‘‘আমার একজোড়া পায়ের প্রয়োজন ছিল
যা যে কোনো পথেই হাঁটতে পারবে’’

হ্যাঁ, একজন পদহীন মানুষের জন্য যে কোনো পথেই হাঁটা সহজ কথা নয়। অন্তত যেখানে প্রবেশাধিকারের সমতা নেই। প্রতিবন্ধী মানুষকে এ দেশে প্রতিদিনই প্রমাণ করতে হয়, তিনিও এই দেশের নাগরিক এবং সেই নাগরিকের মৌলিক অধিকার অবাধ চলাচল, এই সুবিধা তারও প্রাপ্য। যদিও প্রতিনিয়ত খর্ব হয় তার এই মৌলিক অধিকার। তবে প্রবেশাধিকার নিয়ে বলার  আগে একটি বিষয় বলে নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি। 

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দের ব্যবহার আছে। তবে তা আগের মতো সরল নয়। এই শব্দের পেছনের দর্শন বদলে গেছে। এখন বিশ্বে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিকে ‘প্রতিবন্ধী’ বলে না। বরং সমাজ ও পরিবেশ যে বাধা সৃষ্টি করে, সেই বাধাকেই প্রধানত প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা হয়।

জাতিসংঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে Persons with Disabilities (PWD) অর্থাৎ ‘প্রতিবন্ধিতা সম্পন্ন ব্যক্তি’ বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি। বাংলাদেশেও আইনগতভাবে যা স্বীকৃত। ২০১৩ সালের ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে’ ব্যবহার করা হয়েছে Persons with Disabilities কেন অক্ষম বা পঙ্গু বলা হয় না? আন্তর্জাতিকভাবে এসব শব্দকে অবমাননাকর, অসম্মানজনক, পুরোনো মানসিকতার প্রতিফলন হিসেবে ধরা হয়।

আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য Fostering disability inclusive societies for advancing social progress.

অর্থাৎ প্রতিবন্ধিতা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ি, সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করি। বিশ্বকে এই আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আহ্বান কি বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবনের কোথাও প্রতিধ্বনিত হয়? নাকি শহরের যানজট, সরকারি দপ্তরের সিঁড়ি, হাসপাতালের দোতলা, ফুটপাতের ভাঙাচোরা ইট, আর গণপরিবহনের উঁচু সিঁড়িগুলো সব মিলিয়ে একটিই কথা জানান দেয়— এই পথ তোমার নয়। 
প্রতিবছর এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব মানে শুধু জন্মের অধিকার নয়, বরং সসম্মানে বেঁচে থাকা, চলাফেরা করা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে অংশ নেওয়া, এবং সমাজের মূলধারায় নিজের অবস্থান তৈরি করার স্বাধীনতা। কিন্তু বাংলাদেশে দশ থেকে পনেরো শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার সঙ্গে জীবনযাপন করলেও, তাদের অধিকার ও প্রয়োজন সম্পর্কে আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সচেতনতা এখনো ভয়াবহভাবে অপর্যাপ্ত।

প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে বৈষম্য আমাদের চেতনায়, আচরণে এবং সর্বোপরি আমাদের রাষ্ট্রের অবকাঠামোতেই দৃশ্যমান। আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম সূচক হলো—কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক তার রাস্তাঘাট, ভবন, পরিবহন ও সেবা ব্যবস্থা। সেই পরীক্ষায় বাংলাদেশ এখনো খুব নিচে অবস্থান করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। সেই হিসেবে বিশ্বের একশ কোটিরও অধিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯ কোটি ৩০ লাখ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৯ শতাংশ। 

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে  বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পুরুষের সংখ্যা ৯ লাখ ৮১ হাজার ৭৪১ জন এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নারীর সংখ্যা ৬ লাখ ২৬ হাজার ৫৩৯ জন। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে দুই কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। এতো বড় একটি জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে প্রবেশাধিকার থাকবে না; এটা স্বাভাবিক ঘটনা কি? 

একটি দেশের সভ্যতার পরিচয় ঘটে তার রাস্তাঘাট ও প্রতিষ্ঠানের প্রবেশপথে। বাংলাদেশ সেখানে চরমভাবে বিবর্ণ। রাজধানী ঢাকায় একবার হাঁটলেই বোঝা যায়, এই শহর এখনো ভিন্ন সক্ষমতার মানুষের কথা ভেবে গড়ে ওঠেনি। যে ফুটপাত মানুষকে বাঁচাতে বানানো হয়, সেই ফুটপাতই আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে প্রথমেই মৃত্যুভয়ের সামনে দাঁড় করায়। কারও পায়ের নিচে গর্ত, কারও সামনে সিঁড়ি, কোথাও দোকানপাট, কোথাও গাড়ি চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা—সব মিলিয়ে ফুটপাত এখানে মানুষের জন্য নয়; বরং শক্তিধর, সক্ষম ও দাপুটেদের জন্য।

একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীকে আপনি যদি ফুটপাতে তুলতে চান, প্রথমেই তাকে তুলতে হবে কার্বে একটি উঁচু, অনমনীয় বাধায়। প্রতিটি কার্ব, প্রতিটি সিঁড়ি, প্রতিটি অসমান ঢালু জায়গা যেন তাকে বলে, তুমি এই শহরের কেউ নও। এ শুধু ঢাকার নয়; চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী—সব শহরের একই চিত্র। আমাদের পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনায় এখনো প্রবেশাধিকার মানে সিঁড়ির পাশে ছোট্ট একটি র‌্যাম্প আঁকা। কিন্তু সেই র‌্যাম্প এত খাড়া হয় যে তাতে হুইলচেয়ার ওঠানো মানে যন্ত্রণা নয়—বিপদ। সেই র‍্যাম্পে সুস্থ মানুষের বাইকখানা তোলাই মুশকিল হয়ে পড়ে। 

হাসপাতাল এমন একটি জায়গা যেখানে কারো কাছে দয়া নয়, সেবা পাওয়াই মৌলিক অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশে অসুস্থ মানুষ হুইলচেয়ার বা ক্রাচে বা ব্রেইলে চলা মানুষটি হাসপাতালে পৌঁছে প্রথমেই দেখেন—প্রবেশদ্বার সিঁড়ি বাঁধানো। চিকিৎসার চেয়েও বড় শঙ্কা তখন হয়, আমি ভেতরে ঢুকব কীভাবে? এখানে আমার প্রবেশের স্বাধীনতা আছে তো?

একটি অগম্য ভবন কেবল প্রতিবন্ধী মানুষের বিরুদ্ধে নয়, এটি মৌলিক মানবাধিকারের বিরুদ্ধে। একটি জটিল রাস্তা কেবল তার জীবনকে কঠিন করে না, এটি সরাসরি গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। কারণ গণতন্ত্র তখনই শক্তিশালী হয় যখন রাষ্ট্রের প্রতিটি ভবনে, প্রতিটি সেবায় সব নাগরিক সমানভাবে অংশ নিতে পারে। একজন মানুষ ভোটকেন্দ্রে পৌঁছাতে না পারলে তার ভোটাধিকার ক্ষুণ্ন হয়। একজন মামলার বাদী আদালতে ঢুকতে না পারলে বিচার তার নাগালের বাইরে চলে যায়। একজন উদ্যোক্তা সরকারি দপ্তরে যেতে না পারলে তার ব্যবসা আটকে যায়। এগুলো শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, রাষ্ট্রেরই ক্ষতি।

মেট্রোরেলে একটি ঘটনা বলি। সেখানে লিফট আছে। লাইনে দাঁড়িয়ে আছে একজন  হুইল চেয়ার আরোহী। সুস্থ সক্ষম ব্যক্তিরা সকলেই উঠে গেলেন। এবং বলত বলতে গেলেন একটা হুইল চেয়ার অন্তত তিনজনের জায়গা আটকাবে। তাদের তাড়া আছে। পরের বার সে যেন ওঠে। পরের বারও হুড়ুমুড় করে উঠে গেল পদযুক্ত মানুষগণ। যেনো হুইল চেয়ারের দায়ে তার কোনো  ফেরার তাড়া নেই। সময়মতো পৌঁছেও তাকে দুবার ট্রেন মিস করতে হলো। 

২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন পাস করেছে। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, অ্যাক্সেসিবিলিটি বা প্রবেশাধিকার একটি মৌলিক অধিকার। সরকারি-বেসরকারি সব ভবনে র‌্যাম্প, লিফট, প্রতিবন্ধীবান্ধব শৌচাগারের প্রবেশসুবিধা, ব্রেইল সাইন, অডিও-ভিজ্যুয়াল নির্দেশনা—সব থাকতে হবে। কিন্তু আইন যেন কেবল কাগজে-কলমে, নথিতেই জন্ম নেয়ার জন্য, বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। নতুন নির্মিত ভবনেও র‌্যাম্পের নাম করে সামান্য ঢালু সিঁড়ি বানানো হয়, যা হুইল চেয়ার নয়, চড়াইপথে অভ্যস্ত মানুষের চলাচলের উপযোগীও নয় যেন। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মনে করে, অ্যাক্সেসিবিলিটি মানে বাড়তি খরচ। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিটি অ্যাক্সেসিবল ভবন দীর্ঘমেয়াদে বেশি লাভজনক। কারণ তা সর্বজনীনভাবে ব্যবহৃত হয়।

সরকারি তদারকি বিভাগগুলোও প্রায়ই ভবন পরিদর্শন করে; কিন্তু প্রবেশাধিকারের দিকটি অনেক সময়ই গৌণ হিসেবে ধরা হয়। বলা হয়, পরে ঠিক করা যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পরে কখন? কারা করবে? মজার বিষয় হলো, একজন মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মান না, আবার জন্মানও। জীবনের যে কোনো সময় দুর্ঘটনা, রোগ, বয়স, যুদ্ধ, জলবায়ু দুর্যোগ—সব কিছু মিলিয়ে যে কেউ যে কোনো দিন প্রতিবন্ধিতা অর্জন করতে পারেন। তাহলে প্রবেশাধিকার কেবল ‘অন্যের’ বিষয় নয়, এটা আমাদের সবার ভবিষ্যতের নিরাপত্তা।

আমরা হয়তো আজ সক্ষম; কিন্তু বয়স বাড়লে সবাই কখনো না কখনো শারীরিক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হবো। জন্মগত বা দুর্ঘটনা, অসুস্থতা—জীবনের যে কোনো পর্যায়েই কেউ একজন ভিন্ন সক্ষমতার হয়ে যেতেই পারেন। অথচ অ্যাক্সেসিবিলিটি সবার জন্য: শিশুর জন্য সুবিধাজনক পথ, গর্ভবতী নারীর নিরাপদ চলাচল, বয়স্ক মানুষের আরাম, রোগীর সুরক্ষা, সবার স্বাভাবিক গতিশীলতা।

অ্যাক্সেসিবিলিটি মানে ভবন, সেবা ও প্রযুক্তিকে এমনভাবে নির্মাণ করা যাতে সেটি সকলের জন্য ব্যবহারযোগ্য হয়। এটি উন্নয়ন ব্যয় নয়, এটি উন্নয়নের ন্যূনতম শর্ত। বিশ্বের যেসব দেশ সত্যিকার অর্থে সমতা চায়, তারা জানে, প্রবেশাধিকার শুধু প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয় নয়; এটি সকল মানুষের নিরাপত্তা, সম্মান ও উন্নয়নের অংশ। র‌্যাম্প শুধু হুইল চেয়ারের জন্য নয়, শিশু কোলে নেওয়া মা, বয়স্ক মানুষ, আহত ব্যক্তি—সবাই সেই র‌্যাম্প ব্যবহার করে। লিফট শুধু ভিন্ন সক্ষমতার মানুষের জন্য নয়, এটি সভ্যতারও চিহ্ন।

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে রূপান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু কোনো দেশ উন্নত হয় তখনই, যখন তার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সবচেয়ে দুর্বল মানুষটিও নিজেকে নিরাপদ ও স্বাগত মনে করে। কখনো কখনো জনগণের মনোভাব সরকারি ব্যর্থতার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষকে এখনো করুণার চোখে দেখা হয়। তাকে সক্ষম, প্রতিভাবান, কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে না দেখে, বেশিরভাগ সময় তাকে ‘সহানুভূতির বা করুণার পাত্র’ বানিয়ে ফেলা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙ্গে দেয় তার মনোবল। তার আত্মবিশ্বাসটুকু নষ্ট করে দেয়। তাকে হীনমন্য করে তোলে যেন তারই কোনো সহকর্মী বা প্রতিবেশী।

দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা জানেন না কীভাবে ভিন্ন সক্ষমতার ছাত্রকে ক্লাসে অন্তর্ভুক্ত করবেন। অফিসে অনেকে মনে করেন, হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী মানে কম সক্ষম কর্মী। গণপরিবহনে উঠতে গেলে তাকে প্রায়ই বলা হয়, এটা আপনার জন্য না। সিট নাই, পরের বাসে আসেন। 

এই মনোভাবই মূলত সাম্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। কারণ অবকাঠামো গড়া সহজ; কিন্তু মন গড়া কঠিন, দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা আরো কঠিন। আর রাষ্ট্র যদি সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি গড়তে না পারে, তাহলে র‌্যাম্প, লিফট, সাইন—সবই কাগজের উন্নয়ন হয়ে থাকে, জীবনের নয়।

বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটির মতো মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বাস করছেন—দৃষ্টিহীনতা, শ্রবণপ্রতিবন্ধকতা, শারীরিক চলাচলগত প্রতিবন্ধকতা, বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জ, স্নায়বিক পার্থক্যসহ নানা পরিস্থিতি। অর্থাৎ আমরা এই দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে পথ চলার অধিকার দিচ্ছি না। রাষ্ট্রের চোখে তারা নাগরিক, কিন্তু নাগরিকত্বের দরজাটা তাদের জন্য খোলা নয়। বাংলাদেশ চাইলে এখনই পরিবর্তন শুরু করতে পারে। বিশ্বজুড়ে যে নীতিগুলো কার্যকর সেগুলো আমরা খুব সহজেই অনুসরণ করতে পারি:

এ জন্য নতুন ভবন অনুমোদন পাওয়ার আগে অ্যাক্সেসিবিলিটি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রবেশাধিকার নিরীক্ষা করতে হবে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রবেশাধিকার মূল্যায়ন টিম গঠন করা যেতে পারে। লো-ফ্লোর বাস, র‌্যাম্পযুক্ত ট্রেন কোচ, স্টেশন প্ল্যাটফর্মের সমতল নকশা—এসব জরুরি।

সরকারি ওয়েবসাইট, ব্যাংকিং অ্যাপ, শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম—সবই স্ক্রিন রিডার, অডিও-ভিজ্যুয়াল গাইড ইত্যাদিতে উপযোগী করতে হবে। শিশুরা যদি ছোটবেলা থেকেই ভিন্ন সক্ষমতাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে শেখে সমাজ বদলাবে দ্রুত।

উন্নয়নের দিকে ধাবিত আমাদের বাংলাদেশ।  কিন্তু এই পরিবর্তন তখনই অর্থপূর্ণ হবে, যখন রাস্তায় নামা একটি হুইল চেয়ার, হাঁটার লাঠি, সাদা ছড়ি বা ব্রেইল বই সমাজকে সংকুচিত করবে না, বরং সমৃদ্ধ করবে। প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে কোনো সমস্যা নেই; সমস্যাটি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবকাঠামোয়। সমাজের এই খাড়া করে রাখা মনোদেয়াল ভাঙ্গতে হবে।

জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য তাই শুধু স্লোগান নয়, একটি সতর্ক সংকেত। বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থেই সামাজিক অগ্রগতি চায় তাহলে প্রথম কাজটি হলো প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি অফিস, প্রতিটি হাসপাতাল, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সবার জন্য প্রবেশাধিকারের সমতা তৈরি করা। কারণ সমতা মানে দয়া নয়। সমতা মানে সকলের জন্য সমান দরজা। শুধু র‌্যাম্প নয়, দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে।

শুধু আইন নয়, প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। শুধু স্লোগান নয়, প্রতিটি নাগরিকের জীবনে তা দৃশ্যমান করতে হবে। তবেই আমরা বলতে পারব, বাংলাদেশ সত্যিই disability inclusive society গড়ার পথে হাঁটছে। তবেই অগ্রগতি হবে সবার। তবেই রাষ্ট্র হবে মানুষের জন্য, সকল মানুষের জন্য।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক 
 

ঢাকা/তারা//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রব শ ধ ক র ম ন ষ র জন য র জন য ন জনগ ষ ঠ অবক ঠ ম ব যবহ র জন ম ন আম দ র ফ টপ ত জ বন র প রথম সরক র চল চল র সমত

এছাড়াও পড়ুন:

মাধ্যমিকে কর্মবিরতি, বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি

চার দফা দাবিতে দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা গতকাল সোমবার লাগাতার কর্মবিরতি শুরু করেছেন। এর ফলে ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গতকালের বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে গিয়ে ফিরে যায়।

তবে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো বিদ্যালয়ে কর্মচারীদের পাহারায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে তিন দফা দাবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের একাংশ কর্মবিরতি পালন করছে। গতকাল থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে।

বার্ষিক পরীক্ষার মধ্যে শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার বলেছেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সরকারি কর্মচারী বিধি লঙ্ঘনের দায়ে তাঁদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।

গতকাল সন্ধ্যায় বাসসকে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলনের নামে যা করছেন, তা সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল। সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য আপনাদের কিন্তু তৈরি থাকতে হবে। এখানে সরকার একেবারে দৃঢ়ভাবে তার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।’

মাধ্যমিকে কর্মবিরতি

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২৪ অনুযায়ী, সারা দেশে ১৯ হাজার ১১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সাধারণ বা জেনারেল) রয়েছে। এর মধ্যে ৬৩১টি সরকারি। মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৭৯ লাখ। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ৪ লাখ ৮৬ হাজারের বেশি। সরকারি মাধ্যমিকে মোট শিক্ষক ১৩ হাজারের বেশি।

চার দফা দাবিতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির ব্যানারে এ কর্মসূচি চলছে। দাবিগুলো হলো—এক. সহকারী শিক্ষক পদকে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক‍্যাডারভুক্ত করে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গেজেট প্রকাশ। দুই. বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় কর্মরত শিক্ষকদের বিভিন্ন শূন্য পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন দ্রুত কার্যকর করা। তিন. সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বকেয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মঞ্জুরি আদেশ দেওয়া। এবং চার. ২০১৫ সালের আগের মতো সহকারী শিক্ষকদের ২ থেকে ৩টি ইনক্রিমেন্টসহ অগ্রিম বর্ধিত বেতন-সুবিধা বহাল করে গেজেট প্রকাশ।

বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দাবির বিষয়ে তাঁরা প্রথমে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সামনে শিক্ষকেরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু দাবি না মানায় লাগাতার কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন।

কর্মবিরতির কারণে বিভিন্ন বিদ্যালয় আগের দিন রোববার নোটিশ দিয়ে গতকালের পরীক্ষা স্থগিত করে। আবার শিক্ষার্থীরা গতকাল কোনো কোনো বিদ্যালয়ে গিয়ে জানতে পারে, পরীক্ষা হবে না। রাজধানীর গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে পড়ুয়া এক ছাত্রের বাবা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সন্তান বিদ্যালয়ে গিয়েও ফিরে এসেছে। বিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, তাঁরা মৌখিকভাবে পরীক্ষা হবে না বলে জানিয়েছেন।

ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল আগের দিন রোববার নোটিশ দিয়ে পরীক্ষা না নেওয়ার কথা জানিয়েছে। গতকাল সকালে খুলনার সরকারি করোনেশন গার্লস হাইস্কুলের একজন শিক্ষক জানান, তাঁদের বিদ্যালয়ে পরীক্ষা হচ্ছে না।

গতকাল সকালে খুলনা জিলা স্কুলের সামনে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সরফুদ্দিন আয়ান বলে, ‘আজ গণিত পরীক্ষা ছিল, তবে হবে না—এটা জানতাম না। এসে দেখি, পরীক্ষা হচ্ছে না।’ তার মতো খুলনার কয়েকটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা একই সমস্যায় পড়ে। তারা বিদ্যালয়ে যাওয়ার পর শিক্ষকদের কর্মবিরতির খবর পায়।

রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে পরীক্ষা না হওয়ার খবর পাঠিয়েছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা।

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় এ প্রতিবেদক মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখতে পান, বেশ কিছু ছাত্র রয়েছে বিদ্যালয় চত্বরে। অষ্টম শ্রেণির একজন ছাত্র বলল, তাদের পরীক্ষা হয়েছে। তবে পরীক্ষার হলে গার্ড দিয়েছেন কর্মচারীরা। পরে কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কর্মচারীদের দিয়ে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।

তবে শিক্ষকেরা দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা হতে দেননি। বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তাহমিনা ইয়াসমিন বলেন, আদিষ্ট হয়ে বিধি মোতাবেক পরীক্ষা কার্যক্রম চলমান রেখেছেন।

সেখান থেকে পাশের মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, সেই বিদ্যালয়ে সময়সূচি অনুযায়ী গতকাল পরীক্ষা ছিল না।

সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক মোহাম্মদ ওমর ফারুক গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি তাঁদের ডেকে দাবিগুলো পূরণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে তাঁরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করবেন। অন্যথায় তাঁদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চলবে।

প্রাথমিকে একাংশের কর্মবিরতি

সহকারী শিক্ষকদের তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছে প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ। প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের ব্যানারে এ কর্মসূচি চলছে। পরিষদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আপাতত ১১তম গ্রেডসহ তিন দফা দাবি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ায় আজ ২ ডিসেম্বর পরীক্ষা বর্জনসহ লাগাতার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি কর্মসূচি চলবে।

অবশ্য গতকাল সকালে ঢাকায় বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যায়। লালবাগ শিক্ষা এলাকার একটি বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক সকালে পরীক্ষা শুরুর কথা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে কড়া বার্তা আছে। আর সাধারণত ঢাকার বিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের কর্মসূচি সব সময়ই কম পালিত হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সৌদি আরবে শান্তি আলোচনায় আফগানিস্তান ও পাকিস্তান
  • ইচ্ছা না থাকলেও ১৫ বছর পর যে টুর্নামেন্টে খেলবেন কোহলি
  • সব খাবারে কি কারও অ্যালার্জি হতে পারে?
  • আসিম মুনির: পাকিস্তানের নতুন ‘সুলতান’
  • খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় রাবিতে দোয়া
  • মুসলিম সভ্যতায় কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা দেওয়া
  • মাদারীপুরে এক্সপ্রেসওয়েতে ট্রাকের পেছনে বাসের ধাক্কা, নিহত ৩ আহত ১৫
  • শিবচরে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩, আহত ১৫
  • মাধ্যমিকে কর্মবিরতি, বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি