বরিশালে অপসো স্যালাইন লিমিটেড কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পর চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে এক পক্ষের আন্দোলনের মধ্যে নতুন করে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে কারখানা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে মালিকপক্ষ। আজ মঙ্গলবার সকালে শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিতে গেলে চাকরিচ্যুত শ্রমিকেরা তাঁদের বাধা দেন। এ সময় দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়।

২০ দিন ধরে চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে নগরের কবি জীবনানন্দ দাশ (বগুড়া রোড) সড়কে অবস্থিত অপসো স্যালাইন কারখানার সামনের সড়ক অবরোধ করে লাগাতার আন্দোলন করে আসছে শ্রমিকদের একটি পক্ষ। মালিকপক্ষ কারখানা চালুর উদ্যোগ নিলে আজ সকালে শ্রমিকদের অপর একটি পক্ষ কাজে যোগ দিতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, নতুন শ্রমিকেরা কারখানায় ঢুকতে চাইলে চাকরিচ্যুত শ্রমিকেরা তাঁদের বাধা দেন। এরপর তাঁরা ব্যানার নিয়ে চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের আন্দোলনকে ‘অবৈধ’ উল্লেখ করে সড়কে অবস্থান নেন। দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিতে থাকলে আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে জীবনানন্দ দাশ সড়কে যান চলাচল বন্ধ আছে।

কাজে যোগ দিতে যাওয়া শ্রমিকেরা বলছেন, সকালে তাঁরা কোম্পানিতে ঢুকতে গেলে তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। যাঁদের চাকরি আছে, তাঁরা যেন কাজ করার সুযোগ পান, সে দাবি জানান তাঁরা। অন্যদিকে চাকরিচ্যুত শ্রমিকেরা বলছেন, চাকরি পুনর্বহাল না করা পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

অপসো স্যালাইন কারখানা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাকিব মিয়া বলেন, ‘স্টোরিপ্যাক (সিরিঞ্জ ও স্যালাইন সেট প্রস্তুতকারক) শ্রমিকদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করে নতুন শ্রমিকদের দিয়ে কারখানা চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছে মালিকপক্ষ।’

এ ঘটনার পর সংবাদ সম্মেলন করেছে অপসো স্যালাইন লিমিটেড কারখানা কর্তৃপক্ষ। সংবাদ সম্মেলনে অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা অনিন্দ কুমার সরকার বলেন, শ্রম আইন মেনে অপসোনিনের স্টোরিপ্যাক বিভাগের ৪৪৪ জন শ্রমিককে অবসান দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ শ্রমিক অবসানকালীন বেতন–ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার টাকা বুঝে নিয়েছেন। কিন্তু কিছু শ্রমিক ও বহিরাগত ব্যক্তিরা অন্য বিভাগের শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধা দিচ্ছেন। এতে কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ আছে। যেহেতু বর্তমানে সারা দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার বেড়েছে, তাই উৎপাদন বন্ধ থাকলে সামনে স্যালাইনের সংকট প্রকট হতে পারে।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন দিনের ছুটি ঘোষণা দিয়ে ডাকযোগে ৫৭০ জন শ্রমিককে চাকরিচ্যুতির চিঠি পাঠানো হয়। গত ২৯ অক্টোবর চিঠি পাওয়ার পর থেকেই তাঁরা লাগাতার বিক্ষোভ-সমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচি, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি করছেন। তাঁরা কারখানাটির সামনের সড়কে ২০ দিন ধরে অবস্থান নিয়ে আছেন। এতে যান চলাচল বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

শ্রমিকদের আন্দোলনে শুরু থেকেই সংহতি জানিয়েছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) জেলা সমন্বয়ক মনীষা চক্রবর্তী। তিনি বলেন, সম্প্রতি অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিতে ট্রেড ইউনিয়ন চালু হয়েছে। মূলত এ কারণে শ্রমিকদের অপসারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে কম বেতনে নতুন শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে কারখানা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেটা শ্রম আইনের পরিপন্থী ও অমানবিক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স য ল ইন অবস থ ন

এছাড়াও পড়ুন:

যেভাবে ‘ভুক্তভোগীর আয়নায় বন্দী’ বাংলাদেশ

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বারবার ব্যর্থ হওয়ার কারণ কী? কেন আমরা একটা কার্যকর রাষ্ট্র ও টেকসই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারছি না? কেন আমরা সবার সঙ্গে সহাবস্থানের ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারছি না? ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাই আমাদের অতীতের ঘটনা বা গল্পগুলোর ভেতরে। কীভাবে সেই ঘটনা বা গল্পগুলো লেখা হয়েছে আর সেই লেখা কীভাবে আমাদের চরিত্র গঠন করেছে, এটা বোঝা জরুরি।

২.

আমাদের ইতিহাসচর্চায় একটা জিনিস বারবার চোখে পড়ে, আমরা নিজেদের অতীতকে মূলত ভিকটিমহুডের ফ্রেমে (ভুক্তভোগীর আয়নায়) দেখি। সেখানে ‘আমি’ সব সময় নির্যাতিত, বাকি সবাই অত্যাচারী। আমাদের ইতিহাসে যখনই ব্যর্থতার গল্প এসেছে, তখনই আমরা প্রথমে খুঁজেছি—‘কেউ কি আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?’ বা ‘বাইরের কোনো শক্তি কি আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে?’

এ রকম হয়েছে কারণ, এটা সহজ গল্প; সিনেমার মতো বলা যায়, মানুষও দ্রুত বোঝে, সহজে বিশ্বাস করে। কিন্তু এই সহজ গল্প বলা মানে আমাদের নিজের ব্যর্থতার প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়া।

৩.

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর মাঠে নবাব সিরাজউদ্দৌলা হেরে গেলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের হাতে। ইতিহাসের বইগুলোতে আমরা সাধারণত পড়ে থাকি এবং অধিকাংশ মানুষ এভাবেই বলে, মির জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করল, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খানরা ক্লাইভের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নবাবকে বিক্রি করে দিলেন।

গল্পটা আংশিক সত্য; সত্যিই এই লোকেরা ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস কি শুধু এতটুকুই? এর আগে-পরে কী ঘটছিল? ওই সময়ই মোগল সাম্রাজ্য কার্যত ভেঙে পড়ছে। বাংলায় আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার নিয়ে অস্থিরতা, প্রশাসন দুর্বল, রাজস্বব্যবস্থা দুর্নীতিতে ভরা; সেনাবাহিনী আধুনিক নয়, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ছে। এই ভাঙা কাঠামোর ভেতরেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রবেশ করেছে। কিন্তু আমরা এখানে সেই কনটেক্সট, সেই শাসনকাঠামো, সেই সমাজের ক্ষয়কে প্রশ্ন করতে চাই না। কারণ, আমাদের হাতে ইতিমধ্যেই একটা সুন্দর ভিকটিমের গল্প আছে।

হিন্দু বাঙালির কাছে মির জাফর আর ক্লাইভ মিলে তাদের ভিকটিম বানিয়েছেন; মুসলমান বাঙালির ইতিহাসে জগৎশেঠ, ক্লাইভ আর মিরজাফর মিলে আমাদের ‘ভিকটিম’ বানিয়েছেন।

৪.

আসুন দেখি, ওই সময়ে ইউরোপে কী হচ্ছিল। ১৭৭৬ সালে যখন অ্যাডাম স্মিথ দ্য ওয়েলথ অব নেশনস লিখছেন এবং প্রশ্ন করছেন, কেমন করে সম্পদ তৈরি হয়। ঠিক তখনই আমাদের অঞ্চলের বহু নবাব-জমিদার তাঁদের সম্পদ ঢালছেন প্রাসাদ, দরবার, নাচ-গান আর রঙিন আমোদে। আধুনিক বিদ্যা, প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি বা প্রশাসন গড়ার খরচ তাঁদের কাছে গৌণ। অর্থাৎ বিশ্বের খেলাটা বদলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা অনেকটাই আগের শতকের মানসিকতায় আটকে গেছি।

আমাদের সামনে সমুদ্র ছিল, বিশাল উপকূল ছিল; কিন্তু সমুদ্র নিয়ে আমাদের আচরণ কেমন? ‘কালা পানি’–সম্পর্কিত ধারণা থেকে বোঝা যায়, সমুদ্র পাড়ি দিলে জাত যাবে। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের একাধিক ব্যাখ্যায় এই ভয় তৈরি করেছে। বৌধায়ন ধর্মসূত্রের মতো গ্রন্থে সমুদ্রযাত্রাকে জাতচ্যুতি-সৃষ্টিকারী অপরাধ বলা হয়েছে। ফলে বহু উচ্চবর্ণীয় গোষ্ঠীর জন্য বিদেশে ব্যবসা-শিক্ষা-রাজনীতি করতে সমুদ্রে ভেসে যাওয়া সামাজিকভাবে ‘অগ্রহণযোগ্য’ হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে বাঙালি মুসলমানরা কী করেছে? তারা ইউরোপীয়দের মতো দীর্ঘমেয়াদি গ্লোবাল ট্রেড নেটওয়ার্ক (বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্পর্ক) দাঁড় করাতে পারিনি। আমাদের বণিকশ্রেণি কখনোই পর্তুগিজ-ডাচ-ফরাসি-ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর মতো সামুদ্রিক সাম্রাজ্য গড়ার অবস্থায় পৌঁছায়নি; বরং উল্টো দিক থেকে জাহাজ এসেছে, আমরা সেই জাহাজের ভোক্তা হয়েছি।

আরও পড়ুনরাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হয়২৭ মার্চ ২০২৫৫.

আমরা যখন ঔপনিবেশিক আমলের ইতিহাস পড়ি, বলি ব্রিটিশরা আমাদের বিভক্ত করে শাসন করেছে (ডিভাইড এন্ড রুল)। সত্যি তা–ই করেছে; জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পতাকার নিচে হিন্দু-মুসলিম, জাত-জাতি, ভাষা-গোষ্ঠী—সবকিছুকে তারা ব্যবহার করেছে।

কিন্তু আমরা জিজ্ঞেস করি না, এই বিভাজনের বীজ কোথা থেকে এল? জাত-পাত, উঁচু-নিচু বর্ণ, আশরাফ-আতরাফ, জমিদার-রায়ত, গ্রাম-শহর—এসব ফাটল তো উপনিবেশ-পূর্ব সমাজেই ছিল।

ব্রিটিশরা সেই ফাটলগুলোকে আইনি-প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতর বাঁধিয়ে, আদমশুমারি আর পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করেছে। বীজ আমাদের, সার-সেচ তাদের। আশ্চর্য লাগছে? ১৯৪৭-এর দিকে তাকান। আমরা বলি, ‘হিন্দুরা–মুসলমানরা আমাদের বঞ্চিত করল।’ কিন্তু দেশভাগের সময় এক কোটির বেশি মানুষ ঘর হারায়। কয়েক মিলিয়ন মানুষ নিহত হয় ধর্মীয় দাঙ্গায় আর অনাহারে।

এটা শুধু ব্রিটিশের আঁকা দাগ ছিল না; দশকের পর দশক ধরে তৈরি ‘ওরা আমাদের দখল করে নেবে’ ধরনের হিস্টিরিয়ার মধ্য দিয়েই দেশভাগের মাটি প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু আমাদের পাঠ্যবইয়ে আমরা প্রাথমিকভাবে দোষটা প্রায় সব সময় ‘ওদের’ ঘাড়ে চাপিয়ে দিই; ‘মুসলমান হিন্দুকে মারল’, ‘হিন্দু মুসলমানকে মারল’; কিন্তু নিজেদের অপরাধ কি স্বীকার করেছি, নাকি সব কার্পেটের তলায় চেপে রেখেছি?

৬.

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হলো। যখন রাষ্ট্র গঠনের কথা, তখনই দেশ মেতেছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে। পূর্ণাঙ্গ সংবিধান এল ১৯৫৬ সালে। এর আগে ১৯৪৯ সালে অবজেকটিভ রেজল্যুশনের মাধ্যমে ঘোষণা করা হলো, পাকিস্তানের সংবিধানের ভিত্তি হবে ইসলামি আদর্শ।

কিন্তু বাস্তবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। তথাকথিত আধুনিক মুসলমান এলিট গ্রুপ ইসলাম নিয়ে রাজনীতি শুরু করল।

সংবিধান কার্যকর হওয়ার মাত্র দুই বছরের মাথায়, ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেন। সংবিধান স্থগিত হলো। ‘বাইরের শক্তি পাকিস্তানকে অস্থির করে দিল’—এ–ই ছিল বয়ান, এখনো পাকিস্তানে ওই বয়ানই চলছে।

কিন্তু প্রথম সামরিক শাসক তো মুসলমান জেনারেল, ক্ষমতা তো মুসলমান এলিটরাই তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিল। তারা কেন গণতন্ত্রের পথে হাঁটল না?

আরও পড়ুনবাংলাদেশকে কি একটি আধুনিক রাষ্ট্র বানানো সম্ভব০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪৭.

সেক্যুলার এলিটরা যখন এসব করছে, তখন ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো কী করছিল? ১৯৫৩ সালে পাঞ্জাব ও লাহোরে তারা আহমদিয়া–বিরোধী আন্দোলন করছে। তাদের সংবিধান নিয়ে মাথাব্যথা নেই, আধুনিক রাষ্ট্র বানানো নিয়ে চিন্তা নেই, চিন্তা হলো কাকে ‘অমুসলিম’ ও ‘কাফের’ বলে আইন করে সমাজের বাইরে ছুড়ে ফেলা যায়।

রাস্তায় নামল বিভিন্ন ধর্মীয় দল, দাবি করল, আহমদিদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে। আন্দোলন দমাতে লাহোরে সামরিক আইন জারি করতে হলো। এটাই স্বাধীন পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর প্রথম বড় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপগুলোর একটি। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে আহমদিয়াদের আনুষ্ঠানিকভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা হলো। ‘মুসলমানরা সব সময় ভিকটিম’, কিন্তু এই ভিকটিমহুডের ভেতর দিয়েই আবার সমাজের ভেতর একাংশকে আইনিভাবে সমাজের বাইরে ছুড়ে ফেলা হয়।

কেউ বলতে পারেন, ‘অত্যাচার তো শহরে; গ্রাম ভালো ছিল।’ আসলেই কি তাই? গ্রাম নিয়ে আমাদের কল্পনাও তো খুব রোমান্টিক। আমরা বলি, ‘গ্রামবাংলা খুব সুন্দর, শান্ত, সাম্যবাদী।’

কিন্তু ড. বি আর আম্বেদকর ভারতের সংবিধান সভায় দাঁড়িয়ে ১৯৪৮ সালে বলেছেন, ভারতীয় গ্রাম আসলে স্থানীয়তাবাদ, অজ্ঞতা, সংকীর্ণতা আর সাম্প্রদায়িকতার আঁতুড়ঘর। গ্রামের ‘রিপাবলিক’ ভাবটাই বহুদিন ধরে জাতবৈষম্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এটা শুধু হিন্দু গ্রামের কথা নয়; মুসলিম গ্রামেও আশরাফ-আতরাফ, জমিদার-কৃষক—সব জায়গাতেই ক্ষমতাধরেরা নিচের মানুষকে চাপিয়ে রেখেছে। ‘দারিদ্র্য মানেই নিরপরাধ’—এই সোজা সমীকরণ বাস্তবে সত্যি নয়; সুযোগ পেলে নিচের স্তরেও মানুষ আরও নিচের লোককে শোষণ করেছে।

৮.

বাংলাদেশের অনেক ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবী এই ‘ভিকটিম-লুপ’কে আরও পাকাপোক্ত করেছেন। ১৯৭১-এর গণহত্যা বাস্তব; কিন্তু স্বাধীনতার পর আমরা নিজের রাষ্ট্র কীভাবে গড়লাম, কাকে কাকে সুবিধা দিলাম, কার স্বার্থকে বাদ রাখলাম—এই আত্মসমালোচনা খুব কম করি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সরকার পড়ে গেল। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। আমরা ভাবলাম, এবার হয়তো গণতন্ত্র ফিরবে, নির্বাচনী রাজনীতি নতুনভাবে দাঁড়াবে।

কিন্তু খুব দ্রুত দেখি, আলোচনার কেন্দ্র আবার সেই পুরোনো জায়গায়: কে ‘ভারতপন্থী’, কে ‘ইসলামবিদ্বেষী’, কোন গোষ্ঠীকে ‘দেশদ্রোহী’ ঘোষণা করা হবে, কে কার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছে ইত্যাদি। কৃষকের ন্যায্য অধিকার, পোশাকশ্রমিকের মজুরি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা—এসব প্রশ্ন তুলনামূলকভাবে আবারও সাইডলাইনে চলে যায়। যেন প্রতিবার শাসক বদলালেই শুধু ‘নতুন ভিকটিম’ আর ‘নতুন ভিলেন’ বানানোর খেলা শুরু হয়, রাষ্ট্র গঠনের কথা গায়েব।

এখানে সাধারণ নাগরিক হিসেবেও আমাদের দায় কম না। যখন মাদ্রাসার হাজার হাজার ছাত্রকে ঢাকায় এনে কোনো এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ানো হয়, তখন সেই ছাত্ররা কেন তাদের শিক্ষককে প্রশ্ন করেন না, ‘পড়ালেখা বাদ দিয়ে আপনারা কেন আমাদের মিছিল-সমাবেশে নিয়ে যাচ্ছেন?’ যখন কোনো স্কুলের শিক্ষক ক্লাসে ঢুকে শুধু উপস্থিতি নিয়ে মুঠোফোনে ব্যস্ত থাকেন, তখন ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকেরা কতজন সোজাকথা বলেন, ‘আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে এই হেলাফেলা কেন?’ সবকিছুতেই আমরা ফিরে যাই ‘বাইরের ষড়যন্ত্রকারী’র আরামদায়ক গল্পে?

৯.

আমি আসলে যা বলতে চাই, তা খুব সোজা। ‘আমরা নিপীড়িত’—এ বাক্য মিথ্যা নয়। উপনিবেশ, সামরিক শাসন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস—সবকিছুর শিকার হয়েছি আমরা। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা বহুবার অন্যকে নিপীড়নের অংশও হয়েছি; কখনো সক্রিয়ভাবে, কখনো নীরব সমর্থন বা উদাসীনতার মাধ্যমে।

আমাদের লেখা ইতিহাস যদি বারবার এমন হয় যে সেখানে সব দোষ ‘ব্রিটিশ’, ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’, ‘ভারত’, ‘পাকিস্তান’, ‘পশ্চিমা শক্তি’—এসব চরিত্রের ঘাড়ে চাপাই আর নিজের অভিজাতশ্রেণির লোভ, আমাদের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাব, নাগরিককে দক্ষ-শিক্ষিত করার ব্যর্থতা আর নৈতিক কাপুরুষতার কথা চেপে যাই।

আমাদের এখন দরকার একসঙ্গে দুটো কাজ করা: মুখ ধোয়া আর আয়না পরিষ্কার করা। আয়না মানে আমাদের ইতিহাস-বয়ান, টেক্সটবুক, টক শো, যেখানে সব দোষ ‘ওদের’, আর মুখ মানে আমাদের বাস্তব রাজনীতি, সমাজ, দৈনন্দিন আচরণ, যেখানে আমরা স্বীকার করতে পারি যে আমরা একদিকে ‘ভিকটিম’, অন্যদিকে ভিকটিমহুড প্রডিউসার।

এই দ্বৈত সত্য মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়েই হয়তো শুরু হবে আসল রাজনৈতিক আলাপ।

আসিফ বিন আলী শিক্ষক, গবেষক ও স্বাধীন সাংবাদিক। বর্তমানে কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ