ব্যক্তিস্বার্থে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধের সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশন। বুধবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চার সংস্কার কমিশনের প্রধান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। এই প্রতিবেদনে দুদক মোট ৪৭টি সুপারিশ তুলে ধরেছে। 

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও আইনি সংস্কার অংশে প্রথম সুপারিশে বলা হয়েছে- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২০ (২) এইরূপভাবে প্রতিস্থাপন করতে হবে ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টি করবে, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি ব্যক্তিগত স্বার্থে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার করিতে পারবে না এবং অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ হবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক, সকল প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতর অভিব্যক্তিতে পরিণত হবে।’

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

আইনগত সহায়তা আইনের সংশোধনী কি নারীবান্ধব হলো 

নুরে জান্নাতের মায়ের সঙ্গে যখন ওর বাবার দাম্পত্য কলহ শুরু হয়, তখন সে মাতৃগর্ভে। আরও দুই মাস পর নুরে জান্নাত যখন পৃথিবীতে আসে, তখন মা–বাবা দুজনই আদালতের কাঠগড়ায়। তার মা তার বাবার বিরুদ্ধে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেন।

২০২২ সাল। আমি পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম তখন। আমার আদালতে মামলাটি শুনানির জন্য ডাক পড়ে। এক পক্ষে নুরে জান্নাতের বাবা নুরজামাল ইসলাম আর অপর পক্ষে মা আঁখি মণি। আঁখি মণির কোলে ১১ মাসের নুরে জান্নাত। আমার মনে হলো, এ মামলায় শাস্তি হলে কোনো দিন আর মা–বাবাকে একসঙ্গে পাবে না সে। আঁখি মনির সংগতিও নেই মেয়েটাকে একলা বড় করার। মনে হলো, তার মা–বাবাও চায় না আসলে এমন।

উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলি, বোঝাতে থাকি। অবশেষে বরফ গলতে শুরু করে। নুরজামাল এগিয়ে এসে হাত ধরেন আঁখি মণির। একমুহূর্তে আমার এজলাস হয়ে ওঠে পারিবারিক আনন্দের একটা অঙ্গন।

দাম্পত্য বিরোধের সফল নিষ্পত্তির এ সংবাদ ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি ‘বিচারকের মধ্যস্থতায় প্রথম মা-বাবাকে একসঙ্গে পেল ১১ মাসের জান্নাত’ শিরোনামে প্রথম আলোয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পঞ্চগড়ে এ রকম আরেকটি ঘটনা নিয়ে ২৪ এপ্রিল ২০২২ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, ‘আদালতের মধ্যস্থতায় টিকে গেল ১৭ বছরের সংসার’।

সারা দেশে দাম্পত্য কলহ নিয়ে এ রকম হাজারো ঘটনা আছে। ছোটখাটো দাম্পত্য বিরোধের জেরে স্বামী বা স্ত্রী রাগের মাথায় আদালতে মামলা করলেও শেষে আপস–মধ্যস্থতায় সমাধানের বহু নজির রয়েছে। অনেক সময় আবার স্বামীর কারাদণ্ড হলে যে অনিশ্চয়তার পড়তে হবে, সেটা ভেবেও নারীরা মামলা চালাতে চান না​। অনেক ভোগান্তির পর তখন তাঁরা আপস করার জন্য আবেদন করেন। এসব বিবেচনায় ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়েও যৌতুকের জন্য ছোটখাটো মারধর বা বিরোধের ঘটনাকে আপসযোগ্য করা হয়েছে।

যৌতুকের কারণে নির্যাতনের মামলাগুলো অনেক সময় সরাসরি আমলে না নিয়ে আদালত থেকে বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে দেওয়া হতো। এই তদন্তকালেও অনেক মামলা আপস হয়ে যেত। এসব ক্ষেত্রে শুরুতে উভয় পক্ষের মধ্যে আপস–নিষ্পত্তির সুযোগ থাকলে ভাঙন ও ভোগান্তি থেকে রক্ষা পায় পরিবারগুলো।

পৃথিবীর অনেক দেশেই মামলা করার আগে মধ্যস্থতার জন্য মধ্যস্থতাকারীর কাছে যাওয়ার বিধান রয়েছে। আমাদের দেশেও বিচারপ্রার্থী মানুষের এ দাবি ছিল অনেক দিনের।

এসব বিষয় বিবেচনা করে, আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশের অন্যতম দিক হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারায় বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা করার আগে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির বিধান।

এ অধ্যাদেশের আরেকটি বড় দিক হলো মধ্যস্থতা চুক্তির কার্যকারিতা। আগে লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত চুক্তিপত্র পক্ষদের ওপর বাধ্যকর ছিল না। ফলে তারা আপস চুক্তি লঙ্ঘন করে আবার মামলায় জড়িয়ে যেত। বর্তমান আইনে পক্ষদের মধ্যে সম্পাদিত ও চিফ লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা কর্তৃক প্রত্যায়িত মধ্যস্থতা চুক্তি চূড়ান্ত বলবৎযোগ্য এবং পক্ষদের ওপর বাধ্যকর হবে মর্মে বিধান করা হয়েছে। এর ফলে ছোটখাটো বিরোধীয় বিষয়গুলো আপস–মীমাংসার মাধ্যমে জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা ও মধ্যস্থতাকারীর দ্বারাই নিষ্পত্তি হবে। আর বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকছে।

বর্তমান অধ্যাদেশের তফসিলে যৌতুক নিরোধ আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারায় বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতন–সম্পর্কিত অভিযোগ ছাড়াও পারিবারিক আদালত আইন, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, সহকারী জজদের এখতিয়ারভুক্ত বণ্টন–সম্পর্কিত বিরোধ, অগ্রক্রয়–সম্পর্কিত বিরোধ, পিতা–মাতার ভরণপোষণ আইন, চেক ডিজঅনার–সম্পর্কিত অভিযোগ (পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অধ্যাদেশের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আমি প্রশংসা করতে শুনেছি অনেককে। হয়রানি থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে এটা একটা মাইলফলক অধ্যাদেশ হয়েছে মর্মে প্রশংসা করেছেন আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনেরা।

আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারায় যৌতুকের কারণে নির্যাতনের বিষয়টি মামলা পূর্ব মধ্যস্থতার বিধানের আওতাভুক্ত করায় সমালোচনাও করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু এটির প্রয়োজন রয়েছে। এই ধারায় প্রচুর মামলা হলেও এখন সাজা হয়েছে, এমন ঘটনা খুবই বিরল। প্রায় সব ক্ষেত্রে কয়েক বছর মামলা চলার পর ক্লান্ত বাদিনী আপস করতে চান, স্বামীর সংসারে ফিরে যেতে চান। মাঝখানে মামলায় দীর্ঘ হয়রানি ও আইনি জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় পক্ষদের, কিছু ক্ষেত্রে সংসার ভেঙে যায়।

তাই আমাদের সামাজিক পটভূমি ও বিচারের সংস্কৃতি বিবেচনায় তাই বিচার–পূর্ব মধ্যস্থতা বিরাট সুফল বয়ে আনতে পারে। আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারির ফলে এখন আর্থিক সামর্থ্য–নির্বিশেষে যেকোনো ব্যক্তি সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে বিনা মূল্যে আইনি তথ্যসেবা গ্রহণ, আইনি পরামর্শ গ্রহণ এবং বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। মামলা করার আগে মামলায় জয়–পরাজয়, লাভ–ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন।

অনেকে আছেন (বিশেষ করে নির্যাতনের শিকার নারীরা) যাঁদের প্রকৃত অধিকারের ন্যায্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু আইনি জটিলতা, সম্মানহানি ও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ভয়ে প্রতিপক্ষকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজের অধিকার ছেড়ে দেন। এমন মানুষের জন্য আদালতের কাঠগড়া নয়; বরং জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার কাছে আপস–মধ্যস্থতায় বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। এতে একদিকে যেমন রক্ষা হয় সামাজিক সম্মান, তেমনি কোনো প্রকার হয়রানি ও ঝামেলা ছাড়াই বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে। নির্যাতনের শিকার নারীদের এখন সরকারি লিগ্যাল এইডে মধ্যস্থতা পাওয়ার সুযোগ অবারিত হয়েছে বলে এ ধরনের অপরাধও কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে অধস্তন আদালত এবং উচ্চ আদালত মিলে ৪৫ লাখের মতো মামলা বিচারাধীন। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এসব মামলায় আদালতের বারান্দায় বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতার মধ্যে মামলাজট একটি বড় অন্তরায়। রায়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পরও উভয় পক্ষের মধ্যে সমস্যাগুলো জিইয়ে থাকে যুগের পর যুগ। ফলে দাদার আমলে নিষ্পত্তিকৃত বিষয়টি বংশানুক্রমে নাতিদের পর্যন্ত গড়ায়। বিচারপ্রার্থী মানুষকে দ্রুততম সময়ে কম খরচে ন্যায়বিচার প্রদান করা আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হলেও বিপুলসংখ্যক মামলার বিপরীতে বিচারকের স্বল্পতা, পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতাসহ নানান সমস্যার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

এ ক্ষেত্রে আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ মানুষের আইনি সহযোগিতা পাওয়ার পথকে অনেক দূর প্রসারিত করবে। একই সঙ্গে এটি আদালতে মামলার জট হ্রাস করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে।

মতিউর রহমান সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কর্মরত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পরিবারের দায়িত্বহীনতা অন্যতম কারণ: চসিকের তদন্ত কমিটি 
  • শাপলা না হলে ধানের শীষও রাজনৈতিক দলের প্রতীক হতে পারবে না: সারজিস
  • শাপলা না হলে ধানের শীষও প্রতীক হতে পারবে না: সারজিস আলম
  • আইনগত সহায়তা আইনের সংশোধনী কি নারীবান্ধব হলো