বিএনপির পর জামায়াতও কিছু উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে আপত্তি জানাল
Published: 22nd, October 2025 GMT
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত মঙ্গলবারের বৈঠকে ‘দলঘনিষ্ঠ’ উপদেষ্টাদের বাদ দেওয়ার কথা বলেছিল বিএনপি। গতকাল বুধবার জামায়াতে ইসলামীও প্রধান উপদেষ্টাকে তাঁর সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষে কাজ করার অভিযোগ করেছে। তাদের দাবি, ওই উপদেষ্টারা প্রধান উপদেষ্টাকে নানা ভুল তথ্য দিচ্ছেন, বিভ্রান্ত করছেন। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টাকে সতর্ক থাকতেও বলেছে দলটি। জামায়াতের দাবি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন ও পুলিশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ লোকই বিএনপির।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কোনো দলের প্রতি পক্ষপাত থাকা উপদেষ্টারা কারা, জামায়াত তাঁদের কারও নাম উল্লেখ করেনি। তবে এসব উপদেষ্টার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। দলটি বলেছে, নির্বাচনের আগে সরকারকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। সচিবালয়, পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে রদবদল আনতে হবে।
তবে সাক্ষাৎ শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করার স্বার্থে সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আমরা ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি; সামনে আরও অনেক উদ্যোগ আপনারা দেখতে পাবেন।’
জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির হয়ে কাজ করা কয়েকজন উপদেষ্টার নামের তালিকা জামায়াতের প্রতিনিধিদল সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া সচিব পর্যায়ের ৪০ জন কর্মকর্তার তালিকা নিয়ে গিয়েছিল, যাঁরা বিএনপির হয়ে কাজ করছেন বলে জামায়াত মনে করে। কিন্তু পরিবেশ না থাকায় তারা সে তালিকা প্রধান উপদেষ্টাকে দেয়নি। তালিকা দুটি পরে পাঠানো হবে। তবে তারা আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছে, সরকারের প্রশাসন ও পুলিশের ৭০-৮০ ভাগ লোকই বিএনপির। এখন তারা বাকিদের বের করে দিতে চাইছে।
গতকাল সন্ধ্যায় জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সাক্ষাৎ করে। তাঁরা প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলেন।
এ সময় উপস্থিত জামায়াতের অন্য তিন নেতা হলেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম মা’ছুম ও রফিকুল ইসলাম খান। এ সময় সরকারের পক্ষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন। এ দিন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একটি প্রতিনিধিদলও পৃথকভাবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।
আমাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আমরা ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি; সামনে আরও অনেক উদ্যোগ আপনারা দেখতে পাবেন।অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান উপদেষ্টা, অন্তর্বর্তী সরকারসাক্ষাৎ শেষে জামায়াত নেতা আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, ‘যাঁরা উপদেষ্টা, তাঁদের ব্যাপারে বলেছি, সবার ব্যাপারে নয়। আমরা বলেছি, কিছু কিছু লোক আপনাকে (প্রধান উপদেষ্টা) বিভ্রান্ত করেন। আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে। কিন্তু আপনার কিছু লোক আপনার পাশে আপনাকে বিভ্রান্ত করেন এবং তাঁরা কোনো একটা দলের পক্ষে কাজ করেন আমরা মনে করি। তাঁদেরকে, তাঁদের ব্যাপারে আপনাকে হুঁশিয়ার থাকা দরকার।’
বৈঠকে কোনো উপদেষ্টার অপসারণের দাবি তুলেছেন কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা প্রথম দিন দৃষ্টি আকর্ষণ করছি.
এক দিন আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপিও কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। নাম উল্লেখ না করে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিতে প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানিয়েছিল দলটি।
এটি পাল্টাপাল্টি অভিযোগ কি না, জানতে চাইলে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মনে করি পাল্টাপাল্টি কিছু না। যেসব উপদেষ্টা দলীয় ভূমিকা পালন করছেন, আমরা সে বিষয়ে বলেছি। বিএনপির বিষয়টি আমাদের বোধগম্য নয়।’
৭০-৮০ ভাগ কর্মকর্তা একটি দলেরআবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা জানেন ইলেকশন কমিশনের, সচিবালয়ের, পুলিশ প্রশাসনে আজকে সেখানে ৭০-৮০ পারসেন্ট অফিসারই একটি দলের আনুগত্য করছেন। আমরা গেলে তাঁরা বলেন যে প্রচণ্ড চাপ। চাপ কোথায় থেকে? একটি দল থেকে আসছে, তারা বলেছে। পুলিশেও একই অবস্থা। তারপর আমাদের যে প্রসিকিউটর (পিপি) যাঁরা হয়েছেন, ওখানে ৮০ শতাংশ হচ্ছেন একটি বিশেষ দলের।’
তাহের বলেন, অবশ্য তাঁদের (উপদেষ্টা) কেউ বলেছেন, না এটা ৮০ না ৬৫। ৬৫–ও যদি হয়, তাহলে তা অনেক বেশি হয়ে গেল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটা দল ৬৫, আর বাংলাদেশ ৩৫। সারা বাংলাদেশ তো এই যে ইমব্যালেন্সটা (ভারসাম্যহীন) হয়ে আছে।’
প্রধান উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তী সরকার ‘তত্ত্বাবধায়কের মতো’ আছে, নিরপেক্ষ সরকার—এমন কথা উল্লেখ করে জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘আমরা বলেছি আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের মতো আছেন, নিরপেক্ষ সরকার। আপনি এটাকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) করেন। নির্বাচনের আগে আপনি যেখানে যেখানে রদবদল করা দরকার করেন।’ এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা নিজে তত্ত্বাবধান করবেন এবং লটারি পদ্ধতিতে বদলি ঠিক করবেন বলে জানান তাহের।
আরও পড়ুনকয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জানিয়ে এল জামায়াত৫ ঘণ্টা আগেতত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গতত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো দাবি তোলা হয়নি জানিয়ে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে এখনো সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হচ্ছে। তাঁর দল সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপেক্ষায় আছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কোনো ব্যত্যয় না হলে অন্তর্বর্তী সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করবে বলে আশাবাদ জানান তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা কী বলেছেন, এমন প্রশ্নে জামায়াতের এই নেতা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলছেন যে তিনি এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করছেন এবং যেটা করতে হবে, সেটি তিনি করবেন ইনশা আল্লাহ।
এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, নভেম্বর মাসের শেষ দিকে গণভোট এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়নের জন্য ‘এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ (সংবিধানের বাইরে বিশেষ ব্যবস্থা) জারির বিষয়ে আলোচনা হয় বলেও সাংবাদিকদের জানান আবদুল্লাহ তাহের।
জুলাই সনদজুলাই সনদে স্বাক্ষর করায় প্রধান উপদেষ্টা ধন্যবাদ জানিয়েছেন জামায়াতকে। বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন জানিয়ে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা আজকে এটা (জুলাই সনদ) বাস্তবায়নের জন্য ওনার (প্রধান উপদেষ্টা) দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। উনি আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন যে এটা বাস্তবায়ন যদি না হয়, তাহলে এই পরিশ্রম তো পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছু নয়। তো সে কারণে উনি বলেছেন, আমি যথাযথ উদ্যোগ নেব।’
‘একটি আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে হবে’—প্রধান উপদেষ্টাকে এমন কথা বলেছে জামায়াত। দলটির নায়েবে আমির বলেন, ‘এটা কনস্টিটিউশন (সংবিধান) নয়। এটা হচ্ছে এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল অ্যারেঞ্জমেন্ট, যেটা কোনো সরকার এ রকম (অভ্যুত্থান বা বড় পরিবর্তন) একটি পরিস্থিতিতে পড়লে দেওয়ার এখতিয়ার রাখে।’ একটি আদেশের মাধ্যমে এটা হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা জামায়াতের সঙ্গে একমত হয়েছেন উল্লেখ করেন তিনি।
জুলাই সনদের বিষয়ে অধ্যাদেশ জারির কথা কেউ কেউ বললেও তাতে ভিন্নমত রয়েছে জামায়াতের। এই অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আবদুল্লাহ তাহের বলেন, ‘অধ্যাদেশ খুব দুর্বল। এগুলোর সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়ার মতো স্ট্রেংথ (ক্ষমতা) অধ্যাদেশে নেই। কিন্তু আদেশ ইজ ইকুইভেলেন্ট (সমান) টু সাংবিধানিক পরিবর্তন পাওয়ার (ক্ষমতা) এবং অথরিটির দিক থেকে।’ তিনি বলেন, একটি আদেশের মাধ্যম এটাকে বৈধতা দিতে হবে। সেই আদেশের ওপরেই গণভোট হবে। এটা জামায়াত পরিষ্কারভাবে বলে আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের কথায় কনভিন্স (রাজি) হয়েছেন বলে আমাদের মনে হয়। আমরা আশা করি, সেদিকে যাবে।’
অভিযোগ পাল্টাপাল্টিজাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনিক রদবদল ও নিয়োগ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ক্রমেই মুখোমুখি হয়ে পড়ছে। গত সপ্তাহে বিএনপি অভিযোগ তোলে যে উপদেষ্টাদের কয়েকজন জামায়াতের পক্ষে কাজ করছেন। প্রকাশ্য কর্মসূচিতে জামায়াতও পাল্টা অভিযোগ করে, কয়েকজন উপদেষ্টা বিএনপির হয়ে কাজ করছেন। গত দুই দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দল দুটির পৃথক বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টাসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দলীয় আনুগত্যের অভিযোগ আলোচনায় এল।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করবে, এটাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। আমরা এটাকে স্বাগত জানাই। তবে আমরা একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছি, সে লক্ষ্যে প্রশাসনকে ফ্যাসিবাদের দোসরমুক্ত করার কথা বলেছি। নির্বাচনব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত জায়গাগুলোতে সাবধানতা অবলম্বন করে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেছি।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত হ র বল ন জ ল ই সনদ সরক র র ব এনপ র র জন য হয় ছ ন দ র বল ক জ কর আম দ র আপন র আপন ক প রথম ইসল ম করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
নবীজি (সা.) যেভাবে নামাজ পড়তেন
নামাজ এমন একটি বিধান যা কোনো অবস্থাতেই বাতিল হয় না—দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে বা ইশারায়—জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এর পালন অপরিহার্য। একজন মুসলিমের কাছে নামাজ কেবল কিছু শারীরিক ক্রিয়া নয়, বরং এটি আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম।
ইবাদতের এই শ্রেষ্ঠ মাধ্যমটি অবশ্যই আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ (সা.)-এর দেখানো পদ্ধতিতে আদায় করতে হবে। কারণ, তিনি উম্মতকে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, “তোমরা সেভাবে নামাজ আদায় করো, যেভাবে আমাকে নামাজ আদায় করতে দেখেছ।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩১)
তোমরা সেভাবে নামাজ আদায় করো, যেভাবে আমাকে নামাজ আদায় করতে দেখেছ।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩১)এই নির্দেশনা মেনে চলার জন্য নামাজের প্রতিটি ধাপ, তাকবিরে তাহরিমা থেকে শুরু করে সালাম ফেরানো পর্যন্ত, রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী হওয়া আবশ্যক।
নামাজের পূর্ব প্রস্তুতিনামাজ কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত পবিত্রতা। এই পবিত্রতা অর্জনের জন্য প্রথমে উত্তমরূপে অজু বা অজু সম্পন্ন করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা কোরআনে অজুর পদ্ধতি বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন, “হে ঈমানদারগণ, যখন তোমরা নামাজের জন্য প্রস্তুত হবে, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল এবং কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত করো। আর তোমাদের মাথা মাসেহ করো এবং গোড়ালি পর্যন্ত পা (ধৌত করো)।” (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৬)
রাসুল (সা.) বলেন, “পবিত্রতা ব্যতীত কোনো নামাজ কবুল হয় না।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২২৪)
অজু সম্পন্ন করার পর মুসল্লিকে কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে। কাবার দিক হল কিবলা। নামাজে দাঁড়ানোর সময় মুসল্লি তার অন্তর দিয়ে যে নামাজটি পড়তে চান (ফরজ বা নফল), সেটির নিয়ত করবেন।
মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা ইসলামে বিধিবদ্ধ নয়। কেননা রাসুল (সা.) এবং তাঁর কোনো সাহাবি মুখে নিয়ত উচ্চারণ করেননি। (বিন বাজ, আব্দুল আজিজ বিন আব্দুল্লাহ, সিফাতু সালাতিন নবী (সা.)/৩-৪, দারুল মুগনি, রিয়াদ, ২০০২)।
এছাড়া, ইমাম বা একাকী নামাজ আদায়কারীর জন্য সামনে একটি সুতরাহ (আড়াল বা প্রতিবন্ধক) রাখা মুস্তাহাব, কারণ রাসুল (সা.) এর নির্দেশ দিয়েছেন।
আরও পড়ুন‘যাও, আবার নামাজ পড়ো, কারণ তুমি নামাজ পড়োনি’১৮ অক্টোবর ২০২৫নামাজের সূচনা ও কিরাতনামাজ শুরু হয় তাকবিরে তাহরিমা-এর মাধ্যমে। মুসল্লি উভয় হাত কাঁধ বরাবর বা কান পর্যন্ত তুলে ‘আল্লাহু আকবার’ বলবেন। এটাই তাকবির। তাকবির বলার সময় দৃষ্টি থাকবে সিজদার স্থানের দিকে।
হাত বাঁধার সময় ডান হাতের তালু বাম হাতের তালুর ওপর রেখে নাভি বরাবর স্থাপন করা সুন্নাহ। (সহিহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদিস: ৪৭৯)
এরপর শুরুতে সানা বা দোয়ায়ে ইস্তিফতা পাঠ করা সুন্নাত। এটি হল, “সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারাকাসমুকা, ওয়া তা’আলা জাদ্দুকা, ওয়া লা ইলাহা গায়রুক।”
এরপর ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম’ ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে সুরা ফাতিহা পড়তে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কিতাবের প্রারম্ভিক সুরা (ফাতিহা) পাঠ করে না, তার নামাজ হয় না।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৫৬)
ফাতিহা শেষে সশব্দ নামাজে ইমাম ও মুক্তাদি উভয়েই ‘আমিন’ বলবেন। এরপর কোরআনের যা সহজসাধ্য তা তেলাওয়াত করবেন।
উত্তম হল, ফজরের নামাজে বড় সুরা, জোহর, আসর ও ইশার নামাজে মধ্যম মাপের সুরা এবং মাগরিবের নামাজে কখনও ছোট ও কখনও মধ্যম বা বড় সুরা তেলাওয়াত করা। আসরের নামাজ জোহরের চেয়ে হালকা হওয়া কাম্য।
রুকু ও কওমা: অবনত ও স্থিতিশীলতাকোরআন তেলাওয়াত শেষে রুকুতে যাওয়ার সময় মুসল্লি ‘আল্লাহু আকবার’ বলবেন। রুকুতে মাথা পিঠের সমান্তরালে থাকবে এবং উভয় হাত হাঁটুতে রাখা হবে। আঙ্গুলগুলো হবে ছড়ানো। রুকুতে স্থিরতা বজায় রাখা জরুরি।
রুকুর তাসবিহ হল, “সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম” (মহাপ্রভুর পবিত্রতা ঘোষণা করছি), যা কমপক্ষে তিন বা ততোধিক বার বলা উত্তম।
এর সঙ্গে অতিরিক্ত দোয়া হিসেবে “সুবহানাকা আল্লাহুম্মা রাব্বানা ওয়া বিহামদিকা, আল্লাহুম্মাগফির লি” (হে আল্লাহ! আমরা আপনার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করি। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন) পাঠ করা মোস্তাহাব। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৯৬)
সিজদার সময় বেশি বেশি দোয়া করা মুস্তাহাব, কারণ রাসুল (সা.) বলেছেন, “বান্দা তার প্রতিপালকের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় সিজদা-অবস্থায়। তাই তোমরা সিজদায় বেশি বেশি দোয়া করো।এরপর রুকু থেকে ওঠার সময় ইমাম বা একাকী নামাজ আদায়কারী ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ’ (আল্লাহ তার প্রশংসা শুনলেন, যে তাঁর প্রশংসা করল) বলবেন। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পর সবাই বলবেন, “রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ (হে আমাদের প্রতিপালক, আপনার জন্য সকল প্রশংসা)।”
আরো বলতে পারেন, “হামদান কাসীরান ত্বাইয়্যেবান মুবারাকান ফীহি, মিলআস সামাওয়াতি ওয়া মিলআল আরদি, ওয়া মিলআ মা বাইনাহুমা, ওয়া মিলআ মা শি’তা মিন শাইইন বা’দ” (প্রচুর, পবিত্র, কল্যাণময় প্রশংসা, যা আকাশ, পৃথিবী ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী স্থান এবং আপনি যা কিছু চান, তা পূর্ণ করে দেয়)।
মুক্তাদিগণ রুকু থেকে ওঠার সময় কেবল ‘রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ’ থেকে শেষ পর্যন্ত বলবেন। এই সময় পুনরায় হাত বাঁধার দরকার নেই।
সিজদা ও দুই সিজদার মধ্যবর্তী বৈঠক‘আল্লাহু আকবার’ বলে সিজদায় যাওয়ার সময় সম্ভব হলে প্রথমে হাঁটু এবং এরপর হাত দু’টি মাটিতে রাখা উত্তম। যদি এতে কষ্ট হয়, তবে হাত আগে রাখা যেতে পারে।
সিজদা দিতে হবে সাতটি অঙ্গের উপর, কপাল (নাকের সঙ্গে), দুই হাত, দুই হাঁটু এবং দুই পায়ের আঙ্গুলগুলোর ভেতরের অংশ। সিজদার সময় আঙ্গুলগুলো কিবলামুখী ও মিলিত থাকবে।
সিজদার তাসবিহ হল, “সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা” (আমার মহান প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা করছি), যা কমপক্ষে তিন বা ততোধিক বার পাঠ করতে হবে।
সিজদার সময় বেশি বেশি দোয়া করা মুস্তাহাব, কারণ রাসুল (সা.) বলেছেন, “বান্দা তার প্রতিপালকের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় সিজদা-অবস্থায়। তাই তোমরা সিজদায় বেশি বেশি দোয়া করো।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৮২)
এছাড়া, সিজদার সময় কনুইকে পাঁজর থেকে, পেটকে উরু থেকে এবং উরুকে গোছা থেকে দূরে রাখা সুন্নাহ। হাত দুটিকে কুকুরের মতো মাটিতে বিছিয়ে দেওয়া নিষেধ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮২২; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৯৩)
প্রথম সিজদার পর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মাথা উঠিয়ে বসতে হবে। এসময় বাম পা বিছিয়ে তার উপর বসবেন এবং ডান পা খাড়া করে রাখবেন। হাত দু’টি ঊরু ও হাঁটুর উপর থাকবে। এই বৈঠকেও স্থিরতা বজায় রাখা অপরিহার্য।
এই সময় দোয়া পড়তে হবে, “রাব্বিগফির লি, রাব্বিগফির লি” (হে আমার প্রতিপালক, আমাকে ক্ষমা করে দিন)।
অন্য বর্ণনায় দীর্ঘ দোয়া রয়েছে, “আল্লাহুম্মাগফির লি ওয়ার হামনি ওয়ার যুকনি ওয়া আ’ফিনি ওয়াহদিনী ওয়াজবুরনি” (হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন, আমার প্রতি দয়া করুন, আমাকে রিজিক দিন, আমাকে সুস্থতা দিন, আমাকে পথ দেখান এবং আমার ক্ষয়-ক্ষতি পূরণ করে দিন)। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৮০; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৮৫০)
এরপর দ্বিতীয় সেজদা প্রথমটির মতোই সম্পন্ন করতে হবে।
আরও পড়ুনজীবনকে ছন্দে ফেরাবে ‘ধীর নামাজ’২৪ মে ২০২৫নামাজের সমাপ্তিদুই বা চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজের জন্য নিয়ম কিছুটা ভিন্ন।
দুই রাকাতের নামাজ ও প্রথম বৈঠক
যদি নামাজটি দুই রাকাত বিশিষ্ট হয় (যেমন ফজর, জুমা), তবে দ্বিতীয় সিজদা থেকে মাথা তুলে বাম পা বিছিয়ে ডান পা খাড়া রেখে বসবেন। ডান হাত ডান উরুর উপর থাকবে এবং শাহাদাত আঙ্গুল (তর্জনী) দিয়ে আল্লাহর তাওহিদ (একত্ববাদ) এর দিকে ইশারা করবেন। কেউ কেউ বুড়ো আঙ্গুল ও মধ্যমা দিয়ে বৃত্ত তৈরি করে শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করেন, এটাও ঠিক আছে।
এই সময় তাশাহহুদ পাঠ করতে হবে, “আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস সালাওয়াতু ওয়াত ত্বাইয়্যিবাতু, আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান নাবিইউ ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু, আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সালিহীন। আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু।”
এরপর দরুদ পাঠ করবেন, “আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ...” থেকে শেষ পর্যন্ত।
দরুদ শেষে দোয়া পড়বেন, এটা মোস্তাহাব। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী যলামতু নাফসী... শেষ পর্যন্ত।
তবে কেউ কেউ দরুদ শেষে চারটি জিনিস থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে বলেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আ’উযুবিকা মিন আযাবি জাহান্নাম, ওয়া মিন আযাবিল ক্বাবরি, ওয়া মিন ফিতনাতিল মাহইয়া ওয়াল মামাত, ওয়া মিন ফিতনাতিল মাসীহিদ্ দাজ্জাল” (হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই জাহান্নামের আজাব থেকে, কবরের আজাব থেকে, জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে এবং দাজ্জালের ফিতনা থেকে)। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৯১)
এরপর দুনিয়া ও আখেরাতের যেকোনো কল্যাণকর দু’আ পাঠ করে ডান ও বাম দিকে সালাম ফেরাবেন: “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।”
নামাজের প্রত্যেকটি ধাপে রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করাই একজন মুমিনের প্রধান কর্তব্য। একমাত্র সঠিক অনুসরণের মাধ্যমেই আল্লাহর নৈকট্য ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব।তিন বা চার রাকাতের নামাজ ও শেষ বৈঠক
যদি নামাজ তিন (মাগরিব) বা চার রাকাতবিশিষ্ট হয়, তবে প্রথম বৈঠক শেষে (তাশাহহুদ ও দরুদ ছাড়া) ‘আল্লাহু আকবার’ বলে কাঁধ বরাবর হাত তুলে তৃতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়াবেন। তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতে কেবল সুরা ফাতিহা পড়া সুন্নাহ। তবে কখনও কখনও জোহরের তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতে ফাতিহার সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত তেলাওয়াত করাও রাসুল (সা.) থেকে প্রমাণিত আছে।
তিন বা চার রাকাতের শেষ বৈঠকে পা রাখার ভঙ্গিটি হবে তাওয়াররুক। অর্থাৎ, ডান পা খাড়া রেখে বাম পা ডান পায়ের নিচের দিক দিয়ে বের করে দিয়ে নিতম্বের উপর বসবেন। এই বৈঠকের পর পূর্ণ তাশাহহুদ, দরুদ, চারটি বিষয় থেকে আশ্রয় চাওয়া এবং দোয়া পাঠ শেষে সালাম ফেরাবেন।
নামাজের পর জিকিরনামাজ শেষে তিনবার ইস্তিগফার (‘আস্তাগফিরুল্লাহ’) করার পর নিম্নোক্ত জিকিরগুলো পাঠ করা সুন্নাহ, “আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম ওয়া মিনকাস সালাম, তাবারাকতা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৯২)
এরপর একশত পূর্ণ করতে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইইন ক্বাদীর” পাঠ করবেন। এছাড়াও আয়াতুল কুরসি, সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস পাঠ করা সুন্নাহ। ফজর ও মাগরিবের নামাজের পর শেষ তিন সুরা তিনবার করে পড়া মুস্তাহাব। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৪১০)
দৈনন্দিন সুন্নত নামাজদৈনিক বারো রাকাত সুন্নত নামাজ রয়েছে, যাকে সুন্নাতে রাওয়াতিব বলা হয়। এগুলো হল:
জোহরের ফরজের আগে চার রাকাত।
জোহরের ফরজের পরে দুই রাকাত।
মাগরিবের ফরজের পরে দুই রাকাত।
ইশার ফরজের পরে দুই রাকাত।
ফজরের ফরজের আগে দুই রাকাত।
এই ১২ রাকাত নামাজ নিয়মিত আদায়কারীর জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করা হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭২৮)
ফজর ও বিতিরের নামাজ ব্যতীত অন্য সুন্নাতগুলো রাসুল (সা.) সফরে ছেড়ে দিতেন। ফরজ নামাজ মসজিদে আদায় করলেও এই সুন্নাতগুলো বাড়িতে আদায় করা উত্তম। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৩১)
এছাড়াও, আসরের আগে চার রাকাত (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৪২১) এবং জোহরের আগে ও পরে চার রাকাত করে মোট আট রাকাত নামাজ আদায় করারও ফজিলত বর্ণিত আছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ সেই ব্যক্তির উপর দয়া করুন, যে আসরের আগে চার রাকাত নামাজ আদায় করে।”
নামাজের প্রত্যেকটি ধাপে রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করাই একজন মুমিনের প্রধান কর্তব্য। একমাত্র সঠিক অনুসরণের মাধ্যমেই আল্লাহর নৈকট্য ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব।
আরও পড়ুননামাজ: দাসের মহিমা০৪ মার্চ ২০২৫