ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে আলোচনা করতে গত আগস্টে বৈঠকে বসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। দুই নেতার ওই বৈঠকের পর যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে আশার আলো দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বৈঠকের প্রায় দুই মাস পেরোলেও সংঘাত বন্ধে কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। উল্টো রাশিয়া-ইউক্রেন দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে প্রাণহানির পাশাপাশি অবকাঠামোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে গতকাল বুধবার রাশিয়া বলেছে, ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক সত্ত্বেও ইউক্রেনে শান্তিচুক্তি অর্জনের গতি ‘কমে গেছে’।

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজ শহরের একটি বিমানঘাঁটিতে দুই শীর্ষ নেতা সাক্ষাৎ করেছিলেন। তবে সাড়ে তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কোনো ধরনের চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেননি তাঁরা। এরপর লড়াই বন্ধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও ভেস্তে গেছে।

রুশ সংবাদ সংস্থাগুলো গতকাল রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভের একটি বক্তব্য প্রকাশ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের স্বীকার করতে হবে যে চুক্তির পক্ষে (ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে) অ্যাঙ্কোরেজে যে শক্তিশালী গতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা হারিয়ে গেছে।’ তিনি এ অচলাবস্থার জন্য ইউরোপকে দায়ী করেছেন। তারা শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায় বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন ট্রাম্প। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যেই’ ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ থামাতে পুতিনের আপাত অনিচ্ছায় তিনি ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠেছেন।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ফক্স নিউজকে জানান, ইউক্রেনে দূরপাল্লার টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর কথা বিবেচনা করছে ওয়াশিংটন। ওয়াশিংটনের এমন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন রিয়াবকভ। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠালে ইউক্রেনকে ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে হবে।

রিয়াবকভ আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করলে রাশিয়া দ্রুত পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পারমাণবিক পরীক্ষামূলক অবকাঠামো প্রস্তুত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড রাশিয়ার দখলে

যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই গত মঙ্গলবার পুতিন বলেছেন, রুশ বাহিনী চলতি বছর ইউক্রেনের প্রায় পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে। মস্কো যুদ্ধক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কৌশলগত প্রভাব ধরে রেখেছে। 

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র

এছাড়াও পড়ুন:

আমরা কি জেনেবুঝে বিপর্যয় ডেকে আনছি

ঢাকার মাটির নিচে যে ভূতাত্ত্বিক শক্তি সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, তার সামান্যতম বিচ্যুতিতেও এই মহানগরী এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। এই কঠিন বাস্তবতায় শহরটিকে নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ না থাকলেও, এর ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। বিদ্যমান অবকাঠামোকে কেন্দ্র করেই আমাদের এমন উপায় বের করতে হবে, যা এই শহরকে নিরাপদ করতে পারে। 

গত ৩০-৩৫ বছরে ঢাকা শহরের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে, যার একটি বড় অংশই হয়েছে নরম মাটির ওপর। বিশেষ করে, শহরের পূর্বাংশে প্রগতি সরণি থেকে বালু নদ পর্যন্ত এবং শহরের পশ্চিম অংশে শ্যামলী, বছিলার মতো এলাকাগুলো নরম মাটির স্তরের ওপর গড়ে উঠেছে। নরম মাটিতে নির্মিত অবকাঠামো ভূমিকম্পের সময় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। কারণ, এ ধরনের মাটি ভূকম্পন তরঙ্গকে বিবর্ধিত করে এবং তীব্র ঝাঁকুনিতে এর ভারবহন ক্ষমতা হারাতে পারে। এই অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ শহরকে একটি গুরুতর বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

আরও পড়ুনভূমিকম্পে ঢাকার বড় বিপদ স্পষ্ট হচ্ছে৩ ঘণ্টা আগে

অবকাঠামোগত বিশৃঙ্খলা ঢাকার ঝুঁকিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে, যার মূলে রয়েছে বিল্ডিং কোডের (ইমারত বিধিমালা) নির্দেশনাকে প্রয়োগ না করতে পারার ব্যর্থতা। শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ ভবনই কোনো না কোনোভাবে ইমারত নির্মাণ আইন ও বিল্ডিং কোড অমান্য করে তৈরি হয়েছে, যা সেগুলোকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। খুব অল্পসংখ্যক ভবন তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হলেও, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যাই বেশি। বিল্ডিং কোডের এই পদ্ধতিগত লঙ্ঘন মূলত এর প্রয়োগ ও তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার অভাবকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যা একটি কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তাকে অপরিহার্য করে তুলেছে।

ঢাকাকে ভূমিকম্পের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত করতে একটি দ্বিমুখী কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য। একদিকে যেমন বিদ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, তেমনই ভবিষ্যৎ নির্মাণকাজ যেন সম্পূর্ণ নিরাপদ ও টেকসই হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। এই দুটি লক্ষ্য সামনে রেখেই আমাদের কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে।

এর জন্য প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো শহরের প্রতিটি ভবনের ভূমিকম্প ঝুঁকি মূল্যায়ন করা। মূল্যায়নের পর যেসব ভবনকে শক্তিশালী করা সম্ভব, সেগুলোকে রেট্রোফিটিং বা মজবুতকরণ করতে হবে। জাপানের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলো এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ করে তাদের পুরোনো ভবনগুলোকে সুরক্ষিত করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ভবনগুলোর ক্ষেত্রে এই মজবুতকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই; এটিই বিদ্যমান অবকাঠামোকে সম্ভাব্য ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ।

আরও পড়ুনশক্তিশালী কম্পন অনুভব করেছেন ঢাকার ১ কোটির বেশি মানুষ: ইউএসজিএস ২২ নভেম্বর ২০২৫

ভবিষ্যতে ঢাকাকে নিরাপদ রাখতে নতুন নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে কোনো আপস করা চলবে না। নতুন সব নির্মাণকাজে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) কঠোরভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটলে চলবে না। এই কাজ কার্যকরভাবে সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি দ্রুত গঠন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি রাজউক, সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রতিটি সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, যেন তারা নিজ নিজ এখতিয়ারে বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারে।

সরকারি তদারকি–ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে এবং নির্মাণকাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ‘থার্ড-পার্টি মনিটরিং’ একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে।

দুর্যোগ–পূর্ববর্তী এই প্রস্তুতিগুলোর পাশাপাশি, দুর্যোগ–পরবর্তী উদ্ধারব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দেওয়াও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক হলেও সত্য, ঢাকায় দুর্যোগকালীন উদ্ধার সক্ষমতা এতটাই দুর্বল যে একটি ছোট আকারের দুর্যোগ মোকাবিলার জন্যও তা যথেষ্ট নয়। ফায়ার সার্ভিস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো এবং সিটি করপোরেশনের মতো সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। নিকট অতীতে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো ঘটনা আমাদের এই দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুনঢাকার প্রায় সব ভবনই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে: শামীমুজ্জামান বসুনিয়া২১ নভেম্বর ২০২৫

যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অপ্রতুল, সেহেতু আমাদের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত এবং জীবনরক্ষাকারী কৌশল হলো একটি সুপ্রশিক্ষিত ও বিশাল স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তোলা। ভূমিকম্প–পরবর্তী উদ্ধারকাজে সহায়তার জন্য প্রচুর পরিমাণে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করতে হবে। এই অনিশ্চিত কিন্তু সম্ভাব্য দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন ও তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানই হতে পারে দুর্যোগ মোকাবিলার অন্যতম কার্যকর একটি উপায়।

ঢাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি অত্যন্ত গুরুতর এবং এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। তবে হতাশ না হয়ে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে এই ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব। বিদ্যমান ভবনগুলোর রেট্রোফিটিং, নতুন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোডের কঠোর প্রয়োগ এবং দুর্যোগ–পরবর্তী সময়ের জন্য একটি শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবকভিত্তিক উদ্ধারব্যবস্থা গড়ে তোলাই হলো সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ। এই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ কোনো বিকল্প নয়, বরং ঢাকার টিকে থাকার একমাত্র উপায়। এ বিষয়টি উপেক্ষা করে কি আমরা জেনেবুঝে বিপর্যয় ডেকে আনব?

● অধ্যাপক আকতার মাহমুদ: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক

সম্পর্কিত নিবন্ধ