বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান খাদ্য ও অর্থকরী ফসল মিষ্টি আলু। পুষ্টিগুণে ভরপুর মিষ্টি আলু ভাতের বিকল্প হিসেবে শর্করার চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ২৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে এ আলুর চাষ হয়। মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ ও ‘কে’ এবং বিভিন্ন খনিজ পদার্থ আছে।

স্থানীয় জাতের মিষ্টি আলু উৎপাদনে ব্যয় বেশি হওয়া এবং বাজারে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এ ফসল চাষে কৃষকদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। 

তবে, আশার কথা হলো, মিষ্টি আলুর উৎপাদন বাড়িয়ে কৃষকদের লাভবান করতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা উদ্ভাবন করেছেন ‘বাউ মিষ্টি আলু-৫’। এটি স্থানীয় জাতের তুলনায় অধিক ফলনশীল ও লাভজনক।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম আরিফ হাসান খানের নেতৃত্বে একদল গবেষক মিষ্টি আলুর উচ্চ ফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধী নতুন জাত ‘বাউ মিষ্টি আলু-৫’ উদ্ভাবন করেছেন।

গবেষকদলের নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক এ বি এম আরিফ হাসান খান জানিয়েছেন, বাউ মিষ্টি আলু-৫ উচ্চফলনশীল জাত। এটি সাধারণ আলুর চেয়ে তিন গুণ বেশি ফলনশীল। প্রতিটি গাছে এক থেকে দেড় কেজি আলু ধরে। চারা রোপণের ৯০ দিনের মধ্যেই ফলন পাওয়া যায়। এ আলু সারা বছরই চাষ করার উপযোগী। ১০০ দিনের বেশি বয়সে সর্বোচ্চ ফলন দেয় জাতটি। সাধারণ মিষ্টির আলুর গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ২৫ টন হলেও বাউ মিষ্টি আলু-৫ হয় ৩০ টনের বেশি। 

চলতি মৌসুমে ময়মনসিংহ, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল ও খুলনায় বাউ মিষ্টি আলু-৫ এর চারা সরবরাহ করা হয়েছে। এ জাত চাষ করে অধিক ফলন পেয়েছেন কৃষকরা। 

ময়মনসিংহ সদরের কৃষক হাসান বলেছেন, “এই জাতের মিষ্টি আলু চাষ করে গড়ে প্রতি ১০ বর্গমিটারে ৩০ কেজি পর্যন্ত ফলন পেয়েছি। অনান্য স্থানীয় জাতের প্রতি গাছে ৭০০-৭৫০ গ্রাম আলু ধরলেও এই জাতের আলু ১২০০-১৫০০ গ্রাম পর্যন্ত পেয়েছি।” 

আরেক কৃষক বলেন, “আগে আমরা অনেক জমিতে মিষ্টি আলু চাষ করতাম। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও বাজারে দাম কম পাওয়ায় চাষ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এই নতুন জাতের আলু চাষ শুরু করেছি। ফলন বেশি হওয়ায় আশা করছি, লাভবান হতে পারব।” 

ফুলপুরের কৃষক মনু মিয়া বলেন, “ফুলপুরে এই প্রথম বাউ মিষ্টি আলু-৫ চাষ করে সফলতা পেয়েছি। প্রতি গাছে ২০০-৩০০ গ্রাম ওজনের ৬-৭টি পর্যন্ত আলু পেয়েছি আমি।” 

মিষ্টি আলুর নতুন জাত উদ্ভাবন দলের সদস্য স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মুন মোদক বলেছেন, “ক্রিম, বেগুনি ও কমলা— এই তিন রঙের মিষ্টি আলু জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কমলা রঙের আলু গাজরের বিকল্প হিসেবে সালাদ করে খাওয়া যায়। বেগুনি রঙের গোল আলু পুড়িয়ে খেলে দারুণ স্বাদ পাওয়া যায়। পোড়ানোর পর এতে গ্লুকোজ ও সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়। সাধারণ ক্রিম রঙের আলুগুলো সবজি হিসেবে রান্না করা যায়, আবার পুড়িয়ে ও সিদ্ধ করে খাওয়া যায়।”

প্রধান গবেষক অধ্যাপক এ বি এম আরিফ হাসান খান বলেন, “বাউ মিষ্টি আলু-৫ কম-বেশি প্রায় সারা বছরই চাষ করা যায়। তবে, রবি মৌসুমে (১৬ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ) এর ফলন ভালো হয়। মিষ্টি আলু আমিষ, জিংক, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, ভিটামিন ‘ই’, ভিটামিন ‘কে’ ও পটাশিয়ামের জোগান দিতে সক্ষম। উপযুক্ত ও অনুকূল পরিবেশে বাউ মিষ্টি আলু-৫ এর উৎপাদন প্রতি হেক্টরে সর্বোচ্চ ৪০ টন হতে পারে।”

তিনি আরো বলেন, “রোগের সংক্রমণ ও ইঁদুরের উৎপাতসহ কিছু প্রতিকূলতা থেকেই যায়। এমন অবস্থায় সর্বোচ্চ উৎপাদন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৩৩ টন পাওয়া গেছে। দেশে প্রচলিত মিষ্টি আলুর গড় উৎপাদন ১০ টনের মতো। সে হিসেবে এই নতুন জাতের মিষ্টি আলুর উৎপাদন তিন গুণের বেশি। এই জাতের চারা রোপণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো সময় হলো নভেম্বরের শেষের সময়টা। মার্চের শেষের দিকে এ আলু উত্তোলন করলে ফলন সবচেয়ে ভালো পাওয়া যায়।”

ঢাকা/লিখন/রফিক

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর চ ষ কর ফলন প র উৎপ

এছাড়াও পড়ুন:

বিসিএস নন-ক্যাডার পদের নিয়োগে কেন সংকট তৈরি হলো

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম শ্রেণির ক্যাডার এবং কারিগরি বা পেশাগত পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে থাকে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এটিই সবচেয়ে বড় নিয়োগ পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এই পরীক্ষার চাহিদা ও আকর্ষণ গত দুই-আড়াই দশকে অনেকটা বেড়েছে। বিসিএস দিয়ে নিয়োগ পাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ আগেও ছিল; কিন্তু এখন রীতিমতো একাডেমিক পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়!

বর্তমান প্রক্রিয়ায় আবেদনকারী প্রার্থীকে প্রথমে ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এখান থেকে বিজ্ঞাপিত শূন্য পদের কয়েক গুণ প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয়। এরপর লিখিত পরীক্ষায় ন্যূনতম শতকরা ৫০ ভাগ নম্বরপ্রাপ্তদের ডাকা হয় মৌখিক পরীক্ষার জন্য। তিন ধাপের পরীক্ষা পার হওয়ার পর নির্ধারিত ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি; কিন্তু এর বিপরীতে মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত পার হয়েও অসংখ্য প্রার্থী চাকরি পান না। তাঁদের জন্য সুযোগ তৈরি করতে ২০১০ সালে নন-ক্যাডার বিশেষ বিধিমালা করা হয়।

এই বিধির ফলে এক বিসিএস দিয়েই প্রার্থীরা নবম গ্রেডের ক্যাডার এবং ৯ থেকে ১২তম গ্রেডের নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ পেতে থাকেন। সিদ্ধান্তটি চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছে খুবই ইতিবাচক ছিল। কারণ, এতে তাঁদের আবেদনের খরচ এবং বারবার পরীক্ষা দেওয়ার ঝামেলা কমে যায়; কিন্তু সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে বেশিসংখ্যক চাহিদা না দেওয়ার কারণে ২৮তম থেকে ৩৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণ প্রায় ১৯ হাজার প্রার্থী কোনো চাকরি পাননি। বিসিএস পরীক্ষার দীর্ঘ প্রক্রিয়া পার হয়েও পদের অভাবে চাকরি না পাওয়াটা প্রার্থীদের জন্য ছিল হতাশার। সমস্যা সমাধানের জন্য ২০১৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণির পদেও বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।

প্রতিবছরই হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। বিসিএস পরীক্ষা নিয়মিত হলে এবং ফল প্রকাশের প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা গেলে প্রার্থীদের অকারণ অপেক্ষা করতে হয় না

৩৪তম বিসিএস থেকে প্রার্থীরা উল্লেখযোগ্য হারে নন-ক্যাডার পদ পেতে থাকেন। ৩৪তম থেকে ৪১তম বিসিএস পর্যন্ত দুই হাজারের কাছাকাছি থেকে চার হাজারের বেশি প্রার্থী নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ পান। যেমন ৪১তম বিসিএসে নন-ক্যাডার থেকে ৩ হাজার ১৬৪ জনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এর আগের ৪০তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থী ছিলেন ৪ হাজার ৩২২ জন। কিন্তু ৪৩তম বিসিএসে এই সংখ্যা নেমে হয় ৬৪২। মূলত এখান থেকেই সংকটের শুরু।

৪৩তম বিসিএসের আগের পরীক্ষাগুলোতে প্রথমে ক্যাডার পদের ফল প্রকাশ করা হতো। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী নন-ক্যাডারের ফল দেওয়া হতো। এর দরুন বেশি সংখ্যক প্রার্থী চাকরির সুযোগ পেতেন। কিন্তু ২০২৩ সালের নন-ক্যাডার বিধিতে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের চূড়ান্ত ফল একসঙ্গে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার শূন্য পদ উল্লেখের নিয়মও যুক্ত হয়েছে। এর বিরোধিতা করে একদল প্রার্থী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, এভাবে পদ উল্লেখের কারণে নির্ধারিত পদের বাইরে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। অথচ আগের নিয়মে তালিকায় থাকা বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীরা পরবর্তী বিসিএসের আগপর্যন্ত চাহিদামতো নিয়োগের সুযোগ পেতেন।

আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী, ২০২৩-এর নন-ক্যাডার বিধি বাতিল করে আগের বিধি পুনর্বহাল করা যেতে পারে। তা ছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার শূন্য পদ উল্লেখ না করে পদ তৈরির সুযোগ উন্মুক্ত রাখাই ভালো। স্বচ্ছতা বজায় রাখার স্বার্থে ক্যাডারের ফলের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ কিন্তু পদস্বল্পতার কারণে ক্যাডার হিসেবে সুপারিশ না পাওয়া প্রার্থীদের মেধাভিত্তিক তালিকা আলাদা করে প্রকাশ করা যায়। তাহলে এখান থেকেই নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে।

একেকটি বিসিএসে লাখ লাখ আবেদনকারীর মধ্য থেকে খুব সীমিতসংখ্যকই চূড়ান্ত নিয়োগের সুপারিশ পান। সর্বশেষ চূড়ান্ত ফল ঘোষিত ৪৩তম বিসিএসে আবেদন করেছিলেন ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০ জন। এর মধ্য থেকে লিখিত পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয় ১৫ হাজার ২২৯ প্রার্থীকে। লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন ৯ হাজার ৮৪১ জন। শেষ পর্যন্ত চাকরির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন মাত্র ২ হাজার ৮০৫ জন। এভাবে প্রতিটি বিসিএসেই দেখা যায়, আবেদনকারী মোট প্রার্থীর বিপরীতে মাত্র শূন্য দশমিক ৪৫ থেকে শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রার্থী চাকরির সুযোগ পান।

পিএসসি ১২তম গ্রেড পর্যন্ত নিয়োগ দিয়ে থাকে। ১৩তম থেকে ২০তম গ্রেডের নিয়োগ দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। পিএসসির সাবেক কোনো কোনো সদস্য মনে করেন, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সরাসরি নিয়োগ কমিয়ে নন-ক্যাডার নিয়োগ বাড়ানো যেতে পারে। এর ফলে বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীদের একটি অংশ ক্যাডার হতে না পারলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরে চাকরির সুযোগ পাবেন। বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগের ফলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ-বাণিজ্য কমে আসবে। এই প্রক্রিয়ায় যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থীরা বেশি হারে সুযোগ পাবেন এবং তাঁদের সময়, অর্থ ও পরিশ্রম কমবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশনে ৪ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি পদ শূন্য আছে। তবে একসঙ্গে এত পদ পূরণ করা সম্ভব নয়, এমনকি তা উচিতও হবে না। কারণ, প্রতিবছরই হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। বিসিএস পরীক্ষা নিয়মিত হলে এবং ফল প্রকাশের প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা গেলে প্রার্থীদের অকারণ অপেক্ষা করতে হয় না।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিসিএস নন-ক্যাডার পদের নিয়োগে কেন সংকট তৈরি হলো