‘আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জন্য এই মার্কেটই বড় শপিংমলের সমান। ওখানে যা পাওয়া যায়, এখানে তার সবই পাওয়া যায়। মান কম-বেশি হতে পারে। কিন্তু কম দামে পরিবারের সবাইকে পোশাকসহ সব জিনিস দিয়ে খুশি করতে পারছি, এটাই বড় কথা’– গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মতিঝিলের হলিডে মার্কেটে ঈদের কেনাকাটা করতে এসে এ কথা জানান চাকরিজীবী আজহার আলী।
ঈদের বাকি আছে হাতেগোনা কয়েক দিন। এর মধ্যে উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত– সবার মাঝে সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদ পণ্য কেনার ধুম পড়ে গেছে। শেষ মুহূর্তে পছন্দমতো পণ্য সংগ্রহে ব্যস্ত সবাই। সেই ব্যস্ততার একটা রূপ দেখা গেছে হলিডে মার্কেটে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই পাশের সড়কজুড়ে এ মার্কেট। ভোর থেকে রাস্তার দুধারে বিক্রেতারা গৃহস্থালি থেকে শুরু করে তৈজসপত্রসহ সব পণ্য চাটাই, ত্রিপল, ভ্যানে সাজিয়ে বিক্রি শুরু করেন। এটা চলে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। প্রতি সপ্তাহে এই মার্কেটে ক্রেতারা এলেও ঈদের আগে উপচে পড়া ভিড় হয়।
মাটির জিনিসপত্র বিক্রেতা রহমান বলেন, ‘বাঁধাধরা জিনিসপাতি তো থাকেই এহানে। খাওয়া-দাওয়াত্তে শুরু কইরা ঘরের সবকিছু। তারপর হপ্তায় অনেক নয়া জিনিসও আহে। আসলে কাস্টমার যা চায়, তাই নিয়া আহে। আর আমার এই মাটির জিনিসপাতি তো অনেক বড়লোকরাও আইসা কিন্না লয়।’
সড়কের দুই ধার ঘুরে গতকাল দেখা গেছে, অন্য মার্কেটের মতো দামাদামি করে জিনিসপত্র কিনছেন করছেন ক্রেতারা।
সোমা আক্তার কয়েক সেট সুতি থ্রিপিস কিনছেন এই মার্কেট থেকে। তিনি জানান, এখানে নতুন-পুরাতন সব জিনিসের মিশেল আছে। খুঁজে অনেকটা সময় নিয়ে দামাদামি করে ভালো ও নতুন জিনিস পাওয়া যায়। আর যেহেতু জায়গাটা সারিবদ্ধভাবে রয়েছে দুপাশে, তাই দেখেশুনে কিনতে সুবিধা হয়।
অন্য জায়গার ভ্যানে বা ফুটপাতে যে পর্দা বা বিছানার চাদর বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়, সেগুলো এই মার্কেটে দামাদামি করে পাওয়া যায় ৩০০ কিংবা ৪০০ টাকায়। শুধু গৃহস্থালি সামগ্রী নয়, এখানে কফি ও নানা বিদেশি খাদ্যদ্রব্যের কাচের বোতল পরিষ্কার করে বিক্রি হচ্ছে। এসব জিনিসের ক্রেতা কারা, জানতে চাইলে দোকানে থাকা কিশোর কায়েস বলে, ‘এগুলো নেয় আমগোর থিকা স্টুডেন্ট আর
অনেক মহিলা। অনেকে আবার এডির উপর আর্ট কইরা নিজেরা ব্যবসাও করে। তাই বেশি বেশি কইরা লয়।’
বর্তমানে ট্রেন্ডে থাকা সব পোশাক, ব্যাগ, অলংকারসহ সব কিছু এই মার্কেটে পাওয়া যায়। ফলে শিক্ষার্থী ও ট্রেন্ড ফলোয়াররা কম দামে এখান থেকে জিনিসপত্র কিনতে আসেন। মাহি হক ৩টি পাতলা জিন্সের প্যান্ট দামাদামি করে কেনার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, রোজার শেষ সময়ে এমন দামাদামি নিউমার্কেটে করা সম্ভব না। সেজন্য এই জায়গা থেকে খুঁজে জিনিসপত্র বেশি কিনে নিই।
অন্য সময় ভ্যানে মোটামুটি মানের ছেলেদের জুতো ও স্যান্ডেল বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। এখানে সেগুলো দামাদামিতে পাওয়া যায় ৫০০ টাকার ঘরে।
শাড়ি নারীর এক আলাদা আবেগ। সুতি শাড়ি, জর্জেট, হ্যান্ড পেইন্টসহ বিভিন্ন মানের শাড়িও লুফে নিচ্ছেন ক্রেতারা। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঈদের প্রতিদিন নতুন পোশাকে নিজেদের ছবি পোস্ট করার প্রবণতা কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে। হলিডে মার্কেটে ভ্রাম্যমাণ দোকানের শাড়িগুলো দু-তিনবারের বেশি পরা না গেলেও ছবি তুলে পোস্ট করা যায় বলে জানান তরুণী আফসানা। পরে সেই শাড়ি ঘরের নানা কাজে ব্যবহার উপযোগী করা হয় বলে জানান তিনি।
হাল ফ্যাশনে ট্রেন্ডে থাকা তরুণ-তরুণী নির্বিশেষে পরার মতো ড্রপ সোল্ডার টিশার্ট, ব্যাগী জিন্স, বাহারি জুতো থেকে শুরু করে সানগ্লাস ও বিভিন্ন জুয়েলারি সামগ্রী পাওয়া যায়। এগুলোর মূল্য ২০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। তবে এই মার্কেটের মূল বিশেষত্ব হলো এখানে দামাদামি ও যাচাইবাছাইয়ের মাধ্যমে পণ্য কেনা যায়।
এ ছাড়া এবার গৃহসজ্জার অনুষঙ্গের মাঝে আড়ং প্রিন্টের পর্দা ও কাঁথা স্টিচের বিছানার চাদর রয়েছে। সঙ্গে বিভিন্ন আকার ও রঙের কুশন। এগুলোর দামও নাগালের মধ্যে।
নতুন-পুরোনো জিনিসের এই সাপ্তাহিক মার্কেট নিয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতা– উভয়ই খুশি। তবে সড়কের ওপর মার্কেট হওয়ায় শুক্রবার অসুবিধায় পড়তে হয় পথচারীদের। হাতে অনেক সময় নিয়ে বেরোতে হয় বলে জানান ওই এলাকার বাসিন্দা পলি আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমি এই মার্কেট থেকে জিনিসপত্র কিনি। তবু সুনির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ে আর এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। দেশের যে পরিস্থিতি, এখানে একটা নিয়ম তৈরি করতে পারলে আমরা স্বস্তি পেতাম।’
২০০৭ সালে হকার পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে হলিডে মার্কেট চালু করে ঢাকা সিটি করপোরেশন। মাঝে কিছু সময় বিরতি থাকার পর আবার শুরু হওয়া এই হলিডে মার্কেটের বিক্রেতাদের মাঝে কোনো হতাশা নেই। সপ্তাহান্তে এক দিন বসে এই মার্কেট। দোকানিরা জানান, সব বয়সের চাহিদা সম্পন্ন এ রকম বড় একটি মার্কেটের স্থায়ী ব্যবস্থা হোক। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশে ভ্রাম্যমাণ দোকান নিয়ে মাঝে মাঝে সমস্যায় পড়তে হয়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ঈদ র ক ন ক ট এই ম র ক ট জ ন সপত র
এছাড়াও পড়ুন:
দেড়শ বছর টিকে আছে বালিকান্দি চামড়ার হাট
প্রায় দেড়শ বছর আগে মৌলভীবাজারের বালিকান্দি গ্রামে গড়ে ওঠে চামড়ার হাট। কোরবানির ঈদ এলেই মনু নদী তীরবর্তী গ্রামের এ হাটে চামড়া কেনাবেচা চলে দীর্ঘ রাত পর্যন্ত। ক্রেতা-বিক্রেতা, শ্রমিকের আনাগোনায় উৎসবমুখর থাকে বালিকান্দি বাজার।
মৌলভীবাজার জেলায় চামড়া কেনাবেচার একমাত্র হাট বালিকান্দি বাজার। জল ও স্থলপথে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় এটি দ্রুত বিভিন্ন এলাকায় পরিচিতি লাভ করে। স্থানীয় বাজারে চা স্টলের মালিক আব্দুল করিম জানান, তারা বাপ-দাদার আলোচনায় শুনেছেন, চার-পাঁচ পুরুষ আগে এ ব্যবসার যাত্রা শুরু। এক সময় খুব জমজমাট ছিল এ হাট। তিনিও এক সময় চামড়া কেনাবেচায় জড়িত ছিলেন। ব্যবসায় লস খাওয়ায় চায়ের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন এখন।
জানা যায়, ১৮৬০ থেকে ১৮৭০ সালের দিকে এ বাজারের যাত্রা। এখন এ ব্যবসার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। ট্যানারি মালিকরা টাকা আটকে রাখায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। চামড়া বেচাকেনা যখন জমজমাট ছিল, তখন ঈদকেন্দ্রিক বাজার সরব থাকত।
স্থানীয়রা জানান, অতীতে ঈদকেন্দ্রিক মৌসুমি ব্যবসায়ীসহ শতাধিক মানুষ চামড়া কেনাবেচা করতেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা মাংস ছিলে লবণ লাগিয়ে বড় পুঁজির ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতেন। বড় ব্যবসায়ীরা আগেকার দিনে ঢাকার হাজারীবাগ এবং নাটোরে ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতেন। শওকত মেম্বার, সানুর মিয়া, আনোয়ার মিয়া, মো. তারণ, মিন্টু মিয়া, সুলেমান মিয়ারা তাদের আদি পুরুষের ব্যবসার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
গত ৭ জুন ঈদের দিন সন্ধ্যায় সরেজমিন বালিকান্দি চামড়ার বাজারে যেতে দেখা যায় চামড়াবোঝাই ছোট-বড় ট্রাক-পিকআপ, টমটম, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভিড়ে জ্যাম লেগে গেছে। ফাঁড়ি রাস্তায় যেতে হয়েছে বালিকান্দি বাজারে। সেখানে শামিয়ানা টানিয়ে সড়কের পাশে, কোথাও সড়কের অংশজুড়ে চলছে চামড়া থেকে মাংস সরানোর কাজ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এ কাজ করছেন।
চামড়া ব্যবসায়ী সুলেমান মিয়া জানান, ঈদের সময় বালিকান্দি বাজারে এখনও ১৫ থেকে ১৬ হাজার চামড়া কেনাবেচা হয়। এতে এক দিনে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। এবার গরুর আকারভেদে দেড়শ থেকে ৬০০ টাকা দরে চামড়া কেনাবেচা হয়েছে। চামড়া বিক্রি করতে আসা মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা তাফাজ্জুল বিন ফারুকী রাজনগরী জানান, চামড়া ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দেড়শ-দুইশ টাকায় প্রতি পিস চামড়া কিনেছেন। এতে ট্রাক ভাড়া ও অন্যান্য খরচ ওঠানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শওকত মিয়া মেম্বার সমকালকে জানান, ব্যবসার মজা শেষ হয়ে গেছে ২০১৩ সাল থেকে। আগে ঈদ এলেই ট্যানারি মালিকরা বকেয়া পরিশোধ করে দিতেন। এখন বছরের পর বছর যাওয়ার পরও পাওনা টাকা পরিশোধ করেন না। গত বছরের পাওনা ৫৫ লাখ টাকার মাঝে এবার ঈদের আগের দিন ট্যানারি মালিক মাত্র ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এ বছর চার হাজারের বেশি চামড়ায় লবণ লাগিয়ে রেখেছেন। আরও কিছু লবণযুক্ত চামড়া কেনার জন্য দাম-দর চলছে। তিনি জানান, এ বছর বড় গরু কোরবানি দেওয়ার সংখ্যা খুব কম। ছোট চামড়ার সংখ্যাই বেশি।