মুহাম্মাদ (সা.) একজন মানুষ রাসুল
Published: 1st, December 2025 GMT
মুহাম্মাদ (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল—এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর পরিচয় কেবল ঐশী বার্তার বাহক হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি ছিলেন রক্ত-মাংসের একজন মানুষ, যা তাঁর প্রতি আমাদের অনুকরণ ও অনুসরণকে সহজ করে তোলে। এই বিষয়টি উপলব্ধি না করতে পারলে দ্বীনের পথে চলায় ভুল ও বাড়াবাড়ির সৃষ্টি হতে পারে।
পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা যেমন (যেমন ম্যাক্সিম রডিনসন) নবীজি (সা.
তাঁরা নবীজিকে এতটাই অতিমানবীয় হিসেবে তুলে ধরেন যে মনে হয় যেন তিনি পুরোপুরিভাবে আসমানী নির্দেশের একটি যন্ত্রমাত্র—যা যেকোনো নড়াচড়ার জন্য কেবল ওহীর (ঐশী বার্তা) ওপর নির্ভরশীল।
এই ধরনের ধারণা নবীজির মর্যাদাকে খাটো করে। অজান্তেই এটি তাঁকে পৌরাণিক কাহিনীর অর্ধ-দেবতার কাছাকাছি নিয়ে যায়। এমন হলে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাঁর অনুসরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, কারণ একজন মানুষ কী করে একটি যন্ত্রমানবের (রোবট) অনুসরণ করবে?
রাসুল (সা.)-কে অতিরিক্ত পবিত্রতার মোড়কে আবদ্ধ করা এবং পবিত্র কোরআনের এই সুস্পষ্ট আয়াতকে উপেক্ষা করা, “বলো, আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ; আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়” (সুরা কাহফ, আয়াত: ১১০)—মুসলিমদের ধর্মীয় ও জাগতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তিনি ছিলেন প্রজ্ঞাবান নেতাএ কথা নিশ্চিত যে, মানুষের একার পক্ষে সকল সত্যকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কারণ মানুষের চিন্তাশক্তিকে সঠিক দৃষ্টিকোণ দেওয়ার জন্য একটি পদ্ধতির প্রয়োজন হয়, যা কেবল ওহীই দিতে পারে। আল্লাহর দ্বীনের দিকে মানুষকে আহ্বান করার জন্য রাসুল (সা.) এই ওহীর আলোকেই তাঁর দাওয়াহর পদ্ধতি, কৌশল ও বিস্তারিত দিকগুলো নির্ধারণ করতেন।
কাজেই এটি একেবারেই সঠিক নয় যে, রাসুল (সা.)-এর প্রতিটি নড়াচড়া ও স্থিরতা ওহীর নির্দেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। আমরা যদি কিছু বিষয় বিবেচনা করি, তবেই এই সত্যটি বুঝতে পারব:
ক. নবুয়তের জন্য মানবীয় পূর্ণতা নির্বাচন: আল্লাহ শুধু নৈতিকতার ভিত্তিতে কাউকে নবুয়তের জন্য মনোনীত করেন না, বরং এর জন্য প্রয়োজন একটি পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যার মধ্যে রয়েছে—হৃদয় (নৈতিক-আধ্যাত্মিক দিক), বুদ্ধি (সংকল্প-চিন্তাগত দিক) এবং কর্মক্ষমতা (আচরণগত-সৃজনশীল দিক)।
এ কারণেই কোরআন নবী-রাসুলদের প্রশংসা করেছে এই বলে যে, তাঁরা ছিলেন ‘কর্মক্ষমতা ও অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী’ (সুরা সাদ, আয়াত: ৪৫), যেখানে ‘অন্তর্দৃষ্টি’ বলতে বুদ্ধিমত্তা ও বোধশক্তিকে বোঝানো হয়েছে।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর জীবনী লেখার জটিলতা ও সম্ভাবনা১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫খ. ওহী এবং মানবিক চেষ্টার মধ্যে ভারসাম্য: নবীজি (সা.) কোনো প্রচারমূলক কাজ শুরু করতেন আল্লাহর ইঙ্গিতে। কিন্তু কাজটি নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করার জন্য তিনি নিজের প্রজ্ঞা ও চেষ্টা ব্যবহার করতেন, যাতে ফলাফল পূর্ণ ও কল্যাণকর হয়। প্রয়োজনের সময় ওহী এসে সেই চেষ্টার সংশোধন করত (যেমন, বদরের যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে এবং সুরা আবাসা-তে বর্ণিত অন্ধ সাহাবিকে উপেক্ষা করার ঘটনায়) (সুরা আবাসা, আয়াত: ১-১০)। এটি প্রমাণ করে যে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল মানবীয়।
গ. নেতৃত্বের মাধ্যমে অনুকরণীয় আদর্শ সৃষ্টি: মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে নবুয়্যতের সমাপ্তি হয়েছে। এর অর্থ হলো, তাঁর অনুসারীদের ওপর দাওয়াহ ও রিসালাতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার দায়িত্ব বর্তেছে। এর জন্য প্রয়োজন—নবীজি এমন একটি পদ্ধতিকে মূর্ত করে তুলবেন, যা তাঁর উম্মতও কোরআনের চিরন্তন নির্দেশনার আলোকে বাস্তবে অনুসরণ করতে পারবে। যদি সবকিছুই ওহী হতো, তবে এই পদ্ধতি নবীজির ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যেত।
আল্লাহ খুব ভালোভাবেই জানেন, কোথায় তাঁর রিসালাত অর্পণ করতে হবে।কোরআন, সুরা আন'আম, আয়াত: ১২৪আল্লাহর দ্বীন প্রচারে রাসুল (সা.)-এর সক্রিয় মানবিক প্রচেষ্টার গুরুত্ব ভুলে যাওয়ার ফলেই আজ আমাদের মধ্যে এক ধরনের অসহায়ত্ব ও আলস্য দেখা যায়, যা অজুহাত দিয়ে জায়েজ করা হয়।
রাসুল (সা.) ছিলেন বিচক্ষণ শাসকওহী যদিও তাঁর আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল, কিন্তু তিনি কেবল একটি পরিচালিত যন্ত্র ছিলেন না। এমনটা ভাবা রাসুল (সা.)-এর প্রতি চরম অসম্মান। বরং তিনি ছিলেন আবেগ, বুদ্ধিমত্তা এবং ব্যবহারিক সক্ষমতার দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের এক প্রতীক।
এ কারণেই তিনি রিসালাতের ভার বহনের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন—“আল্লাহ খুব ভালোভাবেই জানেন, কোথায় তাঁর রিসালাত অর্পণ করতে হবে।” (সুরা আন'আম, আয়াত: ১২৪)।
আল্লাহর নির্দেশ পালনে তিনি নিজস্ব বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতা দিয়ে সচেষ্ট থাকতেন। ওহী সাধারণত পর্যায়ক্রমিকতা (যেমন গোপনে দাওয়াহ, নিকটাত্মীয়দের কাছে দাওয়াহ, প্রকাশ্য ঘোষণা) নির্ধারণ করত এবং উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নির্দিষ্ট করত, কিন্তু তা বাস্তবায়নের বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্ব তিনি নিজে নিতেন।
যখন তিনি ‘উঠুন এবং সতর্ক করুন’ (সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত: ২) নির্দেশ পেলেন, তখন ওহী তাঁকে কোনো বিস্তারিত পরিকল্পনা দেয়নি। তিনি নিজে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বুঝে একটি কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করেন।
তিনি কুরাইশ বংশের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে যাদেরকে আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য নিকটতম মনে করলেন, তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াহ দেওয়া শুরু করলেন। এরপর তিনি তাঁর নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করার পদ্ধতি বেছে নেন এবং পর্যায়ক্রমে প্রকাশ্যে প্রচার শুরু করেন। এর মাধ্যমে তিনি নতুন দ্বীনের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করেন।
এই উদাহরণ প্রমাণ করে যে, রাসুল (সা.) আল্লাহর একজন প্রেরিত পুরুষ হওয়ার পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। এই মানবিক চেষ্টা ও ওহীর নির্দেশনার মধ্যে যে ইতিবাচক ভারসাম্য, তা উম্মাহকে সভ্যতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একজন মুসলিম যখন এই দুটি বিষয়কে একীভূত করে, তখনই তার মধ্যে সুরা কাহফের আয়াত: “আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ; আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়” এবং সুরা ইসরার আয়াত: “বলো, আমার রব পবিত্র, আমি তো কেবল একজন মানুষ ও রাসুল” (সুরা ইসরা, আয়াত: ৯৩)—এই দুই আয়াতের তাৎপর্য পূর্ণতা পায়।
আরও পড়ুনসাহাবিদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর শেষ উপদেশ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫নবীজির আইন ও ব্যক্তিগত আচরণআমরা যদি বাস্তবিক অর্থে নবীজির মানবিক সত্তাকে মেনে নিই, তবে তাঁর সব কাজকেই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ‘শরীয়ত’ মনে করা সঠিক নয়। উসুল আল-ফিকহ (আইনের মূলনীতি) বিশেষজ্ঞদের মত হলো: রাসুল (সা.)-এর সমস্ত বাণীই শরীয়তের অংশ, যদি না এর বিপরীতে কোনো প্রমাণ থাকে।
কিন্তু তাঁর অনেক আচরণে প্রমাণ রয়েছে যে, তিনি একজন সাধারণ মানুষ (স্বামী, পিতা, বন্ধু), রাজনৈতিক শাসক (সেনা প্রেরণ, গভর্নর নিয়োগ, জনসম্পদ বন্টন) এবং বিচারক (আর্থিক ও দৈহিক বিরোধের মীমাংসা) হিসেবে কাজ করেছেন।
রাসুল (সা.)-এর ফতোয়া (ধর্মীয় রায়) ও বিচার (কাজা) ছিল মূলত শরীয়তের প্রয়োগ, তা নতুন আইন প্রবর্তন ছিল না। তবে তাঁর সেই কাজগুলো কেয়ামত পর্যন্ত উম্মতের জন্য অবশ্য অনুসরণীয়, যা দ্বীন প্রচার, ইবাদতের পদ্ধতি নির্ধারণ, ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এবং গায়েবের খবর (অদৃশ্য বিষয়) জানানোর সাথে সম্পর্কিত।
বাড়াবাড়ির মূলে রয়েছে রাসুল (সা.)-এর সম্পর্কে ভুল ধারণা—কেবল তাঁর ঐশী দিকটির ওপর মনোযোগ দেওয়া এবং তাঁর মানবিক সত্তাকে উপেক্ষা করা।এই পার্থক্যটি বোঝা অত্যন্ত জরুরি। এটি না বুঝলে আক্ষরিক ও বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়, যা সময়ের অপচয় করে। রাসুল (সা.)-কে সব কিছুতেই অনুকরণ করার অজুহাতে মানুষ মূলনীতি, উদ্দেশ্য ও সামগ্রিক বিষয়গুলো ভুলে গিয়ে কেবল ছোটখাটো ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে।
সাহাবি আবু যর গিফারী (রা.) ভেবেছিলেন যে রাসুল (সা.)-এর সকল কাজই শরীয়তের বাধ্যতামূলক অংশ। তিনি একটি হাদিসের ওপর ভিত্তি করে ধন-সম্পদ সঞ্চয় করা হারাম মনে করতেন।
হাদিসটি হলো, “আমার জন্য উহুদ পাহাড় সমান সোনাও আমার কাছে প্রিয় হবে না যে তা আমি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে দেব, তবে তার মধ্যে তিনটি দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ছাড়া।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৯৬)
কিন্তু অধিকাংশ সাহাবি, যার মধ্যে উসমান (রা.) ছিলেন, তাঁরা বুঝেছিলেন যে এটি একটি উচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক শিক্ষা, সাধারণ মানুষের জন্য সার্বজনীন বিধান নয়।
শেষ কথাআমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে মুহাম্মাদ (সা.)-এর কিছু আচরণ তাঁদের জন্য স্থায়ীভাবে বাধ্যতামূলক শরীয়ত হিসেবে গণ্য, আবার কিছু আচরণ ছিল রাজনৈতিক, বিচারিক এবং মানবিক—যা বৈধতা নির্দেশ করতে পারে বা উত্তমতা নির্দেশ করতে পারে, কিন্তু তা সার্বজনীন শরীয়ত নয়। এই পার্থক্য না বুঝতে পারাই সবচেয়ে বড় ভুল।
এই ভুল উপলব্ধির কারণেই অনেকে মুসলিমদের ওপর নবীজির সব কাজকে বাধ্যতামূলক করতে চান, যদিও তা কেবল তৎকালীন আরবীয় রীতিনীতি বা সময়ের প্রভাবে সৃষ্ট সাধারণ কাজ হতে পারে। এই বাড়াবাড়ির মূলে রয়েছে রাসুল (সা.)-এর সম্পর্কে ভুল ধারণা—কেবল তাঁর ঐশী দিকটির ওপর মনোযোগ দেওয়া এবং তাঁর মানবিক সত্তাকে উপেক্ষা করা।
নবী (সা.)-কে একই সঙ্গে নবী ও মানুষ হিসেবে দেখা হলে ধারণায় ভারসাম্য তৈরি হয়। এটি মুসলিমদেরকে তাঁর সম্পর্কে সচেতনভাবে অনুকরণ করতে সক্ষম করবে এবং ইসলামকে তাঁর পথনির্দেশনা অনুসারে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: একজন ম ন ষ র জন য নব জ র ম নব ক ম নব য় উপ ক ষ আল ল হ করত ন ক ষমত ক রআন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
৯ ক্রিকেটারের বিপিএলের নিলাম থেকে বাদ পড়ার ৩ কারণ
অবশেষে জল্পনাকল্পনা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে এবারের বিপিএল। বিসিবির দুর্নীতি দমন পরামর্শক অ্যালেক্স মার্শালের করা অধিকতর তদন্তের পর গত বিপিএলে ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার সন্দেহে ৯ ক্রিকেটারকে বাদ দিয়ে কাল নিলামের জন্য চূড়ান্ত খেলোয়াড় তালিকা প্রকাশ করেছে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল। আজ বিকেলে র্যাডিসন হোটেলে হবে দ্বাদশ বিপিএলের নিলাম।
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মির্জা হুসাইন হায়দারের নেতৃত্বে বিসিবির তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ৯ জন স্থানীয় ও ১ জন বিদেশি ক্রিকেটারকে গত বিপিএলে ফিক্সিংয়ে সন্দেহভাজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে সন্দেহভাজনদের তালিকায় নাম আছে ৬–৭ জন ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্মকর্তা, একজন কোচ ও একজন মিডিয়া ম্যানেজারের। তদন্ত কমিটির অপর দুই সদস্য ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. খালেদ এইচ চৌধুরী এবং সাবেক ক্রিকেটার শাকিল কাসেম।
চূড়ান্ত নিলাম তালিকায় না থাকা অভিযুক্ত ৯ ক্রিকেটারের মধ্যে প্রাথমিক তালিকায় ছিলেন ৮ জন। তাঁরা হলেন দুর্দান্ত রাজশাহীর এনামুল হক, শফিউল ইসলাম, সানজামুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান, ঢাকা ক্যাপিটালসের মোসাদ্দেক হোসেন ও আলাউদ্দিন বাবু এবং সিলেট স্ট্রাইকার্সের আরিফুল হক ও নিহাদুজ্জামান।
আরিফুল প্রথমে প্রাথমিক তালিকায় না থাকলেও পরে তাঁকে ঢোকানো হয়েছিল। এনামুল, মোসাদ্দেক, শফিউল, সানজামুল ও আরিফুল জাতীয় দলে খেলেছেন। জাতীয় দলে খেলা আরেক অভিযুক্ত সিলেট স্ট্রাইকার্সের আল–আমিন হোসেন প্রাথমিক তালিকাতে ছিলেন না, নেই চূড়ান্ত তালিকাতেও।
সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সন্দেহভাজন ক্রিকেটারদের মধ্যে আরও ছিলেন দুর্দান্ত রাজশাহীর সোহাগ গাজী ও ঢাকা ক্যাপিটালসে খেলা শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার থিসারা পেরেরা। তবে অ্যালেক্স মার্শালের তদন্তে ‘নিষ্কৃতি’ পাওয়ায় তাঁরা দুজনই চূড়ান্ত নিলাম তালিকায় জায়গা পেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত হিসেবে এই ১১ ক্রিকেটারের নাম আসার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে। এই ১১ ক্রিকেটার এবং কোচ–কর্মকর্তাসহ অভিযোগ আনা হয়েছে মোট ২০ জনের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুনবিপিএল নিলামের আগে সরাসরি চুক্তি করেছেন যাঁরা১১ ঘণ্টা আগেসূত্র জানিয়েছে, সন্দেহভাজন ক্রিকেটারদের মধ্যে একজন এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে একই ফ্র্যাঞ্চাইজির দুজন আইসিসির ‘রেড ফ্ল্যাগ’ধারী। অর্থাৎ আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের তালিকাতেও তাঁরা সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত।
আইসিসির ‘রেড ফ্ল্যাগ’ধারী ক্রিকেটারটি শুধু গত বিপিএলেই নয়, তার আগের বিপিএলেও সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড করেছেন। যদিও তদন্ত কমিটিকে ওই ক্রিকেটার বলেছেন, তাঁকে আইসিসি কেন সন্দেহ করে, সেটা নাকি তিনি জানেন না। তিনিসহ সন্দেহভাজন ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মূলত তিন ধরনের—খেলায় সুনির্দিষ্ট ঘটনা ঘটিয়ে সরাসরি ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকা, ফিক্সিংয়ে সহায়তা করা বা প্রস্তাব দেওয়া ও তথ্য গোপন করা।
‘রেড ফ্ল্যাগ’ধারী দুই কর্মকর্তাসহ আরও চারজন ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্মকর্তা, একজন কোচ, একজন মিডিয়া ম্যানেজার ও বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের এক কর্মকর্তার নামও আছে স্বাধীন তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে। তবে সবার বিরুদ্ধে সরাসরি ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ করেনি কমিটি।
আরও পড়ুনব্যাট–প্যাড কিনতে পেছাচ্ছে বিপিএল২৭ নভেম্বর ২০২৫একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকের বিরুদ্ধে যেমন অভিযোগ সঠিকভাবে ফ্র্যাঞ্চাইজি চালাতে না পারার। তাঁর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে ফ্র্যাঞ্চাইজির খেলোয়াড় ও অন্য কর্মকর্তারা অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন বলে মনে করে কমিটি।
সন্দেভাজন মিডিয়া ম্যানেজারের বিরুদ্ধেও সরাসরি ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবু তাঁকে নিয়ে সন্দেহের অন্যতম কারণ, প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত এলাকায় বিভিন্ন সময়ে তাঁর অনভিপ্রেত যাতায়াত। এ ছাড়া দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে গত বিপিএলের সময় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
তদন্ত কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য কাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আমরা কিছু খেলোয়াড়–কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে তাদের ব্যাপারে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি। পরে অ্যালেক্স মার্শালের তদন্তের ভিত্তিতে বিসিবি কিছু ক্রিকেটারকে চূড়ান্ত নিলাম তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে।’
আরও পড়ুনপ্রমাণ ছাড়াই কি ৭ ক্রিকেটারকে বিপিএল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, কী বলছে বিসিবি১২ ঘণ্টা আগেচূড়ান্ত নিলাম তালিকায় প্রাথমিক তালিকার কিছু ক্রিকেটারকে না রাখার ব্যাখ্যা দিয়ে বিসিবিও কাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে কয়েকজন খেলোয়াড়সহ কিছু ব্যক্তিকে এবারের বিপিএলে অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে অন্যান্য ঘরোয়া ক্রিকেটে আপাতত তাঁদের খেলতে বাধা নেই।
খেলোয়াড়দের বাইরে সন্দেহভাজনদের তালিকায় কারা আছেন, তা প্রকাশ না করলেও এবারের আসরে তাঁদের দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না করতে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের জানিয়ে দিয়েছে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল।
কাউন্সিলের সদস্যসচিব ইফতেখার রহমান কাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘যারা রেড ফ্ল্যাগড (সন্দেহভাজন) আছে, তারা দলের সঙ্গে থাকতে পারবে না। না মাঠে থাকতে পারবে, না ড্রেসিংরুমে থাকতে পারবে, না বাসে চড়তে পারবে, না হোটেলে থাকতে পারবে। এটাই নিয়ম, সারা বিশ্বে এইভাবেই ইন্টিগ্রিটি ইউনিট চলে।’
অভিযুক্তরা কী বলেনঅভিযুক্ত ক্রিকেটারদের দাবি, অভিযোগ প্রমাণের আগে নিলামের চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাঁদের ‘মানহানি’ করা হয়েছে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে এনামুল প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘একটা প্রতিবেদন দিল আর বাদ দিয়ে দিল! দোষী না, কিন্তু বিপিএল খেলতে দেবে না—এটা কী হলো? কথা শুনে হাস্যকর মনে হচ্ছে।’
শফিউল বলেন, ‘আমি যদি অভিযুক্ত হই আমাকে প্রমাণ দেখাক। মানুষের সামনে প্রমাণ নিয়ে আসুক।’
সানজামুলের কথা, ‘বিসিবির কথা হচ্ছে দোষীও না, আবার দোষী। কী প্রমাণ করল সেটা বুঝলাম না। বলছে সব জায়গায় খেলতে পারব আবার বিপিএল খেলতে পারব না। যতটুকু জানি, যারা সাজাপ্রাপ্ত, তারা সব সময় নিষিদ্ধ থাকে।’
নিহাদুজ্জামান বলেছেন, ‘খুবই অপ্রত্যাশিত এটা। কখনো কল্পনা করিনি।’ নিলাম তালিকা থেকে বাদ পড়া মানতে পারছেন না মিজানুরও, ‘কোনোভাবে মেনে নিতে পারছি না। কী পদক্ষেপ নেব বা কী করব, সেটাও বুঝতে পারছি না।’
মোসাদ্দেক, বাবু, সোহাগ, আল–আমিন ও আরিফুলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।
অভিযুক্তদের প্রতিক্রিয়ার জবাবে গভর্নিং কাউন্সিল সদস্যসচিব ইফতেখারের পাল্টা প্রতিক্রিয়া, ‘রেড ফ্ল্যাগড খেলোয়াড়দের আমরা নিলামের তালিকায় রাখব না, এটা সম্পূর্ণ আমাদের সিদ্ধান্ত। এটার এখতিয়ার আমাদের আছে। আমরা বিপিএল পরিচ্ছন্ন রাখতে চাই।’
আরও পড়ুনবিপিএল নিলামে জায়গা না পাওয়া অভিযুক্ত ক্রিকেটাররা কে কী বলছেন১০ ঘণ্টা আগে