ইউটিউব ঘাঁটলে ভিডিওটি এখনো মিলবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সঙ্গে বাংলাদেশের এক দল শিল্পী ও অভিনেতা। দুলে দুলে, তুড়ি বাজিয়ে তাঁরা গাইছেন, ‘তুমি বন্ধু কালা পাখি,/ আমি যেন কী।’ স্মিতহাস্য হাসিনা এক পর্যায়ে তাঁর বোন রেহানাকে হাত ধরে টেনে আনলেন আনন্দ–উৎসবে যোগ দিতে। দরিদ্র এক দেশের পরাক্রমশালী এক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর স্তাবকদের কেউই তাঁদের এই আনন্দঘন মুহূর্তে ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি একদিন; আর সেদিন তেমন দূরেও নয়, যখন এই গান থেমে যাবে। নিভে আসবে এই তারার মেলা। চোরের মতো পালাতে হবে নিজ বাড়ি থেকে, নিজ দেশ থেকে।

গত বছরের ৫ আগস্ট যেদিন হাসিনা ও তাঁর বোন চারটি সু৵টকেস হাতে নিয়ে দেশ ছাড়েন, তাঁদের মুখে হাসির জায়গায় স্থান পেয়েছিল ভীতি ও গভীর উদ্বেগ। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। লক্ষ জনতা গণভবনের দিকে এগিয়ে আসছে—এ কথা জানার পরও তাঁর অনুগত সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘লেথ্যাল উইপন’ ব্যবহার করে বিক্ষোভ থামাতে। সেনাধ্যক্ষরা সম্মত হননি। শেষ চেষ্টা হিসেবে যোগাযোগ করা হলো বিদেশে অবস্থানরত তাঁর ছেলে মার্কিন নাগরিক জয়ের সঙ্গে। তিনিও নাকি বলেছেন, ‘মা, আর বিলম্ব নয়।’ শোনা যায়, নিরুপায় হাসিনা নাকি হেলিকপ্টারে ওঠার আগে স্বগত স্বরে শুধু বলেছিলেন, ‘এত কিছু করলাম, এই তার প্রতিদান!’

হাসিনাই একমাত্র ক্ষমতাধর ব্যক্তি নন, জনতার রোষে যাঁকে পালাতে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে পূর্ব জার্মানির এরিক হোনেকার, ইরানের শাহেনশাহ রেজা শাহ পাহলভি, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস অথবা আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির কথা ভাবতে পারি।

হাসিনার পতনের সঙ্গে কাছাকাছি মিল রয়েছে মার্কোসের। একটানা ২১ বছর একনায়ক হিসেবে দেশ শাসনের পর জনতার রোষে পতন হয় মার্কোসের। দিনটি ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬। এর তিন বছর আগে নিহত হন জনপ্রিয় বিরোধী রাজনীতিক সিনেটর অ্যাকুইনো। সেই মৃত্যুর জন্য মার্কোস দায়ী, এই সন্দেহে ফুঁসে উঠল মানুষ। রাজনৈতিক বিক্ষোভ এড়াতে মার্কোস হঠাৎ নির্বাচন ডেকে বসেন ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে; কিন্তু ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে সে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যাত হয়, আরও জোরদার হয়ে ওঠে বিক্ষোভ। তাঁর বিশ্বাস ছিল, আর কেউ না হোক ফিলিপাইনে অবস্থানরত মার্কিন ছত্রীসেনারা তাঁকে রক্ষায় এগিয়ে আসবেন।

২৪ ফেব্রুয়ারি, পুরো ম্যানিলা যখন বিক্ষোভে উত্তাল, মালামালাকালাং প্রাসাদে স্ত্রী ইমেলদাকে নিয়ে তিনি প্রহর গুনছিলেন কখন মার্কিন ছত্রীসেনারা হস্তক্ষেপ করবেন। বারবার চেষ্টা করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সঙ্গে কথা বলতে। অবশেষে সেই ফোন এল; কিন্তু রিগ্যানের নয়, তাঁর বিশেষ দূত পল লাক্সাল্টের কাছ থেকে। ‘মি.

প্রেসিডেন্ট, এখন চলে যাওয়ার সময় এসেছে’ লাক্সাল্ট জানালেন। ভয় ও বিস্ময়ে সাদা হয়ে গেলেন মার্কোস, স্ত্রী ইমেলদার দিকে তাকিয়ে বিমর্ষে বললেন, ‘তার মানে সব শেষ।’ খানিক পরেই মালামালাকালাং প্রাসাদের লনে এসে নামল মার্কিন সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার। তাতে করেই পালালেন মার্কোস। যাওয়ার সময় তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘সো, দিস ইজ হাউ ইট এন্ডস’, এভাবেই তাহলে সব শেষ হলো।

হাসিনার পতন এবং পরে বিচারের রায়ে তাঁর ফাঁসির নির্দেশ থেকে এ কথা আমরা বলতে পারি—কোনো নেতা বা নেত্রী, তা তিনি যত ক্ষমতাধরই হোন না কেন, অপরিহার্য নন। ভীতি অথবা মিথ্যা গালগপ্পো তাঁর অনন্ত ক্ষমতা ধারণের কোনো নিশ্চয়তা নয়। জর্জ অরওয়েল লিখেছিলেন, ‘সব স্বৈরতন্ত্রই প্রতারণা ও বলপ্রয়োগের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে; কিন্তু প্রতারণা একবার উন্মোচিত হলে, তাঁদের ভরসা থাকে শুধু শক্তির ওপর। কিন্তু সেই শক্তিও একসময় কর্পূরের মতো উবে যায়, পড়ে থাকে পতিত স্বৈরশাসকের বিস্মিত ও ভীতসন্ত্রস্ত মুখ।’

ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দিয়েছে—যতই পরাক্রমশালী হও, ক্ষমতার অপব্যবহার তোমাকে সিংহাসন থেকে একসময় টেনে নামাবে সেই জনতা, যাদের নামে তুমি সিংহাসন দখল করেছ। এই পতন হবে দ্রুত, তুমি সামলে নেওয়ার আগেই। রেজা শাহ, ফার্দিনান্দ মার্কোস বা শেখ হাসিনা—প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ক্ষমতার গতিপথ এবং তার ঊর্ধ্ব ও নিম্নরেখা, কার্যত অভিন্ন। তাঁদের হাতে রাষ্ট্র, সরকার ও নেতা হয়ে পড়েন এক ও অভিন্ন। তাঁরা কেবল সব ক্ষমতার কেন্দ্রই নন, সব ক্ষমতার উৎসও বটে। একনায়কদের পতনের এটাই মূল কারণ। নেতা হয়ে ওঠেন সেই অক্ষ, যার চারদিকে সবকিছু ঘোরে। ফলে যখন সেই অক্ষ বিপদে পড়ে, তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসার আর কেউ থাকে না।

শেখ হাসিনার কথা ভাবুন। এমন বিপুল ক্ষমতাধর মানুষ, অথচ বিপদ যখন ঘরের দোরগোড়ায়, তাঁর পাশে কেউ নেই। এমনকি দীর্ঘ সময় ধরে যে সামরিক বাহিনীর ওপর ছিল তাঁর পুরো নিয়ন্ত্রণ, বিপদের সময় তাঁরাও উধাও।

ক্ষমতাধরেরা শুধু নিষ্ঠুর শক্তির জোরেই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন না, তাঁকে টিকে থাকতে একটি চমৎকার গল্প ফাঁদতে হয়। বাংলাদেশের হাসিনা, ইরানের শাহ, মিসরের হোসনি মোবারক অথবা রোমানিয়ার চসেস্কু—তাঁরা প্রত্যেকেই দেশের জন্য অপরিহার্য হিসেবে নিজেদের উপস্থিত করেছিলেন। নিজেকেই বাংলাদেশের সবকিছুর নিয়ন্তা ভাবতে শুরু করেছিলেন। ‘আমি না থাকলে বন্যায় ভেসে যাবে দেশ’ বলেছিলেন মার্কোস। হোসনি মোবারক মিসরের পরাক্রমশালী একনায়ক। পদত্যাগের দাবির কথায় বলেছিলেন, ‘আমি চলে গেলে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে মিসর।’

এসব নেতার বলা গল্পগুলো ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে বলার জন্য স্তাবকদের অভাব থাকে না। দেশের মানুষ সে গল্প বিশ্বাস করুক বা না করুক, এসব নেতা সম্ভবত এসব গালগপ্পো নিজেরা বিশ্বাস করতেন। পালানোর সময় হাসিনার বিস্মিত মুখটি স্মরণ করুন, তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি এই দেশের মানুষ, যাদের জন্য তিনি ‘প্রাণপাত’ করেছেন, তাঁরাই চাইছিলেন তাঁর পদত্যাগ। ১৯৮৯ সালে ঠিক এমন একটি মুহূর্তের মুখোমুখি হতে হয়েছিল রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট চসেস্কুকে। ‘অসম্ভব, হতেই পারে না’, এমন দাবি করে তিনি ২১ ডিসেম্বর বুখারেস্টে রোমানিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তরের ব্যালকনি থেকে জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি তোমাদের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেছি, রোমানিয়া ও তার মানুষ আমার নেতৃত্বের পেছনে ঐক্যবদ্ধ।’ তাঁর সে কথা শুনে উপস্থিত মানুষ হো হো করে হেসে উঠেছিল।

হাসিনাও সেই একই দাবি করেছিলেন—একবার নয়, বহুবার। তাঁর সে দাবিকে জায়েজ করার জন্য সদা প্রস্তুত ছিল ভাড়াটে লেখক ও রাজনীতিকেরা। যেমন ‘ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটে’ ২০১৯ সালে সালমান এফ রহমান লিখিতভাবে বলেছিলেন, বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য সাফল্যের গোপন ফ্যাক্টরটি হলো শেখ হাসিনা।

কিন্তু একটা সময় আসে, যখন দেশের মানুষ বানিয়ে বানিয়ে বলা এই গল্প আর বিশ্বাস করতে চান না। রাজনৈতিক নিষ্পেষণের ভয় দেখিয়েও তাঁদের হাতে রাখা যায় না। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের পক্ষে হয়তো সব সময় তাঁদের পতনের রেখাচিত্রটি সহজে ধরা পড়ে না। সে কারণেই যখন ইরানের শাহকে তাঁর বিশ্বস্ত জেনারেল বাদরেইয়ের মুখে শুনতে হয় ‘এখন আপনার যাওয়ার সময় হয়েছে’, অথবা শেখ হাসিনাকে আরেক জেনারেলের মুখে শুনতে হয়, ‘হেলিকপ্টার প্রস্তুত’। তখন তাঁদের মুখ–চোখে একই সঙ্গে ভীতি ও বিস্ময় দানা বাঁধে। নেতা না বুঝতে চাইলেও তাঁর অনুগত অনুগ্রহভোগীদের অনেকেই ভাগে৵র লিখন পড়ে ফেলেন। ফলে নেতাকে একা রেখে সবার আগে পালান তাঁরা। যেমন সপরিবার পালিয়েছিলেন ফজলে নূর তাপসসহ অনেকে।

হাসিনার পতন এবং পরে বিচারের রায়ে তাঁর ফাঁসির নির্দেশ থেকে এ কথা আমরা বলতে পারি—কোনো নেতা বা নেত্রী, তা তিনি যত ক্ষমতাধরই হোন না কেন, অপরিহার্য নন। ভীতি অথবা মিথ্যা গালগপ্পো তাঁর অনন্ত ক্ষমতা ধারণের কোনো নিশ্চয়তা নয়। জর্জ অরওয়েল লিখেছিলেন, ‘সব স্বৈরতন্ত্রই প্রতারণা ও বলপ্রয়োগের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে; কিন্তু প্রতারণা একবার উন্মোচিত হলে, তাঁদের ভরসা থাকে শুধু শক্তির ওপর। কিন্তু সেই শক্তিও একসময় কর্পূরের মতো উবে যায়, পড়ে থাকে পতিত স্বৈরশাসকের বিস্মিত ও ভীতসন্ত্রস্ত মুখ।’

হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ স ন র পতন র জন ত ক বল ছ ল ন ক ষমত র ক ষমত ধ ত ক ষমত র জন য র সময় র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

আগামী বছর জলবায়ু সম্মেলন কপ৩১ আয়োজনের দায়িত্ব পেল তুরস্ক

আগামী বছর জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ৩১ আয়োজন করতে যাচ্ছে তুরস্ক। অস্ট্রেলিয়া যৌথভাবে এ সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তুরস্ক এ দায়িত্ব পেয়েছে। তবে এ সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে দর–কষাকষির নেতৃত্ব দেবে অস্ট্রেলিয়া।

আজ বৃহস্পতিবার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ জানিয়েছেন, ব্রাজিলে আয়োজিত কপ৩০-এ সমঝোতার মধ্য দিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এই সমঝোতায় কপ৩১ আয়োজন নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও তুরস্কের মধ্যে চলমান বিরোধের অবসান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২২ সালে দুই দেশই সম্মেলনটি আয়োজনের আবেদন করেছিল। সমঝোতার আগপর্যন্ত কোনো পক্ষই নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসতে রাজি হয়নি।

অ্যান্থনি আলবানিজ বলেন, বর্তমানে দুই দেশ এমন একটি চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছেছে, যার আওতায় তুরস্ক কপ৩১ এর সভাপতিত্ব করবে এবং সম্মেলন–পূর্ববর্তী অনুষ্ঠান প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে দর–কষাকষির দায়িত্ব পালন করবে অস্ট্রেলিয়া।

আরও পড়ুনদুই ধাপে চুক্তি সম্পন্ন করতে চায় ব্রাজিল১৬ ঘণ্টা আগে

অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (এবিসি) রেডিওকে আলবানিজ বলেন, এই সমঝোতা অস্ট্রেলিয়া ও তুরস্ক—দুই দেশের জন্যই বড় জয়।

উভয় দেশকে মাত্র এক বছরের মধ্যে এই বিশাল সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে হবে। এতে কয়েক হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করবেন এবং জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনা হবে।

আরও পড়ুন‘আমাজনকে মুক্ত করুন’ স্লোগান, হাজারো মানুষের বিক্ষোভ১৬ নভেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ