পারিবারিক জীবনে ‘নারী’, রাষ্ট্রীয় জীবনে ‘ব্যক্তি’
Published: 9th, November 2025 GMT
অসময়ে আজানের ধ্বনি! ব্যাপার কী? না, তিন কন্যাসন্তানের পর রজব আলীর ঘরে পুত্রসন্তান জন্মেছে। শুধু তা–ই নয়। শুনতে পাচ্ছেন কি শঙ্খধ্বনি! উলুধ্বনি! ঠিকই ধরেছেন, নারায়ণ সরকার বড়ই ভাগ্যবান! প্রথমেই তার ঘর আলো করে এসেছে পুত্রসন্তান। দুই প্রতিবেশীর ঘরেই আজ আনন্দের বন্যা।
নারীর প্রতি বৈষম্য কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই শুরু। কন্যাভ্রূণ হত্যায় না–ই বা গেলাম। এই যে জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে জীবনের পরতে পরতে কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্য, নারীর প্রতি বৈষম্য—এর জবাব দেবে কে?
চলুন, প্রথমে জেনে নিই, আমার কন্যারা, আমার নারীরা সন্তান, না কন্যাসন্তান? ব্যক্তি (পারসন) কি না? যদি ‘ব্যক্তি’ হয়ে থাকে, তবে সেখানে কোনো বৈষম্য আছে কি না? কী বলে আমাদের সংবিধান?
আমাদের সংবিধানের আর্টিকেল ২৭–এ নারী–পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’
আর্টিকেল ২৮(১)–এ আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’
আর্টিকেল ২৮(২)–এ বলা আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’
আর্টিকেল ২৯(১)–এ বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী–পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই, সবাই সমান অধিকার লাভ করবে।
এবার সংবিধানের আর্টিকেল ৪১–এ আসুন। এই আর্টিকেল ‘ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন’ অর্থাৎ ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছে। চলুন, আমরা আর্টিকেল ৪১টি একটু দেখে নিই। আর্টিকেল ৪১ (১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে (ক) ‘প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে’ মর্মে উল্লেখ করেছে।
অর্থাৎ ‘আইন’ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার আছে। আর এই ‘আইন’ আমাদের পারিবারিক আইন, যে পারিবারিক আইন নারীকে সম–অধিকার দেয়নি।
আর এ কারণেই সংবিধানের আর্টিকেল ২৭–এ রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী-পুরুষের সম–অধিকার স্বীকৃত হলেও আর্টিকেল ৪১–এর ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’র ‘সুগার কোটিং’ সত্ত্বেও পারিবারিক আইনের বাতাবরণে নারীকে পারিবারিক জীবনে নারীই থেকে যেতে হয়েছে; নারী পরিবারে ব্যক্তি বা সিটিজেন হতে পারেনি।
অর্থাৎ পরিবারে তুমি নারী। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মে তুমি ব্যক্তি বা সিটিজেন বা নাগরিক। এই যে নারী–পুরুষ নিয়ে রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক আইনের দোলাচল, এখানেই নারীর প্রতি বৈষম্য শুরু। এই বৈষম্যই আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
পরিবারে বৈষম্যএকবার ভাবুন, যে মুসলিম মেয়ে তার ভাইয়ের সঙ্গে একইভাবে বড় হলো, একই সঙ্গে বিসিএস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হলো, সে তার পিতার অবর্তমানে ভাইয়ের সমান সম্পত্তি পাবে না, পাবে ভাইয়ের অর্ধেক সম্পত্তি। আর যদি সে হয় হিন্দু কন্যা, তবে তো কথাই নেই। ভাইয়ের উপস্থিতিতে পিতার অবর্তমানে সে কোনো সম্পত্তিই পাবে না। ভাইয়ের সঙ্গে সমযোগ্যতায় রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্টিকেল ২৭–এর নারী–পুরুষের সমান অধিকার বলে ম্যাজিস্ট্রেট হলেও পারিবারিক জীবনে পারিবারিক আইনের কারণে নারী পুরুষের সম–অধিকার থেকে সে হয় বঞ্চিত, তা আপনি হিন্দু, বৌদ্ধ বা ইসলাম—যে ধর্মেরই হোন না কেন।
প্রথমেই শুরু করেছিলাম, ঠিক জন্মমুহূর্ত থেকে কন্যারা, নারীরা কীভাবে বৈষম্যের শিকার। সংসারে, পরিবারে নারী নারীই। ব্যক্তি নয়, সন্তান নয়। যতই আপনি কন্যাসন্তান জন্মের পর আহ্লাদিত হোন না কেন, যতই বলুন না কেন, আপনার চোখে কন্যা–পুত্র যা–ই হোক না কেন, সে ‘সন্তান’। কিন্তু আইন কি তা বলে? সমাজ কি তা বলে? আপনার কন্যাসন্তানটিকে আপনি আপনার পুত্রসন্তানের সমান সম্পত্তি ‘দান’ করে দিয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু তা ‘দান’ই; কন্যার অধিকার নয়।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও সরাসরি নির্বাচনে জিতে সংসদ সদস্য হয়েছেন হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র নারী.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প র ব র ক আইন র ক আইন র আর ট ক ল অর থ ৎ পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
কারও দলীয় স্বার্থ বাস্তবায়ন করা এই সরকারের কাজ নয়: তারেক রহমান
জনগণের ভোটের মাধ্যমে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ ও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম প্রধান কর্তব্য বলে উল্লেখ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘অবশ্যই কারও দলীয় স্বার্থ বাস্তবায়ন করা এই সরকারের কাজ নয়।’
‘হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন-২০২৫’–এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন তারেক রহমান। আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্য জোটের আয়োজনে এ সম্মেলন হয়। সম্মেলনে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠন ও মঠ-মন্দির পরিচালনা কমিটির নেতা–কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ বেদ ও গীতা পাঠের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর অতিথিরা প্রদীপ প্রজ্বালন করেন।
দেশ অস্থিতিশীল হলে পরাজিত, পলাতক ফ্যাসিবাদী অপশক্তির পুনর্বাসনের পথ সুগম হতে পারে বলে সতর্ক করেন তারেক রহমান। এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘গুপ্ত রাজনীতি’ সম্পর্কে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ফ্যাসিবাদের রোষানল থেকে বাঁচতে ফ্যাসিবাদবিরোধীদের কেউ কেউ ‘গুপ্ত কৌশল’ অবলম্বন করেছিল। একইভাবে পতিত–পরাজিত ফ্যাসিবাদী অপশক্তিও বর্তমানে ‘গুপ্ত কৌশল’ অবলম্বন করে দেশের গণতন্ত্রে উত্তোরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করে কি-না, সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান রাখছেন।
ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গী কারও কারও ভূমিকা দেশে ‘আপনার, আমার, আমাদের’ বহু মানুষের অধিকার ও সুযোগকে বিনষ্ট করার হয়ত একটি পরিস্থিতি তৈরি করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পতিত ও পলাতক অপশক্তিকে কোনো সুযোগ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘গুপ্ত বাহিনীর সেই অপকৌশল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্যতম প্রধান কৌশল হচ্ছে, একটি ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য বজায় ও বহাল রাখা।’ সেজন্য বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকার এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গীদের সহযোগিতা ও সমঝোতার দৃষ্টিভঙ্গি সমুন্নত রেখেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি বরাবরই ‘একটি শান্তিকামী, সহনশীল, গণমুখী’ রাজনৈতিক দল বলে উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ভিন্ন দল, ভিন্ন মতের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা, এটি বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। দেশের জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করার স্বার্থেই বিএনপির রাজনীতি বলেও দাবি করেন তিনি।
নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে স্বল্প আয়ের মানুষদের সহায়তার জন্য ৫০ লাখ ‘ফ্যামিলি কার্ড’ বিতরণ এবং তরুণদের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা হবে বলে ঘোষণা করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং একই সাথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভাষা শিক্ষা দিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করে দেশে এবং বিদেশে কাজের ব্যবস্থার পরিকল্পনা আমরা এর মধ্যে হাতে নিয়েছি।’
বাংলাদেশে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্যের বন্ধনই আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সৌন্দর্য।’ এই বৈচিত্র্যময় সমাজে ঐক্যসূত্র বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসাবে এই বাংলাদেশে আপনার যতটুকু অধিকার আমারও ঠিক ততটুকুই অধিকার। কারও বেশি, কারও কম– তা নয়।’ এ সময় তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের উত্থাপিত বিভিন্ন দাবি পূরণের আশ্বাস দেন।
মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্য জোটের আহ্বায়ক সোমনাথ সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবিগুলো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে তুলে ধরেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ইকবাল হাসান মাহমুদ।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্য জোটের সদস্যসচিব ও মুখপাত্র কপিল কৃষ্ণ মণ্ডল, সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক সমেন সাহা, হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, হিন্দু ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিজন কান্তি সরকার, মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতা সুবর্ণা রানী ঠাকুর প্রমুখ।