জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায় সরকার, বিবেচনা করছে বিএনপি
Published: 10th, July 2025 GMT
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে চায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার, যা ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ হিসেবে আলোচিত।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এ লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিলে ৫ আগস্টের আগেই এটি চূড়ান্ত করতে চায় সরকার।
সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি জুলাই ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া বিএনপির কাছে পাঠান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায়। সরকার এই ঘোষণাপত্রে আরও কিছু বিষয় রাখতে চায়, সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত প্রয়োজন।
সরকার প্রণীত খসড়া ঘোষণাপত্রে কিছু শব্দগত মারপ্যাঁচ আছে বলে মনে করেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা। তাঁরা সেগুলোর সংশোধনের প্রস্তাব করবেন।বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, পরপর দুই দিন (মঙ্গল ও বুধবার) বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্ষদ জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় সংস্কার ও জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে জানান, এই ঘোষণাপত্রে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের উল্লেখ নেই। ঘোষণাপত্রে বিএনপি ঐতিহাসিক সব ঘটনার সংযুক্তি চাইতে পারে।
এ ছাড়া সরকার প্রণীত খসড়া ঘোষণাপত্রে কিছু শব্দগত মারপ্যাঁচ আছে বলে মনে করেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা। তাঁরা সেগুলোর সংশোধনের প্রস্তাব করবেন।
জানা গেছে, জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগের পর যুগ সংগ্রামের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। এর পরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ২০২৪ সালে কীভাবে ছাত্র-জনতার গণবিক্ষোভ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান, সে প্রসঙ্গও রয়েছে ঘোষণাপত্রের খসড়ায়। এ ছাড়া খসড়ায় জুলাই অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচার করার অভিপ্রায়ের কথাও রয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৩১ ডিসেম্বর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ তৈরির উদ্যোগ নেয়। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের আশ্বাসে ঘোষণাপত্র প্রকাশের অবস্থান থেকে ছাত্ররা সরে আসেন। তখন জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনায় আসে। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছিল। ১২ ফেব্রুয়ারি বিএনপি এ বিষয়ে তাদের প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দেয়। এরপর প্রায় পাঁচ মাস সরকারের দিক থেকে কোনো উদ্যোগ বা তৎপরতা দেখা যায়নি। পরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আন্দোলনের মুখে গত ১০ মে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এ বিষয়ে গতকাল বুধবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভার আগে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘোষণাপত্র তো ঘোষণাপত্র। এটি একটি রাজনৈতিক দলিল, যা আর্কাইভে (সংরক্ষণাগার) থাকতে পারে। তবে গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪, অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে সাংবিধানিকভাবে কোনো জায়গায় বা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে রাখা যায় কি না, সেটা আলোচনা করে দেখা হবে।’
দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চলমান সংলাপে সংবিধান, জাতীয় নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা হয়। কিছু কিছু বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এর মধ্যে গত মঙ্গলবার রাতে স্থায়ী কমিটির সভায় সংস্কার ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের বিষয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরেন সালাহউদ্দিন আহমদ। এরপর সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে নেতারা মতামত দেন। ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে সংসদে নারীদের আসন ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে। তবে তাঁরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, সে ব্যাপারে এখনো ঐকমত্য হয়নি। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, তাঁরা প্রচলিত পদ্ধতিতে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করার পক্ষে অবস্থান নেবেন।
ওই সভায় বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ মার্কিন শুল্ক আরোপের বিষয়ে বিএনপির নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এই শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্ত হয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র ন ত ছ ত র জনত র সরক র র প য় সরক র ঐকমত য ত কর র ন ত কর আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদের বিষয়ে নিষ্পত্তির পর ভোটের দিকে যাবে এনসিপি
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেও জুলাই সনদে এখনো স্বাক্ষর করেনি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে দলটি সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালাচ্ছে। আইনি ভিত্তি পরিষ্কার হলে এনসিপি সনদে সই করবে। এরপর তারা নির্বাচনী তৎপরতায় ঢুকবে বলে দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে।
এ বিষয়ে এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের চারজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা জানিয়েছেন, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আছে। জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করার বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এনসিপির অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হচ্ছে। ৩১ অক্টোবরের আগেই এনসিপির জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর মধ্যে গত বুধবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ চার সদস্যের প্রতিনিধিদল। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার জন্য এনসিপির প্রতি আহ্বান জানান। এনসিপির দিক থেকে আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এর পাশাপাশি জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে প্রধান উপদেষ্টাকে জারি করার দাবি জানায় এনসিপি।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি বা আইনি ভিত্তি নিয়ে ঐকমত্য কমিশন কী সুপারিশ করে এবং তার ভিত্তিতে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি দেখার জন্য এখন অপেক্ষা করছে এনসিপি।১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এনসিপির কেউ যাননি। সেদিন সকালে দলটির পক্ষ থেকে তিনটি শর্তের কথা বলা হয়েছিল। সেগুলো হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের ‘টেক্সট’ ও গণভোটের প্রশ্নটি চূড়ান্ত করে আগেই জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে; গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি জুলাই সনদে রায় দেয়, তবে নোট অব ডিসেন্টের (ভিন্নমত) কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। গণভোটের রায় অনুযায়ী, আগামী নির্বাচিত সংসদ তাদের ওপর প্রদত্ত গাঠনিক ক্ষমতাবলে সংবিধান সংস্কার করবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি বা আইনি ভিত্তি নিয়ে ঐকমত্য কমিশন কী সুপারিশ করে এবং তার ভিত্তিতে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি দেখার জন্য এখন অপেক্ষা করছে এনসিপি। তাদের শর্ত বা এর কাছাকাছি সিদ্ধান্ত যাতে সরকার নেয়, সে জন্য সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করছে দলটি। আজ শনিবার সকাল ১০টায় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এনসিপির একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করবে বলে দলটি গতরাতে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করছে এনসিপি। সনদের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে গেলে দলের নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হবে।এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীবএনসিপির নীতিনির্ধারকেরা আশা করছেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তে তাঁদের শর্তের প্রতিফলন থাকবে। সেটি হলে ৩১ অক্টোবরের আগেই তাঁরা সনদে স্বাক্ষর করবেন। এরপর দলের নির্বাচনী কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হবে।
দলটির একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, আগামী মাসের শুরুর দিকে এনসিপি কিছু দলীয় প্রার্থী ঠিক করতে পারে। তবে নির্বাচনী জোট বা সমঝোতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরও সময় লাগবে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বাইরে তৃতীয় একটি জোটে গিয়ে নির্বাচন করা অথবা এককভাবে নির্বাচন করা—এই দুটোর যেকোনো একটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সে ক্ষেত্রে কোনো কোনো বড় দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা হতে পারে।
আজ শনিবার সকাল ১০টায় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এনসিপির একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করবে বলে দলটি গতরাতে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে।এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করছে এনসিপি। সনদের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে গেলে দলের নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হবে।’