জুলাই সনদ স্বাক্ষরকে কেবলই আনুষ্ঠানিকতা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

নাহিদ ইসলাম বলেন, 'এটা আমরা এর আগেও বলেছি। আজকেও পুনর্ব্যক্ত করেছি। যদি এর (জুলাই সনদ) কোনো আইনি ভিত্তি না হয়, এর মূল্য, এর কোনো অর্থ তৈরি হবে না। ফলে আমরা এই আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিইনি এবং যদি এর আইনি ভিত্তি তৈরি না হয় এটার কেবল আনুষ্ঠানিকতাও থাকবে না, এটি একটি গণপ্রতারণা এবং জাতির সঙ্গে একটি প্রহসন হবে।'

আজ শনিবার দুপুর ১২টায় রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অস্থায়ী কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন নাহিদ ইসলাম। এ সময় এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেনসহ দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

৯০ এর গণ-অভ্যুত্থানের পরেও তিন দলের জোটের যে রূপরেখা সেই রাজনৈতিক সমঝোতা রক্ষা করা হয়নি বলেন নাহিদ ইসলাম। সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিবর্তন করতে চাইলে আইনি ভিত্তি প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ‘এই ৭২ এর সংবিধান যাতে পরিবর্তন না হয়, পুরোনো ফ্যাসিস্ট কাঠামো যাতে রয়ে যায়--তার জন্য নানান অপচেষ্টা কিন্তু দেশের ভেতরে, দেশের বাইরে থেকে করা হচ্ছে।'

বিগত ফ্যাসিস্ট কাঠামোর সুবিধাভোগীদের চাপের কারণে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল আপস করেছে বলে মন্তব্য করেন এনসিপির নেতা নাহিদ ইসলাম। ফ্যাসিস্ট কাঠামো টিকিয়ে রাখতে, অক্ষুণ্ন রাখতে নানাভাবে চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং আরও কিছু রাজনৈতিক দল এবং অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার চাপেই কিন্তু সরকার এই ঐকমত্য কমিশন গঠন, সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা এবং জুলাই সনদ পর্যন্ত, এত দূর এসেছে।’

৯০ এর পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে দেখতে চান না বলে জানান নাহিদ। তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আমাদের এই উপলব্ধি ছিল যে আমাদের লড়াইটা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নয় কেবল, একটা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সমস্যার সমাধান হবে না। বরং এই সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে ৯০ এর গণ-অভ্যুত্থানের পরে এই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে যেভাবে প্রতারণা করা হয়েছিল, গণ-অভ্যুত্থানকে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে যেভাবে জাতীয় নেতারা এবং সেই সময় রাজনৈতিক দলগুলো পকেটভর্তি করেছিল--আমরা এবার সেটা হতে দেব না।’

গতকাল শুক্রবার জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে ‘জুলাই যোদ্ধাদের’সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের প্রসঙ্গ নিয়েও কথা বলেন এনসিপির আহ্বায়ক। তিনি বলেন, 'সেখানে জুলাই যোদ্ধা যারা ছিলেন, শহীদ পরিবারকে কীভাবে অবমাননা করা হয়েছে এবং জনগণের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক, কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না, জনগণের আকাঙ্ক্ষার কোনো বাস্তবায়ন বা প্রতিফলন গতকালকের অনুষ্ঠানে ঘটেছে বলে আমরা মনে করি না।'

নাহিদ ইসলাম বলেন, 'এটি তখনই ঘটবে, জুলাই গণ-অভুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার সার্বভৌম অভিপ্রায় হিসেবে যখন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস (প্রধান উপদেষ্টা) একটি আদেশ জারির মাধ্যমে এর (জুলাই জাতীয় সনদ) আইনি ভিত্তি তৈরি করবে এবং সেই ভিত্তি অনুসারে গণভোট এবং পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ এবং গণপরিষদ একটি নতুন সংবিধান তৈরি করবে।'

সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন জানান, এনসিপি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনে আমরা জোরালো ভূমিকা পালন করেছি। যদিও শুরুতে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে অনেক দলই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। শুধুমাত্র এটাকে একটা জেন্টেলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট, একটা রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবেই রাখার পক্ষপাতী ছিলেন।' গতকাল ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনার বিচার দাবি করেছে এনসিপি।

গতকাল দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে হটিয়ে দেওয়ার পর ‘জুলাই যোদ্ধারা’ মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান, ভাঙচুর করেন পুলিশের বাসসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি, আগুন জ্বালান সড়কে। দুই ঘণ্টা পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর বৃষ্টির মধ্যে বিকেলের আগে পরিস্থিতি শান্ত হয়। বিক্ষুব্ধদের ঢিল ছোড়াছুড়ি, পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ এবং সাউন্ড গ্রেনেড ফাটানোর মধ্যে উভয় পক্ষের অন্তত ২৭ জন আহত হন।

নানা অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সই হয়েছে নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে তৈরি এই সনদে গতকাল সই করেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল ও জোট। পাশাপাশি সনদে সই করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা।

তবে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা তরুণদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অনুষ্ঠানে যায়নি, সনদে সইও করেনি। এ ছাড়া চারটি বাম দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ জুলাই সনদে সই করেনি। আর গণফোরাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও সই করেনি সনদে। অবশ্য দলগুলো চাইলে পরেও সনদে সই করতে পারবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন হ দ ইসল ম জ ল ই সনদ অন ষ ঠ ন এনস প র গতক ল র আইন

এছাড়াও পড়ুন:

অনিশ্চয়তা কাটুক, স্বাক্ষর হোক আজ

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই নাগরিকদের প্রত্যাশা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মতামত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরি করা জুলাই সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দেশ নির্বাচনী যাত্রায় প্রবেশ করবে। কিন্তু সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতার কারণে জুলাই সনদ সই নিয়ে শেষ সময়ে যে অনিশ্চয়তা ও নাটকীয়তা তৈরি হয়েছে, তা কারও কাছেই প্রত্যাশিত ছিল না।

রাষ্ট্র, সংবিধান, শাসনতন্ত্র সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলো প্রতিবেদন দেওয়ার পর ছয়টি সংস্কার কমিশন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি করে জুলাই সনদ। কিন্তু সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও নির্বাচনের দিন, না তার আগে গণভোট হবে, তা নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মধ্যে মতভিন্নতা তৈরি হয়।

গত মঙ্গলবার রাতে জুলাই সনদের চূড়ান্ত অনুলিপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠায় ঐকমত্য কমিশন। এরপর এ নিয়ে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হলে বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন জরুরি বৈঠকে বসে, প্রধান উপদেষ্টা এনসিপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেন। জরুরি বৈঠকের পরও অচলাবস্থা কেটেছে এমন বলা যাচ্ছে না। দলগুলো তাদের আগের অবস্থানে অনড় রয়েছে। বৈঠক শেষে বিএনপি জানিয়েছে, জুলাই সনদ স্বাক্ষরে তারা প্রস্তুত, জামায়াত বিষয়টি স্পষ্ট করেনি আর এনসিপি সই করবে কি না, সেটা বিবেচনাধীন বলে জানিয়েছে।

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আজ জুলাই সনদ স্বাক্ষর ও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। আমরা মনে করি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক অস্থিরতা ও জাতীয় নিরাপত্তার মতো সংবেদনশীল এবং অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যখন জড়িত, তখন ঘোষিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।

জুলাই সনদ স্বাক্ষর নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে দেশ যদি নতুন কোনো সংকটে পড়ে, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। কোনো রাজনৈতিক দল বা শক্তির দায়িত্বহীনতা, হঠকারিতা বা ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ এর পেছনে কাজ করে থাকলে তা জনগণের জানা–বোঝার বাইরে থাকবে না। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দিলে তার মূল্য শুধু জনগণকে নয়, সেই দলগুলোকেও দিতে হবে।

একই সঙ্গে আমরা মনে করি, জুলাই সনদ স্বাক্ষর ও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠান—এই দুই গুরুদায়িত্ব বাস্তবায়নে ধারাবাহিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের যতটা শক্ত ও জোরালো অবস্থান ও ভূমিকা রাখা দরকার, সেখানে ঘাটতি রয়েছে। শুধু মুখে উৎসবমুখর নির্বাচনের কথা বললে হবে না, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত পূরণ করার মূল দায়িত্ব সরকারের। অবস্থাদৃষ্টে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে অন্তর্বর্তী সরকার যেন ঐকমত্য কমিশনের কাছে দায়িত্ব দিয়ে নিজে ভারমুক্ত থেকেছে। জুলাই সনদ স্বাক্ষর নিয়ে যখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে, যখন এ নিয়ে দেশ একটি জটিল ও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, তখন প্রধান উপদেষ্টা কোন বিবেচনায় ইতালি সফরে গেলেন, তা এক বড় প্রশ্ন। বরং দেশের এমন একটি সংকটময় সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা কমিয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অধ্যাপক ইউনূসের আরও সক্রিয় ভূমিকা ও উদ্যোগ প্রত্যাশিত ছিল।

সবকিছুর পরও আমরা আশা করি, জনগণের দীর্ঘ লড়াই ও আত্মত্যাগের সঙ্গে থেকে যে রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে এবং একসঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে জুলাই সনদ তৈরি করেছে, তারা বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এবং দেশ ও জনগণের স্বার্থে নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব অবসান করে আজ জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফেও ফেব্রুয়ারির প্রথমভাগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে জুলাই সনদ প্রশ্নে জোরালো পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদে আইনি ভিত্তি না থাকলে জাতির সঙ্গে প্রহসন হবে: নাহিদ ইসলাম
  • জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যায়নি এনসিপি,রাজি করাতে সরকারের চেষ্টা অব্যাহত
  • জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক: জোনায়েদ সাকি
  • অনুষ্ঠানে থাকলেও জুলাই সনদে সই করেনি গণফোরাম
  • জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি যেসব দল
  • মঞ্চে রাজনীতিবিদ ও কমিশনের সদস্যরা
  • জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামার পঞ্চম দফা সংশোধন
  • জুলাই জাতীয় সনদ সই আজ, সব দলের থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তা
  • অনিশ্চয়তা কাটুক, স্বাক্ষর হোক আজ