শহুরে জীবনে ম্যাট্রেসের চাহিদা বাড়ছে। ভালো মানের ম্যাট্রেস বেছে নেওয়ার পাশাপাশি তার ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণও জরুরি। বিছানার চাদর যেভাবে নিয়মিত বদলানো হয়, সেভাবে ম্যাট্রেস কি পরিষ্কার করা হয়? কী হয় ম্যাট্রেস নিয়মিত পরিষ্কার না করলে?

হতে পারে জীবাণুর কারখানা

অপরিচ্ছন্ন ম্যাট্রেসের উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশ হয়ে উঠতে পারে জীবাণুদের কারখানা। বিশেষ করে উপদ্রব হতে পারে ডাস্ট মাইটের মতো আণুবীক্ষণিক কীটের। এসব কীট মানুষের শরীরের মৃত কোষ খেয়ে বেঁচে থাকে। আর ওদের শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জি। শুরুতে বোঝা না গেলেও ধীরে ধীরে অ্যালার্জির লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে শরীরে। হাঁচি–কাশি তো আছেই, হাঁপানির সমস্যাও জটিল করে তুলতে পারে এই কীট।

আরও পড়ুনযে কারণে সকালবেলা বিছানা ছেড়ে ওঠা দুঃসাধ্য মনে হয়০২ মার্চ ২০২১প্রভাব পড়তে পারে ত্বকে

ডাস্ট মাইট ত্বকেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ম্যাট্রেসে বাসা বাঁধা ডাস্ট মাইটের আক্রমণ থেকে শরীরে ছোট ছোট র‌্যাশ দেখা দিতে পারে। নোংরা ম্যাট্রেসে ডাস্ট মাইট দু–তিন দিন বেঁচে থাকতে পারে। ফলে র‌্যাশ ছড়ানো এদের জন্য তুলনামূলক সহজ।

ছড়াতে পারে দুর্গন্ধ

দীর্ঘদিনের নোংরা ম্যাট্রেস থেকে ছড়াতে পারে দুর্গন্ধ। বিশেষ করে শরীরের যত ঘাম, ময়লা, আবর্জনা সবকিছুর স্থান হয় বিছানায়। শরীরের মৃত কোষগুলোও ঝড়ে পড়ে বিছানায়। সব মিলিয়ে একটা উটকো দুর্গন্ধের সৃষ্টি করতে পারে নোংরা ম্যাট্রেস।

আরও পড়ুনকোমরব্যথায় চাই যেমন বিছানা ২৬ জানুয়ারি ২০২৩দীর্ঘদিন পরিষ্কার রাখতে চাইলে

ম্যাট্রেস পরিষ্কার করার চেয়ে পরিষ্কার রাখা তুলনামূলক সহজ। ভারী বলে ম্যাট্রেস সহজে টানাহেঁচড়া করাও কঠিন। ফলে বেশ কিছু নিয়ম মেনে সহজেই ম্যাট্রেস পরিষ্কার রাখা সম্ভব।

বিছানায় খাবেন না: বিছানায় বসে খাওয়ার অভ্যাস আছে অনেকেরই। শুধু ম্যাট্রেসের ওপর খাওয়াদাওয়া না করাই ভালো। এতে দুর্ঘটনাবশত ম্যাট্রেসে খাবার বা পানীয় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।

আবরণ ব্যবহার করুন: ম্যাট্রেসের ওপর পানিরোধী হালকা আবরণ ব্যবহার করতে পারেন। নিয়মিত বিরতিতে আবরণ পরিষ্কার করলেই ম্যাট্রেস পরিষ্কার থাকবে।

ভ্যাকুয়াম ক্লিন করুন: কয়েক মাস পরপর ম্যাট্রেস ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করুন। এতে ক্ষুদ্র ময়লা যেমন পরিষ্কার হবে, তেমনই চোখে দেখতে না পাওয়া জীবাণু বা কীট থেকে ম্যাট্রেস থাকবে পরিষ্কার।

খোলা হাওয়ায় রাখুন: টানা ব্যবহারের ফলে ম্যাট্রেস উষ্ণ ও আর্দ্র হয়ে ওঠে। এই আর্দ্রতা দূর করতে ম্যাট্রেসটা বিছিয়ে রাখুন খোলা হাওয়ায়। আলো-বাতাসের সংস্পর্শে ম্যাট্রেসে নতুন করে ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধতে পারবে না।

বিছানা পরিষ্কার রাখুন: ম্যাট্রেস পরিষ্কার রাখতে বিছানা পরিষ্কার রাখার বিকল্প নেই। বিছানার চাদর, বালিশের কভার, কম্বল–জাতীয় বিভিন্ন অনুষঙ্গ প্রতি দুই সপ্তাহে একবার পরিষ্কার করুন। এতে বিছানা অপরিষ্কার হবে কম।

বিছানার ফ্রেম বা কাঠামো পরিষ্কার রাখুন: অনেকে ম্যাট্রেস ও বিছানা পরিষ্কার করলেও বিছানার ফ্রেম বা কাঠামোতে জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করতে ভুলে যান। দীর্ঘদিন অপরিষ্কার থাকলে তাতে জমতে পারে ময়লার আস্তরণ।

নিয়মিত পরিষ্কার রাখলে একটা ম্যাট্রেস ১০ থেকে ১৫ বছর অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। তবে ম্যাট্রেসে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা দ্রুত পরিবর্তন করাই শ্রেয়। তা না হলে তা হয়ে উঠতে পারে শরীরের জন্য ভীষণ ক্ষতিকারক।

সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে

আরও পড়ুনবিছানা–বালিশ কেমন হলে ঘুম ভালো হবে০৪ জুলাই ২০২৩.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম য ট র স পর ষ ক র পর ষ ক র র খ ড স ট ম ইট ব যবহ র

এছাড়াও পড়ুন:

আরও বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের সংগ্রামের জমিন 

মে দিবস। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন শ্রমিকেরা। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়েই কাগজে–কলমে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমের মর্যাদা, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠনের অধিকার। একসময় এসব দাবিই রূপ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ভিত্তিতে।

কিন্তু ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এই দিনে ফিরে তাকাই, তখন প্রশ্ন আসে, এখনো কি সেই সব দাবি প্রাসঙ্গিক? নাকি সময় পাল্টে দিয়েছে সব? এখন তো কাজের ধরনই বদলে গেছে—একদিকে অটোমেশন, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রা। উৎপাদনের পদ্ধতি যেভাবে বদলেছে, তাতে পুরোনো ধরনের শ্রমিক যেন ক্রমে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন।

আজকের দুনিয়ায় পুঁজি এক ক্লিকে দেশান্তরিত হয়, কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে মজুরি কম এবং আইনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। মানুষ এখন আর কেবল শ্রমিক নয়; তাঁদের বলা হচ্ছে ‘ফ্রিল্যান্সার’, ‘কন্ট্রিবিউটর’, ‘পার্টনার’, ‘ডেলিভারি ম্যান’। কিন্তু আসলে, এদের অনেকেই এক নতুন ধরনের দিনমজুর; যাঁদের নেই নিরাপত্তা, নেই সুনির্দিষ্ট অধিকার। কাজ করছেন তাঁরা—কখনো রাস্তায় খাবার পৌঁছে দিয়ে, কখনো কম্পিউটারে চ্যাটবট প্রশিক্ষণ দিয়ে, আবার কখনো অ্যালগরিদম পরিশোধনে; কিন্তু কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন। তাঁরা জানেন না যে তাঁদের কাজের ফল কোথায় যাবে, কীভাবে ব্যবহৃত হবে।

এই ব্যবস্থার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে অ্যামাজন। তাদের গুদাম ও সরবরাহ চেইনে রোবট, ড্রোন ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। শ্রমিকেরা সেখানে নির্ধারিত সময়ের বেশি কাজ করতে বাধ্য হন, মেশিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অথচ যখন তাঁরা সংগঠিত হতে চান, তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠে লবিং, বিরোধিতা, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ। ২০২৩ সালে অ্যামাজনের একাধিক গুদামে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টাকে রুখে দিতে কোম্পানিটি কোটি কোটি ডলার খরচ করে আইনি দল গঠন করে।

মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়; সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না

শুধু অ্যামাজন নয়, গোটা দুনিয়াতেই শ্রমের এক নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে—ডিজিটাল ও প্ল্যাটফর্মভিত্তিক শ্রম। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকেরা কাজ করেন উবার, ফুডপান্ডা, আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো অ্যাপে যুক্ত হয়ে। অথচ তাঁদের নেই কোনো কর্মস্থল, নেই কর্মঘণ্টার নিশ্চয়তা, নেই অসুস্থতার ছুটি বা পেনশনের মতো সামাজিক সুরক্ষা। বাস্তবে তাঁরা একা, বিচ্ছিন্ন। প্রতিযোগিতার চাপে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় অনিরাপত্তার ভেতর।

২০২৩ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের অন্তত ৮০% গিগ-ওয়ার্কার দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। অথচ তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মাস শেষে কোনো নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি পান না। গ্লোবাল গিগ ইকোনমির এই বাস্তবতা বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। আমাদের শহরগুলোয় এখন হাজারো বাইক বা সাইকেলচালক কাজ করছেন খাবার কিংবা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাঁরা কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন।

এর পাশাপাশি আরও একটি বড় পরিবর্তন এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান। প্রশ্ন উঠেছে, এআই কি শ্রমিকের বন্ধু, না প্রতিদ্বন্দ্বী? যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে এআই কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে কাজ হারাতে পারেন। হোয়াইট-কলার পেশাগুলো যেমন হিসাবরক্ষণ, গ্রাহকসেবা, এমনকি সাংবাদিকতার কাজও এই প্রযুক্তির কারণে সংকটে পড়ছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৩ সালের ‘দ্য ফিউচার অব জবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ কাজ হারিয়ে যাবে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের কারণে। তবে একটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। যদি উৎপাদিত পণ্যের খরিদ্দার না থাকে, তাহলে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফা আসবে? আর শ্রমিক না থাকলে কিনবে কে? তবে একই সময়ে ৯ কোটি ৭০ লাখ নতুন ধরনের কাজের সৃষ্টি হতে পারে। কাজগুলো হবে ডেটা অ্যানালিটিকস, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালনা এবং সৃজনশীল ও মানবিক দক্ষতানির্ভর কাজ। এই নতুন শ্রমিকদের অবস্থার কথা ওপরে বলা হয়েছে।

কিন্তু এই নতুন কাজের মালিকানা কার হাতে? শ্রমিকদের নয়, রাষ্ট্রেরও নয়—এই ক্ষমতা এখন করপোরেট অলিগার্কদের হাতে কেন্দ্রীভূত। যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গদের মতো প্রযুক্তি ধনকুবেররা শুধু প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকই নন, তাঁরা রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছেন। করপোরেট লবিংয়ের মাধ্যমে আইন তৈরির পেছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; যেমন ট্যাক্স ছাড়, শ্রম আইন শিথিলকরণ বা প্রতিযোগিতা নীতির ধ্বংস।

বাংলাদেশেও দৃশ্যপট খুব আলাদা নয়। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাঁরা দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি। কিন্তু তাঁরা এখনো ন্যূনতম মানবিক মজুরি পান না। গত বছর শ্রমিকেরা ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি চাইলেও সরকার তা নামিয়ে ১২ হাজারে নিয়ে আসে। আন্দোলনের জবাবে আসে পুলিশি দমন, ধরপাকড়, ভয়ের পরিবেশ। মালিকেরা নতুন প্রযুক্তি বসিয়ে আরও কম শ্রমিক দিয়ে আরও বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করবেন। আগে–পরে এটা অবধারিত।

এই প্রেক্ষাপটে মে দিবস আজ আমাদের সামনে এক নতুন প্রশ্ন তোলে—শ্রমিক আসলে কে? তাঁর অধিকার কী? আর লড়াইটা কিসের জন্য?

যদি শ্রমিকের সংজ্ঞাই বদলে যায়, তাহলে লড়াইয়ের রূপও কি পাল্টাতে হবে না? একসময়ের আট ঘণ্টার কাজের দাবি এখন হয়তো পুরোনো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে বহু মানুষ এখনো দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। কেউ কাজ পাচ্ছেন না, কেউ কাজ করেও মাস শেষে ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কেউ এমন এক ধরনের ডিজিটাল শ্রম করছেন, যার নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা তাঁর নয়, তিনি জানেনই না যে কার জন্য কাজ করছেন।

তাই আজ মে দিবস শুধু অতীত স্মরণের দিন নয়—এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনারও দিন। এটি নতুন ধরনের দাবির জায়গা—ডিজিটাল শ্রমের স্বীকৃতি, গিগ-ওয়ার্কারদের অধিকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি। আর অবশ্যই আমাদের মতো দেশে গায়ে খাটা শ্রমের ন্যায্য মজুরির দাবি।

মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়, সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক, শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না।

এই সত্য যত দিন থাকবে, মে দিবস তত দিন থাকবে; নতুন প্রশ্ন নিয়ে, নতুন লড়াই নিয়ে।

জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

সম্পর্কিত নিবন্ধ