২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় নারায়ণগঞ্জ জেলায় পাসের হার মাত্র ৫২ শতাংশ, যা ঢাকা বোর্ডের ৬৪ শতাংশ এবং জাতীয় গড় ৫৮ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। জেলার শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ফলাফল শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের “বিপর্যয়” সৃষ্টি করেছে।

এই পরিস্থিতি উত্তরণে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জেলার বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে এক বিশেষ মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। জেলা শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। 

শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, এইচএসসি ফল বিপর্যয় নিয়ে দেশে এ ধরনের উদ্যোগ এটিই প্রথম। মতবিনিময় সভায় নারায়ণগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ড.

ফজলুল হক রুমন রেজা মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

তিনি বলেন, করোনাজনিত শিখন ঘাটতি, শিক্ষার্থীদের ক্লাস বিমুখতা, মোবাইল আসক্তি ও কোচিং নির্ভরতা এই খারাপ ফলাফলের মূল কারণ। করোনা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় শিক্ষার মানে স্থায়ী ক্ষতি হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি আরও বলেন, “অটো পাস ও সিলেবাস সংকোচনের ধারাবাহিকতা শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি অনাগ্রহ বাড়িয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ২০২৪ সালের সহিংস ঘটনাবলিও শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে।”

জেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, ইংরেজি, আইসিটি ও হিসাববিজ্ঞানে সর্বাধিক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। তারা বলেন, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংকট, শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি এবং দুর্বল ক্লাস পরিবেশ এর অন্যতম কারণ।

এছাড়া নির্বাচনী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণে রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপও ফলাফলকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। কিছু শিক্ষক সিন্ডিকেটভিত্তিক কোচিং কার্যক্রম পরিচালনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও মনোযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠে।

সমাধানের প্রস্তাব হিসেবে অধ্যক্ষ রুমন রেজা বলেন, “শিখন ঘাটতি পূরণে রিমিডিয়াল ক্লাস চালু, ক্লাসে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ এবং কোচিং নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করলেই এই সংকট কাটানো সম্ভব।”

তিনি কর্মজীবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ক্লাস বা অনলাইন পাঠের ব্যবস্থার আহ্বান জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলেন, “নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফলাফল, পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করে শিক্ষা খাতে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করা জরুরি।”

তিনি আরও প্রস্তাব করেন, জেলা শিক্ষা অফিসের তত্ত্বাবধানে একটি ‘নারায়ণগঞ্জ শিক্ষা উন্নয়ন টাস্কফোর্স’ গঠন করা হোক, যা নিয়মিতভাবে ফলাফল পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন ও সুপারিশ প্রকাশ করবে।

তিনি বলেন, “ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা দূর করতে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন।”

সভায় উপস্থিত একজন অভিভাবক বলেন, “স্কুল হচ্ছে শিক্ষা বিস্তারের কারখানা। কিন্তু অনেক সময় শিক্ষকরা ডাকলেও আমরা অভিভাবকরা যাই না। আমাদের উচিত সন্তানরা ঠিকমতো স্কুলে যাচ্ছে কিনা—তা খোঁজ নেওয়া। শিক্ষকদেরও উচিত শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া।”

সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, “নারায়ণগঞ্জে ২২ হাজার এইচএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১১ হাজার ফেল করেছে। এই চিত্র আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমাদের মতো দেশে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হলে, সেই বোঝা আমরা কীভাবে বহন করব?”

তিনি আরও বলেন, “আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়, দায়িত্ব নিতে চাই। এমন প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই, যেখানে শিক্ষা হবে আনন্দের, উৎসবের। শুধু পাশ করানো নয়, আমরা চাই প্রকৃত মানুষ তৈরি করতে।”

অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “সন্তানদের শুধু শিক্ষকের হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না। আপনাদেরও সময় দিতে হবে, নজর রাখতে হবে।”

শিক্ষা ব্যবস্থার বিদ্যমান সমস্যা স্বীকার করে তিনি বলেন, “এসব সমস্যা ধীরে ধীরে সমাধান করা হবে।”

শিক্ষকদের উদ্দেশে জেলা প্রশাসক বলেন, “আমরা যাদের পড়াচ্ছি, তারা কি আমাদের অনুকরণ করছে? আমরা কি অনুসরণীয় হতে পারছি? আমি বললেই সম্মান আসবে না; যোগ্যতা ও ভালোবাসা অর্জন করতে হবে।”

তিনি যোগ করেন, “আমাদের শিক্ষকরা যোগ্য, তবে আন্তরিকতা আরও বাড়াতে পারলে সমাজের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব।”

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, “শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ যদি একসাথে কাজ করতে পারে, তাহলে এই ফল বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব।”

বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবির বলেন, “ম্যানেজিং কমিটিতে অশিক্ষিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির দায় শিক্ষা বোর্ডের নয়। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে যে নামগুলো আমাদের কাছে আসে, আমরা শুধু অনুমোদন দিই। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেরই জানা উচিত কারা শিক্ষিত ও যোগ্য।”

প্রধান অতিথি হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শোয়াইব আহমাদ খান বলেন, “করোনা ও ছাত্রদের গণঅভ্যুত্থানের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছে।”
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “পৃথিবীর কোনো দেশে পাবলিক পরীক্ষার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ মোতায়েন করতে হয় না।”

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি ও অভিভাবকরা একসঙ্গে কাজ করলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত উন্নয়নের পথে ফিরবে।

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. আ.ফ.ম. মশিউর রহমান, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুকুল ইসলাম রাজিব, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম সুজন, নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি আবু সাউদ মাসুদ, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা মাইনুদ্দীন, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু এবং ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মহানগর সভাপতি মুফতি মাসুদ বিল্লাহ প্রমুখ।
 

উৎস: Narayanganj Times

কীওয়ার্ড: ন র য়ণগঞ জ ন র য়ণগঞ জ ব যবস থ ল ইসল ম আম দ র পর ক ষ ফল ফল উপস থ

এছাড়াও পড়ুন:

১১২ টাকায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনে চাকরি পেলেন ১৪ জন

১১২ টাকার আবেদন ফিতে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগের ৭ ক্যাটাগরির ১৪টি পদে নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। সোমবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা নির্বাচিত প্রার্থীদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেন।

এই ১৪টি পদে ১ হাজার ২৩৩ জন আবেদন করেছিলেন। গত ২৪ অক্টোবর তাদের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সঙ্গে এদিনই ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এরপর গত ২৮ অক্টোবর মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২ অক্টোবর গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ার পরে নিয়োগপ্রাপ্তদের হাতে সোমবার নিয়োগপত্র তুলে দেওয়া হয়।

নিয়োগপ্রাপ্ত আড়াইহাজারের দয়াকান্দা এলাকার হাবিব উল্লাহ বলেন, কোনো রকমের ত্রুটি ছাড়াই এই নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের কোনো রকমের বেগ পোহাতে হয়নি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বিনা টাকায় সরকারি চাকরির প্রতি আস্থা তৈরি হবে।

একইভাবে জুবাইদা মারুফা নামে আকেজন নিয়োগপ্রাপ্ত বলেন, আমাদের এই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল। সেই সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যেই এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এরকম নিয়োগ আগে কখনও শুনি নাই। এই ধারা অব্যাহত থাকলে যারা যোগ্য তারাই এগিয়ে যাবে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের বিষয়টি আসলেই ‘যদি, কিন্তু’ ফ্রেমে সমাজে প্রচলিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা সেই ‘যদি কিন্তু’র ধারণা ভাঙতে চেয়েছি।

যেদিন এই নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করেছিলাম সেদিন প্রত্যয় নিয়েছিলাম এই নিয়োগ ১১২ টাকাতেই হবে। সেই অনুযায়ী নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। আমাদের নিয়োগের প্রত্যেকটি পর্যায়ে আমরা আমাদের স্বচ্ছতার পরিচয় রাখতে সক্ষম হয়েছি।

তিনি আরও বলেন, জুলাই স্পিরিট ছিল মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে আমাদের সন্তানরা চাকরি পাবে। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। নিয়োগপ্রাপ্তরা কর্মক্ষেত্রে শতভাগ সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করবে এই প্রত্যাশা করছি।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাবুল’র উদ্যোগে ৩০০ শয্যা হাসপাতালের পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম চলমান
  • আড়াইহাজারবাসী ও বিএনপির নেতাকর্মীদের আজাদের বিশেষ বার্তা
  • যে কারণে নারায়ণগঞ্জ-৪ খালি রাখলো বিএনপি
  • এইচএসসি ও সমমান উত্তীর্ণদের জন্য ৩ কোটি টাকার স্কলারশিপ ঘোষণা
  • বিএনপি কৃষকদের ফারমার্স কার্ড দিবে : সাখাওয়াত
  • তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নে বন্দরে মহানগর বিএনপির কৃষক সভা
  • ১১২ টাকায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনে চাকরি পেলেন ১৪ জন
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইবিএতে ফুলটাইম ও পার্টটাইম এমবিএ, সিজিপিএ ২.৫০ লাগবে
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা কোর্স, যোগ্যতা এইচএসসি পাস