আবারও সক্রিয় মেঘনা-গোমতীর আতঙ্ক জিতু বাহিনী
Published: 27th, January 2025 GMT
আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার মেঘনা ও গোমতীর নদীপথের আতঙ্ক জলদস্যু জিতু রাঢ়ী ও তার বাহিনীর সদস্যরা।
দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে জিতু তার সহযোগীদের নিয়ে ২৫ কিলোমিটার নৌপথ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অস্ত্র ও ইয়াবা ব্যবসা, নৌযানে ডাকাতি ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, জলদস্যু জিতু ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে গৃহবধূ মমতাজ বেগম হত্যা, চাঞ্চল্যকর হালিম হত্যা, কিশোর সাগর হত্যা, র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলি, ভোটকেন্দ্র থেকে ব্যালট বাক্স লুট, শ্যালকের স্ত্রীকে ধর্ষণচেষ্টা, চাঁদাবাজিসহ ২৯টি মামলা থাকলেও বহাল তবিয়তে তারা।
অন্যদিকে ২০১১ সালে সংঘটিত হালিম হত্যা মামলা তুলে নিতে বাদী মিনু বেগম ও সাক্ষী হারুন সরকারকে প্রায়ই মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে জিতু। এতে প্রাণভয়ে দীর্ঘদিন ধরে গ্রামছাড়া হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন হত্যা মামলার সাক্ষী যুবদল কর্মী হারুন। জিতু ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গত ৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর লিখিত আবেদন করলেও গত চার মাসে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ সুযোগে জিতু বাহিনী সক্রিয় হয়ে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন যুগ ধরে বাহিনীর জিতু ও তার দস্যুদলের সদস্যরা গজারিয়ার গুয়াগাছিয়া, পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকাধীন মেঘনা ও গোমতী নদীতে নৌযানে ডাকাতি, হত্যা, যাত্রীবাহী বালু ও মাটি বহনকারী বাল্কহেড এবং মাছের ট্রলার থেকে চাঁদা আদায়সহ নানা অপকর্ম করছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মেঘনা ও গোমতী নদী মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, চাঁদপুরের মতলব উত্তর, কুমিল্লার দাউদকান্দি ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও সীমানাঘেঁষা হওয়ায় নদীপথে সংঘটিত অপরাধ কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিতে চায় না কোনো জেলার থানা পুলিশ। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জিতু বাহিনী গড়ে তুলেছে অপরাধের বিশাল নেটওয়ার্ক। ফলে এ বাহিনীর অত্যাচারে জিম্মি হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের নাকের ডগায় দিনের পর দিন অসংখ্য অপরাধ করলেও জিতু ও তার সহযোগীরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
স্থানীয় গ্রামবাসী ও ভুক্তভোগী সূত্র জানায়, নব্বই দশকের শুরুর দিকে জেলার গজারিয়ার গুয়াগাছিয়া এলাকার মৃত হাফেজ রাঢ়ীর ছেলে জিতু, তার ভাতিজা, চাচাতো ভাই গেসু, ছলি ও রেনুসহ কিছু নিকটাত্মীয় নিয়ে গড়ে তোলে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী। এরপর শুরু হয় তাদের নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড। অল্প সময়ের মধ্যে পুলিশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’-এর তালিকায় জায়গা করে নেয় এ বাহিনীর সদস্যরা। জিতু ও তার বাহিনীর সদস্যরা একাধিকবার পুলিশ ও র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়। জেল থেকে বের হয়ে তারা আবার একই কাজ শুরু করে।
জানা গেছে, ২০১৫ সালে জিতু আওয়ামী লীগের তৎকালীন এমপি মৃণাল কান্তি দাসের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। এরপর বেপরোয়া হয়ে ওঠে জিতু ও তার বাহিনী। ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আলোচিত হালিম হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী গুয়াগাছিয়া ইউনিয়ন যুবদলের তৎকালীন সভাপতি হারুন সরকারের ওপর হামলা করে তাঁর ডান পা কেটে নেয় জিতু ও তার বাহিনী। নানা অপরাধের মধ্যে ২০১২ সালের ৩১ মার্চ গজারিয়ার মেঘনা নদীতে ডাকাতি করতে গিয়ে এ বাহিনী মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার এতিম কিশোর সাগরকে (১৪) হত্যা করে। ট্রলারযোগে মতলব থেকে
বাড়ি ফেরার পথে ডাকাতের কবলে পড়ে প্রাণ হারায় সাগর। এ ঘটনায় নিহতের দুলাভাই মহসিন মিয়া জিতুকে প্রধান আসামি করে গজারিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন।
২০১১ সালের ২৪ মার্চ রাতে জিতু ও তার বাহিনী আমেরিকা প্রবাসী গৃহবধূ মমতাজ বেগমকে (৫৫) খুন করে ঘরে রক্ষিত স্বর্ণালংকার ও টাকা লুটে নেয়। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় জিতুর ভাই।
এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর ৩১ মার্চ চাঁদার টাকা না দেওয়ায় মতলব উত্তর বেলতলী লঞ্চঘাটের দোকান থেকে ডেকে নিয়ে গজারিয়ার গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামের যুবক হালিমকে হত্যা করে জলদস্যুরা। এ ঘটনায় চাঁদপুরের মতলব উত্তর থানায় জিতুকে প্রধান আসামি করে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহত হালিমের মা মিনু বেগম।
২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁ এলাকায় বাসে ডাকাতির সময় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় জিতুর ভাতিজা দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড ফয়েজ। এ ব্যাপারে র্যাব সোনারগাঁ থানায় মামলা করে।
২০০৯ সালের ২৮ মে রাতে গোমতী নদীর গুয়াগাছিয়ার বসুরচর এলাকায় জিতু ও তার বাহিনী ডাকাতি করার প্রস্তুতিকালে র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলি হয়। গোলগুলি শেষে র্যাব জিতুর দুই ভাই অলি ও কলিমউদ্দিনকে অস্ত্রসহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে। এ ব্যাপারে র্যাব গজারিয়া থানায় মামলা করে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে জলদস্যু জিতু রাঢ়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে মেসেজ পাঠালেও সাড়া মেলেনি।
গজারিয়া থানায় ওসি আনোয়ার আলম আজাদ বলেন, নৌ ডাকাত ও জলদস্যুদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে পুলিশ। বাহিনীর প্রধান জিতু রাঢ়ী ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে। শিগগির জিতুকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। বর্তমানে নৌ ডাকাত ও জলদস্যুদের অপরাধ কর্মকাণ্ড রোধে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত র সহয গ
এছাড়াও পড়ুন:
অপহৃত হওয়া জেলেরা কি ফিরবেন না পরিবারের কাছে
তখন করোনার কাল। কুড়িগ্রাম জেলার ২৬ জন জেলে তাঁদের কাজের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভারত থেকে বাংলাদেশের পথে রওনা দেন। কিন্তু করোনার কারণে হঠাৎ বিধিনিষেধ আসে। তাঁরা রাস্তায় আটকা পড়েন। তবু ঝুঁকি নিয়ে কয়েক দিন পর আবার বের হন। আসাম পুলিশ তাঁদের আটকায়।
মানববন্ধন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনের শরণাপন্ন হয়ে ছাড়িয়ে আনতে আনতে একজন জেলখানায় মারা যান। এরপর বাকিরা বাংলাদেশে ফিরতে পারেন। কিছুদিন আগে সাতজন জেলে ভারতের মেঘালয়ে আটকা পড়েন। তাঁরা এখন ভারতের জেলে। ভারতের আদালত কী রায় দিয়েছেন জানি না। পরিবারগুলোর কান্না থামছে না। এটা গেল চিলমারীর ব্রহ্মপুত্রপারের জেলেপাড়ার ঘটনা।
আগে বঙ্গোপসাগরের ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর প্রায়ই পত্রিকায় আসত। ভারতীয় কোস্টগার্ডও ধরে, ভারতীয় জলদস্যুরাও ধরে। এগুলো ‘ডাল-ভাত ব্যাপার’। ভারত বড় শক্তি। তারা স্থলে মারবে, পানিতে মারবে—এটাই নিয়তি। দয়া করে লাশ ফেরত দিলে তাতেই আমরা খুশি।
দুই.১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ দৈনিক ইত্তেফাক–এর খবর থেকে জানা যায়, ৪০ জেলেকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি, উদ্ধার হননি আগের ৮১ জনও। কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিনের অদূরে সাগর থেকে মাছ ধরার পাঁচটি ট্রলারসহ ৪০ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মির সদস্যরা। পাঁচটি ট্রলারের মধ্যে তিনটি টেকনাফ পৌর এলাকার, অন্য দুটির মালিক শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, জেলেদের উদ্ধারে কাজ চলছে। এ বিষয়ে বোট মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে বলেও জানান সাজেদ আহমেদ।
কিন্তু বিজিবি, কোস্টগার্ড ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা দেশবাসী জানে না। শুধু জানা যাচ্ছে, জেলেরা এখনো উদ্ধার হয়নি। পরিবার–স্বজনদের অপেক্ষা বাড়ছে।
তিন.১৫১৭ সালের কথা। পর্তুগিজরা বাংলার উপকূলে আসে। প্রথম দিকে এরা বাণিজ্য করলেও ধীরে ধীরে দস্যুতা, অপহরণ ও দাস ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।
হুগলি, চট্টগ্রাম ও সুন্দরবন থেকে শুরু করে নোয়াখালী থেকে বরিশাল পর্যন্ত উপকূল এদের ডাকাতির শিকার হয়। গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে নারী, শিশু ও পুরুষদের ধরে নিয়ে যেত এবং দাস হিসেবে বিক্রি করত। এদের নিয়ে যেত পর্তুগিজ উপনিবেশে (গোয়া, মালাক্কা), এমনকি ইউরোপ পর্যন্ত। আর মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল থেকে আসা মগ জলদস্যুরা ডাকাতি চালাত বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, সীতাকুণ্ড ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলের মানুষদের তুলে নিয়ে যেত। বিক্রি করা হতো আরাকানের রাজধানী ম্রাউক উ এবং চট্টগ্রামের কাছে দাসের হাটে।
ফরাসি পর্যটক সেজার ফ্রেডেরিক লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলে দস্যুর হাতে ধরা পড়লে মুক্তি নেই, তারা মানুষ ধরে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে।’ ডাচ পর্যটক ভ্যান ডেন ব্রুক ১৭ শতকে আরাকানিদের দাস ব্যবসার বর্ণনা দিয়েছেন। এই সময়কালে বাংলার উপকূল থেকে অপহৃত মানুষের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে কিছু জায়গা জনশূন্য হয়ে পড়ে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি ভেঙে যায়। গ্রামবাসীরা ভয়ে চলে যায় উপকূল ছেড়ে ভেতরের দিকে।
মোগল শাসকেরা জানতেন, তাঁদের সমৃদ্ধি এই জেলে, কৃষক ও কারিগরদের ওপর নির্ভরশীল। শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৬ সালে এই পর্তুগিজ ও মগদের দমন করেন। এখন কে করবেন দমন?
চার.মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জেরবার। আগে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীরা মাঝেমধ্যে বাহাদুরি দেখাতেন, আমরা নিরীহ বাঙাল হিসেবে মেনে নিতাম। ইদানীং তাঁদের তাড়িয়ে আরাকানের দখল নিয়েছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। তারা আমাদের জেলেদের সেন্ট মার্টিনে যেতে দেয় না, মাছ ধরতে দেয় না। প্রতি সপ্তাহে জেলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার টেরই পায় না।
উজানের ব্রহ্মপুত্র থেকে ভাটির সমুদ্র—সর্বত্রই জেলেদের জীবন কচুপাতার মতো টলমল। তাঁদের শ্রম ছাড়া আমাদের পাতে মাছ ওঠে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলেদের নৌকাই ছিল আমাদের ভরসা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলে গেছেন, তাঁদের ‘পল্লীতে ঈশ্বর থাকেন না’। রাষ্ট্র থেকে বলা হয়, বঙ্গোপসাগর হলো বাংলাদেশের সদর দরজা; কিন্তু সেই সাগরেই আমাদের জেলেদের নিরাপত্তা নেই।
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
[email protected]