Prothomalo:
2025-11-05@11:23:30 GMT

সংখ্যার বেড়াজালে রূপা

Published: 5th, November 2025 GMT

রূপা বাংলাদেশের একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকা অফিসের মানবসম্পদ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছে। তার হাতে সবার বেতন, ওভারটাইম, ইনক্রিমেন্ট, বাজেট, এওপিসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সংখ্যা, হিসাব, ফাইল—এসবের ভেতরেই তার অফিসের পুরোটা দিন কাটে।

অফিসের সবাই ভাবে, রূপা খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ। কিন্তু কেউ জানে না, এই ঠান্ডা মাথার আড়ালে কত চাপ, ক্লান্তি আর অগোছালো জীবনের গল্প জমে আছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে শুরু হয় রূপার ইঁদুর–দৌড়। দুই বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো, স্বামীর টিফিন, রান্না, বাসা গোছানো, অতঃপর ট্রাফিক ঠেলে অফিসে পৌঁছানো—এই সবই তাঁর নিত্যদিনের রুটিন।

অফিসে ঢুকেই শুরু হয়—‘আপা, এই মাসে বেতন কেন কম গেছে’, ‘আমার ওভারটাইমের টাকা কেন মিস হয়েছে’, ‘নতুন নিয়োগের বাজেট আপডেট কী’, ‘স্যালারি নোট কবে পাচ্ছি’, ‘ফাইনাল সেটেলমেন্ট কয়টা বাকি’, ‘কর্মী তালিকা আপডেট নেই কেন’, ‘কত সেভিংস হলো’—আরও কত শত প্রশ্ন নিয়ে অফিস শুরু হয়, তা বলে শেষ করা যাবে না। রূপা জানে, ভুল উত্তর একটাও দেওয়া যাবে না। বেতন শিটের এক লাইনে ভুল মানে কারও সারা মাসের কষ্টের মাশুল। তাই সে চুপচাপ নিজের মনে কাজ করে যায়।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, তবু কম্পিউটার স্ক্রিনের আলোয় রূপার চোখ জ্বলতে থাকে। সহকর্মীরা বাসায় চলে গেলেও সে থাকে—এক্সেল শিটের ডেটা মেলানোতে, বাজেট ট্যাব গোনে, ফর্মুলা ঠিক করে। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, জীবনটা যেন এই সংখ্যার মতো অপরিবর্তনীয়, নিসাড়, নিস্তেজ। তবুও সে থামে না। ছুটি নেওয়ার সুযোগ হয় খুব কম। বাচ্চার স্কুলে অনুষ্ঠানে যাওয়া হয় না, সামাজিক অনেক অনুষ্ঠানেও থাকতে হয় অনুপস্থিত। রূপা ভাবে, একদিন হয়তো কাজের চাপ কম থাকবে, একটু সময় করে ওঠা যাবে। সেই দিন আর আসে না।

পরের সকালে আবার ঘড়ি ধরে অফিসে যায়। সেদিন অফিসে বড়সড় ভুল ধরা পড়ল—একজন সিনিয়র সাংবাদিকের বেতন বেশি গেছে। সবাই ভয়ে স্তব্ধ। রূপাকে ডেকে মানবসম্পদের বিভাগীয় প্রধান জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ভুলটা কেমন করে হলো?’ রূপার বুক ধকধক করছে, মাথা খালি লাগছে, পা কাঁপছে, তবুও সে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি চেক করে জানাচ্ছি।’

সেদিন বাসায় ফিরে সে একা বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে—আর পারছি না। এবার একটু থামা দরকার। হাঁপিয়ে উঠেছি একদম। নিজেকে হারিয়ে ফেলছি প্রতিদিন অসংখ্য সংখ্যার মধ্যে। দিন শেষে অফিসের হিসাব তো মিলে, কিন্তু নিজের মনের হিসাব তো আর মেলে না।

পরদিন সকালে ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে ওঠে, আবারও সেই ইঁদুর–দৌড় শুরু হয়। অতঃপর শুরু হয় আগের দিনের সিনিয়র কর্মীর বেশি বেতন দেওয়ার কারণ খুঁজে বের করা। অনেক চেক করে বের হলো, ভুলটা ছিল হিসাব বিভাগের। সবাই বলে, ‘আপনি ম্যাজিক করেন এক্সেলে।’ রূপা হেসে বলে, ‘ম্যাজিক না, শুধুই মনোযোগ। আর এই মনোযোগটাই আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।’ মনোযোগ দিয়ে নির্ভুলভাবে কাজ করাটাই হচ্ছে দিন শেষের প্রাপ্তি। সাথে মেলে মনের প্রশান্তি। এই নিয়েই তো বেঁচে থাকা।

সেদিন রূপা আবার কম্পিউটারে বসে সংখ্যার মধ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু এবার সে এক মুহূর্তের জন্য থামে। নিজের ডকুমেন্টের এক কোণে লিখে ফেলে—‘আমার জীবন শুধু হিসাব না, একটা যুদ্ধ।’ পরের দিন থেকে সে নিজের ভেতর একটু বদল আনে। কাজ আগের মতোই করে, কিন্তু সময় পেলে অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। পাখিরা উড়ে যায়—যাদের কোনো পে-রোল নেই, কোনো বাজেট নেই।

মাসের শেষে বেতন শিট ফাইনাল হয়, কোনো ভুল নেই। সবাই খুশি। কিন্তু রূপার ভেতরটা ফাঁকা। রাতে বাসায় ফিরে বাচ্চাদের ঘুমন্ত মুখ দেখে সে ভাবে—সংখ্যার বাইরে এই ছোট্ট মুখগুলোর জন্যই হয়তো তার এই প্রাণপণ লড়াই। কেউ যেন আঙুল তুলে বলতে না পারে, ‘তুমি নারী, পুরুষের সমতায় কাজ করতে পারো না।’ জীবনটা কঠিন, কিন্তু হেরে যাওয়ার নয়। সংখ্যার ভেতরেও সে এখন নিজের মানে খুঁজে পায়। সংখ্যার পেছনের মানুষগুলোর প্রশান্তির হাসি, সাথে তাদের নিখাদ ভালোবাসা, আরও আছে এক ক্লান্ত কিন্তু অটল নারী—রূপা, যে কিনা নর–নারীর সমতায় বিশ্বাসী।

সঞ্চিতা সাহা, উপব্যবস্থাপক, মানবসম্পদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অফ স র র ভ তর র একট

এছাড়াও পড়ুন:

সংখ্যার বেড়াজালে রূপা

রূপা বাংলাদেশের একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকা অফিসের মানবসম্পদ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছে। তার হাতে সবার বেতন, ওভারটাইম, ইনক্রিমেন্ট, বাজেট, এওপিসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সংখ্যা, হিসাব, ফাইল—এসবের ভেতরেই তার অফিসের পুরোটা দিন কাটে।

অফিসের সবাই ভাবে, রূপা খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ। কিন্তু কেউ জানে না, এই ঠান্ডা মাথার আড়ালে কত চাপ, ক্লান্তি আর অগোছালো জীবনের গল্প জমে আছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে শুরু হয় রূপার ইঁদুর–দৌড়। দুই বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো, স্বামীর টিফিন, রান্না, বাসা গোছানো, অতঃপর ট্রাফিক ঠেলে অফিসে পৌঁছানো—এই সবই তাঁর নিত্যদিনের রুটিন।

অফিসে ঢুকেই শুরু হয়—‘আপা, এই মাসে বেতন কেন কম গেছে’, ‘আমার ওভারটাইমের টাকা কেন মিস হয়েছে’, ‘নতুন নিয়োগের বাজেট আপডেট কী’, ‘স্যালারি নোট কবে পাচ্ছি’, ‘ফাইনাল সেটেলমেন্ট কয়টা বাকি’, ‘কর্মী তালিকা আপডেট নেই কেন’, ‘কত সেভিংস হলো’—আরও কত শত প্রশ্ন নিয়ে অফিস শুরু হয়, তা বলে শেষ করা যাবে না। রূপা জানে, ভুল উত্তর একটাও দেওয়া যাবে না। বেতন শিটের এক লাইনে ভুল মানে কারও সারা মাসের কষ্টের মাশুল। তাই সে চুপচাপ নিজের মনে কাজ করে যায়।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, তবু কম্পিউটার স্ক্রিনের আলোয় রূপার চোখ জ্বলতে থাকে। সহকর্মীরা বাসায় চলে গেলেও সে থাকে—এক্সেল শিটের ডেটা মেলানোতে, বাজেট ট্যাব গোনে, ফর্মুলা ঠিক করে। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, জীবনটা যেন এই সংখ্যার মতো অপরিবর্তনীয়, নিসাড়, নিস্তেজ। তবুও সে থামে না। ছুটি নেওয়ার সুযোগ হয় খুব কম। বাচ্চার স্কুলে অনুষ্ঠানে যাওয়া হয় না, সামাজিক অনেক অনুষ্ঠানেও থাকতে হয় অনুপস্থিত। রূপা ভাবে, একদিন হয়তো কাজের চাপ কম থাকবে, একটু সময় করে ওঠা যাবে। সেই দিন আর আসে না।

পরের সকালে আবার ঘড়ি ধরে অফিসে যায়। সেদিন অফিসে বড়সড় ভুল ধরা পড়ল—একজন সিনিয়র সাংবাদিকের বেতন বেশি গেছে। সবাই ভয়ে স্তব্ধ। রূপাকে ডেকে মানবসম্পদের বিভাগীয় প্রধান জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ভুলটা কেমন করে হলো?’ রূপার বুক ধকধক করছে, মাথা খালি লাগছে, পা কাঁপছে, তবুও সে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি চেক করে জানাচ্ছি।’

সেদিন বাসায় ফিরে সে একা বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে—আর পারছি না। এবার একটু থামা দরকার। হাঁপিয়ে উঠেছি একদম। নিজেকে হারিয়ে ফেলছি প্রতিদিন অসংখ্য সংখ্যার মধ্যে। দিন শেষে অফিসের হিসাব তো মিলে, কিন্তু নিজের মনের হিসাব তো আর মেলে না।

পরদিন সকালে ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে ওঠে, আবারও সেই ইঁদুর–দৌড় শুরু হয়। অতঃপর শুরু হয় আগের দিনের সিনিয়র কর্মীর বেশি বেতন দেওয়ার কারণ খুঁজে বের করা। অনেক চেক করে বের হলো, ভুলটা ছিল হিসাব বিভাগের। সবাই বলে, ‘আপনি ম্যাজিক করেন এক্সেলে।’ রূপা হেসে বলে, ‘ম্যাজিক না, শুধুই মনোযোগ। আর এই মনোযোগটাই আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।’ মনোযোগ দিয়ে নির্ভুলভাবে কাজ করাটাই হচ্ছে দিন শেষের প্রাপ্তি। সাথে মেলে মনের প্রশান্তি। এই নিয়েই তো বেঁচে থাকা।

সেদিন রূপা আবার কম্পিউটারে বসে সংখ্যার মধ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু এবার সে এক মুহূর্তের জন্য থামে। নিজের ডকুমেন্টের এক কোণে লিখে ফেলে—‘আমার জীবন শুধু হিসাব না, একটা যুদ্ধ।’ পরের দিন থেকে সে নিজের ভেতর একটু বদল আনে। কাজ আগের মতোই করে, কিন্তু সময় পেলে অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। পাখিরা উড়ে যায়—যাদের কোনো পে-রোল নেই, কোনো বাজেট নেই।

মাসের শেষে বেতন শিট ফাইনাল হয়, কোনো ভুল নেই। সবাই খুশি। কিন্তু রূপার ভেতরটা ফাঁকা। রাতে বাসায় ফিরে বাচ্চাদের ঘুমন্ত মুখ দেখে সে ভাবে—সংখ্যার বাইরে এই ছোট্ট মুখগুলোর জন্যই হয়তো তার এই প্রাণপণ লড়াই। কেউ যেন আঙুল তুলে বলতে না পারে, ‘তুমি নারী, পুরুষের সমতায় কাজ করতে পারো না।’ জীবনটা কঠিন, কিন্তু হেরে যাওয়ার নয়। সংখ্যার ভেতরেও সে এখন নিজের মানে খুঁজে পায়। সংখ্যার পেছনের মানুষগুলোর প্রশান্তির হাসি, সাথে তাদের নিখাদ ভালোবাসা, আরও আছে এক ক্লান্ত কিন্তু অটল নারী—রূপা, যে কিনা নর–নারীর সমতায় বিশ্বাসী।

সঞ্চিতা সাহা, উপব্যবস্থাপক, মানবসম্পদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ