান্তি দাও’’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৯৮৫)।
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, নামাজ বান্দার জন্য আত্মার শান্তি ও রবের সঙ্গে মনাজাতের মাধ্যম।
‘ফিরে যাও, নামাজ পড়ো, কারণ তুমি নামাজ পড়োনি’ — এই বাণী আমাদের নামাজের সঠিক পদ্ধতি ও এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। নামাজ কেবল কয়েক মিনিটের ইবাদত নয়, বরং এটি আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম, যা বান্দার জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও বরকত নিয়ে আসে।
নামাজে ধীরস্থিরতা ও মনোযোগ অপরিহার্য। যিনি নামাজ রক্ষা করেন, তিনি তার ইসলাম রক্ষা করেন। আর যিনি তা নষ্ট করেন, তিনি তার ইসলামের ক্ষতি করেন। তাই আসুন, আমরা সঠিকভাবে নামাজ আদায় করি এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও জান্নাতের পথ লাভ করি।
আরও পড়ুন‘হে আমার সন্তান, নামাজ কায়েম করো’১৭ অক্টোবর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ম জ ক য় ম কর ইসল ম র আল ল হ আম দ র র জ বন বল ছ ন বলল ন ত রপর ক রআন
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় যুদ্ধবিরতি নেতানিয়াহুর জন্য ডেকে এনেছে ৬টি বড় বিপদ
গাজায় ইসরায়েলের হামলায় গত দুই বছরে অগণিত প্রাণহানি ও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। তবু দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য এ উপত্যকায় শান্তি যেন অকালেই এসেছে। এমনটাই মনে হচ্ছে কিছু পর্যবেক্ষকের চোখে।
সমালোচকেরা বলছেন, এ যুদ্ধকে নেতানিয়াহু নিজ রাজনৈতিক অবস্থান ও এমনকি তাঁর স্বাধীনতার (বিভিন্ন মামলা থেকে মুক্তি) চ্যালেঞ্জগুলো থেকে মনোযোগ সরানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, এসব সমস্যার একটিও মুছে যায়নি।
যুদ্ধবিরতিকে নেতানিয়াহু বিজয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আলন পিনকাসসহ অনেকের মতে, এ যুদ্ধবিরতি ছিল মূলত সাজানো নাটক; যা হোয়াইট হাউসের চাপে নেতানিয়াহু মানতে রাজি হয়েছেন। কারণ, ওয়াশিংটন গাজা যুদ্ধের আর্থিক ও কূটনৈতিক বোঝা বইতে আর রাজি ছিল না।
তাহলে প্রশ্ন উঠছে, যদি নেতানিয়াহু নতুন কোনো যুদ্ধ শুরু করতে না পারেন, তবে আগামী বছরের ইসরায়েলি নির্বাচনের আগে–পরে নেতানিয়াহুর সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে? আর সেগুলো কতটা ভয়ানক হতে পারে?
চলুন, একে একে দেখে নেওয়া যাক।
১. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতানিয়াহু কি আরও একা হয়ে পড়বেনবর্তমানে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যতটা নিঃসঙ্গ, অতীতে কখনো এতটা ছিল না। আর অনেকের কাছেই সেই নিঃসঙ্গতার প্রতীক এখন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
গত দুই বছরে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। খাদ্য অবরোধে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ দৃশ্য বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। স্বল্প মেয়াদে, যদি না নেতানিয়াহু সরকার আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের স্থায়ীভাবে গাজায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে বিশ্বের গণমাধ্যমে এ হত্যাযজ্ঞের চিত্র আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাবে। এটি ইসরায়েলের একঘরে অবস্থানকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করবে।
যুদ্ধবিরতিকে নেতানিয়াহু বিজয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আলন পিনকাসসহ অনেকের মতে, এ যুদ্ধবিরতি ছিল মূলত সাজানো নাটক; যা হোয়াইট হাউসের চাপে নেতানিয়াহু মানতে রাজি হয়েছেন। কারণ, ওয়াশিংটন গাজা যুদ্ধের আর্থিক ও কূটনৈতিক বোঝা বইতে আর রাজি ছিল না।তবে ইসরায়েলের জন্য ক্রমবর্ধমাণ এ কূটনৈতিক নিঃসঙ্গতা নতুন নয়। গত সেপ্টেম্বরেই নেতানিয়াহু যেন এ অবস্থাকে স্থায়ী করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন একটি ‘সুপার স্পার্টা’ তৈরির স্বপ্ন। সেটি প্রাচীন যুদ্ধবাজ গ্রিক নগররাষ্ট্র স্পার্টার আদলে এমন এক রাষ্ট্র, যা অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন, কূটনৈতিকভাবে আলাদা এবং যুদ্ধকেই জীবনধারা হিসেবে গ্রহণ করবে।
এ বক্তব্য ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীরা ভালোভাবে নেননি। ঘোষণার পরই তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক ধসে পড়ে এবং শেকেলের মান অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় কমে যায়। দেশের ২০০ বড় প্রতিষ্ঠানের সংগঠন ‘ইসরায়েল বিজনেস ফোরাম’ এক বাক্যে বলেছিল, ‘আমরা স্পার্টা নই।’
জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে বক্তৃতা দিচ্ছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালে অধিবেশনকক্ষ ছেড়ে যান অনেক দেশের প্রতিনিধি। এ সময় চারপাশে খালি আসন পড়ে থাকতে দেখা যায়। নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫