জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ঝুট ব্যবসায়ী মনির হত্যা মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও সাবেক সংসদ সদস্য সোলাইমান সেলিমকে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আজ বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আলম এ আদেশ দেন।

কামরুল ইসলামের আইনজীবী আফতাব চৌধুরী জানান, আজ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক মাইনুল ইসলাম খান তিন আসামিকে কারাগারে রাখার আবেদন করেন। পরে আদালত আবেদনটি মঞ্জুর করেন।

এ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ১৮ জুন আনিসুল হকের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। এ ছাড়া গত ২৪ সেপ্টেম্বর কামরুল ইসলামের ৫ দিন এবং ২০ অক্টোবর সোলাইমান সেলিমের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, জুলাই আন্দোলন চলার সময় গত বছরের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেন ঝুট ব্যবসায়ী মো.

মনির। দুপুরে গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। এ ঘটনায় মনিরের স্ত্রী গত ১৪ মার্চ শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

একটি কঙ্কাল

দুই চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস আটকে আধশোয়া হয়ে আছি বিছানায়। হাতে তাদামাসা হুকিউরার বই ‘রক্ত ও কাদা ১৯৭১’। রুশা ও ঋভূ বইটা উপহার দিয়েছে আমাকে। লিখেছে, ‘প্রিয় মেজ চাচাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।’

তাদামাসা হুকিউরা আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিনিধি হিসেবে আট মাস বাংলাদেশে অবস্থান শেষে ১৯৭২ সালের মে মাসের এক রাতে ফিরে যান নিজ দেশ জাপানে। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘রক্ত ও কাদা ১৯৭১’ নামে বই লিখতে শুরু করেন ১২ নভেম্বর ১৯৭০–এ। শেষ করেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ। বইয়ের পাতায় পাতায় শিউরে ওঠার মতো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নিষ্ঠুরতা আর নির্মমতা। বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার মতো সব ঘটনার বর্ণনা। একেবারেই চেনাজানা মানুষ সম্পর্কে অনেক না জানা কথা। যেমন হাতিয়ার রফিক ভাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ২১ বছরের তুখোড় তরুণ। হাতিয়ার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন তিনি। যুদ্ধের সেই সব ভয়াবহ দিনে রফিক ভাইয়ের সঙ্গে হালিম ভাইয়ের রাজনৈতিক টানাপোড়েন ছিল।

বইয়ের মাঝখানে তর্জনী দিয়ে রেখেছি। বইয়ের ভূমিকাটুকু পড়া শেষ করেছি মাত্র। হাতে ধরা বইয়ে তর্জনী সেখানেই। তাদামাসা হুকিউরা বইয়ের ভূমিকার শিরোনাম দিয়েছেন, ‘একটি কঙ্কাল’। তিনি ভূমিকা লেখা শুরু করেছেন এভাবে—

রক্ত ও কাদা ১৯৭১
তাদামাসা হুকিউরা

জাপানি ভাষা থেকে অনুবাদ: কাজুহিরো ওয়াতানাবে
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশ: প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ২০১২
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
সহযোহী শিল্পী: অশোক কর্মকার
পৃষ্ঠা: ১৯২
মূল্য: ৩০০ টাকা

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

‘আমার এক আত্মীয় মেডিকেল কলেজের ছাত্র। সে নাকি সম্প্রতি ১ লাখ ২০ হাজার ইয়েন দিয়ে একটি কঙ্কাল কিনেছে গবেষণার কাজে সহায়ক হবে বলে। কথাটা শুনে আমার কেন যেন ভালো লাগছিল না। পরে জানা গেল, কঙ্কালটি এক বাঙালি মহিলার, যেমনটি আমি দুশ্চিন্তা করেছিলাম। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ২০ বছরের মতো।

‘১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৯ মাসে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর হাতে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। দুই কোটি মানুষ হয়েছিলেন গৃহহারা। এই ছোট্ট দেশের অধিকাংশ এলাকা পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে।’

তাদামাসা হুকিউরা ভূমিকা লেখা শেষ করেছেন এভাবে—যেখানে এসে আমার নিশ্বাস আটকে গেছে। আমি গভীর ব্যথা অনুভব করেছি বুকের ভেতর। তিনি লিখেছেন,

‘সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে ২ লাখ মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। তাঁদের মধ্যে অনেককে হত্যাও করা হয়। শুনেছি, কঙ্কালের ব্যবসায়ীরা ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার কঙ্কাল জাপানে আমদানি করেছে। আমার আত্মীয় যে কঙ্কাল কিনেছে, সেটিও সম্ভবত ওইভাবে চলে এসেছে। বাংলাদেশ কি এতই কষ্টে আছে যে কঙ্কাল পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়!’

হ্যাঁ, তখন আমাদের ভীষণ খারাপ অবস্থা ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন এক দেশ। ৯ মাস কঠিন মুক্তিযুদ্ধের আগে আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। সেখানে শুধু লাখ লাখ মানুষই মারা যায়নি, ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলের খেত। শুরু হয়েছে খাবারের জন্য হাহাকার। অভাব মোকাবিলার জন্য সরকারকে ৩০ লাখ টন চাল বিদেশ থেকে আমদানি বা সাহায্য হিসেবে নিতে হয়েছে। বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে তিন গুণ। সংকট দেখা দিয়েছে শিশুখাদ্যের। গুঁড়া দুধের মজুত অনেক কম।

‘সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে ২ লাখ মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। তাঁদের মধ্যে অনেককে হত্যাও করা হয়। শুনেছি, কঙ্কালের ব্যবসায়ীরা ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার কঙ্কাল জাপানে আমদানি করেছে। আমার আত্মীয় যে কঙ্কাল কিনেছে, সেটিও সম্ভবত ওইভাবে চলে এসেছে। বাংলাদেশ কি এতই কষ্টে আছে যে কঙ্কাল পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়!’

ভয়াবহ দিন গেছে আমাদের। তা–ই বলে কি এত খারাপ অবস্থা ছিল বাংলাদেশের যে বিক্রি করতে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের কঙ্কাল! কারা সেদিন ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশ থেকে কঙ্কালের ব্যবসা চালিয়েছিল। কারা সেদিন এই দেশ থেকে অর্থের বিনিময়ে পাচার করেছিল বাংলাদেশের সন্তানদের কঙ্কাল! কারা তারা?

প্রচলিত ইতিহাসের বাইরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভিন্নমাত্রার ইতিহাস ‘রক্ত ও কাদা ১৯৭১’ আমাদের নতুনভাবে দেশকে জানতে ও ভালোবাসতে শেখায়। অতি সহজ ভাষায় লেখা এই বই আমাদের এক ঘটনা থেকে নিয়ে যায় আরেক ঘটনায়। পড়তে পড়তে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই মানুষের ভালোবাসায়, আনন্দে ভরে ওঠে মন, আবার শিউরে উঠি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নির্মম নিষ্ঠুরতায়। উত্তেজনায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে এই বই পড়তে পড়তে।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাক্ষী হতে আমাদের সবারই ‘রক্ত ও কাদা ১৯৭১’ পড়া দরকার। যে বই না পড়লে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ আর এই গর্বিত বিজয়কে জানা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ