যে কারণে রাকসুতেও ভরাডুবি ছাত্রদলের
Published: 18th, October 2025 GMT
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনেও ভরাডুবি হলো বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। রাকসু নির্বাচনে ২৩টি পদের মধ্যে মাত্র একটি সম্পাদক পদে জিতেছেন ছাত্রদলের প্রার্থী। ১৭টি হল সংসদের শীর্ষ ৫১ পদের কোনোটিতেই ছাত্রদলের প্রার্থীরা জিততে পারেননি। সিনেট ছাত্র প্রতিনিধির পাঁচটি পদের একটিতেও তাঁরা নির্বাচিত হননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনেও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো ছাত্রদল।
রাকসুতে ছাত্রদলের এমন পরাজয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আওয়ামী লীগের আমলে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসে নিয়মিত হলেও তারা সংগঠন গোছাতে পারেনি। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতিতে ‘গ্রুপিং’ বা অন্তঃকোন্দল আছে। যেমন এবারের নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেলের বাইরে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের ক্রীড়া সম্পাদক মেহেদী হাসান। এ ঘটনায় নির্বাচনের আগের দিন গত বুধবার তাঁকে সংগঠন থেকে আজীবন বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল।
গত এক বছরে ছাত্রদল শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করার চেষ্টা করেছে। তারপরও কেন এমন হলো, তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।সুলতান আহমেদ, সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলশিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ততা কমআওয়ামী লীগের আমলে নানা কৌশলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিচয়ে ক্যাম্পাসে ছিলেন ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা। ফলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁদের একধরনের যুক্ততা ছিল। যেটা ছাত্রদলের ছিল না।
ছাত্রদল–সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করেছেন শাখা ছাত্রদলের সহসভাপতি শেখ নূর উদ্দীন (আবীর)। রাকসুর ফলাফলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হয়তো আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে সেভাবে পৌঁছাতে পারিনি, আমাদের চিন্তাভাবনা তাদের বোঝাতে পারিনি। ফলাফল যা-ই হোক, শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করে যাব।’
আওয়ামী লীগ শাসনামলে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের একক আধিপত্য ছিল। ক্যাম্পাসে অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেয়নি ছাত্রলীগ। হলে সিট-বাণিজ্য থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী নির্যাতন, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা জড়িত ছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসে এ ধরনের সংস্কৃতি বন্ধ হয়েছে।
তবে শিক্ষার্থীদের অনেকে মনে করেন, ছাত্রদল রাকসুতে জিতলে ক্যাম্পাসের বর্তমান স্বস্তিদায়ক পরিবেশ বজায় না–ও থাকতে পারে—এমন প্রচারণা ক্যাম্পাসে ছড়িয়েছে তাদের প্রতিপক্ষ। বিষয়টি নির্বাচনে ছাত্রদলকে কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি ও দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের যেসব অভিযোগ উঠছে, সেগুলোর জন্য ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্রদলকে ভুগতে হয়েছে।
নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা ছিলএর বাইরে আরেকটি কারণও শিক্ষার্থীদের ভাষ্যে জোরালোভাবে উঠে এসেছে। সেটা হলো রাকসু নির্বাচন আয়োজনের আলোচনা শুরু হলে এই নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদলের মধ্যে একধরনের অনীহা ছিল। এমন আলোচনাও আছে, ছাত্রদল রাকসু নির্বাচন পেছাতে নানা ধরনের চেষ্টা করেছে। ছাত্রদল ও বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের অনেকে নির্বাচন পেছাতে তৎপর ছিলেন। এক দফা নির্বাচন পেছানোও হয়। এ বিষয়টি শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে নেননি। এর প্রভাবও নির্বাচনের ফলাফলে পড়েছে।
রাকসু নির্বাচনে এমন পরাজয়ের বিষয়ে শিগগিরই আলোচনায় বসবেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছরে ছাত্রদল শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করার চেষ্টা করেছে। তারপরও কেন এমন হলো, তা নিয়ে তাঁরা বিশ্লেষণ করছেন। তবে তাঁরা শিক্ষার্থীদের মতামতকে সম্মান জানিয়ে ফলাফল মেনে নিয়েছেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ছ ত রদল র ক ফল ফল স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী ও পাহাড়ে রাজনৈতিক সংকট
মারমা ও রাখাইন লোকসাহিত্যে ‘তা-বং’ বলে একটি শব্দ আছে। এটি একধরনের ভবিষ্যদ্বাণী। এই ভবিষ্যৎবাণীগুলো প্রবাদ প্রবচন, কবিতা বা গানের আকারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়।
কিছু ক্ষেত্রে এগুলোকে আত্মিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের আগাম সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চাকমা, রাখাইন, মারমা, খিয়াংসহ বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকসাহিত্যে একটি গল্প প্রচলিত আছে।
গল্পে একটি কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বলা হয়েছে, যার দ্বারা একটি রাজনৈতিক দুর্যোগের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
রংরাং পাখির আর্তনাদএক বনে এক কুনো ব্যাঙ বাস করত। সে একদিন শহরে বেড়াতে যায়। ফিরে এসে ব্যাঙটি তার ছোট পাখি বন্ধুকে জানায়, অচিরেই মহা ঝড় আসবে, ভয়ানক ভূমিকম্প হবে, মাটির নিচের বুনো আলু সাত টুকরা হয়ে যাবে, পাহাড়ের নারীরা সমতলে স্থানান্তরিত হবে এবং সমতলের নারীরা স্থানান্তরিত হবে পাহাড়ে। সর্বোপরি মানবসমাজ চার ভাগে ভাগ হবে। আর এই দুর্যোগে ছোটদের অস্তিত্ব কেবল তখনই রক্ষা পেতে পারে, যদি তারা বড়দের কাছে আশ্রয় পায়।
এদিকে ঝড় শুরু হলে ভয়ার্ত ছোট পাখিটি রংরাং নামক পাখির হাঁ করা মুখ দিয়ে ঢুকে পড়ে আর পশ্চাদ্দেশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে রংরাং পাখি বিকট স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। তার আর্তনাদ থেকে কিছু ঘটনাপ্রবাহের জন্ম হয়। চমকে গিয়ে একটি বানর তার হাতে থাকা কুমড়া ফেলে দেয় গাছের নিচে শুয়ে থাকা একটি অজগরের ওপর; এতে অজগর ক্ষিপ্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী এক মুরগির ডেরায় গিয়ে তার সব ডিম সাবাড় করে ফেলে; এই ঘটনায় শোকে-দুঃখে মুরগি গিয়ে একদল পিঁপড়ার বাসা লন্ডভন্ড করে দেয়; এতে পিঁপড়ার দল রাগের মাথায় এক শূকরের গোপনাঙ্গে গিয়ে কামড় বসিয়ে দেয়; আর হতবিহ্বল শূকর ছুটে গিয়ে এক বিধবার জুমখেতের সব ফসল নষ্ট করে ফেলে; দুঃখভারাক্রান্ত বিধবাটি রাজার কাছে গিয়ে নালিশ করে। আর রাজা তদন্ত করার পর কুনো ব্যাঙকে দোষী সাব্যস্ত করে। কেননা তার ভবিষ্যদ্বাণী থেকেই এসব দুর্ঘটনার সূত্রপাত।
আরও পড়ুনপার্বত্য চট্টগ্রাম: বাড়ির পাশে আরশিনগর৩০ মার্চ ২০২২শিশুদের জন্য রচিত বিনোদনমূলক গল্প হলেও এর গভীরে যেন লুকিয়ে আছে একধরনের আগাম বার্তা। এটি পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক সংকটকে নির্দেশ করে, যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্বাসন, পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ, ভূমি বেদখল ও বৈরী রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে সৃষ্ট আদিবাসীদের নানা বঞ্চনার গল্প।
কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী, ‘পাহাড়ের নারীরা সমতলে স্থানান্তরিত হবে এবং সমতলের নারীরা স্থানান্তরিত হবে পাহাড়ে’ মূলত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ে পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ার প্রতিচ্ছবি।
ভূগর্ভস্থ বুনো আলুর সাত ভাগে বিভাজনের কথা যেন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ‘ভাগ করো। শাসন করো’ নীতির ফলে পাহাড়ে তৈরি হওয়া বিভিন্ন দল ও উপদলের ভেতর বিভক্তির রাজনীতিকেই নির্দেশ করে।
১৯৭১ সালের পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহে জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক বঞ্চনার এক স্থায়ী চক্র বিদ্যমান। ১৯৯৭ সালের চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং কাঠামোগত বৈষম্য বেড়েছে। কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী যেন এই রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক। ভূমি হারানো, অস্তিত্বের সংকট ও রাজনৈতিক বঞ্চনা যেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন বাস্তবতা।জনমিতিগত প্রকৌশলজিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে পাহাড়ে সরকারি উদ্যোগে ১৯৭০–৮০ দশকে চার লাখেরও বেশি বাঙালি পরিবারকে পাহাড়ে নিয়ে আসা হয়। এর ফলে পাহাড়ের জনমিতিগত বৈশিষ্ট্য পাল্টে যায় এবং বিপুলসংখ্যক পাহাড়ির ভূমি বেহাত হয়ে যায়। ৭০ হাজারেরও বেশি পাহাড়ি মানুষ ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে। গুচ্ছগ্রাম তৈরি ও স্থানান্তর, ভূমি বেদখল ও ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ, বিদ্রোহ দমন প্রক্রিয়া, নারীর প্রতি সহিংসতা, গণহত্যা, ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন—সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক গভীর রাজনৈতিক সংকট।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সইয়ের মুহূর্ত