লালনের আখড়াবাড়িতে মানুষের ভিড়ে মুঠোফোন চুরি, আটক ৬
Published: 18th, October 2025 GMT
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন শাহর তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবে লাখো মানুষের ঢল নেমেছে। লালন স্মরণোৎসবে এমন জনসমাগম কয়েক দশকে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন বাউল, সাধক, ফকির ও লালনভক্তরা। তবে এই সুযোগে সেখানে বেশ কিছু মুঠোফোন চুরির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সন্দেহভাজন ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ।
আজ শনিবার দুপুরে বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন কুমারখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো.
আটক ব্যক্তিরা হলেন সিরাজগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কান্দাপাড়ার শামিম তালুকদার (২৮), নেত্রকোনার বারহাট্টা থানার ডেউপুর উত্তরপাড়ার সেফায়েত উল্লাহ (১৯), কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের মো. সজিব (১৯), মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রমজান আলী (২৬), ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার রাজিব মিয়া (২০) ও পাবনার চর ভবানীপুর এলাকার আবদুল মালেক (২৫)।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সকাল থেকেই কুমারখালী থানায় ভিড় করছেন ভুক্তভোগীরা।
উপজেলার সদকী ইউনিয়নের দড়ি বাটিকামারা এলাকার স্কুলশিক্ষক পলাশ কুমার বিশ্বাস বলেন, শুক্রবার রাতে লালন মেলায় গিয়ে তাঁর মুঠোফোন হারিয়ে যায়। তিনি থানায় জিডি করেছেন।
ফরিদপুরের কানাইপুর এলাকার মো. বিল্লাল বিশ্বাসও থানায় অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ভিড়ের মধ্যে একটি চক্র পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে নিচ্ছে। তাঁরটি ফোনটিও হারিয়েছে। প্রথম দিনই কয়েক শ ফোন চুরির ঘটনা ঘটেছে বলে তাঁর দাবি।
কুষ্টিয়ার এক সংগীতশিল্পী জানান, মূল মঞ্চে অনুষ্ঠান শেষে সড়কে উঠতেই তাঁর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে নেয় চোরেরা। স্থানীয় এক সাংবাদিকও একই রাতে আখড়াবাড়িতে গিয়ে ফোন হারিয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গার বুদ্ধিমানপাড়ার ব্যবসায়ী তানবিন ইসলাম রাব্বি বলেন, আখড়াবাড়ি এলাকার কয়েক কিলোমিটারজুড়ে ছিল যানজট। রাত ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে তাঁর স্মার্টফোনটি চুরি হয়েছে। ফোনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ নথি থাকায় জিডি করেছেন।
শুক্রবার রাত একটার দিকে আখড়াবাড়িতে সরেজমিনে দেখা যায়, আখড়াবাড়ি, প্রবেশপথ, মেলার মাঠসহ আশপাশের এলাকায় মানুষের ভিড়। ভিড়ের মধ্যে দায়িত্ব পালন করছিলেন একাত্তর টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান কোহিনুর ইসলাম। তিনি বলেন, এবার জাতীয়ভাবে আয়োজন থাকায় আখড়াবাড়িতে ভিড় বেশি। ভিড়ের মধ্যে কখন যে তাঁর ফোনটি চুরি হয়েছে, বুঝতে পারেননি। তিনি জানান, গত বছরও এই উৎসবে কয়েক শ ফোন চুরির ঘটনা ঘটেছিল।
উৎসবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলেও মুঠোফোন চুরির ঘটনা ঘটছে বলে জানান কুমারখালী থানার পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। এ বিষয়ে আইনি কার্যক্রম চলছে।
ফকির লালন শাহর ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে ছেঁউড়িয়ায় জাতীয়ভাবে তিন দিনব্যাপী আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও গ্রামীণ মেলার আয়োজন করেছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এ উৎসব রোববার মধ্যরাতে লালন সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ ন চ র র ঘটন আখড় ব ড় ত শ ক রব র উপজ ল র এল ক র কর ছ ন ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
বাউল–বিরোধিতার আড়ালে চলছে গ্রামের অর্থনীতি দখলের লড়াই
অগ্রহায়ণ মাস চলছে। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসেই দেশের প্রান্তিক কৃষকেরা মাঠের ধান গোলায় তোলেন। হাটে-বাজারে সেই ধান বিক্রি করে একসঙ্গে বেশ কিছু টাকা হাতে আসে কৃষকদের। চাকরিজীবীদের জীবনে ঈদের মাসে যেমন একসঙ্গে বেশ কিছু টাকা হাতে আসে, কৃষকদের জীবনে অগ্রহায়ণ মাস তেমনই। এই সময়ই তাঁরা বাড়িতে স্বজনদের দাওয়াত দেন, পিঠাপুলি বানান, নবান্ন উৎসব করেন এবং নানান সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজন করেন।
অগ্রহায়ণের শুরুতেই সাধারণত গ্রামবাংলায় শীত নেমে আসে। দিন ছোট এবং রাত দীর্ঘ হয়। দীর্ঘ রাতগুলোকে উদ্যাপন করতে আবহমানকাল ধরেই নানান সাংস্কৃতিক উৎসব করে আসছেন গ্রামবাংলার লোকেরা। এসব উৎসবে বাউলগান, পালাগান, গাজির গান, যাত্রাপালা, জলসা কিংবা মাজারগুলোতে ওরস শরিফের প্রভাব একসময় ছিল সবচেয়ে বেশি। গ্রামের বাজার অর্থনীতিতে এসব সাংস্কৃতিক ধারার মানুষদের মধ্যে বিতর্ক ও বিরোধিতা যেমন ছিল, একই সঙ্গে আবার ছিল সহাবস্থানও। ১৯৯০–এর দশক থেকে ওয়াজ মাহফিলও এই তালিকায় জায়গা করে নিতে থাকে এবং ধীরে ধীরে প্রতাপশালী হয়ে ওঠে।
মতাদর্শিক কারণেই ওয়াজ মাহফিল ওপরের সব কটি সাংস্কৃতিক ধারার বিরোধী। আর সেই বিরোধিতা প্রকাশে ওয়াজের বক্তারা কখনো রাখঢাক করেননি। শীতের মৌসুমে ওয়াজগুলোতে বাউলগান, ওরস, জলসা কিংবা যাত্রাপালার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার বিগত দশকগুলোর নিয়মিত ঘটনা। তবু এই বিরোধ বা বিষোদ্গার ছিল সামাজিক বোঝাপড়ার স্তরেই। মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কেউ মামলা–মোকদ্দমা বা সংগঠিত হামলার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু এখন সেটা করছে। কেন?
আরও পড়ুনবাউল-পালাকার-বয়াতিরা কাদের শত্রু২৩ নভেম্বর ২০২৫২.সর্বশেষ ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী দেশে মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। সেটা এখন হয়তো আরও বেড়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন বলছে, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই বাস করে ৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষ। অন্যান্য বিভাগীয় শহরের (মহানগর) জনসংখ্যাও সব মিলিয়ে ২ কোটির কাছাকাছি। এ ছাড়া দেড় কোটির মতো প্রবাসী ছড়িয়ে রয়েছেন বিশ্বের নানান প্রান্তে। মানে দেশের মোট জনসংখ্যার অন্তত ৪১ শতাংশ লোক নিশ্চিতভাবেই গ্রামে থাকেন না। থাকেন মহানগরীগুলোতে ও প্রবাসে। বাকি যাঁরা গ্রামে থাকেন, তাঁদের ভেতর নারী ও শিশুর হার বেশি। সামাজিক বাস্তবতায় গ্রামের রাত্রিকালীন আয়োজনে তাঁদের অংশগ্রহণের সুযোগ কম।
ফলে নবান্ন বা শীতের মৌসুমে এখন দেশের ৮৭ হাজার ১৯১টি গ্রামে পালাগান, ওরস শরিফ কিংবা ওয়াজ মাহফিল যা–ই হোক, তা হয় খুব অল্পসংখ্যক মানুষকে কেন্দ্র করে। ফলে এসব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির যে চাকাটি চলমান ছিল সেটি খুবই সংকুচিত হয়ে এসেছে। এই ক্ষুদ্র অর্থনীতি আর অল্প লেনদেনের ভেতরে তীব্র হয়ে উঠেছে বিবিধ সাংস্কৃতিক ধারার প্রতিযোগিতা!
দেশের অর্থনীতির শক্তিশালী ভিতগুলো এখন আর গ্রামকেন্দ্রিক নেই। অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তির আসনে বসে আছে তৈরি পোশাকশিল্প ও প্রবাসী আয়। ফলে গ্রামের উৎসবগুলো বহু আগেই লোকবল ও অর্থনৈতিক শূন্যতায় জৌলুশ হারিয়েছে। সীমিত পরিসরে তবু নানা ধারার সাংস্কৃতিক আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। মাজারগুলোতে ওরস শরিফ ও ওয়াজ মাহফিল ছাড়া প্রায় সব কটি সাংস্কৃতিক ধারাই চলছিল ধুঁকে ধুঁকে।
অবশ্য এই পরিবর্তন শুধু জনসংখ্যা বা বাজার অর্থনীতির কারণই হয়নি। টেলিভিশন ও তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়িত নতুন বিনোদনের দুনিয়াও গ্রামীণ বিনোদনের পুরোনো সাংস্কৃতিক ধারাকে অনেকটা হটিয়ে দিয়েছে। টেলিভিশন আর ইন্টারনেটের পর্দা মাঠঘাটে সংস্কৃতির অর্থনৈতিক সংগ্রামকে আরও তীব্রতর করে তুলেছে। প্রতিযোগিতার এই তীব্রতা বিবিধ ধারা সংস্কৃতির মধ্যেকার অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বকে আর বিষোদ্গারের সীমানায় আটকে রাখতে পারছে না। সম্প্রতি সেই সীমানা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। দ্বন্দ্বগুলো এখন রূপান্তরিত হয়েছে সহিংসতায়। এই সহিংসতা দেশকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক বিভাজনের পথে।
স্কুলশিক্ষার্থীরা পালা উপভোগ করছে