মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশে সবচেয়ে বেশি কর্মী যায় বাংলাদেশ থেকে। তথাকথিত ‘ফ্রি ভিসার’ নামে নির্দিষ্ট চাকরির নিশ্চয়তা ছাড়াই বছরের পর বছর এসব দেশে যাচ্ছেন কর্মীরা। সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ টাকা নেওয়া হয় তাঁদের থেকে। তারপরও দেশগুলোতে গিয়ে কাজ পাননি ৪৩ শতাংশ কর্মী। গন্তব্যে পৌঁছার পর কাজের অনুমতি পেতে নতুন করে টাকা খরচ করতে হয়েছে তাঁদের।

তৃণমূল অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) পরিচালিত এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ২০২২ সালে কুয়েত, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে যাওয়া ১ হাজার ৮৪ জন প্রবাসী কর্মীর পরিবারে গিয়ে জরিপটি চালানো হয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশের আটটি জেলায় এ জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

জরিপের তথ্য বলছে, বিদেশে যাওয়ার আগে মাসে কর্মীর গড় আয় ছিল ৯ হাজার টাকা। তাঁর পরিবারের আয় ছিল ৩৬ হাজার ২৩৮ টাকা। কম আয়ের জন্যই মূলত তাঁরা বাড়তি খরচ করে ফ্রি ভিসার নামে বিদেশে যান। এ জন্য তাঁদের খরচ করতে হয়েছে পরিবারের বার্ষিক আয়ের চেয়ে বেশি। তাঁর মানে সবাইকে ধার-দেনা করতে হয়েছে। ৭২ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে ঋণ নিয়েছেন। ১১ শতাংশ জমি বন্ধক রেখেছেন, ৬ শতাংশ জমি বিক্রি করেছেন। যাঁরা চাকরি না পেয়ে ফিরে এসেছেন, তাঁরা বন্ধক রেখে যাওয়া জমিও পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।

‘প্রবাসী আয় হারানোর ওপর গভীর মূল্যায়ন: সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর বাংলাদেশিদের ফ্রি ভিসা অভিবাসনের প্রভাব’ শিরোনামের গবেষণা জরিপের তথ্য নিয়ে রাজধানীর একটি হোটেলে আজ রোববার আলোচনা করা হয়। এতে বলা হয়, মধ‍্যপ্রাচ‍্যের দেশগুলোতে যেতে সরকার নির্ধারিত গড় খরচ ১ লাখ ১৬ হাজার ২২৪ টাকা। অথচ ফ্রি ভিসার নামে ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮০২ টাকা খরচ করেছেন কর্মীরা।

জরিপ বলছে, ২০২২ সালে ৯ লাখ ৩৮ হাজার কর্মী গেছেন মধ‍্যপ্রাচ‍্যে। দেশগুলোতে গিয়ে ৫৭ শতাংশ কাজের অনুমতি পেয়েছেন। গিয়ে কাজ না পেয়ে আরও প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ করে কাজের অনুমতিপত্র (ইকামা) নিয়েছেন ২১ শতাংশ কর্মী। ৪৪ হাজার টাকা খরচ করে কাজ পেয়েছেন ৪ শতাংশ কর্মী। গিয়ে কাজ না পেয়ে ফিরে এসেছেন ৪ শতাংশ। তাঁদের নিজেদের টাকা খরচ করে ফিরতে হয়েছে। ৪ শতাংশকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই, এটি বেশ বড় সংখ্যা। তাই এটিকে গুরুত্ব দিয়ে নিতে হবে। আর ১৪ শতাংশ কর্মী দেশগুলোতে গিয়ে বাড়তি খরচ করতে না পারায় কাজের অনুমতি পাননি, দেশেও ফিরতে পারেননি। অবৈধ হয়ে রয়ে গেছেন সেখানে।

দেশের আট জেলা—বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, সাতক্ষীরা ও সুনামগঞ্জে জরিপটি চালানো হয়। জরিপে অংশ নেওয়া ৯১ শতাংশ পুরুষ ও ৯ শতাংশ নারী। নারীরা মূলত গৃহকর্মী হিসেবে যান, যার জন‍্য ফ্রি ভিসা প্রযোজ্য নয়।

ফ্রি ভিসা বলে কিছু নেই। আইএলও কনভেনশন অনুসারে কাজের চুক্তি ছাড়া কর্মী পাঠানো যায় না। অথচ সৌদি আরবের ক্ষেত্রে ৩-৪ শতাংশ কর্মীর নিয়োগ চুক্তি পাওয়া যায়মো.

আশরাফ হোসেন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, বিএমইটি

জরিপে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া কর্মীদের মধ্যে ৫১ শতাংশ বা ৫৫৪ জন কর্মী ফ্রি ভিসা জেনেই বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ৫৪ শতাংশ গেছেন অবৈধ দালাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। ৭ শতাংশ সরাসরি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। ৮ শতাংশ পরিবারের সদস্যের মাধ্যমে। আর ৩১ শতাংশ গেছেন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে।

অনুষ্ঠানে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নেয়ামত উল্ল্যা ভূঁইয়া বলেন, অবৈধ অভিবাসন শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, অর্থনীতিতেও বিরাট ক্ষতি করছে। প্রত্যেক কর্মীর নিয়োগ স্বচ্ছ ও জবাবদিহির মধ্যে রাখতে কাজ করছে সরকার। টাকা পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে নিয়োগকর্তার খরচে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও বায়রার প্রশাসক মো. আশরাফ হোসেন বলেন, ফ্রি ভিসা বলে কিছু নেই। আইএলও কনভেনশন অনুসারে কাজের চুক্তি ছাড়া কর্মী পাঠানো যায় না। অথচ সৌদি আরবের ক্ষেত্রে ৩-৪ শতাংশ কর্মীর নিয়োগ চুক্তি পাওয়া যায়। দক্ষ কর্মী পাঠানোর দিকে যেতেই হবে। দক্ষ কর্মী তৈরি করা গেলে বিদেশিরা এখানে আসবে কর্মী নিতে।

জরিপের তথ্য তুলে ধরেন ওকাপের চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সুপারিশ হলো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। এখানেই মূলত হতাশা কাজ করে। যাঁরা জড়িত, তাঁদের কোনো শাস্তি হয় না। আইন আছে, তা কার্যকর করা দরকার। অভিবাসন খরচ নজরদারি করা জরুরি। দক্ষ কর্মী তৈরির প্রশিক্ষণে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী, সাবেক সহসভাপতি নোমান চৌধুরী, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক কাজী মাহমুদুর রহমান, সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজিয়া হায়দার, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হেড অব প্রোগ্রাম শ্রুতি ঈশিতা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রজেক্ট ম্যানেজার রাহনুমা সালাম খান। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন ওকাপের নির্বাহী পরিচালক ওমর ফারুক চৌধুরী। অভিবাসীদের প্রকল্পের কার্যক্রম নিয়ে বক্তব্য দেন হেলভেটাস বাংলাদেশের ইনটেরিম প্রজেক্ট ডিরেক্টর প্রেমাংশু শেখর সরকার।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খরচ কর পর চ ল শ কর ম কর ম র পর ব র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশ তিন কনভেনশন অনুসমর্থন করবে বুধবার

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই হচ্ছে প্রথম দেশ, যারা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মোট ১০টি মৌলিক কনভেনশনের সব কটি অনুসমর্থন করতে চলেছে। আইএলওর মোট মৌলিক কনভেনশন ১০টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত অনুসমর্থন করেছে ৮টি। আগামী বুধবার দুটি মৌলিক কনভেনশনসহ আরও একটি অর্থাৎ তিনটি কনভেনশন অনুসমর্থন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

আইএলওর এ কনভেনশনগুলোয় সই করবেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ সই হওয়ার কথা রয়েছে। এ সময় আইএলওর ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।

ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্যদেশগুলোর শ্রমমন্ত্রীদের ষষ্ঠ ওআইসি সম্মেলনে (১৫-১৬ অক্টোবর) যোগ দিতে গিয়ে শ্রম উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন এখন কাতারে রয়েছেন। তিনি দেশে ফিরবেন ২১ অক্টোবর। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এ সম্মেলনেও শ্রম উপদেষ্টা আইএলওর তিন কনভেনশন অনুসমর্থনের কথা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ যে তিনটি কনভেনশনে অনুসমর্থন দেবে সেগুলো হচ্ছে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক কনভেনশন ১৫৫, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার মান উন্নয়নে প্রচারণামূলক কাঠামো কনভেনশন ১৮৭ এবং কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধবিষয়ক কনভেনশন ১৯০। এর মধ্যে ১৫৫ ও ১৮৭ হচ্ছে আইএলওর মৌলিক কনভেনশন।

শ্রমসচিব মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই হতে যাচ্ছে প্রথম দেশ, যে দেশ আইএলওর মোট ১০টি মৌলিক কনভেনশন অনুসমর্থন করছে।’

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে গত ২৪ জুলাই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আইএলও এ তিনটি কনভেনশনে অনুসমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, সই করার পর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আইএলওর প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক গিলবার্ট এফ হাউংবোর কাছে তিন কনভেনশন অনুসমর্থনের প্রমাণপত্র কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানো হবে। আগামী ১৭ থেকে ২৮ নভেম্বর জেনেভায় আইএলওর পরিচালনা পর্ষদের ৩৫৫তম অধিবেশন বসবে। এ অধিবেশনে শ্রম উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি দল যাচ্ছে জেনেভায়। তখনো আইএলওর মহাপরিচালকের কাছে তা হস্তান্তর করা হতে পারে।

১৯১৯ সালের ১৯ এপ্রিল ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী গঠিত হয় আইএলও, যার বর্তমান সদস্য ১৮৭। এ পর্যন্ত আইএলওর মৌলিক ৮টিসহ ৩৬টি কনভেনশন ও একটি প্রটোকলে অনুসমর্থন করেছে বাংলাদেশ।

কোন কনভেনশনে কী আছে

আইএলও ১৯৮১ সালে পেশাগত নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য কনভেনশন গ্রহণ করে। এটি আইএলও কনভেনশন ১৫৫, যা অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ (ওএসএইচ) হিসেবে পরিচিত। এখন পর্যন্ত মোট ৮৩টি সদস্যরাষ্ট্র এ কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে। কর্মক্ষেত্রে ওএসএইচ সংস্কৃতি গড়ে উঠলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলোর আস্থা অর্জনে ভূমিকা রাখবে বলে জানায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

আইএলও কনভেনশন ১৮৭ গৃহীত হয় ২০০৬ সালে। ১৫৫ ও ১৮৭ মোটামুটি কাছাকাছি ধরনের। কনভেনশন ১৮৭ অনুসমর্থন করেছে এ পর্যন্ত ৬৯টি সদস্যদেশ। এ কনভেনশনের মূল উদ্দেশ্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়তা করা।

আইএলও কনভেনশন ১৯০ গৃহীত হয় ২০১৯ সালে। এটি অনুসমর্থন করেছে ৪৯টি সদস্যদেশ। এটি অনুসমর্থনের ফলে পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে ও কর্মক্ষেত্রে কর্মরত নারী কর্মী ও শ্রমিকদের অপ্রত্যাশিত আচরণ ও হয়রানি থেকে মুক্ত রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশ তিন কনভেনশন অনুসমর্থন করবে বুধবার