কার্যক্রম নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগের ডাকা ‘লকডাউন’ কর্মসূচির দিন ঢাকা শহরের অনেক মানুষ বাইরে বের হওয়ার সাহস করেননি। কিছু বিচ্ছিন্ন ককটেল বিস্ফোরণ আর যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা এই ভয়কে আরও ঘনীভূত করে।

এই থমথমে পরিবেশকে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা ‘নীরব বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছেন; কিন্তু আসলেই কি এটা বিপ্লব? আদতে এটা তো ছিল ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে স্থবিরতা সৃষ্টি, যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আওয়ামী লীগ দলটি কতটা জনবিচ্ছিন্ন এবং তাদের রাজনৈতিক মৃত্যু কতটা আসন্ন।

এই ভয়ের বিপরীতে মাত্র এক বছর আগের জুলাই-আগস্ট মাসের স্মৃতি এখনো আমাদের মনে উজ্জ্বল। সেদিন ঢাকার রাজপথ ছিল লোকে লোকারণ্য। দেশের প্রায় সব শহরেও নেমে এসেছিল মানুষ। কোনো দলের ডাকে নয়, কোনো রাজনৈতিক নেতার আহ্বানে নয়, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী আর আপামর জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে এসেছিলেন রাস্তায়।

কোটা সংস্কারের মতো একটি নির্দিষ্ট দাবি থেকে শুরু হওয়া সেই আন্দোলন অল্প দিনেই রূপান্তরিত হয়েছিল স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এক গণ-অভ্যুত্থানে। সেই আন্দোলনে ছিল গণমানুষের শক্তি, সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার তেজ।

জুলাই দেখিয়েছিল, জনগণ রাস্তায় নেমে এলে রাষ্ট্রযন্ত্রও তাকে থামাতে পারে না। সেই গণ–অভ্যুত্থানের দেড় বছর পর ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কর্মসূচি দেখাল, ভয় দেখিয়ে মানুষকে হয়তো সাময়িকভাবে ঘরে আটকে রাখা যায়, কিন্তু তাদের মন জয় করা যায় না। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার দুটি ভিন্ন মেরু স্পষ্ট যে —একটি গণশক্তির উত্থান, অন্যটি একটি দলের রাজনৈতিক দর্শনের দেউলিয়াত্ব।

‘লকডাউন’ ব্যর্থতার ব্যবচ্ছেদ: ভয় যখন অস্ত্র

আওয়ামী লীগের ডাকা ‘লকডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশের সবকিছু স্বাভাবিক রাখার আশ্বাস সত্ত্বেও মানুষ কার্যত ‘ঘরবন্দী’–ই ছিল। গত কয়েক দিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ২৫টির অধিক যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও অনেক জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা জনমনে যে আতঙ্ক তৈরি করেছিল—স্কুল-কলেজ একরকম বন্ধই ছিল, ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খুলতে দ্বিধায় ভোগেন এবং সাধারণ মানুষ গণপরিবহন এড়িয়ে চলে। ঢাকার আশপাশে কিছু এলাকায়ও অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে।

আওয়ামী লীগ এই পরিস্থিতিকে তাদের কর্মসূচির সাফল্য হিসেবে দেখতে চেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জনগণ কি তাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘরে বসে ছিল, নাকি আগুন–সন্ত্রাসের ভয়ে? উত্তরটি স্পষ্ট। একজন সাধারণ বাসচালককে বলতে দেখলাম, ‘দৈনিক আয়ে আমার পরিবার চলে, কিন্তু আমি আহত হলে বা মারা গেলে আমার সন্তান ও পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে? তাই গাড়ি বের করিনি।’ যখন একটি রাজনৈতিক দল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করে, ভীতি সৃষ্টি করে তাদের কর্মসূচি সফল করতে চায়, তখন বুঝতে হবে মূলধারার, রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে এসেছে।

আরও পড়ুনদ্য উইকে শেখ হাসিনার নিবন্ধ, অস্বীকারের রাজনীতি ও অসত্য চর্চার নমুনা১৪ নভেম্বর ২০২৫এ উল্লাস কি রাজনৈতিক মৃত্যুর উদ্‌যাপন নয়?

ইতালীয় তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামশির তত্ত্ব অনুযায়ী, যখন কোনো রাজনৈতিক শক্তির প্রতি জনগণের সম্মতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে, তখন টিকে থাকার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় ভয় ও নিপীড়ন। ১৩ নভেম্বরের ‘লকডাউন’ প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগ গণমানুষের সমর্থন হারিয়ে এখন কেবল ভীতি প্রদর্শনের পথেই হাঁটছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নাশকতার অভিযোগে আটক ব্যক্তির অনেকেই ঢাকার বাইরের এবং অর্থের বিনিময়ে কর্মসূচিতে অংশ নিতে এসেছিলেন। ডিএমপি কমিশনারের ভাষ্যমতে, ‘অধিকাংশই রাজধানীর বাইরে থেকে আসা। অর্থের বিনিময়ে তাঁরা ঢাকায় এসে ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণ করে আবার ঢাকার বাইরে চলে যান।’

টিভি চ্যানেলগুলোর ভিডিও প্রতিবেদনে পদ্মা সেতুর ওপারে আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকায় তাদের ‘লকডাউন’ কর্মসূচিতে দেখা গেছে, প্রকাশ্যে দেশীয় অস্ত্র, হাতে ককটেল নিয়ে মিছিল করেছেন তাঁরা। সহিংস মনোভাবের বিষয়টি লুকানোরও প্রয়োজন মনে করেননি সেখানকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ, এমনকি আওয়ামী মহলের বিভিন্ন ফেসবুক পেজ ও তাঁদের নেতা-অ্যাকটিভিস্টদের ফেসবুক পোস্ট থেকেও স্পষ্ট হয় যে এটি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নয়; বরং ভাড়া করা শক্তি দিয়ে আতঙ্ক তৈরির একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা, যা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বকেই স্পষ্ট করে তোলে।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনা কি তাহলে পুলিশের ওপরই সব দায় চাপিয়ে দিলেন০৬ নভেম্বর ২০২৫স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বনাম গণবিরোধী আন্দোলন

সারা বিশ্বে তরুণ প্রজন্ম যেভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিচ্ছে, বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থান ছিল তারই এক শক্তিশালী উদাহরণ। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কেবল সংগঠিত হওয়ার জন্য ব্যবহার করেনি; বরং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের প্রতিটি মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিল।

জুলাইয়ের আন্দোলনের মতো স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন এ দেশে আগেও নানা ইস্যুতে হয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ইস্যুতে ছোট-বড় অনেক স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনই এ দেশে নতুন নয়। বিপরীতে, ১৩ নভেম্বরের ‘লকডাউন’ ছিল একটি শীর্ষ পর্যায় থেকে চাপিয়ে দেওয়া কর্মসূচি। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলীয় নেত্রীর বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা। এই কর্মসূচিতে জনগণের আবেগ বা সমর্থন কোনোটাই ছিল না। মরিয়া হয়ে কর্মসূচি সফল করতে পুরোনো ভিডিও বিকৃতভাবে উপস্থাপন, এআই দিয়ে গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করেও এ ‘লকডাউন’ জনভিত্তি পায়নি। জুলাইয়ের আন্দোলন যেখানে প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেখানে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি দাঁড়িয়েছিল গুজব আর ভীতি প্রদর্শনের ওপর।

১৩ নভেম্বরের জনশূন্য ঢাকা আসলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনের এক করুণ প্রতিচ্ছবি। আওয়ামী লীগ আজ এতটাই জনবিচ্ছিন্ন যে ভয় দেখিয়ে নিজেদের কর্মসূচির ‘সাফল্য’ উদ্‌যাপন করতে হচ্ছে। এই ফাঁকা রাজপথ তাদের বিজয়ের চিহ্ন নয়; বরং রাজনৈতিক মৃত্যুর শোকলিপি।অতীতে সহিংস রাজনীতির ব্যর্থতা

সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি বাংলাদেশে নতুন নয়। ২০১৩-১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের লাগাতার অবরোধকে কেন্দ্র করে অগ্নিসন্ত্রাসের স্মৃতি এখনো মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। সেই সময়েও সাধারণ মানুষ এ অগ্নিসন্ত্রাসের প্রধান শিকার হয়েছিল।

কিন্তু বিএনপি–জামায়াতের সেই অবরোধ আন্দোলন সফল হয়নি। কারণ, তাতে গণমানুষের সমর্থন ছিল না; বরং সেসময়ের সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আরও ক্ষমতাশালী হতে সাহায্য করেছিল।

শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোর হস্তে দমন করার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং নিজেকে স্থিতিশীলতার জন্য অত্যাবশ্যক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এভাবে বিরোধী দলের কিছু ভুল রাজনৈতিক কৌশল শেখ হাসিনাকে ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হওয়ার পথ সুগম করে দিয়েছিল। এরপর আমরা দেখতে পাই পরের ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যেখানে ভিন্নমতকে দমন করা হতো এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ আজ সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করছে। তারা ভুলে গেছে যে সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শন করে জনসমর্থন আদায় করা যায় না; বরং তা বুমেরাং হয়ে নিজেদের দিকেই ফিরে আসে।

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। বুধবার ভোরে গাজীপুর নগরের ভোগড়া পেয়ারাবাগান এলাকায়.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ম ত য ন সন ত র স র র র জন ত ক র জন ত ক দ জনগণ র দ র কর আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ নিয়ে মতপার্থক্য, সরকার প্রস্তুত সিদ্ধান্তে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের উত্তাপ। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এখন পরস্পরবিরোধী। বিএনপি বলছে, জনগণের ভোট ও মতামত ছাড়া কোনো সনদ কার্যকর হলে সেটি টেকসই হবে না। জামায়াতে ইসলামী মনে করে, সনদের মূল কাঠামো পরিবর্তনের চেষ্টা জুলাই আন্দোলনের চেতনা ও ঐক্যকে ক্ষুণ্ন করবে।

এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভাবছে, সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোট আয়োজনের জন্য একটি অধ্যাদেশ জারি করবে। সূত্র বলছে, গণভোটে চার থেকে পাঁচটি প্রশ্ন রাখা হতে পারে, যাতে জনগণ পৃথকভাবে মতামত জানাতে পারেন।

আরো পড়ুন:

বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তী সরকার নতুন পে-স্কেলের কাঠামো নির্ধারণ করবে: অর্থ উপদেষ্টা

জুলাই সনদ
২০২৪ সালের ২৬ জুলাই ছাত্র–জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যে ঐকমত্য দলিল তৈরি হয়, সেটিই এখন পরিচিত ‘জুলাই সনদ’ নামে। এতে তিনটি মৌলিক অঙ্গীকার ছিল—
১. দায়মুক্ত রাজনীতি ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন।
২. নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা।
৩. মানবাধিকার ও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

ছাত্রনেতা, নাগরিক সমাজ, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে তৈরি এই দলিলকে তখন বলা হয়েছিল ‘জনতার শপথনামা’। পরবর্তীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এটি রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু এক বছরের মাথায় সেই ঐকমত্যের ভেতরেই দেখা দিয়েছে ফাটল।

জনগণের রায় ছাড়া সনদ নয়: বিএনপি 
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “জুলাই সনদ জনগণের রক্তে লেখা। এর বাস্তবায়ন জনগণের গণরায় ছাড়া হতে পারে না। সরকার এখন কিছু ধারাকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে। বিশেষ করে প্রশাসনিক পুনর্গঠন, জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত গভর্নর নিয়োগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কাঠামো পুনর্বিবেচনা—এসব বিষয়ে সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।”

বিএনপির একজন নীতি-নির্ধারক বলেন, “আমরা সংস্কারের পক্ষে, কিন্তু সেটি হতে হবে জনগণের ভোটে অনুমোদিতভাবে। এখন সনদের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ সরকারের হাতে, যা ভবিষ্যতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটাতে পারে।”

বিএনপি চায়, সনদ বাস্তবায়নের আগে গণভোট বা জাতীয় নির্বাচনের দিনেই জনমত যাচাই করা হোক।

সনদ পরিবর্তনের চেষ্টা জুলাই বিপ্লব অস্বীকার: জামায়াত 
জামায়াতে ইসলামী মনে করে, সনদের মূল কাঠামো পরিবর্তন বা সংশোধন মানে আন্দোলনের আত্মাকে অস্বীকার করা।

দলটির আমির শফিকুর রহমান বলেন, “যারা জুলাই বিপ্লব মানবেন না, তাদের জন্য ২৬ সালে কোনো নির্বাচন নাই। জুলাই বিপ্লবের স্বীকৃতি দিতে হলে সনদের আইনি ভিত্তি দিতেই হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠদের সিদ্ধান্তই গণতন্ত্র। জুলাই সনদ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মতামতে প্রণীত। কেউ সেটি মানতে না চাইলে তারা গণতন্ত্রকেই অস্বীকার করছে।”

জামায়াতের দাবি-সনদ বাস্তবায়ন এখনই শুরু করতে হবে, বিলম্ব নয়। তাদের মতে, বিএনপি গণভোটের কথা তুলে নির্বাচনের আগে সংগঠনিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে।

দলটির একজন নীতি-নির্ধারক বলেন, “গণভোটে জনগণ যদি সনদের পরিবর্তনের পক্ষে যায়, তাহলে আন্দোলনের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। আমরা চাই বর্তমান কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে দ্রুত বাস্তবায়ন।”

‘গণভোটে জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিতের উদ্যোগ’
অন্তর্বর্তী সরকার সূত্রে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস এবং তার উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ১৩ নভেম্বর  উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সবকিছু চূড়ান্ত হবে। ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ এবং গণভোট করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করবে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। কয়েকজন উপদেষ্টা দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তারা সরকারের মনোভাব এবং বাস্তব পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করছেন রাজনৈতিক দলগুলোকে।

খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী-নাগরিকরা অনলাইনে ও সরাসরি ভোট দিয়ে মতামত জানাতে পারবেন। গণভোটের ফলাফল আইনি মর্যাদা পাবে। ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য ধারাগুলোর তালিকা প্রকাশ করা হবে। স্বরাষ্ট্র ও আইন উপদেষ্টার কার্যালয় ইতিমধ্যে খসড়া প্রণয়ন শুরু করেছে।

সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট আয়োজনের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। মূল উদ্দেশ্য ছিল- ভোটকেন্দ্র ও কর্মকর্তাদের একসঙ্গে কাজে লাগানো গেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সময় বাঁচানো সম্ভব।”

তিনি বলেন, “জুলাই সনদ যদি সত্যিই জনতার দলিল হয়, তবে জনগণের ভোটেই সেটি অনুমোদিত হোক এই চেতনায় আমরা কাজ করছি। দুটি বিষয় মাথায় রেখে কাজ চলছে। দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।”

গণভোটে যে প্রশ্ন রাখার চিন্তা
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, গণভোটে চার থেকে পাঁচটি প্রশ্ন রাখার বিষয়ে চিন্তা চলছে। যেসব বিষয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দল একমত, সেগুলো নিয়ে একটি সাধারণ প্রশ্ন থাকবে। আর যেসব বিষয়ে ভিন্নমত যেমন উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বা নিয়োগ কমিশনের স্বাধীনতা এসব নিয়ে পৃথক প্রশ্ন থাকবে।

ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ও বিরোধ
‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’–এর খসড়া তৈরি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে ৪৮টি সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

কমিশনের প্রাথমিক প্রস্তাবে একটিমাত্র প্রশ্নে গণভোটের সুপারিশ ছিল। কিন্তু বিএনপি ও জামায়াত ভিন্নমত দেয়—তারা চায় ভিন্ন মতামতগুলোকেও আলাদা প্রশ্নে তোলা হোক। বিএনপি বলছে, কমিশন তাদের ‘ভিন্নমত নোট’ উপেক্ষা করেছে। অন্যদিকে জামায়াত বলছে, কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতেই আগে গণভোট হতে হবে, তারপর নির্বাচন।

সরকার এখন কমিশনের প্রস্তাবে কিছু পরিবর্তন আনতে চায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ১৮টি ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবের সবগুলোকে তিন-চারটি প্রশ্নের মধ্যে আনার চেষ্টা হচ্ছে।

‘তিন-চার দিনের মধ্যেই পরিষ্কার হবে’ 
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল  বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের একক নির্দেশনা দেবে—এই প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু আমরা বসে থাকিনি। নিজেদের মতো কাজ করেছি। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা তিন-চার দিনের মধ্যে পরিষ্কারভাবে জানতে পারবেন।”

তিনি আরো বলেন, “সব দলের প্রত্যাশা বিবেচনা করে দেশের ও জনগণের স্বার্থেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

গণভোটের রাজনীতি ও সম্ভাবনা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, “পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে, সংকট আরো গভীর হয়েছে। আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা চাপ তৈরির রাজনীতি করছে এবং রাজনৈতিক কৌশলে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।” 

জনমতের প্রতিক্রিয়া: আশা ও সংশয়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের বড় অংশ গণভোটকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের মতে, এতে নাগরিকরা সরাসরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অংশ নিতে পারবেন। তবে আরেক অংশের আশঙ্কা—রাজনৈতিক দলগুলো যদি গণভোটের ফল না মানে, তবে সেটি নতুন অচলাবস্থা ডেকে আনবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবিদুল হাসান বলেন, “এখন সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। জুলাই সনদ একতার প্রতীক ছিল। এখন সেটি দলীয় অবস্থান নির্ধারণের যন্ত্রে পরিণত হলে জনগণ আবারও হতাশ হবে।”

গণভোটের ইতিহাস: অভিজ্ঞতা মিশ্র
বাংলাদেশে এর আগে মাত্র দুটি গণভোট হয়েছে—১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের সময়ে এবং ১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন প্রশ্নে।

প্রথমটির ফল নিয়ে বিতর্ক ছিল; প্রশাসনিক প্রভাব ও ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে। দ্বিতীয় গণভোট তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য হলেও রাজনৈতিক বিভাজন তখনও রয়ে যায়।

এই প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার গণভোট হলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ, প্রযুক্তিগত স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক ঐক্য নিশ্চিত করা জরুরি।

বিরোধ ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বাস্তবতা
ঢাকা-৮ আসনের ভোটার মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, “জুলাই সনদ নিয়ে বিরোধ এখন কেবল রাজনৈতিক অবস্থান নয় এটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামোর দিক-নির্দেশনাও নির্ধারণ করছে।”

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে দ্রুতই সরকারের সিদ্ধান্ত জানা যাবে। আলোচনা করে যেটা ভালো মনে হয় সরকার সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।”

ঢাকা/এএএম/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কোনো চাঁদাবাজ দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হবো না: চরমোনাই পীর
  • ‘সরকার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করছে’
  • প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিএনপি
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে রাষ্ট্রপতির সই
  • যেখানেই আওয়ামী লীগ দেখবেন, ধরে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন: হাসনাত আবদুল্লাহ
  • ইউনূস সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা চলা শুরু করেছে: নাসীরুদ্দ
  • ‘আগুন–সন্ত্রাস’ দেখে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির সতর্ক হওয়া উচিত: তারেক রহমান
  • আওয়ামীলীগের নাশকতা প্রতিহত করতে সোনারগাঁয়ে মান্নানের নির্দেশে প্রস্তুত নেতৃবৃন্দ
  • জুলাই সনদ নিয়ে মতপার্থক্য, সরকার প্রস্তুত সিদ্ধান্তে