যানজটমুক্ত ঢাকার স্বপ্ন: জুলাই থেকে নামছে ইলেকট্রিক বাস
Published: 20th, June 2025 GMT
রাজধানী ঢাকার সড়কে গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা, বাসের জন্য যাত্রীদের দুর্ভোগ যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা, অসৌজন্যমূলক আচরণ ও নিরাপত্তার সংকট সব মিলিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি আর ভোগান্তি। এই বাস্তবতা উত্তরণ হতে যাচ্ছে। আগামী ১ জুলাই থেকে ঢাকায় শুরু হচ্ছে নতুন রুট-ভিত্তিক গণপরিবহন প্রকল্প, যার লক্ষ্য শহরের যানবাহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং যাত্রীসেবাকে মানবিক ও যুগোপযোগী করা।
এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) । সমন্বিত এই উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, দুই সিটি কর্পোরেশন, বিআরটিএ ও সংশ্লিষ্ট পরিবহন সংগঠনগুলো।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “আমাদের শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা যাতায়াত। এই সমস্যা শুধু অবকাঠামো দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়; দরকার শৃঙ্খলা, সমন্বয় ও যাত্রীকেন্দ্রিক পরিকল্পনা। আমরা সেটাই করতে যাচ্ছি। ১ জুলাই থেকে যে প্রকল্প চালু হচ্ছে, তা পরীক্ষামূলক নয়; এর মাধ্যমে শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।”
আরো পড়ুন:
কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় সাবেক ছাত্রদল নেতা নিহত
ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেলের ৩ আরোহী নিহত
উপদেষ্টা বলেন, “এই উদ্যোগে শুধু ইলেকট্রিক বাস নামানোই নয়, শহরের পরিবহন ব্যবস্থাকে সময়নিষ্ঠ, নিরাপদ ও মানবিক করা হচ্ছে। সড়কে সুশৃঙ্খল চলাচলের জন্যই রুট-ভিত্তিক মডেল এবং মালিকদের সমন্বয় প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে।”
তিনি জানান, প্রকল্পের আওতায় থাকবে নির্দিষ্ট রুট-ভিত্তিক বাস, বাস থামার নির্দিষ্ট স্টপেজ, একক ডিজিটাল টিকিটিং ব্যবস্থা, বাস মালিকদের সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম, প্রশিক্ষিত চালক ও সহকারী, বাসে সিসি ক্যামেরা ও জিপিএস ট্র্যাকিং, নারী-শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যাত্রীদের জন্য নিরাপদ সেবা। শুরুতে ঢাকা শহরের চারটি নির্দিষ্ট রুটে এই ব্যবস্থা চালু হবে। পরবর্তী ধাপে বর্ধিত রুট অন্তর্ভুক্ত করে পুরো ঢাকা শহরে তা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “এত দিন আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন ও প্রতিযোগিতামূলক। এতে রাস্তায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো। এই রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল বাস্তবায়ন হলে পরিবহন ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা ফিরবে এবং নাগরিক ভোগান্তি অনেকটাই কমবে।”
তবে এই প্রকল্প নিয়ে কিছু শঙ্কাও রয়েছে। পরিবহন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, মালিকদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত এবং টিকিট রাজস্ব বণ্টনের মতো ইস্যুগুলো সমাধান না হলে প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো.
যাত্রীরাও চাইছেন এই উদ্যোগ যেন আরেকটি অসম্পূর্ণ প্রকল্পে পরিণত না হয়।
মতিঝিলের কর্মজীবী নারী সোনিয়া রহমান বলেন, “বাসের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করি। যদি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট রুটে বাস চলে এবং যাত্রীদের সম্মান দিয়ে সেবা দেওয়া হয়, তাহলে এটা অবশ্যই বড় পরিবর্তন হবে।”
নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ মেগাসিটিতে কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। ১ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া প্রকল্পটি সফল হলে এটি হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর জন্য একটি রোল মডেল।
ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মনিরুল ইসলাম বলেন, “ইলেকট্রিক বাস খুব ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটা যেন কয়েক মাস পর বন্ধ না হয়ে যায়। পুরোনো অভিজ্ঞতায় আমাদের অনেক হতাশা জমে আছে।”
তিনি বলেন, “ঢাকায় বহু প্রকল্প এসেছে, কিছু শুরু হয়ে হারিয়ে গেছে, কিছু আর বাস্তবায়নই হয়নি। তবে এই বিদ্যুৎচালিত গণপরিবহন প্রকল্প, সরকারি উচ্চপর্যায়ের সমন্বয়, আন্তর্জাতিক অর্থায়ন, এবং প্রযুক্তিনির্ভর রূপরেখাসব মিলিয়ে এই উদ্যোগে বাস্তব পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। শহর যেমন তার রাস্তা ও যানবাহনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, তেমনি তার স্বপ্ন ও সংগ্রামের ছাপ পড়ে সেখানেও। ১ জুলাইয়ের নতুন সুচনা হবে এটা প্রত্যাশা।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বায়ু দূষণের অন্যতম বড় উৎস হলো পুরোনো ডিজেলচালিত বাস। ইলেকট্রিক বাস চালু হলে শুধু শহরের যান চলাচল নয়, বাতাসও হবে পরিচ্ছন্ন।
পরিবেশ গবেষক ড. ফারজানা কবির বলেন, প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ শ্বাস নেয় কালো ধোঁয়ায়। বিদ্যুৎচালিত বাসে কার্বন নিঃসরণ প্রায় শূন্য। এটি শুধু শহরের পরিবেশ নয়, নাগরিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ২০২৫ সালে চারটি রুটে ইলেকট্রিক বাস চালু ও চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। ২০২৬ সালে অতিরিক্ত ১০০ বাস সংযোজন করা। ২০২৭ সালে দুটি চার্জিং ডিপো নির্মাণ করা। ২০২৮ সালে পুরোনো ডিজেলচালিত বাস অপসারণ শুরু করা। ২০২৯ ডিজিটাল টিকিটিং ও লাইভ ট্র্যাকিং সিস্টেমের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা। ২০৩০ সালে ৪০০ বাস ও তিনটি ডিপোসহ সব কাজ সম্পন্ন করা। এটি বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক দেবে ২ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ সরকার দেবে ৩৭৫ কোটি টাকা।
ঢাকা/এনএফ/রাসেল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সড়ক পর বহন পর ব শ গণপর বহন প রকল প র জন য র র পর র পর ব শহর র সমন ব সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ: এক ব্যক্তির ক্ষমতার মেরুদণ্ড
বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হচ্ছে ৭০ অনুচ্ছেদ। বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নের কাল থেকেই এই অনুচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা চলে আসছে। ‘লোভে পড়ে ব্যক্তিস্বার্থে’ সংসদ সদস্যরা তাঁদের ভোট বিক্রি করতে পারেন—এমন আশঙ্কা এবং ‘গণতন্ত্রের সঙ্গে স্থিতিশীল সরকার দরকার’—এমন বাসনা দিয়ে এই অনুচ্ছেদের পক্ষে অজুহাত দেওয়া হয়।
কিন্তু গত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দাবি করতে পারি, স্থিতিশীল সরকারের বাসনা থেকে যে অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছিল, তা স্থিতিশীল সরকার গঠনে ভূমিকা রাখা দূর কি বাত, উল্টো গণতন্ত্রকে একেবারে কাঠামগত ধ্বংস করতেই অধিক ভূমিকা পালন করেছে।
সংসদের ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চাকে গলা টিপে হত্যা করে আদৌ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম সম্ভব কি না, যে শঙ্কা বাহাত্তরেই দেখা দিয়েছিল, আমরা গত ৫০ বছরে অজস্র জীবনের বিনিময়ে সেই সত্য উপলব্ধি করার সক্ষমতা অর্জনের কথা ছিল। কিন্তু এখনো ৭০ অনুচ্ছেদের পক্ষে অনেকেই অবস্থান নিচ্ছেন, দুঃখজনক হলেও সত্য। তাঁরা এখনো বুঝতে পারছেন না, যে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামো শেখ হাসিনার মতো ভয়াবহ স্বৈরাচারের জন্ম দিয়েছে, এর মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে ৭০ অনুচ্ছেদ।
তৈরির প্রেক্ষাপটমুক্তিযুদ্ধের পরপর স্বাধীন বাংলাদেশে গণপরিষদ শুরুই হয়েছিল ‘সদস্যপদ খারিজ আদেশ-১৯৭২’ জারির মাধ্যমে। সেই আদেশে বলা হয়, ‘কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে এবং ওই দলের সদস্যপদ লাভ করে কোনো ব্যক্তি গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা ওই দল থেকে বহিষ্কৃত হন, তবে তাঁর মেয়াদকালের অসমাপ্ত সময়ের জন্য তিনি আর পরিষদ সদস্যপদে থাকবেন না।’
আবার সেই আদেশের মাধ্যমে সংগঠিত কর্মের রক্ষাকবচ হিসেবে যুক্ত করা হয়, ‘এই আদেশের অধীন প্রণীত কোনো আদেশ বা গৃহীত কোনো ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো আদালত কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবেন না।’
বিষয়টি পরে ৭০ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল ১৯৭২ সালেই। একদিকে শেখ মুজিব এর পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছিলেন, ‘অনেকেই লোভে পড়ে ব্যক্তিস্বার্থে এদিক-ওদিক করে। সুষ্ঠুভাবে দেশ চালাতে গেলে গণতন্ত্রের সঙ্গে স্থিতিশীল সরকার দরকার। অন্যদিকে খোদ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের অনেকেই বলেছিলেন, ‘এ ব্যবস্থা সর্বপ্রকার গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থী।’
অর্থাৎ সংসদ সদস্যরা যে রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই দলের প্রস্তাবিত যেকোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত অকপটে মেনে নিতে বাধ্য করে ৭০ অনুচ্ছেদ। কেউ যদি এর ব্যত্যয় ঘটান, তাহলে এর পরিণাম খুব কঠোর, তাঁদের আসনই শূন্য হয়ে যায়।
এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে যে সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে এবং প্রধানমন্ত্রী যে অসীম ক্ষমতা পেয়ে যান, সেটা নিয়ে ১৯৭২ সাল থেকেই তীব্র সমালোচনা চলে আসছে।
দীর্ঘ উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের পথ ধরে রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান যাঁরা তৈরি করেছেন, সেই গণপরিষদের সদস্যদের যে রকম মতামত প্রকাশের ‘স্বাধীনতা’ থাকার কথা ছিল, শুরুতেই তা দেওয়া হয়নি।
পুরো গণপরিষদের কর্তৃত্ব আওয়ামী লীগের আয়ত্তে থাকার পরও গণপরিষদের (নিজ দলের পরিষদ মেম্বার) কাছ থেকে তার স্বাভাবিক মতামত দেওয়ার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এর ফলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধারা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অকার্যকর করা এবং অনুশীলনের শুরু হয় একদম প্রথম দিন থেকেই।
ব্যবহারের ফলাফলসংসদ সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে যান প্রধানত আইন তৈরির উদ্দেশ্যে। নির্বাহী বিভাগ কোন আইনের আওতায় দেশ চালাবে, সেটা ঠিক করে দেওয়া, অর্থাৎ আইন তৈরি করাই তাঁদের প্রধান কাজ। পাশাপাশি সরকার চালাতে যে টাকাপয়সা দরকার, তা জনগণের কাছ থেকে কতটুকু ও কীভাবে আদায় করা হবে এবং কোন কোন খাতে সেগুলো ব্যয় করা হবে, অর্থাৎ বাজেট প্রণয়ন করাও সংসদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেই সঙ্গে নির্বাহী বিভাগ আইন মেনে কাজ করছে কি না, মন্ত্রণালয়গুলো বাজেট ঠিকভাবে খরচ করছে কি না, কোথাও দুর্নীতি–লুটপাট–অপচয় হচ্ছে কি না, তার ওপর নজরদারি করবে এবং সরকারের কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা বিপথে গেলে জবাবদিহি করবে—এগুলোও সংসদের কাজ।
কিন্তু বাংলাদেশের সাংবিধানিক বন্দোবস্তে একই সঙ্গে দলের প্রধান, সরকারপ্রধান ও সংসদনেতা হতে বাধা নেই। তাই ৭০ অনুচ্ছেদ থাকার ফলে দলের কোনো সিদ্ধান্তের (আদতে দলের প্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর) বিরোধিতা করার সুযোগ কোনো সংসদ সদস্যের নেই। তাই সংসদে কী আইন বানানো হবে, বাজেট কেমন হবে, বাজেটের খরচের জবাবদিহি করা যাবে কি না, এমনকি লুটপাট–অপচয় করলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কি না—সবই নির্ভর করে একজনের, মানে প্রধানমন্ত্রীর, ওপর। জনগণের সরাসরি ভোটে ‘নির্বাচিত’ বাকি সংসদ সদস্যদের শুধু আজ্ঞাবহ হিসেবে ‘হ্যাঁ-না’–এর বাইরে কিছু বলার বা করার সুযোগ থাকে না। এমনকি সংসদ সদস্যদের তাঁদের নির্বাচনী এলাকার স্বার্থের প্রতিনিধিত্বও করতে বাধা প্রদান করে এই অনুচ্ছেদ। অতএব ৭০ অনুচ্ছেদসহ ওই পার্লামেন্টকে ‘রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট’ বলাই যায়!
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাগত ৫৪ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বাহাত্তরের সাংবিধানিক বন্দোবস্তে যে দল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতবে, সেই দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধান হবেন। আবার তিনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সংসদনেতাও হবেন।
৭০ অনুচ্ছেদের বলে তিনি একক সিদ্ধান্তে আইন বানাবেন, বাজেট তৈরি করবেন, বাজেট ইচ্ছেমতো খরচ করবেন, রাষ্ট্রপতি নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষমতা পাবেন, রাষ্ট্রপতির হাত দিয়ে বিচারক ও বিচারপতি এবং সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষমতা পাবেন।
আবার তাঁর কাছে যদি দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য থাকে, তাহলে তিনি সংবিধান পরিবর্তনেরও ক্ষমতার অধিকারী হবেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যাঁরা সংসদে যাবেন, ওই সংসদ পরিচালনা করার জন্য দিনে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে যে জনগণ; তাদের প্রতিনিধিদের আইন তৈরি, বাজেট প্রণয়ন, সরকারের ওপর নজরদারি, সরকারের জবাবদিহিসহ সব ক্ষেত্রে স্বাধীন মতামত দিতে পারার সুযোগ থাকতে হবে।
আবার এটাও ঠিক, স্বাধীন মতামতের সুযোগ নিয়ে যেন হরহামেশা সরকার পরিচালনায় অচলায়তন এবং অনাস্থা ভোটের নামে হর্স ট্রেডিং না হয়। পাশাপাশি হর্স ট্রেডিংয়ের দোহাই দিয়ে সংসদে একনায়কতন্ত্র বহাল রাখার চেষ্টা করাও হবে সময়ের বহু বহু পেছনে হাঁটা। তাই বর্তমান সময়ের উপযোগী মধ্যবর্তী সমাধান খুঁজতে হবে আমাদের।
সম্ভাব্য সমাধান৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার করে সংসদ কার্যকর ও গণতান্ত্রিক করার সমাধান দুনিয়াতে রয়েছে। এর একটা সমাধান বা সংস্কার প্রস্তাবনা সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাবও করেছে। তারা বলেছে, ‘অর্থবিল ব্যতীত নিম্নকক্ষের সদস্যদের তাঁদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।’
অর্থাৎ অর্থবিল বাদে সব ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারবেন; এমনকি নিজ দলের বিপক্ষেও। যেহেতু নিজ দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ভোট দিলে দলের ভেতর চাপে পড়ার বা কোণঠাসা হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই ভোটদানের পদ্ধতি প্রকাশ্যে মৌখিক ‘হ্যাঁ-না’–এর পরিবর্তে গোপন ব্যালট বা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে করা যেতে পারে।
শেষ কথাবাংলাদেশের ১৯৭২ সালের যে সংবিধান, তার ক্ষমতাকাঠামোর বাকি সবকিছু ঠিক রেখে শুধু ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার করলেই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হবে না। রাষ্ট্রের সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তর করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করা একটা সামগ্রিক কাজ। বিচ্ছিন্ন দু–একটা কাজ করে কোনোভাবেই রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করা যাবে না। তবে যেসব জায়গায় অবশ্যই সংস্কার করতে হবে, তার মধ্যে প্রধান প্রধান জায়গার অন্যতম ৭০ অনুচ্ছেদ। কারণ, এই অনুচ্ছেদ হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার মেরুদণ্ড!
ফরিদুল হক যুগ্ম সদস্যসচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।