মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে পুরোনো চক্র বা সিন্ডিকেট আবার ‘সক্রিয় হয়েছে’। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা আওয়ামী লীগের নেতা ও দলটির সুবিধাভোগীদের মালিকানাধীন রিক্রুটিং এজেন্সি বাদ দিয়ে নতুন এজেন্সি নিয়ে চক্র গঠন করতে চাচ্ছে।

সাধারণ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা বলছেন, চক্রটি সক্রিয় হয়েছে, এমন একটি সময়ে যখন অন্তবর্তী সরকার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবার চালুর জন্য আলোচনা শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের একটি প্রতিনিধিদল আলোচনা শুরুর জন্য শিগগিরই মালয়েশিয়া যেতে পারে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা আছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ সফরও করে গেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। ফলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবার চালুর আশা আছে।

আরও পড়ুনমালয়েশিয়ার শ্রমবাজার: ‘চক্রে’ ঢুকে চার সংসদ সদস্যের ব্যবসা রমরমা ৩০ মে ২০২৪রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা বলছেন, রুহুল-আমিনুলরা আবার চক্র গঠনের পাঁয়তারা করছেন। মালিকেরা বলছেন, গত বছর আওয়ামী লীগের কয়েকজনকে রেখে চক্র তৈরি করা হয়েছিল। এবার আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলের কাউকে কাউকে চক্রে ঢোকানোর চেষ্টা চলছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কর্মী নিয়োগে অনিয়ম ও অবৈধ বাণিজ্যের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে মালয়েশিয়া চক্র। এ কারণে একাধিকবার বন্ধ হয়েছে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ। সবশেষ গত বছরের জুন থেকে বন্ধ আছে দেশটির শ্রমবাজার।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চক্রে থাকা সাবেক চার সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁরা হলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ মুস্তাফা কামাল, ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.

) মাসুদউদ্দিন চৌধুরী এবং ঢাকার সাবেক সংসদ সদস্য বেনজির আহমেদ। তবে চক্রের মূল হোতা রুহুল আমিন (স্বপন) ও আমিনুল ইসলাম (আমিন নূর) বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা বলছেন, রুহুল-আমিনুলরা আবার চক্র গঠনের পাঁয়তারা করছেন। মালিকেরা বলছেন, গত বছর আওয়ামী লীগের কয়েকজনকে রেখে চক্র তৈরি করা হয়েছিল। এবার আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলের কাউকে কাউকে চক্রে ঢোকানোর চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন করে চক্র গঠনের চেষ্টা হচ্ছে। চক্রকে চাঁদা দিয়ে কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা আর মেনে নেওয়া হবে না। অন্তর্বর্তী সরকার একই পথে হাঁটলে এবার কঠোর আন্দোলন করা হবে।

সমঝোতা স্মারকের দোহাই দিয়ে কোনোভাবেই আবার চক্র তৈরির সুযোগ দেওয়া যাবে না। সংস্কারের সরকারের সময়ে আগের নিয়মে কর্মী পাঠানো হলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।তাসনিম সিদ্দিকী, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার, রামরুচক্র ঠেকাতে স্মারকলিপি

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের চক্র-ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট কিছু রিক্রুটিং এজেন্সিকে শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ দেওয়া হয়। এতে বেশির ভাগ এজেন্সি বঞ্চিত হয়। অনেকে চক্রে থাকা এজেন্সিকে টাকা দিয়ে তাদের নামে শ্রমিক পাঠায়। এ ব্যবস্থা অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে নেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় গত বছর ১ হাজার ৫২০টি রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ। সেখান থেকে শুরুতে ২৫টি এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর তিন দফায় এটি বাড়িয়ে ১০০টির নাম চূড়ান্ত করা হয়। প্রতিটি নাম ঢোকাতে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে। বর্তমানে অনুমোদিত এজেন্সির সংখ্যা আরও বেশি। তাই বাছাই করার নামে আরও বড় বাণিজ্য হতে পারে এবার।

মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সই করা একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয় দেশটিতে। এতে বলা আছে, কর্মী পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাই করবে মালয়েশিয়ার সরকার। বাংলাদেশ সরকারের পাঠানো এজেন্সির তালিকা থেকে অনলাইনে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় বাছাইয়ের কাজটি করবে তারা।

নতুন করে চক্র গঠনের চেষ্টা হচ্ছে। চক্রকে চাঁদা দিয়ে কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা আর মেনে নেওয়া হবে না। অন্তর্বর্তী সরকার একই পথে হাঁটলে এবার কঠোর আন্দোলন করা হবে।বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম

ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফডব্লিউসিএমএস) নামের স্বয়ক্রিয় প্রক্রিয়ায় কাজটি করা হয় একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে। মাইগ্রাম নামের সফটওয়ারটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান আমিনুল ইসলামের কোম্পানি বেস্টিনেট। এতে করে কর্মীপ্রতি ১০০ মালেশিয়ান রিঙ্গিত বা আড়াই হাজার টাকা পাওয়ার কথা প্রতিষ্ঠানটির। তবে পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এজেন্সি বাছাইয়ের নামে তারা অবৈধ বাণিজ্য করেছে বলে অভিযোগ।

কর্মী নিয়োগে চুক্তির এ-সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করে সবার জন্য সুযোগ উন্মুক্ত করার দাবি ব্যবসায়ীদের। তাঁদের ভাষ্য, মালয়েশিয়া সরকার তো বাংলাদেশের এজেন্সি সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখে না। তাই তারা বাছাইয়ের দায়িত্ব নিতে পারে না। এজেন্সি বাছাইয়ে কোনো সূচকও তৈরি করেনি তারা। এ সুযোগে গতবারও নতুন লাইসেন্স নিয়েই চক্রের তালিকায় ঢুকে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ।

দুদকের সার-সংক্ষেপে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মীকে দিতে হয়েছে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। দেড় বছরে সাড়ে চার লাখের মতো কর্মী পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে।

চুক্তি সংশোধনের দাবি তুলেছেন এশিয়ায় অভিবাসন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যের নাগরিক অ্যান্ডি হলও। ৭ এপ্রিল তাঁর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে আবারও বাংলাদেশে চক্র তৈরির পাঁয়তারা চলছে। তাই চক্রের হাতে নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া কয়েকটি ধারা সংশোধন করতে হবে।

একই দাবি বায়রার সদস্যদের। গত ৫ ফেব্রুয়ারি তাঁরা স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে। এতে বলা হয়, রুহুল আমিন ও আমিনুল ইসলামের তৈরি চক্র গতবার মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে জনপ্রতি ১ লাখ ৭ হাজার টাকা করে চাঁদাবাজি করেছে। আবার যাতে সিন্ডিকেট তৈরি না হয়, সে জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। রুহুল-আমিনুলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সব এজেন্সির জন্য কর্মী পাঠানোর সুযোগ উন্মুক্ত রাখতে হবে।

প্রবাসী কল‍্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (কর্মসংস্থান অনুবিভাগ) এ জেড এম নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মালয়েশিয়া শ্রমবাজার নিয়ে কোনো চক্র তৈরির সুযোগ নেই। সব এজেন্সি যাতে কর্মী পাঠানোর কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে, তা চায় মন্ত্রণালয়। মালয়েশিয়ার সঙ্গে বৈঠকে সমঝোতা স্মারকের কিছু বিষয় সংশোধন নিয়ে আলোচনা হবে।

চক্রের কারণে সাত গুণ টাকা গচ্চা

মালয়েশিয়া এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার। এই শ্রমবাজার নিয়ে গঠিত চক্রে ঢুকে বাণিজ্য করা চার সাবেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। দুদকের সার-সংক্ষেপে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মীকে দিতে হয়েছে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। দেড় বছরে সাড়ে চার লাখের মতো কর্মী পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে।

চক্রের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ও অনিয়মের দায়ে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানো বন্ধ হয়ে যায় গত বছর। অনুমোদিত কর্মীদের মালয়েশিয়ায় যেতে সবশেষ সময় ছিল গত বছরের ৩১ মে। ওই সময়ের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষ করেও যেতে পারেননি ১৭ হাজার কর্মী। তবে দেশটিতে যেতে টাকা জমা দিয়ে প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা প্রায় ৫০ হাজার কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বায়রার সদস্যরা। মালয়েশিয়ায় গিয়েও অনেক কর্মী কাজ পাননি। কেউ কেউ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ ফিরে এসেছেন খালি হাতে।

বায়রার সদস্যদের অভিযোগ, গতবার চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে শুরুতেই জামানত হিসেবে ৫ কোটি টাকা করে অগ্রিম জমা নিয়েছিলেন মূল হোতারা। এবার ৫০ লাখ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (সাড়ে ১২ কোটি টাকা) করে জমা নেবেন তাঁরা। এরপর কর্মী পাঠানো শুরু হলে এটি সমন্বয় করা হবে।

বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হলে রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, চক্র তৈরির অভিযোগ ঠিক নয়। এটি একটি গোষ্ঠীর তৈরি গুজব বলে দাবি করেন তিনি।চেষ্টা করেও আমিনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

রুহুল আমিন অস্বীকার করলেও অন্য এজেন্সি মালিকেরা বলছেন, চক্র তৈরির তৎপরতা জোরেশোরেই চলছে। কোন কোন রিক্রুটিং এজেন্সি চক্রে থাকবে, সেই তালিকাও তৈরি হয়েছে। এমন অন্তত দুটো তালিকা পাওয়া গেছে। তৎপরতা বৃদ্ধির কারণ মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার চালু করতে সরকার চেষ্টা করছে।

‘চক্র তৈরির সুযোগ দেওয়া যাবে না’

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২২ মে ঢাকায় বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার যৌথ কারিগরি কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা। এ ছাড়া আলোচনার জন্য মালয়েশিয়া যেতে পারে মন্ত্রণালয়ের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। তবে দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি।

উল্লেখ্য, বিদ্যমান সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ আছে আগামী বছরের আগস্ট পর্যন্ত। এর মধ‍্যে কর্মী পাঠানো শুরু হলে এজেন্সি বাছাইয়ের দায়িত্ব মালয়েশিয়ার হাতে থাকবে। তবে এটি নবায়নের সময় ওই ধারা সংশোধন করার জন্য সমঝোতা হতে পারে।

বায়রার সদস্যরা বলছেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকার প্রধানের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে সমঝোতা স্মারক কিছুটা সংশোধন করে দ্রুত শ্রমবাজারটি চালু করা যেতে পারে। এতে সব এজেন্সির জন্য সুযোগ উন্মুক্ত রাখার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত কর যায়। অন্য দেশ থেকে একইভাবে কর্মী নেয় মালয়েশিয়া।

অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, চক্রটি বারবার দেশের গরিব মানুষদের নিয়ে অবাধে বাণিজ্য করেছে। সমঝোতা স্মারকের দোহাই দিয়ে কোনোভাবেই আবার চক্র তৈরির সুযোগ দেওয়া যাবে না। সংস্কারের সরকারের সময়ে আগের নিয়মে কর্মী পাঠানো হলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে হলে অন্য দেশের মতো একই নিয়মে নিতে হবে। তাসনিম সিদ্দিকীর পরামর্শ, সরকার নতুন করে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে পারে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ রমব জ র ন য় প রথম আল ক র হ ল আম ন র জন ত ক ব যবস থ সরক র র র র সদস র সরক র র ব যবস র আওয় ম গত বছর র জন য সমঝ ত বলছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

মবকে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে একে উসকে দেওয়া হয়েছে

আমাদের সমাজে মব সহিংসতা (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা) কেন ঘটছে? অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমাদের ইতিহাসে আগেও মব সহিংসতার ঘটনাগুলো ছিল। তবে এখন এটা চরম আকার ধারণ করেছে। নানা আকারে হচ্ছে। কারণগুলো বিস্তৃত। সাধারণভাবে আপনি-আমিও কোনো অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে পারি। কোনো ব্যক্তি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত দেখলে সোচ্চার হতে পারি। ওই ব্যক্তিদের পুলিশের হাতে আমরা তুলে দিতে পারি। অপরাধ প্রমাণিত হলে পুলিশ ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করবে, পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাধারণ জনগণ হিসেবে পুলিশে সোপর্দ করার দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে। তার মানে এই নয় যে যাকে অপরাধী মনে করা হচ্ছে, তাকে গণপিটুনি দেওয়া যাবে, হেনস্তা করা যাবে, নির্যাতন করা যাবে। অথচ এই জিনিসটাই করতে দেখা যাচ্ছে। আপনি একটা মানুষকে গণপিটুনি দিতে পারেন না। আর এটা করতে গিয়ে বিভিন্ন আইনি অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত অপরাধ প্রমাণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যক্তিকে অপরাধী বা আসামিও বলা যাবে না। আমাদের সংবিধান, ফৌজদারি আইন, দণ্ডবিধি—কোনো আইনে আপনাকে মব সৃষ্টি করে কারও বিচার করার অধিকার দেওয়া নেই। মবের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বরং সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়, বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। যতগুলো মব সৃষ্টি করা হয়েছে, ততবার বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এটা কোনো নাগরিকের কাম্য নয়। এটা একধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ির সামনে বসে মব তৈরি করতে দেখা গেছে। বাসার ভেতরে গিয়ে মব তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন অফিসে হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে দেখেছি। সবার আগে স্কুল-কলেজে শুরু হয়েছিল। প্রধান শিক্ষক বা জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বা প্রভাবশালী কাউকে হেনস্তা করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।

তখন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং বলা হয়েছিল, এটা মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা মনে করেছেন, এটা মব না, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এভাবে মবের ঘটনাকে অস্বীকার করে মবকে আরও উসকে দেওয়া হয়েছে। মবের মাধ্যমে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছে। মানুষ ভাবছে, বিচারব্যবস্থা খুবই দুর্বল। আমি ছেড়ে দিলে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ওই ব্যক্তি (যাকে অপরাধী ভাবা হচ্ছে) বের হয়ে যাবে। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, শাস্তি হবে না। যেটা করার আমাদেরই করতে হবে। আমাদেরই বিচার করতে হবে। মানুষ মনে করছে, বৈষম্য হচ্ছে। মানসিক হতাশা থেকে মানুষ রাস্তায় নামছে। মবের ঘটনার মধ্য দিয়ে তার অবস্থান ও মানসিক হতাশা প্রকাশ করতে চায়। মবের কোনো ঘটনার বিচার হতে দেখা যাচ্ছে না। কোনোটার বিচার দৃশ্যমান না। সে জন্য আরও বেশি ঘটনা ঘটছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও ভঙ্গুর দশায়।

মব সহিংসতার কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অনেকগুলো রাজনৈতিকভাবে পরিকল্পিত। সেগুলোকে স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাসায় ঢুকে ডাকাতি করা হয়েছে। দোকান লুটপাট করা হয়েছে। পুলিশের ভূমিকাও ছিল নিষ্ক্রিয় পর্যায়ে। পুলিশ নিজেও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। দু–একটা ঘটনায় পুলিশ নিজেও মবের শিকার হয়েছে। একটি প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, ৪৭৭ জন পুলিশ মবের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক দলে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরও কার্যকর ভূমিকা রাখা দরকার মব সহিংসতার বিরুদ্ধে। অনেক সময় কোনো অপরাধের অভিযোগে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে এলে মব সৃষ্টি করা হয়েছে ওই ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য। কেউ যখন দেখেন অপরাধ করলেও তাঁকে ছাড়িয়ে নেওয়া হবে, তখন ওই ব্যক্তি অপরাধ করতে আর ভয় পান না। শাস্তির ভয় থাকে না বলে অপরাধ করতে থাকেন।

আরও পড়ুন‘পানিও দিতে দেয় নাই’, মব তৈরি করে হত্যায় আসামি গ্রেপ্তার মাত্র ১.২৭%১১ ঘণ্টা আগে

মব সহিংসতা বন্ধে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিকদের উদ্যোগ নিতে হবে। মব সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকারকে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। মব সহিংসতার ঘটনাগুলোকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। মবের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে সরকার নির্দেশনা দিলে এবং সেই নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রচারের ব্যবস্থা নিলে মব সহিংসতা কমবে।

রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আরও সচেতন হতে হবে। তাঁদের কর্মকাণ্ড মানুষ দেখছে। সামনে নির্বাচন। সব দলকে সাধারণ মানুষ পর্যবেক্ষণ করছে। কে কী ধরনের আচরণ করছেন, তা দেখা হচ্ছে। তাই রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের মব সহিংসতার মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়ানো উচিত নয়। কোনো বড় রাজনৈতিক দল যদি ঘোষণা দেয় যে আজ থেকে তারা মবের সঙ্গে থাকবে না। তাহলে তৃণমূলের একজন কর্মী তাঁর পদ হারানোর ভয়ে ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তা করে মব সহিংসতায় জড়ানোর আগে দুবার চিন্তা করবেন।

আরও পড়ুনগাইবান্ধায় চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা০২ নভেম্বর ২০২৫

বিচারপ্রক্রিয়ার ত্রুটি দূর করতে হবে। থিওরি (তত্ত্ব) বলে, মানুষ যখন দেখে সে কোনোভাবে সমাজে তার ক্ষমতার চর্চা করতে পারছে না। পাশাপাশি দেখে যে একজন অপরাধী দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো সাজার সম্মুখীন হচ্ছে না। তখন মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। বিচারে গলদ থেকে গেলে মব সহিংসতা ঠেকানো যাবে না।

গণমাধ্যম মব সহিংসতার বিরুদ্ধে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। গণমাধ্যম মব সহিংসতার নেতিবাচক প্রভাব সহজভাবে বিশ্লেষণ করে মানুষকে বোঝাতে পারে। বিষয়গুলোকে আলোচনায় আনতে হবে। সহজভাবে বোঝালে মানুষ তা গ্রহণ করবে।

আরও পড়ুনরূপলাল-প্রদীপকে হত্যায় অংশ নেয় যারা, কী বলছে পরিবার১৯ আগস্ট ২০২৫

আমি নারী হিসেবে বলব, ধর্ষক আমার কাছে সবচেয়ে বড় অপরাধী। তারপরও বলব, ভুক্তভোগীর মতো ধর্ষকেরও আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। জনগণকে মব সহিংসতাবিরোধী অবস্থানে আসতে হবে। যেকোনো কিছু হলে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে যেন মব সহিংসতা করা না হয়। সব বিষয়ে জেনে–বুঝে সুনাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে সমাজে মব সহিংসতা ঘটবে না।

শাহারিয়া আফরিন,
সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুনপুরান ঢাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড: নিরাপত্তাহীনতায় লাল চাঁদের পরিবার, বাড়িতে মাতম১২ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ