জুলাই সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশ ঐক্যকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে: রাষ্ট্র সংস্কার
Published: 30th, October 2025 GMT
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছে, তা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট ঐক্যকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তাই সংকট এড়াতে কমিশনকে দ্রুত সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশগুলো নিয়ে আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।
আজ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ দাবি জানিয়েছেন রাষ্ট্র সংস্কারের নেতারা।
বিবৃতিতে বলা হয়, জুলাই অভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা সংস্কার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে আলাপ-আলোচনার পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে। ঐকমত্য কমিশন যে ঐক্যকে সামনে রেখে প্রায় এক বছর ধরে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, বাস্তবায়নের সুপারিশ সেই ঐক্যকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে।
চ্যালেঞ্জের মূল কারণ হিসেবে বলা হয়, ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যেটুকু আলোচনা করেছিল, সেখানে এ প্রস্তাবে উল্লেখিত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া উপস্থাপন করা হয়নি। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর পর যদি এ প্রস্তাব জাতির সামনে হাজির করা হতো, তাহলে চ্যালেঞ্জ পরিহার করা যেত।
এতে আরও বলা হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটের মাধ্যমে পরবর্তী সংসদকে সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় গঠনগত ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। কিন্তু যেসব প্রস্তাবে কিছু দল আপত্তি জানিয়েছিল, সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সেই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এমন অবস্থায় সংস্কার প্রস্তাবে লিপিবদ্ধ আপত্তির বিষয়গুলোকে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ থেকে মুছে দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মনে করে, দ্রুত ওই সুপারিশ থেকে বের হয়ে না এলে রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশের ভেতরের যৌক্তিক ক্ষোভ পরবর্তী সময়ে দেশের মানুষের ভেতর ছড়িয়ে পড়বে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দেশের মানুষ যখন নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশের প্রতি অন্যায় আচরণ অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠলে দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। দেশের মানুষকে স্বৈরাচারী সরকারের চেয়ে উন্নত জীবন উপহার দেওয়ার সুযোগ হারিয়ে যাবে।
সংকট এড়াতে ঐকমত্য কমিশনকে দ্রুত তাদের সুপারিশগুলো নিয়ে পুনরায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার দাবি জানিয়েছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। তারা বলেছে, সংবিধান টেকসই ও সর্বজনীন করতে তাড়াহুড়ো থেকে বিরত থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোই সংবিধান সংস্কারের একমাত্র পথ। ঐকমত্য কমিশন সঠিক বিবেচনাবোধকে গুরুত্ব দিয়ে দেশকে সংকট থেকে মুক্ত রাখবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রস ত ব
এছাড়াও পড়ুন:
গণভোট নিয়ে ‘ক্রসরোডে’ সরকার
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের গণভোট সংক্রান্ত সুপারিশকে ঘিরে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কি সত্যিই ঐকমত্যের পথে যাচ্ছে, নাকি আবারো রাজনৈতিক অনৈক্যের গভীরে নামছে? বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি প্রত্যেকেরই সুর ভিন্ন। এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলেছে, সংসদ নির্বাচনের দিন বা তার আগে গণভোট আয়োজনের সুযোগ রাখা যেতে পারে। উদ্দেশ্য, সংবিধান সংস্কার নিয়ে জনগণের সরাসরি মতামত নেওয়া।
‘সরকার কী করবে বুঝতে পারছে না’
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরবিরোধী ও উত্তেজিত ভূমিকা নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। দলগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনারা যদি এরকম ভূমিকা নেন, সরকার কী করবে, আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। এত দিন আলোচনার পর যদি ঐকমত্য না আসে, তো আমরা আসলে কীভাবে কী করব, সত্যি আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে।”
আরো পড়ুন:
৫ দাবিতে ৮ দলের নতুন কর্মসূচি, বৃহস্পতিবার স্মারকলিপি
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবিতে ইসলামী আন্দোলনের বিক্ষোভ
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথাগুলো বলেন আইন উপদেষ্টা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
‘কমিশনের অগ্রহণযোগ্য সুপারিশ জাতিকে বিভক্ত করবে’
সনদ বাস্তবায়নে ঐক্যমত কমিশনের সুপারিশ ‘অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে এই সুপারিশ জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অবস্থান তুলে ধরেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। সেখানে যেসব বিষয়ে ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ আলোচনায় আসেনি, তা অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সব সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমরা একমত হতে পারছি না।”
“আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, এই সকল সুপারিশ কেবল জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে।’’
মনগড়া যে কোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে বলেও এ সময় হুঁশিয়ার করেন মীর্জা ফখরুল।
‘নির্বাচনের আগে গণভোট অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক’
জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিকে অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। সেক্ষেত্রে নির্বাচন (সংসদ) অনুষ্ঠানের আগে প্রস্তাবিত গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, “সময় স্বল্পতা, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগ এবং একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মত বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে এবং একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।”
“আমরা আশা করি, জাতির প্রত্যাশা পূরণ এবং দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ২০২৪ সালে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সকল শহীদদের রক্তের অঙ্গীকার অনুযায়ী এবং যারা দীর্ঘ এই সংগ্রামে ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে গুম, খুন, অপহরণ, নির্যাতন, মামলা, হামলার শিকার হয়েছেন, তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে পারব। প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা,”
‘নভেম্বরেই গণভোট দিতে হবে’
জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য একেবারেই ভিন্ন। দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন ও গণভোট দুটি বিষয়ই রাজনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য অপরিহার্য। তাদের মতে, জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সংবিধান সংস্কার বৈধ হবে না।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন,“কমিশনের সুপারিশের আলোকে অবিলম্বে একটা আদেশ জারি চাই। আমরা জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট চাই। গণভোটের রায়ের ভিত্তিতে আমরা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চাই। আমাদের বক্তব্য ও বার্তা স্পষ্ট ও পরিষ্কার।”
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) বিকেলে রাজধানীর মগবাজারে আল-ফালাহ মিলনায়তনের চতুর্থ তলায় এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
অনেকগুলো সেটেল ইস্যু নিয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে অভিযোগ করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে নানাভাবে ফেসবুকে আংশিক বক্তব্য তুলে ধরে, নিজেদের মনগড়া বক্তব্য রেখে জামায়াতে ইসলামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায় কি না-এমন সংশয় তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা জুলাই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই আইনগত ভিত্তির মাধ্যমে। কমিশনের সুপারিশের আলোকে অবিলম্বে একটা আদেশ জারি চাই। আমরা জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট চাই। গণভোটের রায়ের ভিত্তিতে আমরা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চাই। আমাদের বক্তব্য ও বার্তা স্পষ্ট ও পরিষ্কার।”
‘ইউনূসের পদত্যাগের মতো ঘটনা ঘটতে পারে’
বিবাদমান পক্ষগুলোকে অহমিকা এবং তর্ক-বিতর্ক পরিহার করে ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ’ কার্যকরে একমত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি)।
দলটির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে নির্বাচন অনিশ্চিতসহ প্রফেসর ইউনূসের পদত্যাগের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি ভয়ানক রকম জটিল হয়ে পড়তে পারে।”
বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর বিজয় নগরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে দলের অবস্থান তুলে ধরে ধরে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে গতকাল মঙ্গলবার সুপারিশ জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সুপারিশে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাহী আদেশ জারির পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত যে কোনো দিন গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সংসদের প্রথম ৯ মাসে (২৭০ দিন) সংবিধান সংস্কার পরিষদ সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।”
ঢাকা/এসবি