এমনই হয়। বিপদ, সংকট বা সমস্যা এভাবেই চারদিক দিয়ে ধেয়ে আসে। বিহারের বিধানসভা ভোটে অপ্রত্যাশিত ভরাডুবির পর লালু প্রসাদের পরিবারে ঘনিয়েছে অভূতপূর্ব সংকট।

একে একে চার কন্যা পাটনার পিতৃপরিবার ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। তা নিয়ে দলেও চর্চা শুরু হয়েছে। কেননা কন্যাদের অভিযোগের তির যাঁদের বিরুদ্ধে, তাঁরা কেউ পরিবারের না হয়েও লালুর কনিষ্ঠ পুত্র তেজস্বীর সব ঋতুর বন্ধু। অভিযোগ, তাঁদের পরামর্শেই তেজস্বী দল চালাচ্ছেন। তাঁদের কথাতেই ওঠবস করছেন।

এই অবস্থায় পরিবারের কর্তার নীরবতা পালন অস্বাভাবিক বলেই লালু জানিয়ে দিলেন, ঘরের সমস্যা তিনি ঘরেই মেটাবেন। গত সোমবার দলীয় বিধায়কদের নিয়ে ডাকা বৈঠকে তিনি বলেন, পরিবারের সমস্যা তিনি পরিবারের মধ্যেই মেটাবেন। দলের নেতাদের উচিত পারিবারিক এই কোন্দলের দিকে না তাকিয়ে দল ও সংগঠনের প্রতি মনোযোগী হওয়া। দলকে শক্তিশালী করে তোলাই এই মুহূর্তের প্রধান কাজ।

লালু প্রসাদ ও রাবড়ি দেবীর মোট সন্তান ৯ জন। ৭ মেয়ে, ২ ছেলে। সবচেয়ে বড় কন্যা মিসা ভারতী। ৪৯ বছর বয়সী মিসা সেই সময় জন্মেছিলেন, যখন দেশে চালু ছিল ‘মেইনটেন্যান্স অব ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’, সংক্ষেপে যা পরিচিত ছিল ‘মিসা’ বলে।

আরও পড়ুনকিংমেকার ‘পি কে’ চাইছেন বিহারের রাজা হতে২২ অক্টোবর ২০২৫

সেই ‘কালাকানুনে’ জরুরি অবস্থার সময় লালুকে বন্দী করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ‘মিসা’ নামেই নামকরণ হয়েছিল লালু-রাবড়ির প্রথম সন্তান। মিসা ডাক্তারি পাস করে রাজনীতিতে আসেন। পাটলিপুত্র কেন্দ্র থেকে লোকসভার নির্বাচিত সদস্যও তিনি।

লালুর সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট তেজস্বী। ৩৫ বছরের এই সাবেক ক্রিকেটারের হাতেই লালু তুলে দিয়েছেন আরজেডির দায়িত্ব। স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তে পড়তে পড়াশোনা ছেড়ে ক্রিকেটে আকৃষ্ট হন তিনি। পরে চলে আসেন রাজনীতিতে।

বাবার সঙ্গে থেকে থেকে রাজনীতির মারপ্যাঁচ আয়ত্ত করে এ দেশের রাজনৈতিক রীতিনীতি অনুযায়ী উত্তরাধিকার সূত্রে তুলে নিয়েছেন বাবার তৈরি দলের ভার। লালু প্রসাদের পারিবারিক কলহের উৎসও তিনি।

ছোট ভাই তেজস্বী ও তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু সঞ্জয় যাদব এবং রামিজ নেমত খানের বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি অভিযোগ এনে পিতৃপরিবার ছেড়ে চলে গিয়ে যিনি শোরগোল ফেলে দিয়েছেন, সেই রোহিনী আচার্য লালুর দ্বিতীয় সন্তান।

বড় বোন মিসার মতো রোহিনীও ডাক্তার। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার স্বামী সমরেশ সিং ও তিন সন্তানের সঙ্গে তিনি থাকেন সিঙ্গাপুরে। ৪৬ বছরের এই রোহিনীই তাঁর একটি কিডনি দিয়ে পিতা লালুর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন ২০২২ সালে।

২০২৪ সালে লোকসভা ভোটে লালু ও রাবড়ি দেবীর পুরোনো কেন্দ্র সারন থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন রোহিনী। জেতেননি। সামাজিক মাধ্যমে এই রোহিনীর পোস্টেই বিরক্ত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ। জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসার সেটাও ছিল এক কারণ।

রোহিনীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পিতৃগৃহ ত্যাগ করেছেন লালু-রাবড়ির তৃতীয় কন্যা চন্দা সিং, চতুর্থ কন্যা রাগিণী ও সপ্তম কন্যা রাজলক্ষ্মীও।

মিসা ও রোহিনীর মতো চন্দা অবশ্য রাজনীতিতে আসেননি। তাঁর স্বামী বিক্রম সিং পাইলট। রাগিণী ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও পড়া শেষ করেননি। এর আগেই বিয়ে হয়ে যায় রাহুল যাদবের সঙ্গে। এই রাহুল উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংয়ের আত্মীয়। সেই সূত্রে দুই যাদব পরিবার আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধা পড়েছে।

লালু প্রসাদের পঞ্চম কন্যা হেমা যাদবও রাজনীতিতে আসেননি। স্বামী বিনীতের সঙ্গে সংসার করছেন। রাজনীতির আলো তাঁদের মুখে পড়েনি। বিতর্কও সৃষ্টি হয়নি।

ষষ্ঠ কন্যা আনুশকা রাও আইন ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করেন। তাঁর স্বামী চিরঞ্জীবী রাও হরিয়ানার সাবেক কংগ্রেসি বিধায়ক। এই পারিবারিক বিতর্কে হেমা ও আনুশকা কোন পক্ষে, এখনো অজানা।

রোহিনীর পাশে ভাই তেজপ্রতাপ

একে একে ছয় কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার পর রাবড়ি দেবীর গর্ভে আসেন তেজপ্রতাপ। ৩৭ বছরের তেজপ্রতাপও ছোট ভাইয়ের মতো পড়াশোনা ছেড়ে রাজনীতিতে চলে আসেন। তেজস্বী লেখাপড়া ছেড়েছিলেন নবম শ্রেণিতে, তেজপ্রতাপ দ্বাদশ শ্রেণির পর আর পড়াশুনা করেননি।

বিধানসভায় দাঁড়িয়ে ভোটে জিতে নীতীশ মন্ত্রিসভার সদস্য হলেও দলে ক্রমেই তেজপ্রতাপকে ডিঙিয়ে এগিয়ে যান তেজস্বী। বাবার হাত থেকে দলের ভারও একসময় তিনিই তুলে নেন। এই ব্যাটন বদলে লালুরও সম্মতি ছিল।

তেজপ্রতাপকে নিয়ে লালু পরিবারে অশান্তির শুরুও তখন থেকে। পরে তেজপ্রতাপ দল থেকে বহিষ্কৃত হন। পরিবার থেকেও। গড়ে তোলেন নিজের দল। নাম দেন জনশক্তি জনতা দল (জেজেপি)। এবারের ভোটে প্রার্থীও হন। কিন্তু ব্যর্থ।

এই পারিবারিক কোন্দলে বোন রোহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে তেজপ্রতাপ বলেছেন, ‘অপমানিত আমাকেও হতে হয়েছে। আমি সেসব সহ্য করেছি। কিন্তু রোহিনীর সঙ্গে যা হয়েছে, তা সহ্যের অতীত।’

পিতা লালুর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘একবার, শুধু বাবা নির্দেশ দিন, বিহারের মানুষ বিশ্বাসঘাতকদের কবর দেবে। এটা কোনো দলের দখল নেওয়ার লড়াই নয়। এ লড়াই পরিবারের সম্মান বাঁচানোর। এক নারীর সম্মান ও বিহারের মর্যাদা রক্ষার লড়াই।’

রোহিনীর অভিযোগ ঠিক কী

তেজপ্রতাপের দল গঠন ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া লালু পরিবার নিয়ে তেমন কোনো খবর ভোট-পর্বে শোনা যায়নি। হয়তো এই কারণে যে এবার মহাজোট সরকারে চলে আসবে, এই বিশ্বাসই সম্ভবত পারিবারিক কলহ ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। কোন্দল প্রকাশ্যে আসেনি।

গোলমাল শুরু হয় নির্বাচনে ভরাডুবির পর। পরিবারে দোষারোপের পালা শুরু হয়। সামাজিক মাধ্যমে রোহিনী এক বিস্ফোরক পোস্ট করেন। তাতে বলেন, তিনি এক বিবাহিত নারী, এক কন্যা, এক বোন, এক মা। তাঁকে অপমান করা হয়েছে। নোংরা গালিগালাজ করা হয়েছে। আঘাতের জন্য জুতা পর্যন্ত তোলা হয়েছে। তিনি লেখেন, সব সময় সত্যের পথে থেকেছেন। আত্মসম্মানের সঙ্গে আপস করেননি। স্রেফ এই কারণেই অপমান সহ্য করতে হয়েছে।

রোহিনী লেখেন, ‘এক মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে মা, বাবা, বোনদের ফেলে চলে এল। পিতৃগৃহ মাতৃগৃহ থেকে বের করে দেওয়া হলো। অনাথ করে দেওয়া হলো। কোনো পরিবার যেন রোহিনীর মতো কন্যা না পায়।’

এরপর সামাজিক মাধ্যমে আরও একটা পোস্ট দেন রোহিনী। তাতে লেখেন, ‘আমাকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আমি নোংরা। আমার নোংরা কিডনি আমি আমার বাবাকে দিয়েছি। সে জন্য কোটি কোটি টাকা নিয়েছি। বিবাহিত সব মেয়ে বোনদের বলছি, কখনো দেবতুল্য বাবাকে বাঁচাতে যেয়ো না। ভাইদের বোলো, তাঁরা যেন তাঁদের নিজেদের কিংবা হরিয়ানার বন্ধুদের কিডনি দেন। আমি বাবাকে কিডনি দিয়েছিলাম স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির অনুমতি না নিয়ে। আজ আমাকে নোংরা বলা হচ্ছে। আমার মতো ভুল কেউ যেন না করে।’

অভিযোগের তির

তেজপ্রতাপ যাঁদের বিশ্বাসঘাতক বলেছেন, কিংবা রোহিনী যাঁকে ‘হরিয়ানার বন্ধু’ বলেছেন, তাঁরা দুজনেই তেজস্বীর বন্ধু। একজন সঞ্জয় যাদব, অন্যজন রামিজ নেমত খান। দুজনেই তেজস্বীর ছায়াসঙ্গী। রোহিনীর অভিযোগের তিরও ওই দুজনের দিকে ধাবিত। তেজস্বীর ওপর তাঁর রাগ, তিনি সঞ্জয় ও রামিজের হাতে তামাক খাচ্ছেন। দলটাকে ডোবাচ্ছেন।

সঞ্জয় ও রামিজ দুজনের সঙ্গেই তেজস্বীর বন্ধুত্ব ক্রিকেটের সূত্রে। ক্রিকেটার হিসেবে তেজস্বী এমন কিছু আহামরি ছিলেন না। ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছিলেন ঝাড়খন্ডের হয়ে। ওডিশা, আসাম, বাংলা ও ত্রিপুরার বিরুদ্ধে রনজি ট্রফিতে খেলেছেন চারটি ম্যাচ। আইপিএলে নাম লিখিয়েছিলেন দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দলে থাকলেও কোনো ম্যাচ খেলেননি। বেতন ছিল প্রথম দুই বছর ৮ লাখ রুপি করে, পরের দুই বছর ১০ লাখ।

সঞ্জয় যাদব হরিয়ানার বাসিন্দা। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্টের ছাত্র। তেজস্বীর সঙ্গে সঞ্জয়ের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব।

সেই আলাপের রেশ ধরেই ২০১৫ সালে তেজস্বীর ডাকে পাটনা যান সঞ্জয়। লালু ও নীতীশ সেবার বিধানসভা ভোটে কুপোকাত করেন বিজেপিকে। নীতীশের ভোট ম্যানেজার ছিলেন প্রশান্ত কিশোর, আরজেডির সঞ্জয় যাদব। সেই সাফল্য তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য করে তোলে।

রোহিনী-তেজপ্রতাপদের অভিযোগের প্রথম লক্ষ্য যদি হন সঞ্জয়, দ্বিতীয় লক্ষ্য তা হলে রামিজ নেমত খান। উত্তর প্রদেশের বলরামপুরের বাসিন্দা ৩৯ বছরের এই রামিজও ছিলেন ক্রিকেটের পোকা। খেলার সূত্র ধরেই সঞ্জয়ের মতো তিনিও কাছাকাছি চলে আসেন তেজস্বীর। ২০১৬ সালে তিনি যোগ দেন আরজেডিতে। সেই থেকে সঞ্জয় ও রামিজই তেজস্বীর ডান ও বাঁ হাত। তাঁদের পরামর্শ ছাড়া তেজস্বী এক পা–ও চলেন না।

রামিজের বিরুদ্ধে অবশ্য বেশ কিছু ফৌজদারি মামলা আছে। ২০২২ সালে তিনি ও তাঁর স্ত্রী এক খুনের মামলায় আটক হন। পরে জামিন পান। ২০২৪ সালে উত্তর প্রদেশে গ্যাংস্টার আইনেও গ্রেপ্তার হন। পরের বছর জামিন পান।

রোহিনীর ক্ষোভ, যে বাসে চেপে তেজস্বী সারা বিহার চষে বেড়িয়েছেন, তাতে লালু ও রাবড়ি দেবীর জন্য তৈরি করা হয়েছিল দুটি বিশেষ আসন। সেই আসনে সব সময় বসে থেকেছেন সঞ্জয় ও রামিজ। প্রার্থী বাছাই ও টিকিট বিলি হয়েছে তাঁদেরই ইশারায়। তাঁরাই দলকে ডুবিয়েছেন, ভাইকেও।

অবশেষে আসরে লালু

ঘরোয়া বিবাদ মেটাতে অবশেষে আসরে নামতে হয়েছে ৭৭ বছরের অসুস্থ, অশক্ত লালু প্রসাদকে। রোহিনীর অভিযোগে জেরবার তেজস্বী পরিষদীয় দলের বৈঠকের আগে নির্বাচিত বিধায়কদের বলে দেন, তাঁরা যেন অন্য কাউকে নেতা নির্বাচন করেন। যাঁকে উত্তরাধিকার হিসেবে মেনে নিয়েছেন, তাঁকে এভাবে পাশে সরিয়ে রাখতে পারবেন না বলেই সেই বৈঠকের আগে আসরে নামেন লালু। বলেন, পরিবারের গোলমাল তিনি পরিবারেই মেটাবেন। দলকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেবেন না।

বাবার আশ্বাসে তেজস্বীই আবার নেতা হয়েছেন। এবারের ভোটে বিজেপি ও জেডিইউর চেয়ে বেশি ভোট পেয়েও আরজেডিকে কেন এত কম আসন পেতে হলো, মহাজোটকে কেন এভাবে হতাশ হতে হলো, সেই ময়নাতদন্ত শুরু হয়েছে।

তেজস্বীকে নতুনভাবে শুরু করতে হবে পথচলা। পরিবারের অশান্তি মেটানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন লালু। কিন্তু গৃহত্যাগী চার কন্যার মানভঞ্জন করতে পারবেন কি?

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি

মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস দ র প পর ব র র র জন ত ত সন ত ন র বন ধ হয় ছ ল দ র পর প রথম আরজ ড বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

ভূমিকম্পে আশ্রয় নেওয়ার মতো খোলা জায়গা নেই ঢাকায়

ছবি: সাজিদ হোসেন

সম্পর্কিত নিবন্ধ