গণ–অভ্যুত্থানের পরে আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুতদের হামলায় ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের মানবসম্পদ (এইচআর) বিভাগের প্রধানসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর দৈনিক বাংলার মোড়ে আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে এই হামলা হয়। আহত ব্যক্তিদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ একাধিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

পুলিশ বলেছে, বিকেলে ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান আমির হোসেন ব্যাংক থেকে নেমে গাড়িতে ওঠার সময় আন্দোলনরত চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা তাঁকে মারধর করেন। এ নিয়ে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যাংকটির নিরাপত্তাকর্মীসহ কর্মকর্তাদের হাতাহাতি ও ইটের টুকরা নিয়ে পাল্টাপাল্টি হামলা হয়। এতে দুই পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন তদারককারী সংস্থার তদন্তে আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের নিয়োগপ্রক্রিয়ার বিভিন্ন অসংগতি ধরা পড়ে। আল–আরাফাহ্‌ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, বিষয়টি নিয়মের মধ্যে আনার লক্ষ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এর অংশ হিসেবে চিহ্নিত ১ হাজার ৪১৪ কর্মকর্তার মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে অকৃতকার্য ৫৪৭ জনকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

চাকরিচ্যুত এই কর্মকর্তারা গত ২৮ জুলাই সকালে আকস্মিকভাবে আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের প্রবেশমুখে জড়ো হয়ে মানবঢাল তৈরি করেন এবং মারমুখী আচরণ করতে থাকেন। এরপর থেকে আট দিন ধরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা একইভাবে ব্যাংকের প্রধান ফটক বন্ধ করে রাখেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের সরাতে কোনোরূপ শক্তি প্রয়োগ না করার নীতি অবলম্বন করার পরও আজ বৃহস্পতিবার হামলার ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনা তুলে ধরে আল–আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বেশ কিছুদিন ধরেই আল-আরাফাহ্‌ টাওয়ার ভবনে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য পাশের সুরমা টাওয়ারে বসার ব্যবস্থা করা হয়। আজ বিকেল চারটার দিকে ব্যাংকের তিনজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও এইচআর প্রধান আমির হোসেন সুরমা টাওয়ার থেকে নেমে গাড়িতে উঠছিলেন। চাকরিতে বহালের দাবিতে আন্দোলনকারীরা এইচআর প্রধানকে মারধর করেন। তাঁদের উদ্ধার করতে ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মীরা এগিয়ে গেলে চাকরিচ্যুত শতাধিক কর্মকর্তা লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পল্টন থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিকেল সোয়া চারটার দিকে আল–আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের তিনজন ডিএমডি ও এইচআর প্রধান ব্যাংক থেকে নেমে গাড়িতে উঠছিলেন। এ সময় ব্যাংকটির চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা তাঁদের গাড়ি ঘিরে ফেলেন। একপর্যায়ে তাঁরা এইচআর প্রধান আমির হোসেনকে মারধর করেন। এ সময় ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মীরা বাধা দেন। এতে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর হামলা চালান। এ সময় ইটের টুকরা নিয়ে দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি হামলা করে। প্রায় ২০ মিনিট এই অবস্থা চলার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন। এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ দেওয়া হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আল–আরাফাহ্‌ ব্যাংকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চাকরিচ্যুতদের আক্রমণে আহত ব্যাংকটির এইচআর বিভাগের প্রধান আমির হোসেনকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গুরুতর আহত ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী শাহিনুরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হামলাকারীদের হাত থেকে ব্যাংকের তিনজন ডিএমডিকে উদ্ধার করে পুলিশ। আহত অন্যদের মধ্যে রয়েছেন আল–আরাফাহ্‌ ব্যাংকের কর্মী লিটন (২৫), ইলিয়াস (৩৮), ফাহিম (১৯), রকি হোসেন (২৬), তোফায়েল (৩২), নুর আলম (৪২), আরিফ (২৫), জাকির হোসেন (২৫), সাগর (২৯), লুৎফর, ফারুক ও সোহেল।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ কর চ য ত কর মকর ত র ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

সংখ্যার বেড়াজালে রূপা

রূপা বাংলাদেশের একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকা অফিসের মানবসম্পদ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছে। তার হাতে সবার বেতন, ওভারটাইম, ইনক্রিমেন্ট, বাজেট, এওপিসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সংখ্যা, হিসাব, ফাইল—এসবের ভেতরেই তার অফিসের পুরোটা দিন কাটে।

অফিসের সবাই ভাবে, রূপা খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ। কিন্তু কেউ জানে না, এই ঠান্ডা মাথার আড়ালে কত চাপ, ক্লান্তি আর অগোছালো জীবনের গল্প জমে আছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে শুরু হয় রূপার ইঁদুর–দৌড়। দুই বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো, স্বামীর টিফিন, রান্না, বাসা গোছানো, অতঃপর ট্রাফিক ঠেলে অফিসে পৌঁছানো—এই সবই তাঁর নিত্যদিনের রুটিন।

অফিসে ঢুকেই শুরু হয়—‘আপা, এই মাসে বেতন কেন কম গেছে’, ‘আমার ওভারটাইমের টাকা কেন মিস হয়েছে’, ‘নতুন নিয়োগের বাজেট আপডেট কী’, ‘স্যালারি নোট কবে পাচ্ছি’, ‘ফাইনাল সেটেলমেন্ট কয়টা বাকি’, ‘কর্মী তালিকা আপডেট নেই কেন’, ‘কত সেভিংস হলো’—আরও কত শত প্রশ্ন নিয়ে অফিস শুরু হয়, তা বলে শেষ করা যাবে না। রূপা জানে, ভুল উত্তর একটাও দেওয়া যাবে না। বেতন শিটের এক লাইনে ভুল মানে কারও সারা মাসের কষ্টের মাশুল। তাই সে চুপচাপ নিজের মনে কাজ করে যায়।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, তবু কম্পিউটার স্ক্রিনের আলোয় রূপার চোখ জ্বলতে থাকে। সহকর্মীরা বাসায় চলে গেলেও সে থাকে—এক্সেল শিটের ডেটা মেলানোতে, বাজেট ট্যাব গোনে, ফর্মুলা ঠিক করে। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, জীবনটা যেন এই সংখ্যার মতো অপরিবর্তনীয়, নিসাড়, নিস্তেজ। তবুও সে থামে না। ছুটি নেওয়ার সুযোগ হয় খুব কম। বাচ্চার স্কুলে অনুষ্ঠানে যাওয়া হয় না, সামাজিক অনেক অনুষ্ঠানেও থাকতে হয় অনুপস্থিত। রূপা ভাবে, একদিন হয়তো কাজের চাপ কম থাকবে, একটু সময় করে ওঠা যাবে। সেই দিন আর আসে না।

পরের সকালে আবার ঘড়ি ধরে অফিসে যায়। সেদিন অফিসে বড়সড় ভুল ধরা পড়ল—একজন সিনিয়র সাংবাদিকের বেতন বেশি গেছে। সবাই ভয়ে স্তব্ধ। রূপাকে ডেকে মানবসম্পদের বিভাগীয় প্রধান জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ভুলটা কেমন করে হলো?’ রূপার বুক ধকধক করছে, মাথা খালি লাগছে, পা কাঁপছে, তবুও সে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি চেক করে জানাচ্ছি।’

সেদিন বাসায় ফিরে সে একা বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে—আর পারছি না। এবার একটু থামা দরকার। হাঁপিয়ে উঠেছি একদম। নিজেকে হারিয়ে ফেলছি প্রতিদিন অসংখ্য সংখ্যার মধ্যে। দিন শেষে অফিসের হিসাব তো মিলে, কিন্তু নিজের মনের হিসাব তো আর মেলে না।

পরদিন সকালে ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে ওঠে, আবারও সেই ইঁদুর–দৌড় শুরু হয়। অতঃপর শুরু হয় আগের দিনের সিনিয়র কর্মীর বেশি বেতন দেওয়ার কারণ খুঁজে বের করা। অনেক চেক করে বের হলো, ভুলটা ছিল হিসাব বিভাগের। সবাই বলে, ‘আপনি ম্যাজিক করেন এক্সেলে।’ রূপা হেসে বলে, ‘ম্যাজিক না, শুধুই মনোযোগ। আর এই মনোযোগটাই আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।’ মনোযোগ দিয়ে নির্ভুলভাবে কাজ করাটাই হচ্ছে দিন শেষের প্রাপ্তি। সাথে মেলে মনের প্রশান্তি। এই নিয়েই তো বেঁচে থাকা।

সেদিন রূপা আবার কম্পিউটারে বসে সংখ্যার মধ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু এবার সে এক মুহূর্তের জন্য থামে। নিজের ডকুমেন্টের এক কোণে লিখে ফেলে—‘আমার জীবন শুধু হিসাব না, একটা যুদ্ধ।’ পরের দিন থেকে সে নিজের ভেতর একটু বদল আনে। কাজ আগের মতোই করে, কিন্তু সময় পেলে অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। পাখিরা উড়ে যায়—যাদের কোনো পে-রোল নেই, কোনো বাজেট নেই।

মাসের শেষে বেতন শিট ফাইনাল হয়, কোনো ভুল নেই। সবাই খুশি। কিন্তু রূপার ভেতরটা ফাঁকা। রাতে বাসায় ফিরে বাচ্চাদের ঘুমন্ত মুখ দেখে সে ভাবে—সংখ্যার বাইরে এই ছোট্ট মুখগুলোর জন্যই হয়তো তার এই প্রাণপণ লড়াই। কেউ যেন আঙুল তুলে বলতে না পারে, ‘তুমি নারী, পুরুষের সমতায় কাজ করতে পারো না।’ জীবনটা কঠিন, কিন্তু হেরে যাওয়ার নয়। সংখ্যার ভেতরেও সে এখন নিজের মানে খুঁজে পায়। সংখ্যার পেছনের মানুষগুলোর প্রশান্তির হাসি, সাথে তাদের নিখাদ ভালোবাসা, আরও আছে এক ক্লান্ত কিন্তু অটল নারী—রূপা, যে কিনা নর–নারীর সমতায় বিশ্বাসী।

সঞ্চিতা সাহা, উপব্যবস্থাপক, মানবসম্পদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংখ্যার বেড়াজালে রূপা