নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী হাফডজনের বেশি প্রার্থী। তাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে নির্বাচনী মাঠে নতুন মুখ হলেও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একজন পরিচিত মুখ অধ্যাপক আলিয়ার হোসেন। তিনিই প্রথম টেকসই, স্মার্ট ও আধুনিক নারায়ণগঞ্জ গড়তে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৬ দফা নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছেন শহর ও বন্দরের ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে। ইশতেহারের ১৬ দফা তুলে ধরে ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, লিফলেট করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে ৩১ দফা প্রচারপত্রের সঙ্গে তার নির্বাচনী ইশতারও মানুষের মাঝে বিতরণ করেছেন আলিয়ার হোসেন। আগামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দিয়ে বিএনপির প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য নানা কায়দায় তার প্রচার-প্রচারণা চলছে। 

লন্ডনের নর্থামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান আলিয়ার হোসেন নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সমাজ সেবক হাজী মোজাফ্ফর আলী কন্ট্রাক্টরের নাতি, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক এমপি আলহাজ্ব আফজাল হোসেন ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আতাহার হোসেন সামসুর ভাতিজা এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক তিনবারের এমপি এডভোকেট আবুল কালামের ভাগ্নে। বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী আলিয়ার হোসেন বাসযোগ্য সুন্দর নগরী গড়তে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে চান।

অধ্যাপক আলিয়ার হোসেন বলেন, আমার রাজনীতিতে আসার একটি উদ্দেশ্য হলো সুস্থ রাজনীতি এবং একটি ডেভলপমেন্ট থিংকিং থেকে রাজনীতিতে আমার পদার্পণ। আমি নারায়ণগঞ্জের ছেলে হিসাবে নারায়ণগঞ্জের পরিবর্তন দেখতে চাই। আমার কষ্ট লাগে যখন আমার জন্মস্থানের মানুষগুলো খুব অসুবিধার মধ্যে আছে। তাদের সুখ শান্তি নেই এবং তারা যে সমস্যাগুলো ফেইজ করছে আমি যদি এগুলো কিছু না করতে পারি তখন এটা আমাকে পীড়া দেয়। সেই দায়িত্ববোধ থেকে আমার রাজনীতিতে আসা। তাছাড়া আমি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের সাথে জড়িত। আমি যদি সেগুলো আন্তর্জাতিকভাবে করতে পারে তাহলে কেন আমার নিজের দেশের জন্য করতে পারবো না। বা নিজের এলাকার জন্য কেন করব না। সেই চিন্তা থেকে আমার রাজনীতিতে আসা। আমি আশি করি রাজনৈতিক পটভূমি যাই হোক না কেন আমি আপনাদের পাশে আছি এবং থাকবো। নারায়ণগঞ্জ এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে আমি সর্বদাই পাশে থাকবো। 

নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে নেতৃস্থানীয়, মনোনয়ন প্রত্যাশী এবং ভোটারদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যারা নমিনেশন প্রত্যাশী, আপনারা ভুলে যাবেন না আপনারা প্রত্যেকেই লিডার। আপনারা যে-ই নমিনেশন পান আপনি বা আপনারা অঞ্চল ভিত্তিক পাবেন। দল যাকে নমিনেশন দিবে তখন একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নিবেন। সেই দায়িত্ব যদি সঠিকভাবে পালন করতে না পারেন তার জন্য কিন্তু আপনাকে ইহকাল এবং পরকালে জবাবদিহি করতে হবে। একজন গ্রেট লিডার সে-ই হয়, যে তার জনগণকে বুঝতে পারে। যে নিজের স্বার্থের আগে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। 
তাই আমি বলবো রাজনীতি এক জিনিস আর জনগণকে ম্যানেজ করা বা সামলানো আরেক জিনিস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু বুঝতে হবে। বুঝতে হবে রাজনীতি, অর্থনীতি। সুতরাং এগুলা কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই জানতে হবে বুঝতে হবে। সেই জিনিসগুলো কিন্তু মাথায় রেখেই আপনাদেরকে সামনে এগুতে হবে। আমি সব সময় আপনাদের পাশেই থাকবো দল যেই সিদ্ধান্ত নিবে মাথা পেতে নিব। আর দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় তাহলে আপনাদের সবাইকে নিয়ে আমি সামনে আগাবো। 

‎আলিয়ার হোসেন বলেন, আমরা রাজনীতিতে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখবো। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেবের ৩১ দফা যদি দেখেন, একত্রে কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ না করি তাহলে কোন কিছুই করা সম্ভব হবে না। সততা নিষ্ঠার সঙ্গে আমাদেরকে কাজ করতে হবে। আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করি তাহলে আমাদের নিজেদের পরিবেশ নষ্ট হয়। নিজেরাই নিজেদেরকে শোধরানোর চেষ্টা করেন।

‎অধ্যাপক আলিয়ার বলেন, জনগণের কাছ থেকে কিন্তু একজন ভালো লিডারশিপ আসবে। আপনারা চার্জ করেন বড়লোক হতে গেলে কিন্তু বাংলাদেশে তিনটা জিনিস লাগে। এক হচ্ছে পৈত্রিক সূত্রে, আরেকটা হচ্ছে দুর্নীতি করে, আরেকটি হচ্ছে ব্যাংক লোন করে। আমি এবং আমাদের জনগণও প্রার্থী বাঁছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় টাকাটাকে প্রাধান্য দেয়। এগুলো দেখা মোটেও ঠিক না। ফাস্ট দেখতে হবে আমাদের যোগ্যতা। আমরা যেমন একজন সন্ত্রাসীকে পছন্দ করি না ঠিক একইভাবে কোন দুর্নীতিবাজ যাদের ব্যাংক লোন রয়েছে, যাদের কাছে আমাদের সম্পদ নিরাপদ না তাদের ক্ষেত্রে এখন থেকে আপনারা প্রেসার ক্রিয়েট করেন। 
যেমনি হোক তারা ঠিক হয়ে যাবে না হলেও পরবর্তীতে কোন চান্স থাকবে। আমার মনে হয় আপনাদেরকে অবশ্যই তাদের নিজস্ব  ও ব্যক্তিগত বিষয়গুলো দেখা উচিত। শুধু তাই নয়, তাদের ক্যাপাসিটি এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা ও তাদের নৈতিকতা দেখতে হবে। যদি আমরা একটি সুন্দর নারায়ণগঞ্জ ও বাংলাদেশ দেখতে চাই তারেক রহমান সাহেবের স্বপ্ন ৩১ দফাকে বাস্তবায়ন করতে চাই  তাহলে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। নারায়ণগঞ্জকে প্রাচ্যের ডান্ডি বলা হয়। নারায়ণগঞ্জ একটি প্রাচীন শহর ছিল এখানে অনেক ঐতিহ্য রয়েছে। আজকে দেখেন আমাদের ঐতিহ্য বলতে তেমন কিছুই নেই। একটি ভালো রাস্তায়ও নেই যেখানে আমাদের জনগণ সুন্দর ভাবে হাঁটা চলাচল করবে। একটা হাসপাতাল নেই। ভালো একটি স্কুল নেই, কলেজ নেই, ভালো ইনডাস্ট্রিয়াল নেই। বিনোদনের জন্য যথাযথ জায়গা নেই। নদীগুলো দূষিত হয়ে যাচ্ছে ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালাইজেশনের কারণে। সব কিছু মিলিয়ে আমি আমার নির্বাচনী ইশতেহারে ১৬টি পয়েন্ট দিয়েছি। আপনারা যদি মনে করেন আমি যোগ্য প্রার্থী তাহলে আমার পাশে থাকবেন, আমাকে অনুপ্রেরণা দেন, আমার জন্য আপনার আওয়াজ তুলুন, আমার জন্য দোয়া করুন। আর আমি যদি নমিনেশন নাও পাই তাহলেও আমি আপনাদের সাথে থাকবো। এবং যারাই নেতৃত্বে থাকবে আমি বলবো আসুন এখন থেকেই আমরা একত্রিত হই, সবাই একসাথে মিলেমিশে আমাদের নারায়ণগঞ্জকে সুন্দরভাবে মানুষের বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলি।

.

উৎস: Narayanganj Times

কীওয়ার্ড: ব এনপ ন র য়ণগঞ জ ন র য়ণগঞ জ ৫ ন র য়ণগঞ জ র আল য় র হ স ন র র জন ত ত আপন দ র ব এনপ র ক জ কর আম দ র র জন য স ন দর আপন র

এছাড়াও পড়ুন:

বিস্মৃতির ছোবল

গতকালও ওরা এখানেই ছিল। চায়ের দোকানের পাশে যে অ্যালোভেরার ঝোপ, তার ঠিক পাশেই বেঞ্চি পেতে বসেছিল ওরা তিনজন। অথচ ওদের মধ্যে একজনের অ্যালোভেরাগাছগুলোকে ছোট ছোট সাপ বলে ভ্রম হয়, অনেক দিন ধরেই। তারপরও ওই ঝোপের পাশেই ওরা বসেছিল।

ওদের মধ্যে একজন কখনো হাসে না। এ বিষয়ে ওর কাছ থেকে কোনো হৃদয়বিদারক গল্প ওরা শুনতে পায়নি। কেবল পরিচয়ের শুরু থেকেই ওরা জানত, ও কখনো হাসবে না। হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশের জন্য ওদের কাছে হাসিটাকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ মনেও হয়নি। বরং কান্না, কান্নাকে সব সময়ই ওদের কাছে খাঁটি একটা অনুভূতি বলে মনে হয়। মনে হয়, বৃষ্টি আর কান্না, এই দুইজন বেরিয়ে আসে কেবল আকাশ যখন ফেটে পড়ে তখনই।

তাই বলে গতকাল, অ্যালোভেরা ঝোপের পাশে বসে, ওরা কাঁদছিলও না। ওদের কান্নার নিজস্ব সময় আছে, সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের মতোই। শিশুর মতো যখন–তখন কেঁদে ফেলার বাতিক ওদের নেই। যদিও ঠিক এই সময়টায় না কাঁদলে, আর কখন কাঁদা উচিত, সেটাও ওরা বুঝতে পারছিল না।

‘আমাদের নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। সাধারণত শেষ দেখা বলতে আমরা যা বুঝি, তা আরও অনেক বেশি বিয়োগাত্মক হওয়ার কথা। আমার মনে হয় না এত শান্ত একটা বিদায়, শেষবারের মতো হতে পারে।’—না হাসতে পারা মানুষটা বলল।

‘কোনটা শেষবার, তা কি আসলেই কখনো জানা সম্ভব? এমনকি মৃত্যুও এভাবে বলেকয়ে আসে না। কেবল হয়তো মৃত্যুদণ্ডের আসামিদের ব্যাপারটা বাদ দিলে’—মেয়েটা জবাব দিল।

‘কিন্তু তারপরও, ফাঁসির আসামি হলেও, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনের আশা সবারই থেকেই যায়। একদম সত্যিকারের মরে যাওয়ার আগে, কেউ কি বিশ্বাস করে যে সে মরে গেছে?’—ওদের মধ্যে প্রথমে যে এসেছিল এই চায়ের দোকানটায়, সে নিজের অভিমত জানাল।

অথচ আশ্চর্য ব্যাপার হলো, ও চা খায় না। এমনকি যেবার শ্রীলঙ্কা থেকে চা এল বলে বাসায় খুব হইচই হলো, সেবারও, ও এক চুমুক চা মুখে দেয়নি। এমনকি ও সিগারেটও খায় না। কিন্তু তবু, চায়ের দোকানে ও–ই প্রথমবার এসেছিল। এসেছিল আসলে অ্যালোভেরার ঝোপের কথা জানতে পেরে।

‘আমাদের নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। সাধারণত শেষ দেখা বলতে আমরা যা বুঝি, তা আরও অনেক বেশি বিয়োগাত্মক হওয়ার কথা। আমার মনে হয় না এত শান্ত একটা বিদায়, শেষবারের মতো হতে পারে।’—না হাসতে পারা মানুষটা বলল।

না! পেটের বা যৌনাঙ্গের কোনো ব্যারামই ওকে অ্যালোভেরার খোঁজে এত দূর নিয়ে আসেনি। আপনারা যতটা ভাবছেন, চায়ের দোকানটা অত কাছেও না, যে বিনা পয়সার অ্যালোভেরার লোভে ও এত দূর আসবে। অ্যালোভেরার ঝোপের কাছে ও এসেছিল, কারণ সুদূর অতীতে এমন কোনো অ্যালোভেরার ঝোপের ভেতরেই, সে তার শৈশব হারিয়ে ফেলেছিল। এরপর একটু বড় হওয়ার পর থেকে, কারও মুখে অ্যালোভেরার ঝোপের গল্প শুনলেই, সেখানে সে হাজির হয়।

শৈশব ফিরে পাওয়ার কোনো প্রকল্প হাতে নিয়ে কিন্তু সে ঘুরে বেড়ায় না। কারণ একে একে কৈশোর, যৌবন বা আরও যা কিছু নিয়ে সবাই হাপিত্যেশ করে, তার সবকিছু অকালেই হারিয়ে ফেলার পর, ফিরে আসার জন্য অ্যালোভেরার ঝোপ ছাড়া ওর আসলে আর কিছু ছিল না।

‘মরে যাওয়ার নিশ্চয়তার বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্য আমরা কিন্তু ঠিক জুতসই মানুষ নই’—খেই ধরে না হাসতে পারা মানুষটা ‘বরং এই আলোচনা আমরা রাস্তার ওই পাশের বাসিন্দাদের জন্য ছেড়ে দিতে পারি। ওখানে ওদের, মৃত্যুর বাইরে আর কী নিয়েই–বা কথা বলার আছে।’

রাস্তার ওপাশে একঝাঁক ফিঙে হঠাৎ আকাশে উড়াল দিল। কিন্তু ওই ফিঙেরা ওর আলাপের বিষয়বস্তু নয়। বরং ফিঙেদের আকাশটাকে ঢেকে রেখে যে গাছগুলো গোঁয়ারের মতো দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনের কবরস্থানটার দিকেই তার ইঙ্গিত।

‘আমার মনে হয় না’ মেয়েটা দ্বিমত করে। ‘মৃত্যু নিয়ে আমাদের এত অবসেশন, কারণ জন্ম নেওয়ার পর থেকে জীবনের সবচেয়ে নিশ্চিত বিষয়টা মেনে নিতে, আমাদের বড় কষ্ট হয়। ওপাশে, ওদের এপিটাফে লেখা সন তারিখের ওপরও শেওলা পড়ে গেছে অনেক বছর আগে। আমার মনে হয়, তার চেয়ে জীবন নিয়ে কথা বলতেই ওরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। মৃত্যু পুরোপুরিই জীবিতদের বিষয়।’

তিনজনের কান্নার নিজস্ব সময়টা তিনটা ঘড়ির কাঁটার অঙ্কের মতো, একই সঙ্গে একই ঘরে না আসতে পারায়, ওরা কাঁদছিল না। কিন্তু এ কথা সত্যি, সময়টা কান্নারই ছিল। আর এই বেদনামুখর সময়কে আরও গুরুগম্ভীর করে তোলার জন্য মৃত্যুর চেয়ে ভারী বিষয় আর কী–ই বা হতে পারত?

অবাক করা বিষয় হলো, মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে ওদের ভালোই লাগছিল। একটা কুকুরের মৃত্যু যেমন করে মাঝেমধ্যে মানুষকে পারমাণবিক বোমার কথা ভুলিয়ে দেয়, হয়তো তেমনি করেই। তাই মৃত্যুর আলাপটা শেষ করতে চাইছিল না কেউ।

অথচ অবাক করা বিষয় হলো, মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে ওদের ভালোই লাগছিল। একটা কুকুরের মৃত্যু যেমন করে মাঝেমধ্যে মানুষকে পারমাণবিক বোমার কথা ভুলিয়ে দেয়, হয়তো তেমনি করেই। তাই মৃত্যুর আলাপটা শেষ করতে চাইছিল না কেউ। সে জন্যই কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথাটা তুলল হাসতে না পারা মানুষটা।

‘আমার সাপটা মরে গেছে, গতকাল রাতে। সকালেও ওকে খাবারদাবার খাইয়ে বের হয়েছিলাম। রাতে ফিরে দেখলাম, মরে পড়ে আছে। একটা ইঁদুর মুখে নিয়ে মরেছিল ও, অথচ খাঁচাটার মধ্যে ইঁদুর ঢোকার মতো কোনো রাস্তাই নেই।’ প্রিয় পোষ্যর মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে, বিষয়টার রহস্যময়তা সম্পর্কেই ওর আগ্রহ বেশি মনে হলো। অথবা হয়তো মৃত্যু সম্পর্কেই, কে জানে।

বাকিরা কিন্তু এবার বেশ শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ল। সাপটার সঙ্গে ওদেরও অনেকবার দেখা হয়েছে। বরং এটাই খুব আশ্চর্যের বিষয় যে সাপটাকে জ্যান্ত খাবার খেতে দেওয়ার সময়, মৃত্যু বিষয়টা ওদের কখনো বিচলিত করেনি।

‘আহা!’ বলল মেয়েটা। ‘প্রচণ্ড বিষধর হলেও, ও কিন্তু বেশ লাজুক ছিল। শুধু খাওয়ার সময়টা বাদে। বাকি সময় কেমন চুপটি করে পড়ে থাকত খাঁচার কোনায়। আমার মনে হয় আমাদেরকে চিনতে পারত, ঘরে ঢুকলেই দেখেছি কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত।’

এই দৃষ্টির বিষয়টা নিয়ে, স্বীকার না করলেও, ওদের কিন্তু একটা ভাবনা আছে। সে জন্যই সাপের পাশাপাশি, সাপের খাঁচাটার কথাও ওদের বিশেষ করে মনে পড়ে। না হাসতে পারা বন্ধুটি থাকে চিলেকোঠায়। এই চিলেকোঠায় সরাসরি ঘরের ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যায় না। কোনো একটা নিরাপত্তাজনিত কারণেই হয়তো বাইরের একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে সেখানে উঠতে হয়। সিঁড়িটা আবার ঘেরা একটা তারের জাল দিয়ে। যতবারই এই সিঁড়ি দিয়ে ওরা ওঠে, ওদের মনে হয় ওরা একটা খাঁচার মধ্যে ঢুকে পড়ছে ধীরে ধীরে। দূর থেকে কেউ দেখলে হয়তো ভাবত সাপের লেজটাই এঁকেবেঁকে ঢুকছে। চিলেকোঠায় ঢোকার পর সাপটাকে দেখতে দেখতে, ওদেরও নিজেদের বন্দী মনে হতো। পার্থক্য কেবল সাপটার মতো নিজেদের এই বন্দিত্ব নিয়ে ওরা এতটা নিস্পৃহ থাকতে পারত না। বরং সাপটার আধবোজা চোখের দিকে তাকিয়ে ওদের মনে হতো ওই চোখে ওদের জন্য উপচে পড়ছে উপহাস। খাঁচার কোন পাশে কে দাঁড়িয়ে আছে, তা বুঝতে না পারাদের দিকে, একজন বোদ্ধার চোখের ভাষা যেমন হয়।

সাপের মুখে থাকা মরা ইঁদুরের দিকে শুরুতে সাপের মালিকের মতো এত মনোযোগ না দিলেও, একটা সময় ওরা ইঁদুরটার কথাও ভাবতে শুরু করে। বাসাটায় খুব একটা ইঁদুরের উপদ্রব আছে বলে ওরা কখনো শোনেনি। ওই ঘোরালো সিঁড়ি বেয়ে একটা ইঁদুর চিলেকোঠায় পৌঁছে, সাপের সরু জালির খাঁচায় কী করে ঢুকে পড়ল, তার হদিস কিছুতেই ওদের মিলছিল না।

‘ইঁদুর বোধ হয় মানুষের মতোই, তাই না? যখন তার ডাক আসে, তখন যেমন করেই হোক একটা সাপ খুঁজে নিয়ে তার খাঁচায় ঢুকে পড়বেই। মানুষের জীবনে ঢুকে পড়ার মতো একটা সাপের খাঁচার কখনো অভাব হয় না, তাই না? বা ঢোকার পথের? যতই সুখের জীবন থাকুক তার; থাকুক নিরাপত্তা, একটা সাপ কিন্তু সব সময় তাকে ডাকতেই থাকে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে ওই সাপের বিষদাঁত আলিঙ্গন করার তাড়নাতেই যেন মানুষ ছুটে চলেছে, সৃষ্টির আদি থেকে।’ হাসতে না–পারা মানুষটার নিজের জীবনের কথাই যেন মনে হয়।

আগন্তুকেরা ক্ষণিকের জন্য আসে, আবার চলে যায়। ওরা তিনজন জানে, ওরা আর এখানে কখনো ফিরবে না। কখনো কখনো মৃত্যুর চেয়েও বড় কোনো অন্ধকার, মানুষকে আড়াল করে ফেলে। তারা আর ফিরে আসতে পারে না।

‘হুম, আর সাপেরও কখনো অভাব হয় না নিজস্ব একটা মানুষের। যদিও ওরা বলে, সাপের কোনো স্মৃতি নেই, শত্রু–মিত্র চেনার ক্ষমতাও নেই, আমার কিন্তু কথাটা বিশ্বাস হয় না। আমার মনে হয়, বিষ নিজেই একটা স্মৃতি। বিষদাঁতের পথ বেয়ে যে খুঁজে ফেরে নিজের অতিক্রান্ত অতীতকে। আর খুঁজে না পেয়ে আতঙ্কিত হয়েই ছোবল দিতে থাকে একে-তাকে’—কথাগুলো বলতে বলতে প্রথমবার আসা মানুষটা খানিকটা চঞ্চল হয়ে উঠল। হঠাৎ করে তার মনে হলো, অনেক দিন আগে যাকে সে অ্যালোভেরার ঝোপে হারিয়ে ফেলেছিল, সেটা কি তার শৈশব? নাকি কোনো একটা সাপ? নাকি একটা অতিদীর্ঘ সাপের বিষদাঁত হয়ে সে নিজের অতিক্রান্ত অতীতকেই খুঁজে ফিরছে ঝোপঝাড়ে?

তার অন্যমনস্কতা অন্য দুজনের মধ্যেও সংক্রমিত হলো। একজন ডুবে গেল তার মৃত সাপটির স্মৃতিচারণায়। আরেকজন সময়কে একটা সাপের আদলে কল্পনা করতে করতে নিজেই যেন একটা ফণা হয়ে দুলতে লাগল মৃদু ছন্দে। আর মেয়েটা, তার মন এখনো পড়ে আছে ওপাশের কবরগুলোর মধ্যেই। সত্যিই কি মৃতরা কেবল জীবনের কথাই ভাবে? নাকি মরে যাওয়ার পরে, এসব ভাবনা খস খস শব্দ করে উড়ে যাওয়া বাদুড়গুলোর মতোই অর্থহীন মনে হয়?

একটা সময় আলো নিভে আসে। চায়ের দোকানের আগন্তুকেরা ক্ষণিকের জন্য আসে, আবার চলে যায়। কিন্তু ওরা তিনজন জানে, ওরা আর এখানে কখনো ফিরবে না। কখনো কখনো মৃত্যুর চেয়েও বড় কোনো অন্ধকার, মানুষকে আড়াল করে ফেলে। তারা আর ফিরে আসতে পারে না।

কিন্তু শব্দ? শব্দ বেঁচে থাকে। যা কিছু উচ্চারিত হলো, তাই ধ্বনিত হবে ইথারে, আরও অনেক যুগ পরেও। আমাদের শ্রবণসীমার বাইরে চলে গেলে, শব্দগুলোকে আমরা মৃত ভাবি। নিজেদের কানের ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনো দ্বিধাই আমাদের মধ্যে জন্ম নেয় না। অথচ শব্দ অমর, অক্ষয়, অজর। যা কিছু উচ্চারিত হলো, সাপের খোলসের মতো হয়তো সে বারবার নিজেকে পাল্টাবে। কিন্তু সেটা প্রস্থান নয়, পুনরায় ফিরে আসার সংকেত মাত্র। হয়তো মৃত্যুও, আমাদের অনুভূতির বা বোধের সংকীর্ণতারই আরেক নাম। হয়তো আমাদের বোধের সীমার বাইরে, সচেতন সত্তার কখনো মৃত্যু হয় না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কর্মদিবসের শেষ দিনে প্রধান শিক্ষকের মৃত্যু
  • প্রশিক্ষকদের দায়িত্বে উদাসীনতাসহ যেসব অসংগতি উঠে এল প্রাথমিক তদন্তে
  • চবি ছাত্রদলের ৪২০ জনের কমিটিতে নারী মাত্র ১১
  • চলন্ত গাড়ির নিচে পড়েও অক্ষত অবস্থায় ফিরল ৩ বছরের শিশুটি
  • মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদন
  • যমুনা ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন
  • এই তিন কন্যার একজন ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়িকা, স্বামীও নায়ক
  • নিকোলাই গোগোলের নগরে
  • বিস্মৃতির ছোবল