মিনহাজের বিদায়: এই মনোবেদনা রাখিব কোথায়
Published: 27th, October 2025 GMT
ম্যাথ ক্যাঙারুর বার্ষিক সভা থেকে দেশে ফিরে আবার দুই দিনের সফরে জামালপুর-ময়মনসিংহের উদ্দেশে বের হয়ে পড়ি। সেখান থেকে ২৩ অক্টোবর অগ্নিবীণা এক্সপ্রেসে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা রওনা হই। রাত সোয়া ৯টার দিকে হোয়াটসঅ্যাপে চট্টগ্রাম বন্ধুসভার শিহাবের একটি বার্তা আসে, একটি ছবি সংযুক্ত। ট্রেনের দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগের কারণে ছবিটি তখন খুলতে পারিনি। প্রায় এক ঘণ্টা পর নেটওয়ার্ক ফিরে এলে ছবিটি খুলে দেখি। সদা হাস্যময় মিনহাজের মুখ। একমুহূর্তের জন্য বুঝতে পারিনি, এটি এক মনোবেদনার সংবাদ।
আমাদের প্রিয় সৈয়দ মোহাম্মদ মিনহাজ হোসাইন আর নেই! (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।)
আমি হতবিহ্বল হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি। বিশ্বজিৎ চৌধুরী ২৪ অক্টোবর বিকেলে মিনহাজকে স্মরণ করার সভায় উপস্থিত থাকার কথা জানিয়েছেন। তখনই বুঝতে পারি, বিদেশে থাকায় আমি মিনহাজের এই অকাল প্রয়াণের খবর সময়মতো জানতে পারিনি।
রাতের অন্ধকার চিরে ট্রেন এগিয়ে চলে, আর আমার মন ফিরে যায় বছর দশেক আগে এক দিনে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নেমে আমরা কয়েকজন যাচ্ছি বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির উদ্দেশে। সঙ্গে আছে তরুণ মিনহাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগের এক উদ্যমী প্রভাষক। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করা হচ্ছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা।
চট্টগ্রাম শহর থেকে অনেক দূরে চন্দনাইশের সেই ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেখি, উৎসবমুখর পরিবেশ। ল্যাবে চলছে প্রতিযোগিতা, বাইরে নানা আয়োজন। শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের সক্রিয় উপস্থিতি। সেদিন দেখা হয়েছিল আমার প্রিয় শিক্ষক চট্টগ্রাম কলেজের অজিত স্যারের সঙ্গেও। আর মিনহাজ ব্যস্ত ছিল তার দায়িত্বে। সম্ভবত সেটিই ছিল আমাদের প্রথম পরিচয়।
এরপর দেখি, মিনহাজ আমাদের প্রথম আলো বন্ধুসভা চট্টগ্রাম শাখার সদস্য। গণিত অলিম্পিয়াডের কাজ করতে গিয়ে সারা দেশের বন্ধুসভার অনেক উদ্যমী, দেশপ্রেমী তরুণের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, মিনহাজ তাদের অন্যতম।
পরে নানা সময় ফোনে, ই–মেইল বা মেসেজে মিনহাজের সঙ্গে কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে, কাজ হয়েছে। সব সময়ই তার চিন্তা ছিল, ছেলেমেয়েদের জন্য কী করা যায়। বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি থাকার সময় বন্ধু উৎসব, তারুণ্যের উৎসব—এসব আয়োজনে ছিল তার উজ্জ্বল উপস্থিতি।
নজির আহমেদ চৌধুরী রোডে মিনহাজদের একান্নবর্তী পরিবারের সবার বসবাস। সেখান থেকেই ১৯ অক্টোবর ২০২৫ সকালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল মিনহাজ। সেটিই ছিল তার শেষ যাত্রা। নিজের মেয়ে ও স্ত্রীর কাছে আর ফেরা হলো না মিনহাজের।চট্টগ্রামের জন্য তার ভাবনা ছিল অবিরাম।
এরই মধ্যে সে যোগ দেয় চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেও তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল শিক্ষার্থীরা। সৈয়দ মোহাম্মদ মিনহাজ হোসাইন ছিল চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। পাশাপাশি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) পিএইচডি গবেষক। চুয়েট থেকে তার এমএসসি ও বিএসসি ডিগ্রি। তার গবেষণার ক্ষেত্র ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং, কম্পিউটার ভিশন ও পরিবেশবিজ্ঞান। মিনহাজ ২০২৪ সালে বেস্ট রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড এবং ইউজিসি পিএইচডি ফেলোশিপ অর্জন করেন। তার গবেষণা বহু আন্তর্জাতিক জার্নাল ও কনফারেন্সে প্রকাশিত হয়েছে।
আমার সঙ্গে যখনই আলাপ হয়, তখনই শুনি কোনো না কোনো আয়োজনের কথা। মিনহাজের উৎসাহেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিয়া-ইন্ডাস্ট্রি কমিটির সদস্য হই, কারিকুলাম সভায় যোগ দিই, এমনকি অ্যাক্রেডিটেশন ভিজিটেও উপস্থিত থাকি।
মিনহাজ একাডেমিক ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করত। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির মডারেটর, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি কম্পিউটার ক্লাবের প্রোগ্রামিং উইংয়ের মডারেটর এবং আইইইই প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট ব্র্যাঞ্চের মেন্টর হিসেবে তার ব্যস্ততার কমতি ছিল না।
মিনহাজ নিজের কথা খুব কম বলত। সব সময় বন্ধুসভা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রসঙ্গ। পরিচয়ের বহু বছর পর জানতে পারি, তার দাদি আর আমার ছোট দাদি সহোদরা। আমরা দুজনই চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা এলাকার সন্তান।
মিনহাজের বাবা আমার চাচা হলেও পাড়ার অন্যদের মতো আমিও তাঁকে ভাই ডাকতাম। মিনহাজ সব সময় আমাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করত কেন জানি না।
মনে করার চেষ্টা করছিলাম, হয়তো ছোটবেলায় ওর বাবার কাঁধে মিনহাজকে দেখেছি। এমইএস স্কুলের মাঠে যখন আমরা ক্রিকেট খেলতাম, তখন হয়তো ছোট্ট মিনহাজও দর্শক হয়ে থাকত।
নজির আহমেদ চৌধুরী রোডে মিনহাজদের একান্নবর্তী পরিবারের সবার বসবাস। সেখান থেকেই ১৯ অক্টোবর ২০২৫ সকালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল মিনহাজ। সেটিই ছিল তার শেষ যাত্রা। নিজের মেয়ে ও স্ত্রীর কাছে আর ফেরা হলো না মিনহাজের।
মাস কয়েক আগে ওর সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল। আলোচনার বিষয়—চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কীভাবে প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামিংয়ে আরও ভালো করতে পারে। তখন সে জানায়, সে এখন বিভাগের চেয়ারম্যান। শুধু প্রিমিয়ার নয়, চট্টগ্রামের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রামিং টিম নিয়ে একটি বুটক্যাম্প আয়োজন করতে চায়। আমি যেন আয়োজনে সাহায্য করি। নানা ব্যস্ততায় সেই আয়োজন পিছিয়ে যায়। কে জানত, মিনহাজ সেই স্বপ্ন পূরণ করে যেতে পারবে না!
সেই থেকে মনকে সান্ত্বনা দেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। মিনহাজ আমার প্রায় ২০ বছরের ছোট। ওর এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কী দরকার ছিল!
মহান আল্লাহ তাআলার পরিকল্পনা আমরা জানি না। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী।
আল্লাহ তাআলা মিনহাজকে জান্নাতবাসী করুন।
কিন্তু এ মনোবেদনা আমি রাখব কোথায়!
মুনির হাসান প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউন ভ র স ট র উদ দ শ উপস থ ত
এছাড়াও পড়ুন:
সোলার ফেজ-২–এর উদ্বোধন: সৌরশক্তিনির্ভর সেচে খরচ ৩০ শতাংশ কমে
বাংলাদেশের সেচব্যবস্থা মূলত আমদানি করা ডিজেলের ওপর নির্ভরশীল। সৌর সেচপাম্প শুধু ডিজেল ব্যবহার কমায় না; বরং কৃষকদের সেচ খরচ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমায়। ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫ হাজার সৌর সেচপাম্প স্থাপন ও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর অঙ্গীকার আছে সরকারের।
সৌরশক্তিনির্ভর কৃষি সেচের প্রকল্প সোলার (সোলার এনার্জি ফর অ্যাগ্রিকালচারাল রেজিলিয়েন্স) ফেজ-২–এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন বক্তারা। রাজধানীর একটি হোটেলে আজ সোমবার এ অনুষ্ঠান হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় সফলভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে প্রথম পর্যায়ে। এ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু হচ্ছে। এটি এখন পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া ও কেনিয়াতেও সম্প্রসারিত হচ্ছে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার মাধ্যমে। এ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও জলবায়ু সহনশীলতার ভিত্তিতে টেকসই সৌর কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা।
আন্তর্জাতিক পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট (আইডব্লিউএমআই) এবং সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো–অপারেশন (এসডিসি) যৌথভাবে আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
কর্মশালায় বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বারিন্দ বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এ ছাড়া উন্নয়ন সহযোগী, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সোলার প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশে আইডব্লিউএমআই ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) সঙ্গে যৌথভাবে করা গবেষণায় দেখা গেছে, সৌর সেচপাম্প শুধু ডিজেল ব্যবহার কমায় না; বরং কৃষকদের সেচ খরচ ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমায়। সময়সাশ্রয়ী ও শ্রমসাশ্রয়ী সেবা প্রদান করে এবং দেরিতে বর্ষা শুরু হলে অতিরিক্ত সেচের সুযোগ সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ ও ভারতের তুলনামূলক গবেষণায় আইডব্লিউএমআই দেখিয়েছে যে সাধারণ ধারণার বিপরীতে সৌর সেচ সব সময় ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার ঘটায় না। বাংলাদেশে অপারেটর পরিচালিত সৌর পাম্প টেকসই পানি ব্যবহার নিশ্চিত করেছে।
কৃষিখেতে সৌরশক্তি ব্যবহারে এগিয়ে এসেছেন নারীরা