পোর্তোয় মৃত্যুর ছোবল চলছেই!

এক মাসের একটু বেশি সময়ের ব্যবধানে নিজেদের সাবেক তিন ফুটবলারকে হারাল পর্তুগিজ ক্লাবটি। গত ৩ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান পোর্তোর সাবেক উইঙ্গার দিয়োগো জোতা। তাঁর ভাই আন্দ্রে সিলভাও মারা যান একই দুর্ঘটনায়। সিলভাও পোর্তোর সাবেক ফুটবলার। কাল ক্লাবটির অনুশীলন সেন্টারে হৃদ্‌রোগে (কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট) আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাঁদের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী সাবেক অধিনায়ক জর্জ কস্তা। ৫৩ বছর বয়সী সাবেক এ সেন্টারব্যাকের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে পোর্তো।

আরও পড়ুননেইমারের ‘কামব্যাক’ জোড়া গোলে: ব্রাজিল দলে ফিরবেন কবে২০ ঘণ্টা আগে

পোর্তোর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পোর্তোর কিংবদন্তি অধিনায়ক ও বর্তমানে পেশাদার ফুটবল পরিচালক কার্ডিওপালমোনারি অ্যারেস্টের শিকার হয়ে মঙ্গলবার মারা গেছেন।’

ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় পোর্তোয় কাটানো এবং ক্লাবটির হয়ে ২৪টি শিরোপাজয়ী কস্তা মঙ্গলবার সকালে অনুশীলন সেন্টারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর মারা যান কস্তা।

পর্তুগিজ ক্লাবটির বয়সভিত্তিক দলে তিন বছর কাটানোর পর ১৯৯০ সালে মূল দলে সুযোগ পান ‘বিচো’ (অ্যানিমেল) নামে খ্যাতি পাওয়া কস্তা। ২০০৫ সাল পর্যন্ত পোর্তোয় থাকার মাঝে কিছুদিন ধারে খেলেছেন তিনটি ক্লাবে। বেলজিয়ামের স্ট্যান্ডার্ড লিয়েগ ক্লাবের হয়ে খেলে ২০০৬ সালে অবসর নেন কস্তা।

আটবার পর্তুগালের শীর্ষ লিগজয়ী সাবেক এই ফুটবলারের ক্যারিয়ারে সেরা সময় ২০০৪ চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়। জোসে মরিনিও তখন পোর্তোর কোচ। ফাইনালে মোনাকোকে হারিয়ে ১৭ বছর পর পোর্তোকে ইউরোপের সেরা ক্লাব টুর্নামেন্টের শিরোপা এনে দিয়েছিলেন কস্তা-ডেকোরা।

কস্তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ইনস্টাগ্রামে পর্তুগালের সাবেক মিডফিল্ডার ডেকো লিখেছেন, ‘আজ (কাল) পর্তুগিজ ফুটবল এবং পোর্তো তাদের অন্যতম সেরা প্রতীককে হারাল। জর্জ কস্তা ছিলেন পোর্তোর চেতনার ধারক। একজন কিংবদন্তি অধিনায়ক, যিনি সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তোমার নাম চিরকাল স্মরণ করা হবে।’

আরও পড়ুনঘরের মাঠে আর্জেন্টিনার হয়ে ‘শেষ’ ম্যাচটা খেলতে পারবেন তো মেসি০৫ আগস্ট ২০২৫

পোর্তোর হয়ে ৩২৪ ম্যাচ খেলা কস্তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন তাঁর সাবেক কোচ মরিনিও। বর্তমানে ফেনারবাচে কোচের দায়িত্ব পালন করা এই পর্তুগিজ কোচ সংবাদ সম্মেলনে কস্তার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি, ‘সে এখন আমার সঙ্গে কথা বলতে পারলে এটা বলত, সংবাদ সম্মেলন শেষ করুন, আগামীকালের ম্যাচটা খেলুন এবং জিতুন। আমাকে ভুলে যান। আজ এবং আগামীকাল নিজের কাজটা সারার সেই চেষ্টাই করব আমি। তারপর কাঁদব।’

ফুটবল ছাড়ার পর ১৬টি ক্লাবে কোচের দায়িত্ব সামলেছেন কস্তা। গত মৌসুমে পোর্তোয় ফেরেন ক্লাবটির পেশাদার ফুটবলের পরিচালক হিসেবে। পর্তুগালের হয়ে ৫০ ম্যাচ খেলা কস্তা তাঁর দেশের সোনালি প্রজন্মের ফুটবলার—লুইস ফিগো, রুই কস্তা, রুই বেন্তো ও লুইস মিগুয়েলদের সঙ্গে ১৯৯১ অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন তিনি।

কস্তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী লুইস মন্টেনেগ্রোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখা হয়, ‘এটা ধাক্কা।’ কস্তাকে ‘নিবেদন ও প্রতিশ্রুতির উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেন মন্টেনেগ্রো।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর ত গ ল র পর ত গ জ ফ টবল র

এছাড়াও পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্র এক ফোনকলেই গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে পারে, কিন্তু করে না কেন?

মার্কিন রাজনৈতিক পরিসরে যখন কেউ ফিলিস্তিনের মানবিক বিপর্যয়ের কথা তোলে, তখনই প্রশ্ন আসে, ‘৭ অক্টোবরের হামাসের বিষয়টা কী হবে?’ এ প্রশ্ন যেন একটি অস্ত্র, যা দিয়ে ফিলিস্তিনপন্থী বা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলা মানুষদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়, বিশেষত মার্কিন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। অথচ এর পাল্টা জবাব হতে পারে, ‘৬ আগস্টের বিষয়টা তাহলে কী হবে?’

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় প্রথম পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল। তিন দিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে দ্বিতীয় বোমা ফেলা হয়। এই দুই হামলায় আনুমানিক দুই লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল।

এর আগেই ১৯৪৫ সালের মার্চে ‘অপারেশন মিটিংহাউস’ নামে পরিচিত ভয়াবহ অগ্নিবোমা হামলায় টোকিওতে কয়েক হাজার মানুষ মারা যান এবং এক মিলিয়নের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন।

আজ গাজার গণহত্যার সময় যে ‘সংখ্যার রাজনীতি’ আমরা দেখছি, তা এক শীতল বাস্তবতার প্রতিফলন। টোকিও অভিযানের নেতৃত্বদানকারী মার্কিন জেনারেল কার্টিস লে মে খুব ভালো করেই জানতেন, জনবহুল এলাকায় ন্যাপাম ফেলার মানে কী। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘যদি আমরা যুদ্ধে হেরে যেতাম, তাহলে আমাদের সবাইকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হতো।’

আরও পড়ুনযে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে হামলা চালাল ইসরায়েল১৪ জুন ২০২৫

লে মে শুধু জাপানেই থেমে থাকেননি। ১৯৮৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন, মার্কিন বোমা উত্তর কোরিয়ার ২০ শতাংশ জনগণকে হত্যা করেছিল এবং ‘যা নড়াচড়া করেছে’—এ রকম সবকিছুকে তারা লক্ষ্যবস্তু করেছিল।

ইতিহাসবিদ ব্রুস কামিংস নিউজউইকে বলেছিলেন, ‘বেশির ভাগ আমেরিকান জানেনই না যে আমরা উত্তর কোরিয়ার শহরগুলো জাপান বা জার্মানির তুলনায় বেশি ধ্বংস করেছিলাম।…কিন্তু প্রত্যেক উত্তর কোরীয় জানেন। তাঁদের মগজে সেটা গেঁথে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা কখনো এসব শুনি না।’

সম্মিলিত শাস্তির নীতি

লে মে একসময় কিউবার বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন, যদিও প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তাঁকে আটকে দেন। কিন্তু ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় ন্যাপাম হামলার সময় তিনি ‘মানুষকে পাথরযুগে ফেরত পাঠানোর’ বোমাবর্ষণ নীতিতে বিশ্বাস করতেন।

গালফ যুদ্ধ (১৯৯১) শুরুর আগেই লে মে মারা যান। কিন্তু আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এবং আরও বহু মার্কিন আগ্রাসনে তাঁর তত্ত্ব বেঁচে আছে। আকাশ থেকে নির্বিচারে গণসন্ত্রাস চাপিয়ে দিয়ে স্থানীয় জনগণকে অমানবীয় করে তোলা হয়, যেখানে সবাইকে দোষী ধরা হয় এবং সম্মিলিত শাস্তি দেওয়া হয়।

সাম্প্রতিক মার্কিন বক্তব্যও এ ধারাই বজায় রেখেছে। ৮ সেপ্টেম্বর জেরুজালেমে এক বাসস্ট্যান্ডে দুই ফিলিস্তিনির হামলায় ছয়জন ইসরায়েলি নিহত হওয়ার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি ঘোষণা করেন, ‘এই বর্বরতার বিরুদ্ধে আমরা ইসরায়েলের পাশে আছি।’

এখানে প্রশ্ন ওঠে: মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কি সত্যিই স্বাধীন, নাকি ইসরায়েলপন্থী লবিগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? একই সঙ্গে কি দুটি বিষয় সত্য হতে পারে? আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খামখেয়ালি মন্তব্য বা ‘শান্তি উদ্যোগ’ আসলে কী বোঝায়?

বিশ্বনেতারা শোক প্রকাশ করেন, আর বিশ্লেষক মুইন রাব্বানির ভাষায় ‘সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা’ আবারও সক্রিয় হয়—‘টেরর টাওয়ার’, ‘ব্রিডিং গ্রাউন্ড’ ইত্যাদি প্রোপাগান্ডা শব্দগুচ্ছ ছড়িয়ে দিয়ে ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধ আড়াল করার প্রচেষ্টা চলে।

এখানে প্রশ্ন ওঠে: মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কি সত্যিই স্বাধীন, নাকি ইসরায়েলপন্থী লবিগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? একই সঙ্গে কি দুটি বিষয় সত্য হতে পারে? আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খামখেয়ালি মন্তব্য বা ‘শান্তি উদ্যোগ’ আসলে কী বোঝায়?

আরও পড়ুনট্রাম্প ও নেতানিয়াহু মূলত ‘জেনোসাইড পুরস্কারের’ যোগ্য ২৭ আগস্ট ২০২৫প্রত্যাখানেযাগ্যতা বনাম বাস্তবতা

একসময় ‘প্লজিবল ডিনায়েবিলিটি’ (প্রত্যাখ্যানযোগ্যতা) ছিল মার্কিন কৌশলের কেন্দ্রীয় উপাদান। কিন্তু এডওয়ার্ড স্নোডেন, চেলসি ম্যানিং ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ফাঁস করা তথ্য সেই মুখোশ খুলে দিয়েছে। তবু ইসরায়েলের অস্বাভাবিক প্রভাব—মার্কিন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে—আরও জটিল অস্বীকারযোগ্যতার কাঠামো তৈরি করেছে।

বাইডেন–হ্যারিস প্রশাসন ‘গাজা পিয়ার প্রকল্প’-এর মতো হাস্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে আর ট্রাম্প–ভ্যান্সের দল ‘উইটকফ প্ল্যান’ বা ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ হুমকির মতো কৌতুকময় নাটক করেছে। কিন্তু উভয় প্রশাসনই জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে এবং ইসরায়েলকে অব্যাহত সামরিক সহায়তা দিয়েছে। বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র চাইলে এক ফোনকল বা নির্বাহী আদেশেই গাজার গণহত্যা থামাতে পারত।

কিন্তু বাস্তবতা হলো মার্কিন রাজনীতি ও নিরাপত্তাকাঠামো ইসরায়েলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আইপ্যাকের নির্বাচনী তহবিল থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশিক্ষণ, নজরদারি প্রযুক্তি—সবখানেই ইসরায়েলি প্রভাব দৃশ্যমান।

প্রক্সি রাষ্ট্র ও মার্কিন আধিপত্য

এতে প্রশ্ন ওঠে, ইসরায়েলি জায়নবাদী আদর্শ, প্রযুক্তি ও রাজনীতির এই অতিরিক্ত প্রভাব আসলে কি যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক নীতির জন্যই এক ‘অস্বীকারযোগ্য’ প্রক্সি কাঠামো?

সিরিয়ার শাসন পরিবর্তন, লেবাননকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, ইরানকে লক্ষ্য করে যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞা, মিসরকে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ দিয়ে শ্বাসরোধ করা, আব্রাহাম চুক্তি—সবই সেই ইঙ্গিত দেয়।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকান ইহুদি সমাজ কোথায় দাঁড়াবে? সমর্থনকারী বা বিরোধী উভয় পক্ষের জন্যই এটি এক কঠিন বাস্তবতা। নেতানিয়াহু, যিনি আমেরিকায় বহু বছর কাটিয়েছেন, একদিকে প্রগতিশীলদের কাছে সমালোচিত, অন্যদিকে জায়নবাদীদের কাছে নায়ক হিসেবে বিবেচিত হন।

শেষ পর্যন্ত, বর্তমান কাঠামো কেবল ইসরায়েলকে মার্কিন প্রক্সি হিসেবে ধরে রাখছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত বিশ্বভূমিকা নিয়ে গভীরভাবে প্রশ্ন না ওঠে। একই সঙ্গে এই প্রক্সি ভূমিকা মার্কিন ইহুদি সমাজের জন্য নতুন বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা নিয়ে তাদের ভাবনা শুরুই হয়নি।

আমিয়েল আলকালাই মার্কিন কবি, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, প্রবন্ধকার, সমালোচক ও গবেষক।

মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ