জীবনের পথে আমরা সবাই খুঁজি সুখের ঠিকানা, মুক্তির দিশা। কিন্তু সেই পথ কোথায়? নবীজির জুমার খুতবায় একটি কথা বারবার আসত, ‘সর্বোত্তম কথা আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম পথ মুহাম্মদের পথ, আর সবচেয়ে খারাপ কাজ নতুন উদ্ভাবিত বিষয়, প্রতিটি নতুন উদ্ভাবন বিদআত, প্রতিটি বিদআত পথভ্রষ্টতা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৬৭)

এখানে ‘পথ’ বলা হয়েছে রূপকার্থে। মূল অর্থ হবে হেদায়াত বা পথনির্দেশ। নবীজির হেদায়াত মানে তাঁর জীবনাদর্শ, তাঁর পথচলা, যা আমাদের সুখের চাবিকাঠি। এই লেখায় আমরা দেখব, হেদায়াত কী, কেন এটা জরুরি, আর কীভাবে আমরা দৈনন্দিন জীবনে এটা প্রয়োগ করব।

নবীজির হেদায়াত মানে কী?

‘হেদায়াত’ শব্দটা এখানে তাঁর সিরাত, তাঁর পদ্ধতি, তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় পথ অর্থে ব্যবহার হয়েছে। এতে আছে তাঁর আদেশ, কর্ম, নিষেধ, পছন্দ—সবকিছু। আল্লাহ বলেছেন, ‘রাসুল তোমাদের যা দেন, তা গ্রহণ করো, যা থেকে নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো।’ (সুরা হাশর, আয়াত: ৭)

এটা ইমানদারের জন্য বাধ্যতামূলক। আর ‘হুদা’ মানে আল্লাহর পথে পৌঁছানোর দিশা, যা নবীজির মাধ্যমে আসে। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি সরল পথের দিকে ডাকো।’ (সুরা শুরা, আয়াত: ৫২)

আরেক আয়াতে বলেছেন, ‘তাঁকে মেনে চললে তোমরা হেদায়াত পাবে।’ (সুরা নুর, আয়াত: ৫৪)

আরও পড়ুনকিশোরদের ইসলাম অনুশীলনে আগ্রহী করার উপায়২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

হেদায়াত অনুসরণ করলেই দুনিয়া-আখেরাতের সুখ মিলবে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর রাসুলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ আছে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের আশা করে এবং আল্লাহকে বেশি স্মরণ করে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ২১)

সুখ তো সবাই চায়, কিন্তু চির সুখের পথ একটাই—নবীজির হেদায়াত। তিনি এসেছিলেন মানুষকে সঠিক পথ দেখাতে, জীবনকে সুন্দর করতে।

ইবনুল কাইয়্যিম বলেছেন, দুনিয়া-আখেরাতের সুখ-সাফল্যের পথ শুধু রাসুলদের নির্দেশনার মধ্যেই নিহিত। ভালো-মন্দের বিস্তারিত জ্ঞান তাঁদের থেকে নিতে হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিও তাঁদের অনুসরণের মাধ্যমে অর্জিত হবে। ভালো কাজ, কথা, চরিত্র—সব তাঁদের হেদায়াত। তাঁরা হলেন সত্যের সঠিক মাপকাঠি। যে নিজের জন্য সুখ চায়, তার উচিত নবীজির হেদায়াত, সিরাত জেনে নেওয়া, যাতে অজ্ঞদের দল থেকে বেরিয়ে অনুসারীদের দলে যোগ দেয়। (জাদুল মাআদ ফি হায়্যি খায়রিল ইবাদ, ১/৬৮, দারু আলমিল ফাওয়াইদ, মক্কা, ১৯৯৫)

ইবনে তাইমিয়া বলেন, মানুষের পরিপূর্ণতা রাসুলদের হেদায়াত অনুসরণে। যে ব্যক্তি এর কাছাকাছি, সে পরিপূর্ণতার নিকটবর্তী। আর যে দূরে, সে অপূর্ণ। পরিপূর্ণ সে, যে আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করে, তাঁর পছন্দে সহমত থাকে এবং তাকদিরে ধৈর্য ধারণ করে (দাকাইকুত তাফসির, ২/২৯৯, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৮)

ইবাদতের মূল দুটি

ইবাদতের মূল হলো ইখলাস আর অনুসরণ। কোনো আমল কবুল হবে না, যদি না আল্লাহর জন্য খাঁটিভাবে করা হয় এবং নবীজির হেদায়াত অনুসারে করা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।’ (সুরা কাহফ, আয়াত: ১১০)

আরও পড়ুনমহানবীর তায়েফ যাত্রা: শিক্ষা ও উপদেশ১৭ নভেম্বর ২০২৫

ইবনে তাইমিয়া বলেন, ইবাদত শরিয়ত ও অনুসরণের ওপর নির্ভরশীল, খেয়ালখুশি বা বিদআতের ওপর নয়। ইসলামের দুই ভিত্তি: শুধু আল্লাহর ইবাদত, আর রাসুলের শরিয়ত অনুসারে ইবাদত। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাকে এক শরিয়তের ওপর স্থাপন করেছি, তুমি তা অনুসরণ করো, অজ্ঞদের খেয়াল অনুসরণ করো না।’ (সুরা জাসিয়া, আয়াত: ১৮)

মুহাম্মাদ আল-গাজালি বলেন, নবীজি শুধু মিলাদের গল্প নন, মুসলিমের সঙ্গে নবীজির সম্পর্ক গভীর। যে তাঁকে অন্তরে ধারণ করে না, কাজে-চিন্তায় অনুসরণ করে না, তার হাজার দরুদ পাঠ অর্থহীন। (ফিকহুস সিরাহ, পৃষ্ঠা ৫, দারুল কলম, দামেস্ক, ১৯৯৫)

নবীজির হেদায়াত জানার ৫ উপায়

ইবনে কাইয়্যিম (রহ.

) নবীজির হেদায়াত বোঝার ৫টি উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন:

১. রিসালাতের মূল বোঝা: এটা হলো তাওহিদ। নবীজি এসেছিলেন তাওহিদ শেখাতে, আল্লাহর একত্বের দিকে ডাকতে, শয়তান থেকে দূরে রাখতে। মুসলিম-কাফির, মুমিন-মুনাফিকের পার্থক্য শেখাতে।

২. পূর্ণ আনুগত্য: তাঁর খবরে বিশ্বাস করা, আদেশ অনুযায়ী আমল করা, নিষেধ মেনে চলা। আদেশ মানে করা, নিষেধ মানে ত্যাগ করা।

৩. সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা ও তাঁর কাছে ফয়সালা চাওয়া: আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতিপালকের কসম, তারা মুমিন হবে না, যতক্ষণ না তোমাকে তাদের বিবাদে ফয়সালাকারী মেনে নেয়, তোমার ফয়সালায় মনে অস্বস্তি না পায়, পূর্ণ সমর্পণ করে।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৬৫)

৪. নবুয়তের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা: খন্দকের যুদ্ধে নবীজি পাথরে আঘাত করে বললেন, ‘আল্লাহু আকবার, পারস্য জয় হলো, ইয়েমেন জয় হলো, আমি সানআর দরজা দেখছি।’

আল্লাহর রাসুলের (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তী সময়ে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং নবুয়তের ওপর বিশ্বাস অপরিহার্য, কেননা, ওহীর জ্ঞানই প্রকৃতি জ্ঞান।

৫. সিরাত অধ্যয়ন করে পুরোপুরি সঙ্গী হওয়া: নবীজির বংশ, বৈঠক, যুদ্ধ, দৈনন্দিন জীবন—সব জানা। (জাদুল মাআদ ফি হায়্যি খায়রিল ইবাদ, ১/১০, দারু আলমিল ফাওয়াইদ, মক্কা, ১৯৯৫)

আরও পড়ুনমহানবীর (সা.) প্রতি সাহাবিদের সীমাহীন ভালোবাসা১৩ নভেম্বর ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: নব জ র হ দ য় ত ত অন স র জন য র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

সর্বোত্তম পথ মুহাম্মদ (সা.)–এর পথ

জীবনের পথে আমরা সবাই খুঁজি সুখের ঠিকানা, মুক্তির দিশা। কিন্তু সেই পথ কোথায়? নবীজির জুমার খুতবায় একটি কথা বারবার আসত, ‘সর্বোত্তম কথা আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম পথ মুহাম্মদের পথ, আর সবচেয়ে খারাপ কাজ নতুন উদ্ভাবিত বিষয়, প্রতিটি নতুন উদ্ভাবন বিদআত, প্রতিটি বিদআত পথভ্রষ্টতা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৬৭)

এখানে ‘পথ’ বলা হয়েছে রূপকার্থে। মূল অর্থ হবে হেদায়াত বা পথনির্দেশ। নবীজির হেদায়াত মানে তাঁর জীবনাদর্শ, তাঁর পথচলা, যা আমাদের সুখের চাবিকাঠি। এই লেখায় আমরা দেখব, হেদায়াত কী, কেন এটা জরুরি, আর কীভাবে আমরা দৈনন্দিন জীবনে এটা প্রয়োগ করব।

নবীজির হেদায়াত মানে কী?

‘হেদায়াত’ শব্দটা এখানে তাঁর সিরাত, তাঁর পদ্ধতি, তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় পথ অর্থে ব্যবহার হয়েছে। এতে আছে তাঁর আদেশ, কর্ম, নিষেধ, পছন্দ—সবকিছু। আল্লাহ বলেছেন, ‘রাসুল তোমাদের যা দেন, তা গ্রহণ করো, যা থেকে নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো।’ (সুরা হাশর, আয়াত: ৭)

এটা ইমানদারের জন্য বাধ্যতামূলক। আর ‘হুদা’ মানে আল্লাহর পথে পৌঁছানোর দিশা, যা নবীজির মাধ্যমে আসে। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি সরল পথের দিকে ডাকো।’ (সুরা শুরা, আয়াত: ৫২)

আরেক আয়াতে বলেছেন, ‘তাঁকে মেনে চললে তোমরা হেদায়াত পাবে।’ (সুরা নুর, আয়াত: ৫৪)

আরও পড়ুনকিশোরদের ইসলাম অনুশীলনে আগ্রহী করার উপায়২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

হেদায়াত অনুসরণ করলেই দুনিয়া-আখেরাতের সুখ মিলবে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর রাসুলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ আছে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের আশা করে এবং আল্লাহকে বেশি স্মরণ করে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ২১)

সুখ তো সবাই চায়, কিন্তু চির সুখের পথ একটাই—নবীজির হেদায়াত। তিনি এসেছিলেন মানুষকে সঠিক পথ দেখাতে, জীবনকে সুন্দর করতে।

ইবনুল কাইয়্যিম বলেছেন, দুনিয়া-আখেরাতের সুখ-সাফল্যের পথ শুধু রাসুলদের নির্দেশনার মধ্যেই নিহিত। ভালো-মন্দের বিস্তারিত জ্ঞান তাঁদের থেকে নিতে হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিও তাঁদের অনুসরণের মাধ্যমে অর্জিত হবে। ভালো কাজ, কথা, চরিত্র—সব তাঁদের হেদায়াত। তাঁরা হলেন সত্যের সঠিক মাপকাঠি। যে নিজের জন্য সুখ চায়, তার উচিত নবীজির হেদায়াত, সিরাত জেনে নেওয়া, যাতে অজ্ঞদের দল থেকে বেরিয়ে অনুসারীদের দলে যোগ দেয়। (জাদুল মাআদ ফি হায়্যি খায়রিল ইবাদ, ১/৬৮, দারু আলমিল ফাওয়াইদ, মক্কা, ১৯৯৫)

ইবনে তাইমিয়া বলেন, মানুষের পরিপূর্ণতা রাসুলদের হেদায়াত অনুসরণে। যে ব্যক্তি এর কাছাকাছি, সে পরিপূর্ণতার নিকটবর্তী। আর যে দূরে, সে অপূর্ণ। পরিপূর্ণ সে, যে আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করে, তাঁর পছন্দে সহমত থাকে এবং তাকদিরে ধৈর্য ধারণ করে (দাকাইকুত তাফসির, ২/২৯৯, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৮)

ইবাদতের মূল দুটি

ইবাদতের মূল হলো ইখলাস আর অনুসরণ। কোনো আমল কবুল হবে না, যদি না আল্লাহর জন্য খাঁটিভাবে করা হয় এবং নবীজির হেদায়াত অনুসারে করা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।’ (সুরা কাহফ, আয়াত: ১১০)

আরও পড়ুনমহানবীর তায়েফ যাত্রা: শিক্ষা ও উপদেশ১৭ নভেম্বর ২০২৫

ইবনে তাইমিয়া বলেন, ইবাদত শরিয়ত ও অনুসরণের ওপর নির্ভরশীল, খেয়ালখুশি বা বিদআতের ওপর নয়। ইসলামের দুই ভিত্তি: শুধু আল্লাহর ইবাদত, আর রাসুলের শরিয়ত অনুসারে ইবাদত। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাকে এক শরিয়তের ওপর স্থাপন করেছি, তুমি তা অনুসরণ করো, অজ্ঞদের খেয়াল অনুসরণ করো না।’ (সুরা জাসিয়া, আয়াত: ১৮)

মুহাম্মাদ আল-গাজালি বলেন, নবীজি শুধু মিলাদের গল্প নন, মুসলিমের সঙ্গে নবীজির সম্পর্ক গভীর। যে তাঁকে অন্তরে ধারণ করে না, কাজে-চিন্তায় অনুসরণ করে না, তার হাজার দরুদ পাঠ অর্থহীন। (ফিকহুস সিরাহ, পৃষ্ঠা ৫, দারুল কলম, দামেস্ক, ১৯৯৫)

নবীজির হেদায়াত জানার ৫ উপায়

ইবনে কাইয়্যিম (রহ.) নবীজির হেদায়াত বোঝার ৫টি উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন:

১. রিসালাতের মূল বোঝা: এটা হলো তাওহিদ। নবীজি এসেছিলেন তাওহিদ শেখাতে, আল্লাহর একত্বের দিকে ডাকতে, শয়তান থেকে দূরে রাখতে। মুসলিম-কাফির, মুমিন-মুনাফিকের পার্থক্য শেখাতে।

২. পূর্ণ আনুগত্য: তাঁর খবরে বিশ্বাস করা, আদেশ অনুযায়ী আমল করা, নিষেধ মেনে চলা। আদেশ মানে করা, নিষেধ মানে ত্যাগ করা।

৩. সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা ও তাঁর কাছে ফয়সালা চাওয়া: আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতিপালকের কসম, তারা মুমিন হবে না, যতক্ষণ না তোমাকে তাদের বিবাদে ফয়সালাকারী মেনে নেয়, তোমার ফয়সালায় মনে অস্বস্তি না পায়, পূর্ণ সমর্পণ করে।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৬৫)

৪. নবুয়তের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা: খন্দকের যুদ্ধে নবীজি পাথরে আঘাত করে বললেন, ‘আল্লাহু আকবার, পারস্য জয় হলো, ইয়েমেন জয় হলো, আমি সানআর দরজা দেখছি।’

আল্লাহর রাসুলের (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তী সময়ে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং নবুয়তের ওপর বিশ্বাস অপরিহার্য, কেননা, ওহীর জ্ঞানই প্রকৃতি জ্ঞান।

৫. সিরাত অধ্যয়ন করে পুরোপুরি সঙ্গী হওয়া: নবীজির বংশ, বৈঠক, যুদ্ধ, দৈনন্দিন জীবন—সব জানা। (জাদুল মাআদ ফি হায়্যি খায়রিল ইবাদ, ১/১০, দারু আলমিল ফাওয়াইদ, মক্কা, ১৯৯৫)

আরও পড়ুনমহানবীর (সা.) প্রতি সাহাবিদের সীমাহীন ভালোবাসা১৩ নভেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ