ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম প্রতিরোধে কোনো আসনের পুরো নির্বাচন বন্ধের ক্ষমতা ফেরত চায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ইসি।

নির্বাচন কমিশনের সভা শেষে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ কথা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।

নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘আগে (অনিয়ম হলে) পুরো আসনের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা আমাদের ছিল। সেটি পরে বাদ দেওয়া হয়। এখন শুধু কেন্দ্রের ভোট বাতিল করা যায়। আমরা আবার পুরো আসনের ভোট বন্ধের ক্ষমতা ফেরত চাচ্ছি। এটা ফেরত পাওয়ার জন্য আমরা প্রস্তাব করেছি এবং আশা করি এটা ফেরত পাব।’

যে ক্ষমতা হারিয়েছে ইসি

ইসিকে নির্বাচন বাতিল করাসংক্রান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১ ধারায়। ৯১ (এ) উপধারায় বলা ছিল, ইসি যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে নির্বাচনে বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।

আরপিওর এই ধারা পরে সংশোধন করা হয়। ওই সংশোধনী ২০২৩ সালের জুলাই মাসে জাতীয় সংসদে পাস হয়। সংশোধনীতে ‘ইলেকশন’ শব্দের জায়গায় ‘পোলিং’ শব্দ স্থাপন করা হয়। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ইলেকশন’ শব্দ দিয়ে পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বোঝায়। অর্থাৎ তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সময়টা হলো ‘ইলেকশন’। আর ‘পোলিং’ হলো শুধু ভোটের দিন। ‘ইলেকশন’ শব্দটা থাকলে ভোটের আগেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারত। কিন্তু সংশোধনী পাসের কারণে ইসির ক্ষমতা খর্ব হয়। সে শুধু ভোটের দিন ভোট স্থগিত করতে পারবে।

অন্যদিকে আরপিওর ৯১ (এ) ধারা নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণার পর তা ইসির কাছে পাঠানো হয়। ইসি সচিবালয় গেজেট প্রকাশ করে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর গেজেট প্রকাশ না করা পর্যন্ত ইসি ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে কি না, সেটি পরিষ্কার ছিল না।

এ কারণে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন এই বিধানের সঙ্গে আরেকটি উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেটা হলো, কোনো অনিয়ম, জোরজবরদস্তি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ এলে নির্বাচন কমিশন কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোট বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন দিতে পারবে।

তবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভায় ইসির প্রস্তাবিত বিধানটিতে বদল এনে বলেছিল, যেসব ভোটকেন্দ্রে অভিযোগ আসবে, ইসি শুধু সেগুলোতে ভোটের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। সেভাবেই তখন আইনটি সংসদে পাস হয়। ফলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, কোনো ভোটকেন্দ্রের ফলাফল পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছে মনে করলে ইসি শুধু নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করে নতুন নির্বাচন দিতে পারে।

এমতাবস্থায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০২৩ সালের সংশোধনীর কারণে হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে চায় ইসি। আজ বৃহস্পতিবার ইসির সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পরে সংবাদ ব্রিফিংয়ে সভার সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো.

সানাউল্লাহ। তিনি জানান, সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলেও বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। কমিশনের আগামী সভায় এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হবে।

আজীবনের মামলা তথ্য সংযুক্তির চিন্তা

এ নির্বাচন কমিশনার জানান, প্রার্থীর মনোনয়নপত্রে সংযুক্ত হলফনামায় কিছু নতুন সংযুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলার বিবরণ শুধু ২০ বছর নয়, বরং সারা জীবনের তথ্য হলফনামায় যুক্ত করার বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে।

হালনাগাদ ভোটার তালিকার খসড়া শিগগির

গত ২০ জানুয়ারি শুরু হওয়া হালনাগাদ কার্যক্রমে প্রায় ৪৪ লাখ ৬ হাজার নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছেন। মৃত ভোটার শনাক্ত হয়েছে ২১ লাখের বেশি। ব্রিফিংয়ে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের আশা, আগামী সপ্তাহেই হালনাগাদ তালিকার খসড়া প্রকাশ করা সম্ভব হবে। নারী ও পুরুষ ভোটারের ব্যবধান কমে এসেছে। এটি এখন প্রায় ১৮ লাখে দাঁড়িয়েছে।

সীমানা পুনর্বিন্যাস চূড়ান্ত পর্যায়ে

৩০০টি আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। ইসি জানিয়েছে, ২২১টি আসনের বিষয়ে কোনো আপত্তি আসেনি। কারিগরি কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর খসড়া প্রকাশ করা হবে। ব্রিফিংয়ে মো. সানাউল্লাহ বলেন, ভোটার সংখ্যা ও জনসংখ্যার ভারসাম্য এনে সীমানা নির্ধারণ করা হচ্ছে। ঢাকায় খুব বেশি আসনসংখ্যার পরিবর্তন হবে না। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে ঐকমত্য কমিশনে বিশেষায়িত কমিটির মাধ্যমে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের পরামর্শ এসেছে। বাস্তবতার নিরিখে তা কতটুকু করা যাবে, তা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।

দলের নিবন্ধন যাচাই শুরু

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জমা পড়া আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই শেষে এক খসড়া করা হয়েছে। যাঁদের আবেদন কিছুটা অসম্পূর্ণ, তাঁদের ১৫ দিন সময় দিয়ে তথ্য পূরণ করতে বলা হয়েছে।

তালিকায় ‘শাপলা’ নেই

ইসি আইনজীবী প্যানেল পুনর্গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে। নতুন প্রতীক তালিকায় ‘শাপলা’ রাখা হয়নি। নাগরিক ঐক্য ও এনসিপি এই প্রতীক দাবি করলেও, তা বিবেচনায় আসেনি বলে জানান নির্বাচন কমিশনার মো. সানাউল্লাহ।

ইসি সার্ভিস ও এনআইডি সংশোধন প্রসঙ্গে

ব্রিফিংয়ে আরও জানানো হয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন সংশোধন ও ইসি সার্ভিস নামে একটি আলাদা নিয়োগ কাঠামো গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সচিব ও কর্মকর্তাদের এই কাঠামোতে নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ১৯৯১ সালের নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ আইনে কিছু সংশোধনের প্রস্তাব উঠেছে।

এ ছাড়া গত ৭ মাসে প্রায় ৯ লাখ এনআইডি সংশোধনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে, বর্তমানে মাত্র ৭৪ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে। ধর্ম পরিবর্তনসহ অন্যান্য জটিলতা কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ভ টক ন দ র স ন উল ল হ র প রস ত ব আসন র ভ ট কর মকর ত ব ত ল কর র ক ষমত র ফল ফল প রক শ আরপ ও ত করত

এছাড়াও পড়ুন:

১৩ দিনে পাঁচবার ভূমিকম্পে কাপল নরসিংদী

নরসিংদীতে আবারো ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভোর ৬টা ১৪ মিনিটে জেলার শিবপুর উপজেলায় ৪ দশমিক ১ মাত্রার হালকা ভূমিকম্পে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

গত ১৩ দিনের মধ্যে পাঁচটি ভূমিকম্প জেলার মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তারা জানান, কখন আবার ভূমিকম্প হয় সেই আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে।

আরো পড়ুন:

আবারো ভূমিকম্প অনুভূত, উৎপত্তিস্থল নরসিংদী

ঢাবিতে রবিবার থেকে অনলাইনে চলবে ক্লাস কার্যক্রম

গত ২১ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে দেশে। এর উৎপত্তিস্থলও ছিল নরসিংদীর মাধবদীতে। এতে বিভিন্ন ভবনে ফাটল ধরে এবং ১০ জনের প্রাণহানী হয়। ২২ নভেম্বর জেলার পলাশ ও মাধবদীতে ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। ২৭  নভেম্বর পলাশে ৩ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।

শিবপুরের বাসিন্দা রাশেদা বেগম বলেন, “আজ বৃহস্পতিবার সকালে হওয়া ভূমিকম্পে খুব ভয় পেয়ে যাই। বুঝতেই পারছিলাম না কী হচ্ছে। আগের দিনগুলোতেও নরসিংদীতে ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্প আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে।”

ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, “কম্পনটা খুব বেশি সময় ছিল না, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডই মনে হয়েছে অনেক লম্বা। পরিবার নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।”

স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষার্থী আফসানা বলেন, “নভেম্বর মাস থেকে ভূমিকম্প হচ্ছে। আমরা আতঙ্কে আছি।”

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা জানান, “এটি ৪ দশমিক ১ মাত্রার হালকা ভূমিকম্প। উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায়।”

নরসিংদী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন বলেন, “আজকে সকালের দিকে ভূমিকম্প হয়েছে। আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি। জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে নিরাপত্তা নির্দেশনা অনুসরণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি। মানুষের নিরাপত্তায় প্রয়োজনে আমরা সব ব্যবস্থা গ্রহণ করব।” 

গত এক মাসে দেশে উল্লেখযোগ্যভাবে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সর্বশেষ গত ১ ডিসেম্বর রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ৪ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যার উৎপত্তিস্থল ছিল মায়ানমারের মিনজিন এলাকায়। 

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউরোপিয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ইএমএসসি) জানায়, ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল ভূপৃষ্ট থেকে ৩০ কিলোমিটার। উৎপত্তি স্থল ছিল টঙ্গী থেকে ৩৩ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরপূর্বে ও নরসিংদী শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে।

ঢাকা/হৃদয়/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ