ইলিশ মাছে ‘ভিটামিন এ’ ভরপুর। এর ‘ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড’ বিষণ্নতা কাটায়। এই মাছ খেলে ত্বক ও চুলে জেল্লা বাড়ে, হৃদযন্ত্রের খারাপ চর্বি দূর হয়। ক্যালসিয়াম ও আয়রন থাকায় ইলিশ খাওয়া হাড়ের জন্যও ভালো। এর পরও কখনও কি শুনেছেন, ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি মেটাতে কেউ ইলিশ খেতে চাইছে? শর্ষে ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, কড়কড়ে ইলিশ ভাজা নিয়ে কাড়াকাড়ি বরাবর রসনার তৃপ্তি মেটাতে। জাতীয় মাছ যেন পাতে জোটে তাই প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল দুই মাস ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত মোট ২২ দিন ইলিশ পরিবহন, বেচাকেনা, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকে। ইলিশ উৎপাদন এভাবে বেড়েছে বছর বছর। এ সময় জেলেদের অন্নসংস্থানে ভিজিএফ কর্মসূচিতে চাল দেওয়া হয়। যদি কেউ তখন ইলিশ ধরার চেষ্টা করে তবে আছে কঠিন শাস্তি।
ইলিশকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন চাঁদপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.
দেশে সারাবছর যে সংখ্যক ইলিশ পাওয়া যায়, তার ৫৬ শতাংশ আসে বঙ্গোপসাগর থেকে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মেলে মেঘনা অববাহিকায়; বাকি ৪ শতাংশ আসে পদ্মা নদী থেকে। কিন্তু সাগর থেকে মেঘনায় ইলিশের ঝাঁক আসার পথেই অন্তত দেড়শ ডুবোচর আছে।
২০০৮-০৯ সালে দেশে ২.৯৯ লাখ টন ইলিশ উৎপাদন হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৫.৭১ লাখ টন ইলিশ আহরণ করা হয়। গত এক যুগেরও বেশি সময়ে দেশে ইলিশের উৎপাদন ৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও ইলিশ উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে উন্নতি কম দেখা গেছে। ইলিশের জীবনচক্র কি তাহলে চ্যালেঞ্জের মুখে?
বিশ্বে ইলিশ আহরণকারী দেশ রয়েছে ১১টি– বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। এর মধ্যে বাংলাদেশ ইলিশ উৎপাদনে শীর্ষে। বিশ্বে মোট ইলিশের ৭৫-৮০ শতাংশ উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। এই ইলিশ কি আন্তঃসীমান্তীয় মাছ?
আনিছুর রহমান বললেন, ৩৩ বছরের গবেষণা জীবনে তিনি দেখেছেন, ইলিশ আন্তঃসীমান্ত এবং গভীরভাবে পরিযায়ী। ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্রধান যে অঞ্চল ইলিশ বেছে নিয়েছে সেই বঙ্গোপসাগরের লিভিং জোন থেকে এরা বড় নদনদীতে উঠে আসে। মেঘনা বেল্টে তাদের যে চলাচল, বেড়ে ওঠা; আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বৃষ্টি-বাদল কম হলেও এরা প্রজননের উদ্দেশ্যে ছুটে আসে। যদিও ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিলেও তারা প্রজনন করে।
ইলিশের পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না। এক দেশের সীমানা থেকে আরেক দেশে চলে যাবে। ভারত-মিয়ানমারে চলে যাবে বাংলাদেশের জলসীমা ছাড়িয়ে। তাই শুধু নদী নয়; নদী-সাগর-মোহনা সবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ভালো অবস্থায় রাখার কথা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
আনিছুর রহমানের মতে, সাগর থেকে মোহনা বেয়ে, যেটা মেঘনা বেল্ট বলা হয়, পদ্মা ও গঙ্গা দিয়ে ভারতে পর্যন্ত চলে যায় ইলিশ। বাংলাদেশের জলসীমা পেরিয়ে ভারতে যেতে মাছটির ২২ দিন সময় লেগে যায়। তাঁর গবেষণামতে, ইলিশ প্রতিদিন ৭২ থেকে ৭৪ কিলোমিটার স্রোতের বিরুদ্ধে নদীপথ অতিক্রমের সক্ষমতা রাখে। অবশ্য মাছটি ডিম ছাড়ে বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যেই। যদি ভারতে চলে গিয়েও ডিম ছাড়ে, ইলিশকে সেই সুযোগ দিতে হবে। কারণ সেই মাছ আবার বাংলাদেশেও আসতে পারে।
বঙ্গোপসাগরের ইলিশ বাংলাদেশের গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের হুগলি বা ভাগীরথী নদী দিয়ে এবং মিয়ানমারের ইরাবতী নদী দিয়ে উজানে যেতে থাকে। বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-ভারত একই অববাহিকার অংশ। যে কারণে ইরাবতীর ইলিশও বাংলাদেশে আসতে পারে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, ‘ইলিশের বাড়ি’ কোন নদী?
আনিছুর রহমানের বক্তব্য, বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-তুরাগ নদেও আগে ইলিশ মিলত। এখন তো অন্যান্য মাছও কমে গেছে। পদ্মা হলো প্রধান। রূপসা-বিষখালী-শিবসা-পায়রা অনেক নদী আছে। যদি উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়া যায়, প্রায় প্রতিটি জেলার নদীতে ইলিশ মিলবে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা-মেঘনার শাখানদী বা উপনদীগুলোতেও ইলিশ মিলবে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্ণফুলী, চাঁদপুর অঞ্চলে মেঘনা, খুলনা অঞ্চলে রূপসা, বরিশালে কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা, আড়িয়াল খাঁ, ভৈরব নদে ইলিশ মিলবে।
আনিছুর রহমানের নিজের বাড়ি মাগুরা। ওই অঞ্চলের নবগঙ্গা, মধুমতীসহ সুন্দরবন-সংলগ্ন নদীগুলোতে ইলিশ এখন কমে গেলেও আছে।
২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক সনদ পায় ইলিশ। দেশে পদ্মার ইলিশ হাঁক দিয়ে কেনাবেচায় বাড়তি শশব্যস্ত হয়ে ওঠে বাজার।
পদ্মার ইলিশ কেন স্বাদের হয়– এ প্রশ্নে আনিছুর রহমান বলেন, প্রমত্তা পদ্মাই তো এখন সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। নদীতে পানির পরিমাণ ও গুণগত মান ভালো রাখতে হবে। কারণ ইলিশের স্বাদের ক্ষেত্রে স্রোতের মাত্রা একটি ফ্যাক্টর।
বস্তুত, প্রতিবেশ ব্যবস্থা ঠিক থাকলে মাছের খাবার ঠিক থাকে; তখন মাছও ভালো থাকে। যে কারণে একই মাছ বিলে থাকলে এক স্বাদ, আর পুকুরে তা চাষ করলে আরেক স্বাদ। ইলিশ মাছও কোন অঞ্চলের কোন খাবার খেয়ে বড় হচ্ছে, তার ওপরে এর স্বাদ নির্ভর করে। আনিছুর বলেন, সাগরে যে ধরনের প্লাংকটন আছে, সেটা পদ্মায় নেই। আবার পদ্মার প্লাংকটন সাগরে নেই। সাগর থেকে চলে আসার পর একই ইলিশ যখন পদ্মা-মেঘনা বেল্টে চলাচল করে, তখন তার স্বাদ পাল্টে যায়। যদিও খোদ পদ্মা নদী আগের মতো না থাকায় এখন ইলিশের সেই স্বাদ মানুষ খুঁজে ফেরে।
গবেষকরা দেখেছেন, পদ্মায় গত কয়েক বছরে কমে আসছে দ্রবীভূত অক্সিজেন। ২০১৮ সালে পদ্মার পানিতে ডিও ছিল ৮ দশমিক ৭০। ২০২২ সালে ডিওর মান পাওয়া যায় ৫ দশমিক ৪১। মেঘনায় ২০১৮ সালে ডিওর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৪০, যা ২০২২ সালে কমে হয় ৬ দশমিক ৮৪। পদ্মায় ২০২২ সালে পানিতে অ্যামোনিয়ার গড় উপস্থিতি ছিল শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। মেঘনায় পানিতে ২০২২ সালে অ্যামোনিয়া হয়েছে শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ। তাহলে ইলিশ ধরা বন্ধে হম্বিতম্বির চেয়ে ইলিশের বাড়ি নদীগুলো সংরক্ষণ কি বেশি জরুরি নয়?
আনিছুর রহমান মনে করেন, শুধু ইলিশ কেন; সব মাছের জন্য নদী সংরক্ষণ জরুরি। ইলিশ নদীর মিঠাপানিতে আসছে ডিম ছাড়ার জন্য। জাটকা বড় হয়ে ফিরে যাচ্ছে সাগরে। এই যে আসা-যাওয়ার বিরাট পথ অতিক্রম করে, এটা যদি দূষিত থাকে; বালু উত্তোলনসহ নানাবিধ কারণে নষ্ট হয়ে যায়; জাটকা ধরে ফেলা হয়; পানি যথেষ্ট না হয়; সময়মতো বৃষ্টিপাত না
হয়, তাহলে ইলিশের চলাচল ও জীবনচক্র বাধাগ্রস্ত হয়।
ইলিশ একটা প্রাণী, যা নদীর সঙ্গে খুবই সম্পৃক্ত। নদী ভালো না থাকলে জুয়োপ্লাংকটন-ফাইটোপ্লাংকটন প্রভৃতি জলজ সম্পদ অর্থাৎ ইলিশ সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইলিশ গভীর পানির মাছ এবং স্বচ্ছ পানি এলেই ডিম ছাড়তে নদীতে আসতে শুরু করে। তাই ইলিশের জন্য নদীর পানির মান বৃদ্ধিতে নজর দিতে হবে।
বর্তমান সময়ে আধুনিকায়ন, যন্ত্রায়ন, ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে ওঠাসহ নানাবিধ কারণে নদী অনেক ক্ষেত্রেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, ফারাক্কা-তিস্তা ব্যারাজ; সেগুলো তো আছেই। মানুষ যেমন বাতাস না থাকলে স্থলে বাঁচতে পারে না; মাছ পানি না থাকলে বাঁচতে পারে না। সেই পানি যদি হয় দূষিত অথবা চলাচলের ক্ষেত্র কম, তাহলে মাছ থাকবে কোথায়? নদীতে পানি থাকতে হবে এবং সে পানি হতে হবে বিশুদ্ধ। তাহলেই মাছ ভালো থাকবে, ইলিশ ভালো থাকবে। বঙ্গোপসাগর অববাহিকার বাকি দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বৈঠক করা প্রয়োজন; সমন্বয় থাকা প্রয়োজন যাতে মাছের চলাচল, জীবনচক্র ও জাটকা থেকে ইলিশে পরিণত হওয়ার সুযোগ অক্ষুণ্ন থাকে।
আইরিন সুলতানা; লেখক ও পরিবেশকর্মী
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ২০২২ স ল অবব হ ক পদ ম র র জন য দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি কোথায়
বাংলাদেশে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ শব্দটি সাধারণত ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে ব্যবহার করা হয়। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালি বা মুসলমান। এই জনসংখ্যাগত বাস্তবতাই বেশির ভাগ সময় দেশের রাজনীতিতে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু জনগণনার কাগজে সংখ্যার উপস্থিতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা উন্নত জীবনে রূপ নেয় না। মানুষ আসলে কীভাবে বেঁচে আছে, তারা কোন সেবার ওপর নির্ভর করছে, কোন ধরনের বাধার মুখোমুখি হচ্ছে, এগুলো যদি আমরা দেখি, তাহলে এক ভিন্ন ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা চোখে পড়ে।
কিছু পরিসংখ্যানের ভিত্তি করে এটি লেখা হয়েছে। পরিসংখ্যানগুলো সরকারি ও আন্তর্জাতিক বিশ্বস্ত তথ্যসূত্রের ওপর ভিত্তি করে আনুমানিক হিসাব। অনেক ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট ‘সরকারি’ সংখ্যা নেই, তাই বিশ্বাসযোগ্য ডেটা থেকে যুক্তিসংগতভাবে অনুমান করা হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা কিছুটা কমবেশি হতে পারে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২.বাংলাদেশের প্রায় ১১ কোটি মানুষ (প্রায় ৬৫ শতাংশ) সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর নির্ভরশীল। তাঁরা কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগী। গ্রামীণ পরিবার, যাদের বেসরকারি চিকিৎসা নেই এবং শহরের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবার, যারা গুরুতর অসুস্থ হলে সরকারি হাসপাতালে যান (বাংলাদেশ হেলথ ফ্যাসিলিটি সার্ভে ২০১৭; বিবিএস আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২)।
১২ কোটি মানুষ (প্রায় ৭০ শতাংশ) যাঁদের শিক্ষাজীবন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। ১ কোটি ৮৬ লাখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী (প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, ২০২৩), প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ সরকারি ও আধা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজের শিক্ষার্থী (বিএএনবিইআইএস ২০২২) এবং প্রায় ৩০ লাখ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী (ইউজিসি বার্ষিক প্রতিবেদন)। পরিবারের গড় আকার ধরে এই শিক্ষানির্ভর জনগোষ্ঠী প্রায় সব জেলায় রয়েছেন।
গণপরিবহন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। সারা দেশে নিবন্ধিত ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ১০ লাখের কম যা মোট যানবাহনের ১ শতাংশের কম (বিআরটিএ ২০২২)। ফলে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ (প্রায় ৮৮ শতাংশ) বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও রিকশার মতো গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল (বিবিএস পরিবহন জরিপ ২০২০)। প্রতিদিন কর্মস্থল ও বিদ্যালয়ে যেতে তাঁরা ভিড়, অব্যবস্থা ও অনিরাপদ অবস্থার মুখোমুখি হন, কারণ, বিকল্প কোনো সাশ্রয়ী পরিবহন নেই।
বাসস্থানের চিত্রও উদ্বেগজনক। ৭ কোটি মানুষ (প্রায় ৪১ শতাংশ) অনিরাপদ বা দুর্যোগপ্রবণ ঘরে বাস করেন। ১ কোটি ৬০ লাখ শহুরে বস্তিবাসী (ইউএন-হ্যাভিটট ২০২০)। সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি গ্রামীণ মানুষ টিন, বাঁশ বা খড়ের ঘরে থাকে (বিবিএস জনশুমারি ২০২২)। প্রায় পাঁচ লাখ গৃহহীন (সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়) এবং চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়)।
বিচারব্যবস্থায় মামলার জট এখনো ভয়াবহ। সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী দেশে প্রায় ৩৭ লাখ মামলা এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। নিম্ন আদালতে বিচারকের সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন; প্রতি ১৮.৮ লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন বিচারক। আইন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, মামলার গড় সময়কাল ও জটের কারণে বিচারপ্রার্থীদের অন্তত ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ সময়মতো রায় পান না। বিশেষত জায়গা–জমি নিয়ে বিবাদ, শ্রমবিরোধ, পারিবারিক মামলা ও ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর বিলম্ব চলতে থাকে।
পরিবেশগত ঝুঁকিও প্রায় সর্বজনীন। ১৬.৫ কোটি মানুষ (প্রায় ৯৭ শতাংশ) এমন বায়ু শ্বাস নেয়, যা নিরাপদ সীমার চেয়ে অনেক বেশি দূষিত (ডব্লিউএইচও ২০২৩; ডিওই ২০২২)। প্লাস্টিক দূষণ প্রভাব ফেলে ১০ কোটি মানুষের (প্রায় ৫৯ শতাংশ) জীবনে (বিশ্বব্যাংক ২০২১; পরিবেশ অধিদপ্তর)। সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ (প্রায় ৩২ শতাংশ) নিরাপদ পানীয় জল পায় না (ডব্লিউএইচও/ইউনিসেফ জেএমপি ২০২২)।
৩.এই পরিসংখ্যানগুলো স্পষ্ট করে যে বাংলাদেশের প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো সেসব মানুষ, যারা সরকারি সেবা, গণপরিবহন, ন্যায়বিচার, বাসস্থান এবং পরিবেশগত নিরাপত্তার উপর নির্ভরশীল। এরা সেই জনগোষ্ঠী যাদের বেশির ভাগ অনানুষ্ঠানিক শ্রমজীবী বা ক্ষুদ্র স্বনিয়োজিত কর্মজীবী, প্রান্তিক উৎপাদক ও জীবিকানির্ভর পরিবার, বাস্তুচ্যুত, বেকার অথবা সহায়তানির্ভর গোষ্ঠী। এরাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ। এদের জন্য নাই উন্নত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, যোগাযোগ আর নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা। স্বাধীনতার এত বছরেও তাদের জন্য এই মৌলিক সেবাগুলোর অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিই এই সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য কাজ করত, তাহলে আজ তাদের এই অবস্থা হতো না। বাস্তবতা হলো, তারা ক্ষমতার এজেন্ডায় নেই। দলগুলো বরাবরই কাজ করেছে উচ্চবিত্ত ও সুবিধাভোগী মানুষেরর জন্য, যারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন, বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ে, বিদেশে চিকিৎসা করান এবং নিরাপদ আবাসনে থাকেন। এখানে একটি ক্ষুদ্র মধ্য ও উচ্চ আয়ের মানুষদের ‘উন্নয়ন’ নিশ্চিত করতে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত, অনিরাপদ, এবং সম্পদ থেকে বঞ্চিত।
যেসব দল নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি করে, তারা এই প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি করে না। তারা সংখ্যার রাজনীতি করে, জীবনের রাজনীতি নয়। বিশ্বপুঁজিবাদের আজকের রূপ অনুসরণ করে বাংলাদেশে যে কেবল উন্নয়নহীনতা তৈরি হয়েছে তা নয়; বরং এক নতুন রকমের ‘এক্সক্লুসিভ’ আধুনিকতা নির্মাণ করছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বাইরেই টিকে থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।
এই পুঁজিবাদ তার অন্তর্নিহিত বৈষম্য প্রবণতার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে না; বরং এটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উৎপাদন সম্পর্ক থেকে আলাদা করে একটি বহিষ্কৃত জনগোষ্ঠীতে রূপান্তর করে, যাদের কোনো নিশ্চিত অধিকার, সম্পদ কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। শুধু ভোট দেওয়ার অধিকার নয়, যত দিন এই নির্ভরশীল, বঞ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি ও জাতীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা অর্জন না করবে, তত দিন এই ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ মানুষের জীবন থেকে অবহেলা যাবে না; তাদের সংখ্যা কেবলই ক্ষমতার করিডরে অর্থহীনই থেকে যাবে।
কৌশিক আহমেদ লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। সামাজিক আন্দোলন এবং বিকল্প রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ নিয়ে কাজ করছেন।
* মতামত লেখকের নিজস্ব