ট্রাম্পের প্রক্সি যুদ্ধ ‘ঈশ্বরের ইচ্ছায়’ হচ্ছে!
Published: 17th, October 2025 GMT
বিশ্বের অনেক মানুষ এখন আমেরিকাকে ভালো চোখে দেখে না। তাদের মনে আমেরিকার প্রতি রাগ, ক্ষোভ আর অবিশ্বাস জমে আছে। ‘ম্যানিফেস্ট ডেসটিনি’ বা ‘ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমেরিকার বিস্তৃতি ঘটবে’—উনিশ শতকের এই ধারণাকে একুশ শতকের ভাষায় ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে হাজির করায় নতুন করে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও ঘৃণার ঢেউ উঠতে পারে।
ম্যানিফেস্ট ডেসটিনি বা ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমেরিকার বিস্তৃতি ঘটবে—এ ধারণা প্রথম সামনে এনেছিলেন ডেমোক্র্যাট রিভিউ ম্যাগাজিনের সম্পাদক জন ও’সালিভান। তাঁর লেখার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা বিস্তারকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বা ঐশ্বরিক অনুমোদনের সঙ্গে যুক্ত করার ধারণা জনপ্রিয় হয়। উনিশ শতকে এই ধারণাকে ভিত্তি ধরে আমেরিকা নেটিভ আমেরিকানদের ওপর জুলুম চালিয়েছিল।
আরও পড়ুনগাজা যুদ্ধ থামিয়েও ট্রাম্প নোবেল পেলেন না কেন১২ অক্টোবর ২০২৫১৮৪৫ সালে ও’সালিভান লিখেছিলেন, ‘আবিষ্কার, অনুসন্ধান, বসতি স্থাপন বা প্রতিবেশী অধিকারের মতো হাস্যকর যুক্তি দিয়ে ভূমি দখল বন্ধ করা যাবে না।’ অর্থাৎ নেটিভ বা আদি বাসিন্দাদের ভূমি মালিকানার সব দাবিই তিনি খারিজ করে দিয়েছিলেন। পরে এই ম্যানিফেস্ট ডেসটিনির ধারণা শুধু উত্তর আমেরিকাতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও। ধীরে ধীরে আমেরিকার নেতাদের মনে হতে থাকে, যদি ‘ঈশ্বরের পরিকল্পনা’ অনুযায়ী আমেরিকার পুরো মহাদেশ দখলের অধিকার থাকে, তবে পুরো পৃথিবী কেন নয়?
এই চিন্তার পরিণতি সবচেয়ে ভালো জানে কিউবা ও ফিলিপাইন। উনিশ শতকের শেষভাগে যে যুদ্ধকে কিউবানরা ‘স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনীয় যুদ্ধ’ এবং ফিলিপিনোরা ‘মুক্তির লড়াই’ বলে অভিহিত করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন হে সেটিকে ‘দারুণ এক ছোট যুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সেই সংঘাতেই গঠিত হয়েছিল আধুনিক কিউবা, ফিলিপাইন ও সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্প কিন্তু কোনো ধর্মীয় মিশনারি নন; তিনি একজন ব্যবসায়ী। তাঁর কাছে ভূখণ্ড মানে শুধুই বস্তুগত সম্পদ, যা আমেরিকার মর্যাদা ও সম্পদ বাড়ায়। তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মীয় উন্মাদনা যত কমই হোক, তাঁর ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান সমর্থকেরা তাঁকে শতভাগ সহযোগিতা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদ যে মূল বিশ্বাসে আটকে আছে, তা হলো আমেরিকা যাদের ‘উদ্ধার’ করছে, তারা আমেরিকার চেয়ে নিম্নস্তরের।১৮৯৫ সালে কিউবার মানুষ স্পেনের শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে নামে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলির নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে কিউবার পক্ষ নিয়ে যুক্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্র স্পেনকে পরাজিত করে কিউবার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এই সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বিশ্বে একটি শক্তিশালী এবং সদয় দেশ হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়; যেন তারা ঈশ্বরের নির্দেশে অন্য দেশের জন্য শান্তি বজায় রাখছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে দেখিয়েছিল, তারা শুধু শক্তিশালী নয়, বরং শান্তি রক্ষার দায়িত্বও নিতে পারে।
কিন্তু একই সময়ে ফিলিপাইনে যা ঘটেছিল, তা ছিল ভয়াবহ। দুর্ভিক্ষ, রোগব্যাধি, মৃত্যু, পরিবেশ ধ্বংস দ্বীপরাষ্ট্রটিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। ১৮৯৮ সালের প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে স্পেন ফিলিপাইনকে আমেরিকার হাতে তুলে দিলে শিগগিরই ফিলিপিনো ও মার্কিন বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ফিলিপাইন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ।
আরও পড়ুনট্রাম্প যা করছেন, তাতে তুরস্ক আর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫যুক্তরাষ্ট্র বারবার একই ভুল করে। ১৮৯৮ সালের ‘দারুণ ছোট যুদ্ধ’ ভবিষ্যতের সব মার্কিন যুদ্ধে নকশা ঠিক করে দিয়েছে। এসব যুদ্ধ শুরু হয় স্বল্প সময়ের জন্য এবং সহজ জয় পাওয়ার আশায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করে। এই যুদ্ধ আমেরিকার মধ্যে এক যুদ্ধবীরোচিত মানসিকতা তৈরি করেছিল। প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট ১৮৯৭ সালে নেভাল-ওয়ার কলেজের শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, ‘সব মহান জাতিই যোদ্ধা জাতি। যখন কোনো জাতি যুদ্ধের মানসিকতা হারায়, তখন তারা শ্রেষ্ঠদের সমকক্ষ হওয়ার অধিকার হারায়।’
সমালোচক পল ফুসেল লিখেছিলেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি একপ্রকার ‘অরওয়েলীয় যুক্তি’ তৈরি করে, যেখানে যুদ্ধই হয়ে যায় ‘শান্তিরক্ষা অভিযান’; আর নাগরিকের কর্তব্য হলো যেকোনো অন্যায় মেনে নেওয়া—যতক্ষণ তা ‘স্বাধীনতার নামে’ করা হচ্ছে।
ট্রাম্প এই ঐতিহ্যেরই উত্তরসূরি। গত জানুয়ারিতে অভিষেক ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের ম্যানিফেস্ট ডেসটিনি নিয়ে নক্ষত্রলোক পর্যন্ত পৌঁছে যাব।’ তিনি বলতে চেয়েছিলেন, আমেরিকান নভোচারীরা মঙ্গল গ্রহে আমেরিকার পতাকা স্থাপন করবেন। কিন্তু তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদী ইচ্ছার তালিকায়’ পৃথিবীর ভূখণ্ডও আছে। সেটি আছে কানাডা, গাজা, গ্রিনল্যান্ড, এমনকি পানামা খাল পর্যন্ত। ট্রাম্প এমনকি প্রতিরক্ষা দপ্তরের পুরোনো নাম ‘ডিপার্টমেন্ট অব ওয়ার’ বা ‘যুদ্ধ মন্ত্রণালয়’ও ফিরিয়ে এনেছেন। নিশ্চয়ই ট্রাম্প ও ম্যাককিনলির সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। ম্যাককিনলি মনে করতেন, ঈশ্বর তাঁকে ফিলিপিনোদের ‘শিক্ষিত, সভ্য ও খ্রিষ্টান’ করার দায়িত্ব দিয়েছেন।
আরও পড়ুনট্রাম্প ও ব্লেয়ার গাজায় আসলে কি করতে চান০৫ অক্টোবর ২০২৫ট্রাম্প কিন্তু কোনো ধর্মীয় মিশনারি নন; তিনি একজন ব্যবসায়ী। তাঁর কাছে ভূখণ্ড মানে শুধুই বস্তুগত সম্পদ, যা আমেরিকার মর্যাদা ও সম্পদ বাড়ায়। তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মীয় উন্মাদনা যত কমই হোক, তাঁর ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান সমর্থকেরা তাঁকে শতভাগ সহযোগিতা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদ যে মূল বিশ্বাসে আটকে আছে, তা হলো আমেরিকা যাদের ‘উদ্ধার’ করছে, তারা আমেরিকার চেয়ে নিম্নস্তরের।
১৯০১ সালে সিনেটর অ্যালবার্ট বেভারিজ ঘোষণা করেছিলেন, ‘ঈশ্বর এক হাজার বছর ধরে ইংরেজভাষী ও জার্মান জাতিকে শুধু আত্মতুষ্টির জন্য নয়, বরং বিশ্বের শাসক হিসেবে তৈরি করেছেন, যাতে তারা বর্বর ও নিচু মানের জাতিদের শাসন করতে পারে।’ ইতিহাসবিদ আর্চিবল্ড ক্যারি কুলিজ লিখেছিলেন, ‘যারা আমেরিকার নিঃস্বার্থ মহত্ত্বে সন্দেহ প্রকাশ করে, তারা স্বভাবতই শয়তান ও দুষ্টচক্রের লোক।’ আমেরিকানরা নিজেদের উদ্দেশ্যের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বে এতটাই বিশ্বাসী যে তারা বুঝতেই পারে না, তাদের কর্মকাণ্ড অন্যদের জীবনে কতটা ধ্বংস ডেকে আনে।
এই একই নৈতিক যুদ্ধংদেহী মানসিকতা বারবার দেখা গেছে বে অব পিগস থেকে ভিয়েতনাম, ইরাক থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত। ট্রাম্প সেই নীতি ধরেই হাঁটছেন। এতে সেই পুরোনো প্রবাদটাই মনে পড়ে, ‘একই কাজ বারবার করে ভিন্ন ফল আশা করা বোকামি।’
জো জ্যাকসন মার্কিন লেখক ও ইতিহাস বিশ্লেষক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র আম র ক র ফ ল প ইন কর ছ ল র জন য শ শতক
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্পের প্রক্সি যুদ্ধ ‘ঈশ্বরের ইচ্ছায়’ হচ্ছে!
বিশ্বের অনেক মানুষ এখন আমেরিকাকে ভালো চোখে দেখে না। তাদের মনে আমেরিকার প্রতি রাগ, ক্ষোভ আর অবিশ্বাস জমে আছে। ‘ম্যানিফেস্ট ডেসটিনি’ বা ‘ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমেরিকার বিস্তৃতি ঘটবে’—উনিশ শতকের এই ধারণাকে একুশ শতকের ভাষায় ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে হাজির করায় নতুন করে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও ঘৃণার ঢেউ উঠতে পারে।
ম্যানিফেস্ট ডেসটিনি বা ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমেরিকার বিস্তৃতি ঘটবে—এ ধারণা প্রথম সামনে এনেছিলেন ডেমোক্র্যাট রিভিউ ম্যাগাজিনের সম্পাদক জন ও’সালিভান। তাঁর লেখার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা বিস্তারকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বা ঐশ্বরিক অনুমোদনের সঙ্গে যুক্ত করার ধারণা জনপ্রিয় হয়। উনিশ শতকে এই ধারণাকে ভিত্তি ধরে আমেরিকা নেটিভ আমেরিকানদের ওপর জুলুম চালিয়েছিল।
আরও পড়ুনগাজা যুদ্ধ থামিয়েও ট্রাম্প নোবেল পেলেন না কেন১২ অক্টোবর ২০২৫১৮৪৫ সালে ও’সালিভান লিখেছিলেন, ‘আবিষ্কার, অনুসন্ধান, বসতি স্থাপন বা প্রতিবেশী অধিকারের মতো হাস্যকর যুক্তি দিয়ে ভূমি দখল বন্ধ করা যাবে না।’ অর্থাৎ নেটিভ বা আদি বাসিন্দাদের ভূমি মালিকানার সব দাবিই তিনি খারিজ করে দিয়েছিলেন। পরে এই ম্যানিফেস্ট ডেসটিনির ধারণা শুধু উত্তর আমেরিকাতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও। ধীরে ধীরে আমেরিকার নেতাদের মনে হতে থাকে, যদি ‘ঈশ্বরের পরিকল্পনা’ অনুযায়ী আমেরিকার পুরো মহাদেশ দখলের অধিকার থাকে, তবে পুরো পৃথিবী কেন নয়?
এই চিন্তার পরিণতি সবচেয়ে ভালো জানে কিউবা ও ফিলিপাইন। উনিশ শতকের শেষভাগে যে যুদ্ধকে কিউবানরা ‘স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনীয় যুদ্ধ’ এবং ফিলিপিনোরা ‘মুক্তির লড়াই’ বলে অভিহিত করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন হে সেটিকে ‘দারুণ এক ছোট যুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সেই সংঘাতেই গঠিত হয়েছিল আধুনিক কিউবা, ফিলিপাইন ও সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্প কিন্তু কোনো ধর্মীয় মিশনারি নন; তিনি একজন ব্যবসায়ী। তাঁর কাছে ভূখণ্ড মানে শুধুই বস্তুগত সম্পদ, যা আমেরিকার মর্যাদা ও সম্পদ বাড়ায়। তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মীয় উন্মাদনা যত কমই হোক, তাঁর ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান সমর্থকেরা তাঁকে শতভাগ সহযোগিতা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদ যে মূল বিশ্বাসে আটকে আছে, তা হলো আমেরিকা যাদের ‘উদ্ধার’ করছে, তারা আমেরিকার চেয়ে নিম্নস্তরের।১৮৯৫ সালে কিউবার মানুষ স্পেনের শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে নামে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলির নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে কিউবার পক্ষ নিয়ে যুক্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্র স্পেনকে পরাজিত করে কিউবার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এই সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বিশ্বে একটি শক্তিশালী এবং সদয় দেশ হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়; যেন তারা ঈশ্বরের নির্দেশে অন্য দেশের জন্য শান্তি বজায় রাখছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে দেখিয়েছিল, তারা শুধু শক্তিশালী নয়, বরং শান্তি রক্ষার দায়িত্বও নিতে পারে।
কিন্তু একই সময়ে ফিলিপাইনে যা ঘটেছিল, তা ছিল ভয়াবহ। দুর্ভিক্ষ, রোগব্যাধি, মৃত্যু, পরিবেশ ধ্বংস দ্বীপরাষ্ট্রটিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। ১৮৯৮ সালের প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে স্পেন ফিলিপাইনকে আমেরিকার হাতে তুলে দিলে শিগগিরই ফিলিপিনো ও মার্কিন বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ফিলিপাইন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ।
আরও পড়ুনট্রাম্প যা করছেন, তাতে তুরস্ক আর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫যুক্তরাষ্ট্র বারবার একই ভুল করে। ১৮৯৮ সালের ‘দারুণ ছোট যুদ্ধ’ ভবিষ্যতের সব মার্কিন যুদ্ধে নকশা ঠিক করে দিয়েছে। এসব যুদ্ধ শুরু হয় স্বল্প সময়ের জন্য এবং সহজ জয় পাওয়ার আশায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করে। এই যুদ্ধ আমেরিকার মধ্যে এক যুদ্ধবীরোচিত মানসিকতা তৈরি করেছিল। প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট ১৮৯৭ সালে নেভাল-ওয়ার কলেজের শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, ‘সব মহান জাতিই যোদ্ধা জাতি। যখন কোনো জাতি যুদ্ধের মানসিকতা হারায়, তখন তারা শ্রেষ্ঠদের সমকক্ষ হওয়ার অধিকার হারায়।’
সমালোচক পল ফুসেল লিখেছিলেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি একপ্রকার ‘অরওয়েলীয় যুক্তি’ তৈরি করে, যেখানে যুদ্ধই হয়ে যায় ‘শান্তিরক্ষা অভিযান’; আর নাগরিকের কর্তব্য হলো যেকোনো অন্যায় মেনে নেওয়া—যতক্ষণ তা ‘স্বাধীনতার নামে’ করা হচ্ছে।
ট্রাম্প এই ঐতিহ্যেরই উত্তরসূরি। গত জানুয়ারিতে অভিষেক ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের ম্যানিফেস্ট ডেসটিনি নিয়ে নক্ষত্রলোক পর্যন্ত পৌঁছে যাব।’ তিনি বলতে চেয়েছিলেন, আমেরিকান নভোচারীরা মঙ্গল গ্রহে আমেরিকার পতাকা স্থাপন করবেন। কিন্তু তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদী ইচ্ছার তালিকায়’ পৃথিবীর ভূখণ্ডও আছে। সেটি আছে কানাডা, গাজা, গ্রিনল্যান্ড, এমনকি পানামা খাল পর্যন্ত। ট্রাম্প এমনকি প্রতিরক্ষা দপ্তরের পুরোনো নাম ‘ডিপার্টমেন্ট অব ওয়ার’ বা ‘যুদ্ধ মন্ত্রণালয়’ও ফিরিয়ে এনেছেন। নিশ্চয়ই ট্রাম্প ও ম্যাককিনলির সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। ম্যাককিনলি মনে করতেন, ঈশ্বর তাঁকে ফিলিপিনোদের ‘শিক্ষিত, সভ্য ও খ্রিষ্টান’ করার দায়িত্ব দিয়েছেন।
আরও পড়ুনট্রাম্প ও ব্লেয়ার গাজায় আসলে কি করতে চান০৫ অক্টোবর ২০২৫ট্রাম্প কিন্তু কোনো ধর্মীয় মিশনারি নন; তিনি একজন ব্যবসায়ী। তাঁর কাছে ভূখণ্ড মানে শুধুই বস্তুগত সম্পদ, যা আমেরিকার মর্যাদা ও সম্পদ বাড়ায়। তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মীয় উন্মাদনা যত কমই হোক, তাঁর ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান সমর্থকেরা তাঁকে শতভাগ সহযোগিতা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদ যে মূল বিশ্বাসে আটকে আছে, তা হলো আমেরিকা যাদের ‘উদ্ধার’ করছে, তারা আমেরিকার চেয়ে নিম্নস্তরের।
১৯০১ সালে সিনেটর অ্যালবার্ট বেভারিজ ঘোষণা করেছিলেন, ‘ঈশ্বর এক হাজার বছর ধরে ইংরেজভাষী ও জার্মান জাতিকে শুধু আত্মতুষ্টির জন্য নয়, বরং বিশ্বের শাসক হিসেবে তৈরি করেছেন, যাতে তারা বর্বর ও নিচু মানের জাতিদের শাসন করতে পারে।’ ইতিহাসবিদ আর্চিবল্ড ক্যারি কুলিজ লিখেছিলেন, ‘যারা আমেরিকার নিঃস্বার্থ মহত্ত্বে সন্দেহ প্রকাশ করে, তারা স্বভাবতই শয়তান ও দুষ্টচক্রের লোক।’ আমেরিকানরা নিজেদের উদ্দেশ্যের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বে এতটাই বিশ্বাসী যে তারা বুঝতেই পারে না, তাদের কর্মকাণ্ড অন্যদের জীবনে কতটা ধ্বংস ডেকে আনে।
এই একই নৈতিক যুদ্ধংদেহী মানসিকতা বারবার দেখা গেছে বে অব পিগস থেকে ভিয়েতনাম, ইরাক থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত। ট্রাম্প সেই নীতি ধরেই হাঁটছেন। এতে সেই পুরোনো প্রবাদটাই মনে পড়ে, ‘একই কাজ বারবার করে ভিন্ন ফল আশা করা বোকামি।’
জো জ্যাকসন মার্কিন লেখক ও ইতিহাস বিশ্লেষক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ