‘ভিক্কে লয়, গানের ট্যাকা দিয়া ব্যাটাটাক মানুষ করিম’
Published: 13th, May 2025 GMT
‘এই মন তোমাকে দিলাম/ এই প্রেম তোমাকে দিলাম/ তুমি চোখের আড়াল হও/ কাছে কিবা দূরে রও/ মনে রেখো আমিও ছিলাম...।’ এ গান ভেসে আসছিল গাইবান্ধা শহরের রেলগেট এলাকার একচালা একটি চায়ের দোকান থেকে।
সেখানে বিভোর হয়ে গান গাইছেন এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী যুবক। নাম শহিদুল ইসলাম (৩০)। ছড়ি হাতে হেঁটে ভিক্ষা করেন তিনি। সপ্তাহের তিন দিন জেলা শহর আর বাকি চার দিন গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে অর্থসহায়তা চান তিনি।
রেলগেট এলাকায় কার্তিকের চায়ের দোকান নামে পরিচিত ওই জায়গায় বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান গেয়ে শোনান শহিদুল। ‘এই বুকে বইছে যমুনা/ অথই প্রেমের জল’; ‘কোনো একদিন আমায় তুমি খুঁজবে/ সেই দিন ওগো প্রিয়ে আমার ভালোবাসা বুঝবে’; ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে’।
গতকাল রোববার বিকেলে শহিদুলের গান মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মোদাছিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও তিনি (শহিদুল) প্রতিভাবান। তাঁর সুরেলা কণ্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হলাম। তিনি প্রায়ই চায়ের দোকানটিতে আসেন। আর গানগুলো শিকড়ের গান। যা হৃদয় স্পর্শ করে।’
মোদাছিরুজ্জামানের কথায় ভাগ বসিয়ে স্থানীয় আইনজীবী শাহনেওয়াজ খান বলেন, শহিদুলের গান শুনে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হন। সবাই তাঁকে ভালোবাসেন। অনেকে গান শুনে আর্থিক সহায়তাও করেন।
কার্তিকের চায়ের দোকানে প্রায়ই আসেন শহিদুল। তাঁর গানের কারণে চায়ের দোকানটিতে প্রায়ই লোক জড়ো হন। এতে চায়ের বিক্রিও ভালো হয় বলে জানান কার্তিক।
গানের শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহিদুল ইসলামের কণ্ঠে যে সুর আছে, তা অনেকেই জানতেন না। একদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁর একটি গান ভাইরাল হয়। তখন থেকেই তাঁকে দেখলে অনেকেই গান শোনার আবদার করেন। কখনো চায়ের স্টলে, কখনো ফুটপাতে কিংবা গাছতলায় বসে তাঁকে সেসব আবদার মেটাতে হয়। গান শুনে খুশি হয়ে অনেকেই ১০, ৫০, ১০০ টাকা দেন। আগে প্রতিদিন ভিক্ষা করে তিনি পেতেন ২০০-৩০০ টাকা। তা দিয়ে টেনেটুনেও পাঁচজনের সংসার চালাতে পারতেন না। এখন গান গেয়ে তাঁর কিছুটা বাড়তি উপার্জন হচ্ছে। ভিক্ষার পাশাপাশি গান গেয়ে দৈনিক আয় করছেন ৫০০-৬০০ টাকা। তবে প্রতিদিন একই অবস্থা থাকে না। শ্রোতারা গান না শুনলে ভিক্ষার টাকার ওপরই তাঁকে নির্ভর করতে হয়।
শহিদুল ইসলাম গাইবান্ধা সদর উপজেলার উত্তর ঘাঘোয়া গ্রামের দিনমজুর রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে। মা সবিরন বেগম গৃহিণী। চার ভাই–বোনের মধ্যে শহিদুল দ্বিতীয়। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে, ছোট বোন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। শহিদুল জন্ম থেকেই অন্ধ; লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। তবে ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি বেশ দুর্বলতা ছিল। কিন্তু গান শেখার সুযোগ পাননি। দুই বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে বাবা প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অভাবের সংসার, অন্ধত্ব—এসব কারণে কাজ না পেয়ে শহিদুল মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকেই ভিক্ষাবৃত্তিতে নামেন।
পরিবারের বিষয়ে শহিদুল জানান, ২০২০ সালের শেষ দিকে তিনি এক নারীকে বিয়ে করেছিলেন। কয়েক মাস পর তাঁকে ফেলে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চলে যান স্ত্রী। পরে একটি ছেলের জন্ম হয়। ছেলেটি তাঁর কাছেই আছে। পাঁচ বছর বয়সী ছেলেসহ শহিদুলের সঙ্গে আছেন তাঁর মা, বাবা আর ছোট বোন। বাবার দিনমজুরি এবং তাঁর ভিক্ষার টাকা দিয়ে কোনোমতে পাঁচ সদস্যের সংসার চলে।
ভিক্ষাবৃত্তিকে লজ্জার কাজ বলে মনে করেন শহিদুল। তিনি বলেন, ‘ভিক্কে করান নজ্জার কাম। তাই গান কয়া কামাই করব্যার চাম। হামাক অনুষ্ঠানগুলেত গান কওয়ার দিলে ভিক্কে করান নাগতো না। একন গান কয়া কামাই করি মুই বাকি জীবনটে কাটে দিব্যার চাম। গানের ট্যাকা দিয়া ব্যাটাটাক মানুষ করিম।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
রেহানা, টিউলিপ, আজমিনা ও রাদওয়ানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু
পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে পৃথক তিন মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের (ববি) বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।
দুর্নীতির দমন কমিশনের (দুদক) করা এই তিন মামলায় আজ বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এ এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম আলোকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) তরিকুল ইসলাম।
টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি)। তিনি দেশটির সাবেক ‘সিটি মিনিস্টার’। তিনি এখন বাংলাদেশে বিচারের মুখোমুখি।
এর আগে গত ১১ আগস্ট প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের অপর তিন মামলায় শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।
পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের করা পৃথক ছয় মামলায় শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবারের সদস্যসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে গত ৩১ জুলাই অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার দুই বিশেষ জজ আদালত। এর মধ্যে তিন মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১১ আগস্ট তারিখ ধার্য করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন। বাকি তিন মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৩ আগস্ট তারিখ ধার্য করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক মো. রবিউল আলম।
আরও পড়ুনপ্লট বরাদ্দে দুর্নীতির মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু১১ আগস্ট ২০২৫মামলায় শেখ হাসিনা পরিবারের বাইরে যে ১৬ জন অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁরা হলেন জাতীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, গণপূর্তের তৎকালীন সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিয়া, সাবেক সদস্য মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, সদস্য কবির আল আসাদ, সদস্য তন্ময় দাস, সদস্য নুরুল ইসলাম, সাবেক সদস্য মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, সাবেক সদস্য সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, পরিচালক শেখ শাহিনুল ইসলাম, উপপরিচালক হাফিজুর রহমান, হাবিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব সালাউদ্দিন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার।
আরও পড়ুনটিউলিপের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব রয়েছে১১ ঘণ্টা আগেদুদকের পিপি খান মো. মইনুল হোসেন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী, ঢাকায় যাঁদের প্লট-গাড়ি-বাড়ি কিছুই নেই, তাঁরা মূলত সংস্থার প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন করতে পারেন। কিন্তু শেখ হাসিনার পরিবার রাজউকের কাছে মিথ্যা হলফনামা দেয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, তাঁদের ঢাকা শহরে জমি-বাড়ি কোনো কিছুই নেই। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, শেখ হাসিনা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের নামে বাড়ি-জমি-গাড়ি সবই আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁরা রাজউকের ৬০ কাঠার প্লট নিয়েছেন, যা অপরাধ। অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গসহ অন্যান্য অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনা-রেহানা-টিউলিপসহ ২৩ জনকে আদালতে হাজিরে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির নির্দেশ০১ জুলাই ২০২৫দুদকের পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের ছয় মামলায় শেখ হাসিনাসহ অন্যদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পরে মামলাগুলো বিচারের জন্য দুটি বিচারিক আদালতে বদলির আদেশ দেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত।
শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে বরাদ্দ নেওয়া প্লটের বিষয়ে ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৬০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে ছয় মামলায় গত ১০ মার্চ অভিযোগপত্রের অনুমোদন দেয় দুদক।
টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে: দুদক চেয়ারম্যানআমাকে হয়রানির জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে: টিউলিপটিউলিপের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আদালতের বিষয়, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ নয়: মুহাম্মদ ইউনূস