শাড়ি পরে ক্লাসে আসতে হয় মেয়েটিকে
Published: 23rd, November 2025 GMT
মেয়েটি বসেছিল শ্রেণিকক্ষের দ্বিতীয় বেঞ্চে। স্কুল ইউনিফর্ম পরা একদল মেয়ের মাঝে কেবল সে-ই শাড়ি পরা। ফলে চট করে তার দিকে চোখ চলে যায়।
বিদ্যালয়ে কোনো অনুষ্ঠান থাকলে মেয়েশিক্ষার্থীরা শাড়ি পরে আসে। কিন্তু শুধু একটি মেয়েই কেন শাড়ি পরে এসেছে? তাহলে কি বিদ্যালয়ের বাইরে কোনো অনুষ্ঠান? নাকি অন্য কিছু?
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় মেয়েদের এই মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি অবস্থিত। উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বিদ্যালয়টি। বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি জানতে গত ২২ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়টিতে গেলে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।
উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর সাতক্ষীরা জেলার সবচেয়ে বাল্যবিবাহপ্রবণ এলাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘স্মল এরিয়া এস্টিমেশন’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাতক্ষীরায় ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৬২ শতাংশের বেশি। আর শুধু শ্যামনগরেই বাল্যবিবাহের হার ৬৩ শতাংশ। অন্যদিকে জেলার দিক দিয়ে বাল্যবিবাহে সাতক্ষীরার অবস্থান অষ্টম।
সরেজমিনে যাওয়া শ্যামনগরের বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের অনেকেই বাল্যবিবাহের শিকার। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলেই শিক্ষার্থীদের বিয়ে দেওয়া শুরু হয়। আর দশম শ্রেণি পর্যন্ত উঠতে উঠতে একেকটি শ্রেণির প্রায় অর্ধেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। যাদের বিয়ে হয়ে যায়, তাদের অনেকেরই আর বিদ্যালয়ে ফেরা হয় না। পড়াশোনার পাট পাকাপাকি চুকে যায়।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাল্যবিবাহ নিয়ে মেয়েদের লড়াইয়ের গল্পগুলো বলছিলেন। জানা গেল, এই বিদ্যালয়ে এখন যে ব্যাচটি দশম শ্রেণিতে আছে, তাদের ২০ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পর মাত্র একজন বিদ্যালয়ে ফিরেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘স্মল এরিয়া এস্টিমেশন’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাতক্ষীরায় ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৬২ শতাংশের বেশি। আর শুধু শ্যামনগরেই বাল্যবিবাহের হার ৬৩ শতাংশ। অন্যদিকে জেলার দিক দিয়ে বাল্যবিবাহে সাতক্ষীরার অবস্থান অষ্টম।কথায় কথায় শাড়ি পরে বিদ্যালয়ে আসা মেয়েটির গল্পও জানা গেল। মেয়েটি দশম শ্রেণিতে পড়ে। একমাত্র সে-ই বাল্যবিবাহের পর শ্রেণিকক্ষে ফিরেছে।
বিদ্যালয়টির ইউনিফর্ম সাদা কামিজ, খয়েরি রঙের ওড়না ও পায়জামা। সাধারণত স্কুলছাত্রীরা ওড়না যেভাবে ক্রস করে পরে, এখানে সেভাবে পরার চল কম। বিশেষ করে বড় ক্লাসের মেয়েদের। তারা ওড়না গায়ে ছড়িয়ে পরে।
বিদ্যালয়টিতে ইউনিফর্ম পরার বিষয়ে খুব একটা কড়াকড়ি নেই। তবে শাড়ি পরে শ্রেণিকক্ষে আসার ঘটনাও বিরল।
শাড়ি পরে দ্বিতীয় বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকাতেই সে একটা লাজুক হাসি দিল।
মেয়েটিকে জিজ্ঞেস না করে পারা গেল না যে, ‘শাড়ি পরে ক্লাসে এসেছ যে?’
মেয়েটির চটজলদি জবাব, ‘আমি শাড়ি পরেই ক্লাসে আসি।’
কথায় কথায় মেয়েটি জানাল, গত বছর তার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে আর পড়তে দিতে চাইছিল না। তার স্বামীও চায় না। পরে শিক্ষকসহ তার অনেক অনুরোধের পর শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে রাজি হয়। ৫ মাস ধরে সে আবার বিদ্যালয়ে আসছে।
মেয়েটি বলল, ‘ওরা (স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি) বলছেন, শাড়ি না পরলে স্কুলে আসতে দেবে না। জামা-প্যান্ট (ইউনিফর্ম) পরলে লোকজন খারাপ বলবে। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। তাই শাড়ি পরেই স্কুলে আসতে রাজি হয়েছি।’
আরও পড়ুনপ্রতি দুটি মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে১৬ নভেম্বর ২০২৫শিক্ষকের চেষ্টায় রাজি
মেয়েটির স্বামী ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করেন। বয়স ২০ বছর। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। সে ক্ষেত্রে স্বামীরও তো বাল্যবিবাহ হয়েছে—মন্তব্য করলে হেসে মাথা নাড়ায় মেয়েটি।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে, ১৮ বছরের নিচের বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের নিচের বয়সী ছেলের বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ।
শাড়ি পরা মেয়েটির বাল্যবিবাহ নিয়ে শিক্ষকেরা আফসোস করলেন। তাঁরা বললেন, মেয়েটির বাবা ভ্যানচালক। দুই বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে সে দ্বিতীয়। বড় বোন একই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছে। ভাই ছোট।
বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটি নিজের পছন্দে বাল্যবিবাহ করেছে। বিয়ের দুই দিন পর মেয়ের বাবা তাঁকে বিষয়টি জানান। মেয়েটি মেধাবী। তাই তিনি পড়া চালু রাখতে অনুরোধ জানান মেয়েটির স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে। কিন্তু তাঁরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না।
আরও পড়ুনএশিয়ায় বাল্যবিবাহে শীর্ষে বাংলাদেশ, বিশ্বে অষ্টম০৯ মার্চ ২০২৫বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে, ১৮ বছরের নিচের বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের নিচের বয়সী ছেলের বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ।ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘পরিবারটি যাঁদের কথা শোনে, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাঁদের মাধ্যমে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মেয়ের স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়িকে রাজি করাই। তবে তাঁরা রাজি হয়েছেন একটি শর্তে—মেয়েটিকে শাড়ি পরে আসতে হবে। স্কুলের ইউনিফর্ম আছে। কিন্তু আমিও ভাবলাম, শাড়ি পরতে দিলে যদি মেয়েটি পড়তে পারে, তাহলে আসুক না শাড়ি পরে। যত দিন স্কুলে আসতে পারে, আসুক।’
মেয়েটি এসএসসি পরীক্ষা দেবে কি না, জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘মেয়েটার খুব ইচ্ছা পরীক্ষা দেওয়ার। দেখা যাক, ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে কী বলে।’
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের কণ্ঠে হতাশা। তিনি বললেন, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের অনেক বোঝানোর পরও তাঁরা ঠেকাতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্র্য, অসচেতনতা ও নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে বাবা-মা মেয়ের বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরাও নিজেদের পছন্দে বিয়ে করে ফেলছে।
মেয়েটিকে প্রশ্ন করি, ‘পড়াশোনা চালিয়ে যাবে?’
জবাবে বলল, ‘আমি তো পড়তেই চাই। এসএসসি পরীক্ষা দিতে চাই। দেখি, ওরা কী বলে।’
আরও পড়ুনসচেতনতামূলক পদক্ষেপে বাল্যবিবাহ কমে ৫৪%১১ ডিসেম্বর ২০২৪১৬০ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ
শ্যামনগর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা দপ্তরের উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মিনা হাবিবুর রহমান জানালেন, এখানে ৩৬টি মাদ্রাসাসহ ৮২টি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট ১ হাজার ১২ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছাত্রী ৮০০ জন।
মিনা হাবিবুর রহমান জানান, বাল্যবিবাহের কারণে বিদ্যালয়গুলোতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত গড়ে ৩০ শতাংশ এবং মাদ্রাসাগুলোয় ৫০ শতাংশ ছাত্রী থাকে না।
মিনা হাবিবুর রহমান বলেন, এখানে অসাধু কাজিদের কারণেও বাল্যবিবাহ হচ্ছে। কাজিরা দুটি খাতা রাখেন। একটি খাতায় বাল্যবিবাহ হয়—এমন ছেলেমেয়ের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। এটি প্রশাসনকে দেখানো হয় না। বাল্যবিবাহের নিবন্ধনও হয় না। ফলে নির্যাতনের শিকার হয়ে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটলে মেয়েরা আইনি সুবিধাও পায় না।
আরও পড়ুন৫১% মেয়ের বিয়ে আঠারোর আগেই১২ জুন ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বছর র ন চ র বয়স ব দ য লয়ট দশম শ র ণ ১৮ বছর র ইউন ফর ম শ য মনগর র অন ক উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
শাড়ি পরে ক্লাসে আসতে হয় মেয়েটিকে
মেয়েটি বসেছিল শ্রেণিকক্ষের দ্বিতীয় বেঞ্চে। স্কুল ইউনিফর্ম পরা একদল মেয়ের মাঝে কেবল সে-ই শাড়ি পরা। ফলে চট করে তার দিকে চোখ চলে যায়।
বিদ্যালয়ে কোনো অনুষ্ঠান থাকলে মেয়েশিক্ষার্থীরা শাড়ি পরে আসে। কিন্তু শুধু একটি মেয়েই কেন শাড়ি পরে এসেছে? তাহলে কি বিদ্যালয়ের বাইরে কোনো অনুষ্ঠান? নাকি অন্য কিছু?
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় মেয়েদের এই মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি অবস্থিত। উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বিদ্যালয়টি। বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি জানতে গত ২২ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়টিতে গেলে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।
উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর সাতক্ষীরা জেলার সবচেয়ে বাল্যবিবাহপ্রবণ এলাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘স্মল এরিয়া এস্টিমেশন’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাতক্ষীরায় ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৬২ শতাংশের বেশি। আর শুধু শ্যামনগরেই বাল্যবিবাহের হার ৬৩ শতাংশ। অন্যদিকে জেলার দিক দিয়ে বাল্যবিবাহে সাতক্ষীরার অবস্থান অষ্টম।
সরেজমিনে যাওয়া শ্যামনগরের বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের অনেকেই বাল্যবিবাহের শিকার। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলেই শিক্ষার্থীদের বিয়ে দেওয়া শুরু হয়। আর দশম শ্রেণি পর্যন্ত উঠতে উঠতে একেকটি শ্রেণির প্রায় অর্ধেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। যাদের বিয়ে হয়ে যায়, তাদের অনেকেরই আর বিদ্যালয়ে ফেরা হয় না। পড়াশোনার পাট পাকাপাকি চুকে যায়।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাল্যবিবাহ নিয়ে মেয়েদের লড়াইয়ের গল্পগুলো বলছিলেন। জানা গেল, এই বিদ্যালয়ে এখন যে ব্যাচটি দশম শ্রেণিতে আছে, তাদের ২০ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পর মাত্র একজন বিদ্যালয়ে ফিরেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘স্মল এরিয়া এস্টিমেশন’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাতক্ষীরায় ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৬২ শতাংশের বেশি। আর শুধু শ্যামনগরেই বাল্যবিবাহের হার ৬৩ শতাংশ। অন্যদিকে জেলার দিক দিয়ে বাল্যবিবাহে সাতক্ষীরার অবস্থান অষ্টম।কথায় কথায় শাড়ি পরে বিদ্যালয়ে আসা মেয়েটির গল্পও জানা গেল। মেয়েটি দশম শ্রেণিতে পড়ে। একমাত্র সে-ই বাল্যবিবাহের পর শ্রেণিকক্ষে ফিরেছে।
বিদ্যালয়টির ইউনিফর্ম সাদা কামিজ, খয়েরি রঙের ওড়না ও পায়জামা। সাধারণত স্কুলছাত্রীরা ওড়না যেভাবে ক্রস করে পরে, এখানে সেভাবে পরার চল কম। বিশেষ করে বড় ক্লাসের মেয়েদের। তারা ওড়না গায়ে ছড়িয়ে পরে।
বিদ্যালয়টিতে ইউনিফর্ম পরার বিষয়ে খুব একটা কড়াকড়ি নেই। তবে শাড়ি পরে শ্রেণিকক্ষে আসার ঘটনাও বিরল।
শাড়ি পরে দ্বিতীয় বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকাতেই সে একটা লাজুক হাসি দিল।
মেয়েটিকে জিজ্ঞেস না করে পারা গেল না যে, ‘শাড়ি পরে ক্লাসে এসেছ যে?’
মেয়েটির চটজলদি জবাব, ‘আমি শাড়ি পরেই ক্লাসে আসি।’
কথায় কথায় মেয়েটি জানাল, গত বছর তার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে আর পড়তে দিতে চাইছিল না। তার স্বামীও চায় না। পরে শিক্ষকসহ তার অনেক অনুরোধের পর শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে রাজি হয়। ৫ মাস ধরে সে আবার বিদ্যালয়ে আসছে।
মেয়েটি বলল, ‘ওরা (স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি) বলছেন, শাড়ি না পরলে স্কুলে আসতে দেবে না। জামা-প্যান্ট (ইউনিফর্ম) পরলে লোকজন খারাপ বলবে। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। তাই শাড়ি পরেই স্কুলে আসতে রাজি হয়েছি।’
আরও পড়ুনপ্রতি দুটি মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে১৬ নভেম্বর ২০২৫শিক্ষকের চেষ্টায় রাজি
মেয়েটির স্বামী ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করেন। বয়স ২০ বছর। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। সে ক্ষেত্রে স্বামীরও তো বাল্যবিবাহ হয়েছে—মন্তব্য করলে হেসে মাথা নাড়ায় মেয়েটি।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে, ১৮ বছরের নিচের বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের নিচের বয়সী ছেলের বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ।
শাড়ি পরা মেয়েটির বাল্যবিবাহ নিয়ে শিক্ষকেরা আফসোস করলেন। তাঁরা বললেন, মেয়েটির বাবা ভ্যানচালক। দুই বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে সে দ্বিতীয়। বড় বোন একই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছে। ভাই ছোট।
বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটি নিজের পছন্দে বাল্যবিবাহ করেছে। বিয়ের দুই দিন পর মেয়ের বাবা তাঁকে বিষয়টি জানান। মেয়েটি মেধাবী। তাই তিনি পড়া চালু রাখতে অনুরোধ জানান মেয়েটির স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে। কিন্তু তাঁরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না।
আরও পড়ুনএশিয়ায় বাল্যবিবাহে শীর্ষে বাংলাদেশ, বিশ্বে অষ্টম০৯ মার্চ ২০২৫বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে, ১৮ বছরের নিচের বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের নিচের বয়সী ছেলের বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ।ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘পরিবারটি যাঁদের কথা শোনে, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাঁদের মাধ্যমে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মেয়ের স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়িকে রাজি করাই। তবে তাঁরা রাজি হয়েছেন একটি শর্তে—মেয়েটিকে শাড়ি পরে আসতে হবে। স্কুলের ইউনিফর্ম আছে। কিন্তু আমিও ভাবলাম, শাড়ি পরতে দিলে যদি মেয়েটি পড়তে পারে, তাহলে আসুক না শাড়ি পরে। যত দিন স্কুলে আসতে পারে, আসুক।’
মেয়েটি এসএসসি পরীক্ষা দেবে কি না, জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘মেয়েটার খুব ইচ্ছা পরীক্ষা দেওয়ার। দেখা যাক, ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে কী বলে।’
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের কণ্ঠে হতাশা। তিনি বললেন, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের অনেক বোঝানোর পরও তাঁরা ঠেকাতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্র্য, অসচেতনতা ও নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে বাবা-মা মেয়ের বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরাও নিজেদের পছন্দে বিয়ে করে ফেলছে।
মেয়েটিকে প্রশ্ন করি, ‘পড়াশোনা চালিয়ে যাবে?’
জবাবে বলল, ‘আমি তো পড়তেই চাই। এসএসসি পরীক্ষা দিতে চাই। দেখি, ওরা কী বলে।’
আরও পড়ুনসচেতনতামূলক পদক্ষেপে বাল্যবিবাহ কমে ৫৪%১১ ডিসেম্বর ২০২৪১৬০ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ
শ্যামনগর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা দপ্তরের উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মিনা হাবিবুর রহমান জানালেন, এখানে ৩৬টি মাদ্রাসাসহ ৮২টি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট ১ হাজার ১২ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছাত্রী ৮০০ জন।
মিনা হাবিবুর রহমান জানান, বাল্যবিবাহের কারণে বিদ্যালয়গুলোতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত গড়ে ৩০ শতাংশ এবং মাদ্রাসাগুলোয় ৫০ শতাংশ ছাত্রী থাকে না।
মিনা হাবিবুর রহমান বলেন, এখানে অসাধু কাজিদের কারণেও বাল্যবিবাহ হচ্ছে। কাজিরা দুটি খাতা রাখেন। একটি খাতায় বাল্যবিবাহ হয়—এমন ছেলেমেয়ের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। এটি প্রশাসনকে দেখানো হয় না। বাল্যবিবাহের নিবন্ধনও হয় না। ফলে নির্যাতনের শিকার হয়ে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটলে মেয়েরা আইনি সুবিধাও পায় না।
আরও পড়ুন৫১% মেয়ের বিয়ে আঠারোর আগেই১২ জুন ২০২৫