জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায় সরকার, বিবেচনা করছে বিএনপি
Published: 10th, July 2025 GMT
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে চায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার, যা ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ হিসেবে আলোচিত।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এ লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিলে ৫ আগস্টের আগেই এটি চূড়ান্ত করতে চায় সরকার।
সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি জুলাই ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া বিএনপির কাছে পাঠান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায়। সরকার এই ঘোষণাপত্রে আরও কিছু বিষয় রাখতে চায়, সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত প্রয়োজন।
সরকার প্রণীত খসড়া ঘোষণাপত্রে কিছু শব্দগত মারপ্যাঁচ আছে বলে মনে করেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা। তাঁরা সেগুলোর সংশোধনের প্রস্তাব করবেন।বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, পরপর দুই দিন (মঙ্গল ও বুধবার) বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্ষদ জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় সংস্কার ও জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে জানান, এই ঘোষণাপত্রে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের উল্লেখ নেই। ঘোষণাপত্রে বিএনপি ঐতিহাসিক সব ঘটনার সংযুক্তি চাইতে পারে।
এ ছাড়া সরকার প্রণীত খসড়া ঘোষণাপত্রে কিছু শব্দগত মারপ্যাঁচ আছে বলে মনে করেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা। তাঁরা সেগুলোর সংশোধনের প্রস্তাব করবেন।
জানা গেছে, জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগের পর যুগ সংগ্রামের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। এর পরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ২০২৪ সালে কীভাবে ছাত্র-জনতার গণবিক্ষোভ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান, সে প্রসঙ্গও রয়েছে ঘোষণাপত্রের খসড়ায়। এ ছাড়া খসড়ায় জুলাই অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচার করার অভিপ্রায়ের কথাও রয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৩১ ডিসেম্বর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ তৈরির উদ্যোগ নেয়। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের আশ্বাসে ঘোষণাপত্র প্রকাশের অবস্থান থেকে ছাত্ররা সরে আসেন। তখন জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনায় আসে। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছিল। ১২ ফেব্রুয়ারি বিএনপি এ বিষয়ে তাদের প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দেয়। এরপর প্রায় পাঁচ মাস সরকারের দিক থেকে কোনো উদ্যোগ বা তৎপরতা দেখা যায়নি। পরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আন্দোলনের মুখে গত ১০ মে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এ বিষয়ে গতকাল বুধবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভার আগে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘোষণাপত্র তো ঘোষণাপত্র। এটি একটি রাজনৈতিক দলিল, যা আর্কাইভে (সংরক্ষণাগার) থাকতে পারে। তবে গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪, অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে সাংবিধানিকভাবে কোনো জায়গায় বা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে রাখা যায় কি না, সেটা আলোচনা করে দেখা হবে।’
দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চলমান সংলাপে সংবিধান, জাতীয় নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা হয়। কিছু কিছু বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এর মধ্যে গত মঙ্গলবার রাতে স্থায়ী কমিটির সভায় সংস্কার ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের বিষয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরেন সালাহউদ্দিন আহমদ। এরপর সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে নেতারা মতামত দেন। ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে সংসদে নারীদের আসন ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে। তবে তাঁরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, সে ব্যাপারে এখনো ঐকমত্য হয়নি। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, তাঁরা প্রচলিত পদ্ধতিতে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করার পক্ষে অবস্থান নেবেন।
ওই সভায় বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ মার্কিন শুল্ক আরোপের বিষয়ে বিএনপির নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এই শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্ত হয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র ন ত ছ ত র জনত র সরক র র প য় সরক র ঐকমত য ত কর র ন ত কর আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
অন্তর্ভুক্তির আগে বিচার: ঐকমত্যের নামে দায়মুক্তি নয়
৯ জুলাই বুধবার প্রথম আলোতে প্রকাশিত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদারের ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া ছাড়া ঐকমত্য কি টেকসই হবে’ নিবন্ধটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের অবতারণা করেছে।
আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের সেই প্রবন্ধে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় সমর্থক গোষ্ঠীর দলকে বাদ দিয়ে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ার চেষ্টা চলছে, তা টেকসই না-ও হতে পারে। তাঁর লেখায় দক্ষিণ আফ্রিকা, রুয়ান্ডা ও আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের তত্ত্বের আলোকে একধরনের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছে।
আমরা অবশ্যই স্বীকার করি, নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য আলোচনা ও অংশগ্রহণ জরুরি। কিন্তু জালাল উদ্দিন শিকদারের বিশ্লেষণ একটি বিপজ্জনক ভ্রান্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ‘অন্তর্ভুক্তি’ ও ‘দায়মুক্তি’র মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যকে গুলিয়ে ফেলছেন। তাঁর উপস্থাপিত আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত ও তাত্ত্বিক কাঠামো বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে কেবল অসংগতিপূর্ণই নয়; বরং তা মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার অগণিত মানুষের সঙ্গে এক নির্মম পরিহাস।
এর বিপরীতে আমাদের দেখা উচিত, কেন বর্তমান প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তির আহ্বান কেবল অবাস্তবই নয়; বরং তা একটি ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই গণতন্ত্রের জন্য আত্মঘাতী।
আরও পড়ুনঅন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া ছাড়া ঐকমত্য কি টেকসই হবে০৯ জুলাই ২০২৫দক্ষিণ আফ্রিকা ও রুয়ান্ডার শিক্ষা কীজালাল উদ্দিন শিকদার তাঁর যুক্তির সমর্থনে নেলসন ম্যান্ডেলার ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ ও রুয়ান্ডার ‘গাচাচা আদালত’–এর উদাহরণ টেনেছেন। কিন্তু তিনি এসব উদাহরণের মূল শর্তটিই এড়িয়ে গেছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসানের পর যে কমিশন গঠিত হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল ‘সত্য কথন’ ও ‘অনুশোচনা’। অপরাধীরা কেবল তখনই ক্ষমা বা সাধারণ ক্ষমার আওতায় এসেছিলেন, যখন তাঁরা জনসমক্ষে নিজেদের অপরাধের পূর্ণাঙ্গ সত্য স্বীকার করেছেন ও ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এটি ছিল ব্যক্তিপর্যায়ের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে একটি ক্ষতবিক্ষত সমাজকে নিরাময়ের প্রক্রিয়া।
প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ কি আজ পর্যন্ত তার শাসনামলের নৃশংসতার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেছে? ক্ষমা চেয়েছে? উত্তরটি সরল: ‘না’। দলটি এখনো হত্যা ও দমন–পীড়নকে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ দিয়ে ঢাকার চেষ্টায় রত। সুতরাং সত্য ও অনুশোচনাহীন প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ আফ্রিকার উদাহরণ টানা বাংলাদেশের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার শামিল।
একইভাবে রুয়ান্ডার ১৯৯৪ সালের গণহত্যার পর যে ‘গাচাচা’ নামে সামাজিক বিচারব্যবস্থা চালু হয়েছিল, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল লাখ লাখ অপরাধের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা এবং সামাজিক পুনর্মিলন ঘটানো।
কিন্তু এর পাশাপাশি রুয়ান্ডার নতুন সংবিধান ও আইনে ‘গণহত্যার আদর্শ’ (জেনোসাইডাল আইডিওলজি) প্রচারকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। যেসব রাজনৈতিক শক্তি গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের পুনরুত্থানের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। সেখানে অপরাধী কাঠামোর সঙ্গে আপস করে ঐকমত্য হয়নি; বরং অপরাধী মতাদর্শকে সমূলে উৎপাটন করে নতুন সমাজ গড়া হয়েছে।
সুতরাং তিনি যে দুটি মডেলকে ‘অন্তর্ভুক্তির’ উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন, সেগুলো আসলে ‘দায়মুক্তির’ নয়; বরং ‘ন্যায়বিচার-পরবর্তী রিকনসিলিয়েশন’ মডেল। এর মূল বার্তা হলো: আগে বিচার, সত্য উন্মোচন ও দায় স্বীকার; তারপর ক্ষমা ও পুনর্গঠন।
লাইপহার্ট, হান্টিংটন ও অনুপস্থিত ‘মিলিট্যান্ট ডেমোক্রেসি’জালাল উদ্দিন শিকদার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরেন্ড লাইপহার্টের কনসোসিয়েশনাল ডেমোক্রেসি ও স্যামুয়েল হান্টিংটনের দ্য থার্ড ওয়েভ গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছেন। লাইপহার্টের তত্ত্বটি মূলত বহুধাবিভক্ত সমাজে (যেমন ভাষা, ধর্ম বা জাতিগতভাবে বিভক্ত) স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর অভিজাতদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির কথা বলে।
কিন্তু লাইপহার্ট কখনোই বলেননি যে রাজনৈতিক শক্তি গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি, অর্থাৎ মানবাধিকার, আইনের শাসন ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর অস্বীকার করে ও সহিংসতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তাকেও ক্ষমতার অংশীদার করতে হবে।
আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ শাসনামলে এবং বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে ভয়াবহ শক্তি প্রয়োগ করে প্রমাণ করেছে যে তারা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। তাই লাইপহার্টের তত্ত্ব এখানে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক।
অন্যদিকে স্যামুয়েল হান্টিংটনও গণতান্ত্রিক উত্তরণের ক্ষেত্রে এলিটদের মধ্যে সমঝোতার কথা বলেছেন। কিন্তু সেই সমঝোতা তখনই সফল হয়, যখন পরাজিত স্বৈরাচারী শক্তি নতুন গণতান্ত্রিক ‘খেলার নিয়ম’ মেনে নিতে রাজি হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কি সেই নিয়ম মানার কোনো ইঙ্গিত দিয়েছে? তাদের নেতারা যখন প্রকাশ্যে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন করেন, তখন কি হান্টিংটনের তত্ত্ব তাঁদের জন্য রক্ষাকবচ হতে পারে? উত্তরটা সহজ: ‘না’।
এখানে লেখক অত্যন্ত জরুরি একটি তাত্ত্বিক ধারণা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন, তা হলো, ‘মিলিট্যান্ট ডেমোক্রেসি’ বা ‘আত্মরক্ষাকারী গণতন্ত্র’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্ল লোয়েনস্টাইন ধারণাটি জনপ্রিয় করেন।
এর মূল কথা হলো—গণতন্ত্রকে অবশ্যই সেই সব শক্তির বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করার অধিকার ও সামর্থ্য রাখতে হবে, যারা গণতন্ত্রের সুযোগ ব্যবহার করেই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়। এটি প্রতিশোধ নয়, গণতন্ত্রের আত্মরক্ষার একটি অপরিহার্য প্রতিরোধব্যবস্থা।
এই নীতির ভিত্তিতেই যুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানি তার সংবিধানে নব্য নাৎসি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে এবং ১৯৫২ সালে সোশ্যালিস্ট রাইখ পার্টিকে নিষিদ্ধ করে। একেবারে সাম্প্রতিক কালেও ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের ঐতিহাসিক রায়ে এই নীতির প্রতিফলন দেখা যায়।
তুরস্কের রেফাহ পার্টি কিংবা স্পেনের বাথাসুনা দলের মতো দলকে নিষিদ্ধ করার রায়কে আদালত এই যুক্তিতেই সমর্থন দিয়েছেন যে যেই দল সহিংসতাকে উসকে দেয় বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক লক্ষ্য পোষণ করে, তাকে নিষিদ্ধ করা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের অধিকার।
আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর সহিংস কর্মকাণ্ড এবং মূল দলের মানবতাবিরোধী অপরাধ কি সেই সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না?
ভোটের সংখ্যা বনাম নৈতিক বৈধতাজালাল উদ্দিন শিকদারের একটি সরল প্রশ্ন: যে দলের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটার ছিল এবং এখনো ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদের উপেক্ষা করা হবে কীভাবে?
যদিও এই ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটের সংখ্যা নিয়ে অনেক বিশ্লেষকই দ্বিমত করে থাকেন। তবু যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই তার এখনো কিছু ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু প্রশ্নটি একটি মৌলিক বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যায়—ভোটের সংখ্যা কি অপরাধের লাইসেন্স হতে পারে?
ইতিহাস এর সুস্পষ্ট উত্তর দেয়। স্পেনে নিষিদ্ধ হওয়া বাথাসুনা দলের ১০ শতাংশের বেশি ভোট ছিল। জার্মানিতে নিষিদ্ধ হওয়া নব্য নাৎসি দলেরও আঞ্চলিক নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সমর্থন ছিল (১১%-এর বেশি)। কিন্তু কোনো সভ্য রাষ্ট্রেই ভোটের শতাংশকে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি।
রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বের অধিকার শর্তহীন নয়; এটি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার শর্তে অর্জিত হয়। যে দল রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নিজ দেশের নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালায়, সে তার রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের নৈতিক ও আইনি অধিকার দুটোই হারায়।
তুরস্কের রেফাহ পার্টি বনাম রাষ্ট্র মামলায় (২০০৩) আদালত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, যে রাজনৈতিক দল সহিংসতাকে বা সহিংসতার হুমকিকে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তাকে নিষিদ্ধ করা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের কেবল অধিকারই নয়; বরং আত্মরক্ষার এক অপরিহার্য কর্তব্য।
এই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় আয়নার মতো স্বচ্ছ। যখন দেশের আদালত ভিডিও প্রমাণ সাপেক্ষে আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোকে তাদের সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে, তখন ‘ভোট আছে তাই ছাড় দিতে হবে’—এই যুক্তি তো ‘কৌতুক’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমার মতে, এখানে মূল বিভাজনটি আওয়ামী লীগ নামের অপরাধী কাঠামো ও তার সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে করতে হবে। আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী কিন্তু অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন, এমন ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিকদের নতুন কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে সংগঠিত হতে বাধা কোথায়?
এমন একটি দল করে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তারা বসতেই পারে। কিন্তু একটি অপরাধী সংগঠনকে তার পুরোনো কাঠামো, নেতৃত্বসহ ফিরিয়ে আনার দাবি প্রকারান্তরে ১০% সমর্থকের কাঁধে বন্দুক রেখে পুরো জাতিকে জিম্মি করার নামান্তর নয় কি?
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘অন্তর্ভুক্তি’র আসল অর্থজাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো যখন ‘অংশগ্রহণমূলক’ বা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচনের কথা বলে, তখন এর অর্থ এই নয় যে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত একটি দলকে বিচারের ঊর্ধ্বে রেখে নির্বাচনে সুযোগ দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক আইনের মূল ভিত্তি হলো ‘অ্যাকাউন্টেবিলিটি’ বা জবাবদিহি প্রদর্শন। জাতিসংঘের ‘রুল অব ল ফর পোস্ট কনফ্লিক্ট স্টেটস: অ্যামনেস্টিস’ নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা আছে যে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমা (অ্যামনেস্টি) গ্রহণযোগ্য নয়।
বিবিসি আইয়ের সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে ফাঁস হওয়া একটি অডিও রেকর্ডিং এই জবাবদিহির প্রশ্নকে আরও জোরালো করেছে। বিবিসি কর্তৃক যাচাইকৃত ওই রেকর্ডিংয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার’ করার এবং ‘যেখানেই তাদের পাবে, সেখানেই গুলি করার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ধরনের প্রত্যক্ষ নির্দেশনার প্রমাণ যেখানে বিদ্যমান, সেখানে ‘অন্তর্ভুক্তির’ নামে দায়মুক্তির কোনো সুযোগ থাকে না।
কাজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন অন্তর্ভুক্তির কথা বলে, তখন তারা সব বৈধ রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে একটি সুস্থ নির্বাচনী পরিবেশ বোঝায়। যে দল নিজেই নিজের বৈধতা নষ্ট করেছে, তাকে বাদ দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অগ্রহণযোগ্য বলবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং একটি অভিযুক্ত দলকে বিচার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিতে দিলে সেই নির্বাচনই আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
কারণ, তা হবে বিচারহীনতার সংস্কৃতির চূড়ান্ত উদাহরণ। অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই ঝুঁকি নেবে, এটা ভাবা কঠিন।
ঐকমত্যের ভিত্তি হোক ন্যায়বিচারবাংলাদেশের নতুন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ভিত্তি হতে হবে ন্যায়বিচার; দায়মুক্তি নয়। আওয়ামী লীগ নামে রাজনৈতিক কাঠামোটি তার কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে আলোচনার টেবিল থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
এখন তাদের স্থান রাজনৈতিক ময়দানে নয়, আদালতের কাঠগড়ায়। তাদের অপরাধের বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর, অনুশোচনা ও ক্ষমার পথ ধরে তাদের সমর্থকেরা নতুন কোনো রূপে রাজনীতিতে ফিরতেই পারেন।
কিন্তু তার আগে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক ছাড় দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা হবে জুলাই-আগস্টের শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অস্থিতিশীল ও বিচারহীন রাষ্ট্র রেখে যাওয়া।
টেকসই ঐকমত্য প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় না, এ কথা সত্য। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য হলো, ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো ঐকমত্যই টিকে থাকে না।
আরিফ রহমান গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী
*মতামত লেখকের নিজস্ব