ডিসেম্বরের পরে তো প্রশ্নই আসে না বরং নির্বাচন আগে সম্ভব: আমীর খসরু
Published: 20th, April 2025 GMT
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া প্রস্তাব একত্রিত করে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো প্রকাশে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সনদে স্বাক্ষর করে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা দরকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সেটা ডিসেম্বর পর্যন্ত যাওয়ারও দরকার নেই। ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা সেটা সিদ্ধান্ত নিয়ে, আমরা জাতীয় সনদ সই করে ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন করা সম্ভব। ডিসেম্বরের পরে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না বরং আগে করা সম্ভব।’
রোববার রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে দলটির লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
বৈঠকে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বরকতউল্লা বুলু এবং গণ অধিকার পরিষদের পক্ষে দলটির সভাপতি নুরুল হক নুর, সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, সহসভাপতি ও মুখপাত্র ফারুক হাসানসহ দলটির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
আমীর খসরু বলেন, ঐকমত্য কেউ সৃষ্টি করছে না, সবাই সবার মতামত দিয়েছে, সুতরাং যেসব জায়গায় ঐকমত্য হবে, সেগুলো শুধু আমরা সংস্কারের মধ্যে নিয়ে আসব। আর যেগুলো ঐকমত্য হবে না, সেগুলো নির্বাচনের পরে যার যার ম্যান্ডেটের জন্য যাবে এবং ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে এসে এটা পাস করবে।
তিনি বলেন, ‘বুঝেশুনে না বুঝলে সেটা কোনো সমাধান না। সুতরাং অতিসত্বর আমরা সংস্কারের ঐকমত্য নির্ধারণ করে জাতীয় সনদ সই করে ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের যথেষ্ট সুযোগ রাখা আছে এবং করা সম্ভব।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ ড স ম বর র ঐকমত য
এছাড়াও পড়ুন:
কী হবে যদি গণভোটে ‘না’ জয়ী হয়
রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে সংস্কার বাস্তবায়নের রূপরেখা অনুমোদন করেছে। রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে তা ইতিমধ্যে আইনি ভিত্তি পেয়েছে। প্রধান দলগুলোর সবাই খুশি না হলেও দৃশ্যত তারা এটি মেনেই নিয়েছে। ফলে সংস্কার নিয়ে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তার আপাত সুরাহা হয়েছে বলা চলে। তবে ভবিষ্যৎ সংস্কার পুরোপুরি নির্ভর করছে গণভোটের ফলাফলের ওপর। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ এর পরিবর্তে ‘না’ জয়ী হলে কী হবে—সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। ঐকমত্য কমিশনের নয় মাসের আলোচনা, রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের চেষ্টা ভেস্তে যাবে? আপাতত এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর কারও কাছেই নেই।
‘না’ ভোট জয়ী হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী দল জুলাই সনদ মেনে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবে না। পরবর্তী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ইচ্ছার ওপরই সংস্কার নির্ভর করবে। ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই ‘সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার’ এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা’ ঘোষণা করে বিএনপি। সেই আলোকেই দলটি ভবিষ্যৎ সংস্কার এগিয়ে নিতে পারে। তা আবার জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার সঙ্গে মেলে না। অবশ্য জামায়াত জুলাই সনদের প্রায় সবগুলো সংস্কার প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে। গণভোটে ‘না’ জয়ী হলেও কি জুলাই সনদ মেনে সংস্কার করবে, নাকি নিজেদের মতো করে নতুন ফর্মুলা সামনে আনবে, তা সময়ই বলে দেবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনায় ৬টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর মধ্যে ৪৮টি প্রস্তাব সংবিধান-সংক্রান্ত। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তাবে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের ভিন্নমত আছে। ভিন্নমত সত্ত্বেও বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দল গত ১৭ অক্টোবর সনদে সই করে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়। কিন্তু সনদ ও গণভোটের আইনি ভিত্তি, সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত থেকে যায়। গত ২৮ অক্টোবর সনদ বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প সুপারিশ সরকারকে দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে গণভোটের সময় নিয়ে সিদ্ধান্তের ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।
এরপর ১৩ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রকাশ করে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট হবে একই দিনে। চারটি বিষয়ের ওপর একটি প্রশ্নে হবে গণভোট। চারটি বিষয় হলেও আসলে এর মধ্যে সংবিধান সম্পর্কিত ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাবই আছে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে আগামী সংসদ হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর পদ্ধতি) ১০০ সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। অর্থাৎ এসব সংস্কার করতে হলে অবশ্যই ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হতে হবে।
জুলাই সনদ প্রণয়নে গঠিত ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গত ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী মনোভাব দেখান, আবার প্রত্যাখ্যান হলে তা মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।
আলী রীয়াজ বলেছিলেন, ১৭৯০ থেকে শুরু করে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে ৮০০ শতাধিক গণভোট হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে গণভোট ‘ফেল’ করেছে। তিনি আরও বলেন, শঙ্কাটা অন্য জায়গায়। এত দিনের চেষ্টা, এত বিষয়ে ঐকমত্য হলো। তারপর জনগণের কাছ থেকে সেটা প্রত্যাখ্যান হয়ে গেল। সেটা মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার।
আরও পড়ুনজাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে: প্রধান উপদেষ্টা১৩ নভেম্বর ২০২৫চার প্রশ্নের উত্তর একটি, ঝুঁকি৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাব নিয়ে গণভোট হবে। প্রস্তাবগুলোকে চারটি বিষয়ে ভাগ করে একটি প্রশ্নে হবে গণভোট। গণভোটের প্রশ্নটি হবে এ রকম: ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’
ক. নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
খ. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
গ. সংসদে নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
ঘ. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
আরও পড়ুনযে চার বিষয়ে হবে গণভোট, একটি প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে মতামত১৩ নভেম্বর ২০২৫‘গণভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে মতামত জানাতে হবে। এখানেই মূল জটিলতাটা রয়ে গেছে। চারটি প্রশ্নের কোনো কোনোটিতে বিএনপি ও সমমনাদের আপত্তি আছে। জামায়াত ও সমমনাদের আপত্তি আছে অল্প কিছু বিষয়ে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝামাঝি অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। হয় জুলাই সনদ অনুসারে সংস্কার এগিয়ে নেওয়ার স্বীকৃতি দিয়ে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিতে হবে। নতুবা ‘না’ ভোটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এর ফলে ‘না’ ভোট জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেওয়া যাচ্ছে না।
রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মত হচ্ছে—কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সংস্কার প্রস্তাবের পক্ষ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল হওয়ার সুযোগ দেবে বলে মনে হয় না। ফলে তাদের সমর্থক ও ভোটারেরা ‘না’ ভোটের দিকে ঝুঁকতে পারে।
অন্যদিকে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, উচ্চকক্ষের ক্ষমতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সাংবিধানিক পদে নিয়োগের বিষয়ে বিএনপির ভিন্নমত বেশি। ফলে দলটির সমর্থকদের অনেকে ‘না’ ভোট দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এর মধ্যে গত শুক্রবার নোয়াখালীর নিজ নির্বাচনী এলাকায় এক কর্মসূচিতে গণভোটে ‘না’ ভোট দিতে আহ্বান জানান বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক।
আরও পড়ুনজুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করলেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন১৩ নভেম্বর ২০২৫সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের কী হবেজুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ অনুযায়ী, গণভোটের প্রশ্নের প্রথম বিষয় হলো: ‘নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে’।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব দলই একমত। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যে প্রক্রিয়া জুলাই সনদে রয়েছে, এর কয়েকটি ধাপ নিয়ে ভিন্নমত আছে বিএনপির।
এই পরিস্থিতিতে গণভোটে ‘না’ জয়ী হলে এবং বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গঠনের প্রক্রিয়া কীভাবে গ্রহণ করে, সেটা দেখার বিষয়। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় অপেক্ষমাণ আছে। রায়ের নির্দেশনা মানার একটা বাধ্যবাধকতা আছে। ফলে জুলাই সনদ জনগণের রায় না পেলেও উচ্চ আদালতের রায়ের বিষয়টি থাকবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে গত ১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা