কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পদ্মা নদীর দুর্গম চরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গুলি ও কুপিয়ে তিনজনকে হত্যার ঘটনায় করা একটি মামলায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে। এদিকে মামলার পর আজ বৃহস্পতিবার চরে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া অভিযানে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মামলার কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

এদিকে দুর্গম চরে একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আছে বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, এসব গোষ্ঠীর সদস্যরা চরের বালু ও জমি দখল নিয়ে গোলাগুলির ঘটনা ঘটায়। এক চরে অপরাধ করে আরেক চরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কখনো চরের বিশাল কলাবাগান, আবার একেবারে সীমান্তের শূন্যরেখায় মাঠের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

গত সোমবার সকালে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মণ্ডল গ্রুপের সঙ্গে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ‘কাকন বাহিনী’র মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষের তিনজন নিহত হন। তাঁরা হলেন মণ্ডল গ্রুপের আমান মণ্ডল (৩৬) ও নাজমুল মণ্ডল (২৬) এবং কাকন বাহিনীর লিটন (৩০)। এ ঘটনায় মণ্ডল গ্রুপের পক্ষ থেকে কাকন বাহিনীর কাকনকে প্রধান আসামি করে ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে গতকাল বুধবার একটি হত্যা মামলা করা হয়।

কে এই কাকন

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, পদ্মার দুর্গম চরে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত কাকন বাহিনী। বাহিনীটির প্রধান দৌলতপুর উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের মাঝদিয়াড় গ্রামের মো.

হাসানুজ্জামান কাকন (৫০)। ২০০১ সালে এলাকার একটি হত্যাকাণ্ডে তাঁর পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলে তিনি পরিবারসহ দৌলতপুর থেকে পালিয়ে পাশের পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় বসবাস শুরু করেন।

স্থানীয় সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, কাকন ১৯৯৪ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি পাস করেন। এরপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ২০০৭ সালে তিনি সৌদি আরবে চলে যান। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের আশ্রয়ে এলাকার বালুমহালগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে শুরু করেন। এই বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তিনি গড়ে তোলেন বাহিনী। পরে তিনি কুষ্টিয়া, পাবনা, বাঘা, নাটোর ও রাজশাহীর পদ্মা নদীর চর ও বালুর ঘাটগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমানে কাকন বাহিনীর প্রায় ৪০ জনের বেশি সক্রিয় সদস্য আছে।

চরে পুলিশের অভিযান

আজ সকালে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস্) ফয়সাল মাহমুদের নেতৃত্বে জেলা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, কয়েকটি থানার ওসিসহ ১২০ জন পুলিশ সদস্য চরে অভিযান চালান। সকাল ১০টা থেকে দৌলতপুর উপজেলায় পদ্মা নদীর আবেদের ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে অভিযান শুরু করেন। তাঁরা বিভিন্ন চরের গ্রামগুলোতে যান। কোনো কোনো চরে নৌকা রেখে হেঁটে গ্রামের ভেতর প্রবেশ করেন। গ্রামের বাসিন্দারা পুলিশদের দেখে খুশি হন। তাঁরা পুলিশকে জানিয়েছেন, কাকন বাহিনীসহ আরও কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠনের ভয়ে থাকেন তাঁরা। জমি দখলসহ ফসল কেটে নিয়ে যায়। চাঁদাবাজি করে।

বিকেলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস্) ফয়সাল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন নৌকাতে বাঘা সীমান্তে রয়েছি। সাত ঘণ্টার বেশি সময় কয়েকটি চরে অভিযান চলেছে। দিনের এই অভিযান রাতেও চলবে। এটা যে শুধু আসামি ধরা তা নয়, মানুষকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে, সন্ত্রাসীদের আশ্রয় এই চরগুলোতে আর হবে না।’ তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডে জড়িত কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি, তবে ৬৮টি ইয়াবাসহ ১ জনকে আটক করা হয়েছে।

কাকন বাহিনীর সঙ্গে ‘সম্পৃক্ততা নেই’, তা–ও আসামি

পদ্মার চরে সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল বিকেলে মণ্ডল গ্রুপের পক্ষ থেকে ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে দৌলতপুর থানায় হত্যা মামলা করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, ঘটনায় জড়িত নয়, এমন কয়েকজন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

মামলায় মরিচা ইউনিয়নের ভুরকা হাটখোলাপাড়া এলাকার উজ্জ্বল সরদার (৪৫) ও তাঁর ভাই রফিকুল সরদারকে ২ ও ৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে। কাকন বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকা ওই ব্যক্তিদের আসামি করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, উজ্জ্বল সরদার দৌলতপুরে নদীভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলার ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি মরিচা এলাকায় ভাঙন রোধে কাজ করছেন। ওই কাজ বন্ধ বা অন্যের হাতে না দেওয়ায় পরিকল্পিতভাবে তাঁকে ও তাঁর ভাইকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।

উজ্জ্বল সরদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংঘর্ষের সময় আমি আমার বাড়িতে ছিলাম। তার সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে। অথচ আমাদের দুই ভাইকে মামলার আসামি করা হয়েছে। কাকন বাহিনীর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমি একজন ঠিকাদার। দৌলতপুরে নদীভাঙন এলাকায় আমার জিও ব্যাগ ফেলার কাজ চলছে। স্থানীয় এক সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সেই কাজ বন্ধ করতে বাদীপক্ষকে দিয়ে আমাদের আসামি করিয়েছেন।’

মামলার বাদী মিনহাজ মণ্ডল বলেন, ‘নিহত দুজনের মধ্যে একজন আমার ছেলে, অন্যজন ভাগনে।’ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়, এমন কয়েকজন ব্যক্তিকে আসামি করার অভিযোগের ব্যাপারে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ বলেন, মামলার তদন্তে যাঁদের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হবে, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে। আর যাঁরা নির্দোষ, তাঁরা অবশ্যই অব্যাহতি পাবেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সন ত র স দ লতপ র র আস ম সরদ র ঘটন য় ল সরদ

এছাড়াও পড়ুন:

‘শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন, এখনো কেন গুলি করছেন’

আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২১তম সাক্ষী হিসেবে বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন আহত জুলাই যোদ্ধা মো. সানি মৃধা। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার (গত বছরের ৫ আগস্ট) পরও গোলাগুলির শব্দ শুনে ছাত্র-জনতা আশুলিয়া থানার দিকে যায়। ওই সময় তাঁরা পুলিশদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন, এখনো কেন গুলি করছেন? এরপর পুলিশ তাঁদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করছিল।

আশুলিয়ার বাসিন্দা সানি মৃধা জবানবন্দিতে বলেন, তিনি গত বছরের ৫ আগস্ট দুপুরে বাইপাইল এলাকায় অবস্থান করছিলেন। সেদিন বেলা আনুমানিক ২টা থেকে আড়াইটায় সময় জানতে পারেন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। তখন তাঁরা বিজয় মিছিল বের করেন। ওই সময় আশুলিয়া থানার দিক থেকে অনেক গোলাগুলির শব্দ আসছিল। তাঁরা (ছাত্র-জনতা) আশুলিয়া থানার দিকে রওনা হন।

সানি মৃধা বলেন, থানার সামনে যাওয়ার পর তাঁর দুই পা, হাত ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লাগে। পরে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান সহযোদ্ধারা।

এ মামলায় আসামি ১৬ জন। তাঁদের মধ্যে ৮ জন এখন কারাগারে। তাঁরা হলেন ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী ও মো. শাহিদুল ইসলাম (সাভার সার্কেল), ঢাকা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল মালেক, আরাফাত উদ্দীন, কামরুল হাসান, শেখ আবজালুল হক ও সাবেক কনস্টেবল মুকুল চোকদার।

বৃহস্পতিবার তাঁদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এই মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামসহ আট আসামি পলাতক।

এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণ হবে আগামী বুধবার। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ মামলাটির বিচার চলছে। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারক মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও বিচারক নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।

জেরায় পুলিশ হত্যা, লুটপাট প্রসঙ্গ

জবানবন্দির পর আসামিপক্ষের আইনজীবী জেরা করেন সাক্ষী সানি মৃধাকে। জেরায় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে তাঁরা বাইপাইল এলাকায় বিজয় মিছিল করছিলেন। সে জায়গা থেকে আশুলিয়া থানার দূরত্ব এক কিলোমিটার উত্তরে। তিনি আশুলিয়া থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন।

জেরায় এ মামলার আসামি আবদুল্লাহিল কাফীর আইনজীবী সৈয়দ মিজানুর রহমান প্রশ্ন করেন, বিজয় মিছিলের সময় আশুলিয়া থানার আশপাশে সব পুলিশ সদস্যের বাড়ি লুট করা হয় এবং যেসব বাসায় পুলিশ সদস্য ভাড়া বাসায় থাকতেন, সেখানে তল্লাশি করে তাঁদের মারা হয়।

এর জবাবে সানি মৃধা বলেন, এ কথা সত্য নয়।

তখন আইনজীবী মিজানুর রহমান বলেন, বিজয় মিছিল ঢাকা অভিমুখে গেছে, আশুলিয়া থানার দিকে যায়নি।

এর জবাবে সানি মৃধা বলেন, এ কথাও সত্য নয়।

আইনজীবী বলেন, সবাই যখন বিজয় উল্লাস করতে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করেছিল, সে সময় সানি মৃধাসহ কিছু ব্যক্তি আশুলিয়া থানা লুটপাট করতে যান এবং অজ্ঞাত ব্যক্তির গুলিতে তিনি (সানি মৃধা) আহত হন।

এ প্রশ্ন করতেই প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) আপত্তি জানায়। প্রসিকিউশন বলে, একজন জুলাই যোদ্ধাকে লুটপাটকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বা তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

পরে ট্রাইব্যুনাল প্রশ্নটি আপত্তিসহকারে নেন।

জেরায় সানি মৃধা বলেন, আশুলিয়া থানার সামনে মূল সড়কের ওপর একটি ওভারপাস (পদচারী–সেতু) আছে।

তখন সানি মৃধাকে আইনজীবী মিজানুর বলেন, পুলিশ সদস্য সোহেল রানা ও রাজু আহমেদকে মেরে ওভারপাসে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, তা দেখেছেন?

জবাবে সানি মৃধা বলেন, তিনি দেখেননি।

তখন ট্রাইব্যুনাল এটিকে (দুই পুলিশ সদস্যকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা) ‘লিডিং কোশ্চেন’ (যে প্রশ্নে উত্তরের ইঙ্গিত থাকে) হিসেবে উল্লেখ করেন। পরে এটি আমলে নেননি ট্রাইব্যুনাল।

জেরায় আইনজীবী মিজানুরের আরেক প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী সানি মৃধা বলেন, পুলিশ ভ্যানে কে আগুন দিয়েছে, তা তিনি দেখেননি।

পুলিশের সাবেক দুই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো

মানবতাবিরোধী অপরাধের পৃথক দুটি মামলায় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম এবং সিআইডির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মশিউর রহমানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেন বলে প্রথম আলোকে জানান প্রসিকিউটর তারেক আব্দুল্লাহ।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় চট্টগ্রামে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলামকে বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। পরে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

অন্যদিকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সংঘটিত গুম-খুনের একটি মামলায় মশিউর রহমানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউটর তারেক আব্দুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, মশিউর রহমানকে বৃহস্পতিবার সকালে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁকে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। গুমের শিকার ৩৫ জনের বেশি ব্যক্তির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মশিউরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলার অপর আসামি বরিশাল রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ