ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেছেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেবল গাজা ইস্যুতে সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা সন্ত্রাসী এবং বিখ্যাত আইন লঙ্ঘনকারী ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। গাজা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আইন প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা গাজায় ইসরায়েলের ব্যাপক ও অবিশ্বাস্যভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার  আইন (আইএইচএল) লঙ্ঘন, পরবর্তী দিনগুলোতে এর প্রয়োগ ও অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলে।”

শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) তুরস্কের চাংকিরি কারাতেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফারেন্স হলের রেক্টরেট ভবনে ‘গাজা কনফ্লিক্ট: এ ডাইং ডিক্লারেশন অফ ইন্টারন্যাশনাল ল’ (গাজা সংঘাত: আন্তর্জাতিক আইনের মৃত্যুকালীন জবানবন্দী) শীর্ষক শিরোনামে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন। 

আরো পড়ুন:

‘সাজিদ হত্যার ৯০তম দিন, এরপর কি আমি?’

ইবি শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ, রেহায় পায়নি রোগীরা

তিনি অক্টোবরে গাজার সীমান্ত এলাকায় হামাসের আক্রমণের বৈধতা, গাজার উপর ইসরায়েলের আক্রমণ এবং এর বৈশিষ্ট্য, ইসরায়েলের আক্রমণ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে ইসরায়েলের আচরণ নিয়ে আলোচনা করেন। 

উপাচার্য বলেন, “১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের একটি চক্রান্তের ফলে ইসরায়েল অবৈধভাবে জন্মগ্রহণকারী একটি রাষ্ট্র। গাজা সংঘাতে ইসরায়েলের আচরণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের অভূতপূর্ব লঙ্ঘন। ২০২৩ সাল থেকে গাজা সংঘাতে ইসরায়েলের আচরণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ভিত্তি ধ্বংস করে দিয়েছে।”

আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও ফৌজদারি আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণকে বৈধ দাবি করে তিনি বলেন, “গাজা উপত্যকা একটি দখলকৃত অঞ্চল এবং এর জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অধিকারী (বিখ্যাত ফিলিস্তিনের প্রাচীর মামলায় আইসিজে-র উপদেষ্টা মতামত)। হামাসের আক্রমণ দখলদার ইসরাইলের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ছিল এবং তাই জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের অধীনে ‘আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগে’ বলা যেতে পারে। স্থায়ী দখলদারিত্ব আত্মরক্ষার অধিকারের চিরস্থায়ী চরিত্রের জন্ম দেয়।”

এ ক্ষেত্রে ইসরাইলের আচরণ মূল্যায়নে তিনি বলেন, “গাজার উপর ইসরাইলের আক্রমণ আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগে পাল্টা আক্রমণ বা আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হয় না। কারণ ইসরাইল দখলদার শক্তি। আইসিজের মতামত হল- আন্তর্জাতিক আইনে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার ৫১ অনুচ্ছেদের অধিকার নেই। এটি জাতিসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ ২(৪) লঙ্ঘন করে একটি নতুন আক্রমণ।”

উপাচার্য বলেন, “আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন (আইএইচএল) অনুসারে ইসরায়েলের আক্রমণ নিষিদ্ধ শ্রেণীর কর্মকাণ্ডের আওতায় পড়ে। এতে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে আক্রমণ, নির্বিচারে আক্রমণ, বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর (বাসস্থান, বাজার, দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য) বিরুদ্ধে আক্রমণ, মানবিক সাহায্যের উপর স্বেচ্ছাচারী বিধিনিষেধের মাধ্যমে অনাহারকে যুদ্ধের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য জিনিসপত্র ধ্বংস করা, মানবাধিকার কর্মীদের উপর আক্রমণ, সুরক্ষিত ব্যক্তিদের, সাংবাদিকদের হত্যা, নির্যাতন, নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা, বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধ, সম্মিলিত শাস্তি, যুদ্ধবন্দীদের হত্যা, ঘোড়া-বিধ্বংসী যুদ্ধ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও যুদ্ধে সন্ত্রাস ইত্যাদি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন (আইএইচএল) লঙ্ঘনের শামিল।”

অনুষ্ঠান শেষে সফরের বিষয়ে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি খুবই অবাক হয়েছি যে বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০৭ সালে শুরু হয়েছিল। এত অল্প সময়ের মধ্যেই এটি আশ্চর্যজনকভাবে এগিয়েছে। বিশাল ও অটল প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কতদূর এগিয়ে যেতে পারে। এটিই তার বাস্তব উদাহরণ। এটি বেশ আশ্চর্যজনক যে, এই সময়ের মধ্যে আপনি আপনার শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করেছেন এবং আপনার দেশের বাইরে থেকে অনেক শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করেছেন।”

ইবি উপাচার্য তুরস্কের চাংকিরি কারাতেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরাসমাস+ কেএ১৭১ আন্তর্জাতিক ক্রেডিট মবিলিটি প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণভিত্তিক ভ্রমণে অংশ নেন। ইরাসমাস সমন্বয় অফিস থেকে পাঠানো আমন্ত্রণপত্রে উপাচার্যকে আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ভ্রমণে অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে।

ঢাকা/তানিম/মেহেদী

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব শ বব দ য ল র আচরণ উপ চ র য ক রমণ র উপর ইসর য ক আইন

এছাড়াও পড়ুন:

মুহাম্মাদ (সা.) একজন মানুষ রাসুল

মুহাম্মাদ (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল—এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর পরিচয় কেবল ঐশী বার্তার বাহক হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি ছিলেন রক্ত-মাংসের একজন মানুষ, যা তাঁর প্রতি আমাদের অনুকরণ ও অনুসরণকে সহজ করে তোলে। এই বিষয়টি উপলব্ধি না করতে পারলে দ্বীনের পথে চলায় ভুল ও বাড়াবাড়ির সৃষ্টি হতে পারে।

পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা যেমন (যেমন ম্যাক্সিম রডিনসন) নবীজি (সা.)-কে তাঁর নবুয়তের বৈশিষ্ট্য থেকে বঞ্চিত করে কেবল একজন অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তির মানসিক প্রবণতার ফল হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, তেমনি কিছু মুসলিম লেখকও এর বিপরীত বাড়াবাড়ি করেছেন।

তাঁরা নবীজিকে এতটাই অতিমানবীয় হিসেবে তুলে ধরেন যে মনে হয় যেন তিনি পুরোপুরিভাবে আসমানী নির্দেশের একটি যন্ত্রমাত্র—যা যেকোনো নড়াচড়ার জন্য কেবল ঐশী বার্তার ওপর নির্ভরশীল।

তাঁরা নবীজিকে এতটাই অতিমানবীয় হিসেবে তুলে ধরেন যে মনে হয় যেন তিনি পুরোপুরিভাবে আসমানী নির্দেশের একটি যন্ত্রমাত্র—যা যেকোনো নড়াচড়ার জন্য কেবল ওহীর (ঐশী বার্তা) ওপর নির্ভরশীল।

এই ধরনের ধারণা নবীজির মর্যাদাকে খাটো করে। অজান্তেই এটি তাঁকে পৌরাণিক কাহিনীর অর্ধ-দেবতার কাছাকাছি নিয়ে যায়। এমন হলে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাঁর অনুসরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, কারণ একজন মানুষ কী করে একটি যন্ত্রমানবের (রোবট) অনুসরণ করবে?

রাসুল (সা.)-কে অতিরিক্ত পবিত্রতার মোড়কে আবদ্ধ করা এবং পবিত্র কোরআনের এই সুস্পষ্ট আয়াতকে উপেক্ষা করা, “বলো, আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ; আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়” (সুরা কাহফ, আয়াত: ১১০)—মুসলিমদের ধর্মীয় ও জাগতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তিনি ছিলেন প্রজ্ঞাবান নেতা

এ কথা নিশ্চিত যে, মানুষের একার পক্ষে সকল সত্যকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কারণ মানুষের চিন্তাশক্তিকে সঠিক দৃষ্টিকোণ দেওয়ার জন্য একটি পদ্ধতির প্রয়োজন হয়, যা কেবল ওহীই দিতে পারে। আল্লাহর দ্বীনের দিকে মানুষকে আহ্বান করার জন্য রাসুল (সা.) এই ওহীর আলোকেই তাঁর দাওয়াহর পদ্ধতি, কৌশল ও বিস্তারিত দিকগুলো নির্ধারণ করতেন।

কাজেই এটি একেবারেই সঠিক নয় যে, রাসুল (সা.)-এর প্রতিটি নড়াচড়া ও স্থিরতা ওহীর নির্দেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। আমরা যদি কিছু বিষয় বিবেচনা করি, তবেই এই সত্যটি বুঝতে পারব:

ক. নবুয়তের জন্য মানবীয় পূর্ণতা নির্বাচন: আল্লাহ শুধু নৈতিকতার ভিত্তিতে কাউকে নবুয়তের জন্য মনোনীত করেন না, বরং এর জন্য প্রয়োজন একটি পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যার মধ্যে রয়েছে—হৃদয় (নৈতিক-আধ্যাত্মিক দিক), বুদ্ধি (সংকল্প-চিন্তাগত দিক) এবং কর্মক্ষমতা (আচরণগত-সৃজনশীল দিক)।

এ কারণেই কোরআন নবী-রাসুলদের প্রশংসা করেছে এই বলে যে, তাঁরা ছিলেন ‘কর্মক্ষমতা ও অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী’ (সুরা সাদ, আয়াত: ৪৫), যেখানে ‘অন্তর্দৃষ্টি’ বলতে বুদ্ধিমত্তা ও বোধশক্তিকে বোঝানো হয়েছে।

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর জীবনী লেখার জটিলতা ও সম্ভাবনা১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

খ. ওহী এবং মানবিক চেষ্টার মধ্যে ভারসাম্য: নবীজি (সা.) কোনো প্রচারমূলক কাজ শুরু করতেন আল্লাহর ইঙ্গিতে। কিন্তু কাজটি নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করার জন্য তিনি নিজের প্রজ্ঞা ও চেষ্টা ব্যবহার করতেন, যাতে ফলাফল পূর্ণ ও কল্যাণকর হয়। প্রয়োজনের সময় ওহী এসে সেই চেষ্টার সংশোধন করত (যেমন, বদরের যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে এবং সুরা আবাসা-তে বর্ণিত অন্ধ সাহাবিকে উপেক্ষা করার ঘটনায়) (সুরা আবাসা, আয়াত: ১-১০)। এটি প্রমাণ করে যে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল মানবীয়।

গ. নেতৃত্বের মাধ্যমে অনুকরণীয় আদর্শ সৃষ্টি: মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে নবুয়্যতের সমাপ্তি হয়েছে। এর অর্থ হলো, তাঁর অনুসারীদের ওপর দাওয়াহ ও রিসালাতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার দায়িত্ব বর্তেছে। এর জন্য প্রয়োজন—নবীজি এমন একটি পদ্ধতিকে মূর্ত করে তুলবেন, যা তাঁর উম্মতও কোরআনের চিরন্তন নির্দেশনার আলোকে বাস্তবে অনুসরণ করতে পারবে। যদি সবকিছুই ওহী হতো, তবে এই পদ্ধতি নবীজির ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যেত।

আল্লাহ খুব ভালোভাবেই জানেন, কোথায় তাঁর রিসালাত অর্পণ করতে হবে।কোরআন, সুরা আন'আম, আয়াত: ১২৪

আল্লাহর দ্বীন প্রচারে রাসুল (সা.)-এর সক্রিয় মানবিক প্রচেষ্টার গুরুত্ব ভুলে যাওয়ার ফলেই আজ আমাদের মধ্যে এক ধরনের অসহায়ত্ব ও আলস্য দেখা যায়, যা অজুহাত দিয়ে জায়েজ করা হয়।

রাসুল (সা.) ছিলেন বিচক্ষণ শাসক

ওহী যদিও তাঁর আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল, কিন্তু তিনি কেবল একটি পরিচালিত যন্ত্র ছিলেন না। এমনটা ভাবা রাসুল (সা.)-এর প্রতি চরম অসম্মান। বরং তিনি ছিলেন আবেগ, বুদ্ধিমত্তা এবং ব্যবহারিক সক্ষমতার দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের এক প্রতীক।

এ কারণেই তিনি রিসালাতের ভার বহনের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন—“আল্লাহ খুব ভালোভাবেই জানেন, কোথায় তাঁর রিসালাত অর্পণ করতে হবে।” (সুরা আন'আম, আয়াত: ১২৪)।

আল্লাহর নির্দেশ পালনে তিনি নিজস্ব বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতা দিয়ে সচেষ্ট থাকতেন। ওহী সাধারণত পর্যায়ক্রমিকতা (যেমন গোপনে দাওয়াহ, নিকটাত্মীয়দের কাছে দাওয়াহ, প্রকাশ্য ঘোষণা) নির্ধারণ করত এবং উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নির্দিষ্ট করত, কিন্তু তা বাস্তবায়নের বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্ব তিনি নিজে নিতেন।

যখন তিনি ‘উঠুন এবং সতর্ক করুন’ (সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত: ২) নির্দেশ পেলেন, তখন ওহী তাঁকে কোনো বিস্তারিত পরিকল্পনা দেয়নি। তিনি নিজে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বুঝে একটি কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করেন।

তিনি কুরাইশ বংশের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে যাদেরকে আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য নিকটতম মনে করলেন, তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াহ দেওয়া শুরু করলেন। এরপর তিনি তাঁর নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করার পদ্ধতি বেছে নেন এবং পর্যায়ক্রমে প্রকাশ্যে প্রচার শুরু করেন। এর মাধ্যমে তিনি নতুন দ্বীনের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করেন।

এই উদাহরণ প্রমাণ করে যে, রাসুল (সা.) আল্লাহর একজন প্রেরিত পুরুষ হওয়ার পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। এই মানবিক চেষ্টা ও ওহীর নির্দেশনার মধ্যে যে ইতিবাচক ভারসাম্য, তা উম্মাহকে সভ্যতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একজন মুসলিম যখন এই দুটি বিষয়কে একীভূত করে, তখনই তার মধ্যে সুরা কাহফের আয়াত: “আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ; আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়” এবং সুরা ইসরার আয়াত: “বলো, আমার রব পবিত্র, আমি তো কেবল একজন মানুষ ও রাসুল” (সুরা ইসরা, আয়াত: ৯৩)—এই দুই আয়াতের তাৎপর্য পূর্ণতা পায়।

আরও পড়ুনসাহাবিদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর শেষ উপদেশ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫নবীজির আইন ও ব্যক্তিগত আচরণ

আমরা যদি বাস্তবিক অর্থে নবীজির মানবিক সত্তাকে মেনে নিই, তবে তাঁর সব কাজকেই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ‘শরীয়ত’ মনে করা সঠিক নয়। উসুল আল-ফিকহ (আইনের মূলনীতি) বিশেষজ্ঞদের মত হলো: রাসুল (সা.)-এর সমস্ত বাণীই শরীয়তের অংশ, যদি না এর বিপরীতে কোনো প্রমাণ থাকে।

কিন্তু তাঁর অনেক আচরণে প্রমাণ রয়েছে যে, তিনি একজন সাধারণ মানুষ (স্বামী, পিতা, বন্ধু), রাজনৈতিক শাসক (সেনা প্রেরণ, গভর্নর নিয়োগ, জনসম্পদ বন্টন) এবং বিচারক (আর্থিক ও দৈহিক বিরোধের মীমাংসা) হিসেবে কাজ করেছেন।

রাসুল (সা.)-এর ফতোয়া (ধর্মীয় রায়) ও বিচার (কাজা) ছিল মূলত শরীয়তের প্রয়োগ, তা নতুন আইন প্রবর্তন ছিল না। তবে তাঁর সেই কাজগুলো কেয়ামত পর্যন্ত উম্মতের জন্য অবশ্য অনুসরণীয়, যা দ্বীন প্রচার, ইবাদতের পদ্ধতি নির্ধারণ, ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এবং গায়েবের খবর (অদৃশ্য বিষয়) জানানোর সাথে সম্পর্কিত।

বাড়াবাড়ির মূলে রয়েছে রাসুল (সা.)-এর সম্পর্কে ভুল ধারণা—কেবল তাঁর ঐশী দিকটির ওপর মনোযোগ দেওয়া এবং তাঁর মানবিক সত্তাকে উপেক্ষা করা।

এই পার্থক্যটি বোঝা অত্যন্ত জরুরি। এটি না বুঝলে আক্ষরিক ও বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়, যা সময়ের অপচয় করে। রাসুল (সা.)-কে সব কিছুতেই অনুকরণ করার অজুহাতে মানুষ মূলনীতি, উদ্দেশ্য ও সামগ্রিক বিষয়গুলো ভুলে গিয়ে কেবল ছোটখাটো ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে।

সাহাবি আবু যর গিফারী (রা.) ভেবেছিলেন যে রাসুল (সা.)-এর সকল কাজই শরীয়তের বাধ্যতামূলক অংশ। তিনি একটি হাদিসের ওপর ভিত্তি করে ধন-সম্পদ সঞ্চয় করা হারাম মনে করতেন।

হাদিসটি হলো, “আমার জন্য উহুদ পাহাড় সমান সোনাও আমার কাছে প্রিয় হবে না যে তা আমি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে দেব, তবে তার মধ্যে তিনটি দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ছাড়া।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৯৬)

কিন্তু অধিকাংশ সাহাবি, যার মধ্যে উসমান (রা.) ছিলেন, তাঁরা বুঝেছিলেন যে এটি একটি উচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক শিক্ষা, সাধারণ মানুষের জন্য সার্বজনীন বিধান নয়।

শেষ কথা

আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে মুহাম্মাদ (সা.)-এর কিছু আচরণ তাঁদের জন্য স্থায়ীভাবে বাধ্যতামূলক শরীয়ত হিসেবে গণ্য, আবার কিছু আচরণ ছিল রাজনৈতিক, বিচারিক এবং মানবিক—যা বৈধতা নির্দেশ করতে পারে বা উত্তমতা নির্দেশ করতে পারে, কিন্তু তা সার্বজনীন শরীয়ত নয়। এই পার্থক্য না বুঝতে পারাই সবচেয়ে বড় ভুল।

এই ভুল উপলব্ধির কারণেই অনেকে মুসলিমদের ওপর নবীজির সব কাজকে বাধ্যতামূলক করতে চান, যদিও তা কেবল তৎকালীন আরবীয় রীতিনীতি বা সময়ের প্রভাবে সৃষ্ট সাধারণ কাজ হতে পারে। এই বাড়াবাড়ির মূলে রয়েছে রাসুল (সা.)-এর সম্পর্কে ভুল ধারণা—কেবল তাঁর ঐশী দিকটির ওপর মনোযোগ দেওয়া এবং তাঁর মানবিক সত্তাকে উপেক্ষা করা।

নবী (সা.)-কে একই সঙ্গে নবী ও মানুষ হিসেবে দেখা হলে ধারণায় ভারসাম্য তৈরি হয়। এটি মুসলিমদেরকে তাঁর সম্পর্কে সচেতনভাবে অনুকরণ করতে সক্ষম করবে এবং ইসলামকে তাঁর পথনির্দেশনা অনুসারে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে।

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছাত্রশিবির–সমর্থিত প্যানেলের ভিপি-জিএস প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ
  • মুহাম্মাদ (সা.) একজন মানুষ রাসুল
  • পৌর কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত করুন