জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বললেই এত দিন শুধু নদী বা সমুদ্রসংলগ্ন গ্রামীণ জনপদের কথাই ভাবা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি গবেষণা প্রমাণ করেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ২২টি শহর ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। নদীভাঙন, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড় ও পানিসংকটের শিকার হয়ে হাজার হাজার মানুষ গ্রাম ছেড়ে এসব শহরে আশ্রয় নিচ্ছেন। এতে উপকূলীয় নগরগুলো অতিরিক্ত জনচাপ, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও নাগরিক দুর্ভোগের এক নতুন সংকটে ডুবে যাচ্ছে।

সাতক্ষীরা বা খুলনার মতো শহরগুলোর বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া অসংখ্য মানুষের জীবন জলবায়ু উদ্বাস্তুর ক্রমবর্ধমান ঢেউয়ের প্রতীক। ভিটেমাটি আর জীবিকা হারিয়ে একটু ভালো থাকার আশায় শহরে এসে তাঁরা দেখছেন, শহরের অবস্থাও ভালো নয়। সাতক্ষীরা পৌরসভায় লোকসংখ্যা এক দশকে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে আর ৪৭টি বস্তি গড়ে উঠেছে কেবল গ্রাম থেকে আসা এ অসহায় মানুষগুলোর ভারে।

বুয়েটের গবেষকদের জার্নাল অব ওয়াটার অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণায় এসব উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় উঠে আসা ফলাফল স্পষ্ট করেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকৃত প্রভাব শুধু সংখ্যা দিয়ে নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চরম ভোগান্তি দিয়েই পরিমাপ করতে হবে।

উপকূলীয় শহরগুলোর এ ঝুঁকির মূল কারণ বহুমুখী। প্রথমত, ভূগর্ভস্থ পানি ও কৃষিজমিতে লবণাক্ততা এতটাই বেড়েছে যে পানীয় জলের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে এবং কৃষকেরা পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, উপকূলের মানুষ দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিয়ে শহরে ভিড় করায় যানজট, বস্তি ও নাগরিক দুর্ভোগ বাড়ছে। বরিশাল শহরের রিকশাচালকদের বড় অংশই এর উদাহরণ। তৃতীয়ত, নদীভাঙন, খালের পলি ভরাট ও দুর্বল স্লুইসগেটের কারণে সামান্য বৃষ্টি বা জোয়ারেই শহরগুলো তলিয়ে যায়। মোরেলগঞ্জ বাজার দিনে দুবার পানির নিচে থাকে। চতুর্থত, কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার অভাব জলাবদ্ধতাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে, যা স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যাহত করে।

একদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারেন। অন্যদিকে উপকূলীয় শহরগুলোর এ দুর্বলতা টেকসই নগর অর্জনের পথে বড় বাধা। গবেষণায় চালনা, পাথরঘাটা, মোরেলগঞ্জ ও কুয়াকাটার মতো শহরগুলো ‘অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের সমাধান খুঁজতে হবে।

সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে বহুমাত্রিক কৌশল নিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোতে বসবাস উপযোগিতা খুঁজে বের করতে হবে। বিকল্প কৃষিব্যবস্থা ও পেশার সুযোগ তৈরি করতে হবে। জলবায়ু-সহনশীল জীবিকাব্যবস্থা উন্নয়ন, নগরে সঠিক বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং বেড়িবাঁধের সুরক্ষার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কেবল তখনই এই শহরগুলো জলবায়ু উদ্বাস্তুদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে পারবে, অন্যথায় জননিরাপত্তা ও উন্নয়ন—দুটোই মুখ থুবড়ে পড়বে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ শহরগ ল জলব য উপক ল

এছাড়াও পড়ুন:

টেকসই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বললেই এত দিন শুধু নদী বা সমুদ্রসংলগ্ন গ্রামীণ জনপদের কথাই ভাবা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি গবেষণা প্রমাণ করেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ২২টি শহর ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। নদীভাঙন, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড় ও পানিসংকটের শিকার হয়ে হাজার হাজার মানুষ গ্রাম ছেড়ে এসব শহরে আশ্রয় নিচ্ছেন। এতে উপকূলীয় নগরগুলো অতিরিক্ত জনচাপ, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও নাগরিক দুর্ভোগের এক নতুন সংকটে ডুবে যাচ্ছে।

সাতক্ষীরা বা খুলনার মতো শহরগুলোর বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া অসংখ্য মানুষের জীবন জলবায়ু উদ্বাস্তুর ক্রমবর্ধমান ঢেউয়ের প্রতীক। ভিটেমাটি আর জীবিকা হারিয়ে একটু ভালো থাকার আশায় শহরে এসে তাঁরা দেখছেন, শহরের অবস্থাও ভালো নয়। সাতক্ষীরা পৌরসভায় লোকসংখ্যা এক দশকে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে আর ৪৭টি বস্তি গড়ে উঠেছে কেবল গ্রাম থেকে আসা এ অসহায় মানুষগুলোর ভারে।

বুয়েটের গবেষকদের জার্নাল অব ওয়াটার অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণায় এসব উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় উঠে আসা ফলাফল স্পষ্ট করেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকৃত প্রভাব শুধু সংখ্যা দিয়ে নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চরম ভোগান্তি দিয়েই পরিমাপ করতে হবে।

উপকূলীয় শহরগুলোর এ ঝুঁকির মূল কারণ বহুমুখী। প্রথমত, ভূগর্ভস্থ পানি ও কৃষিজমিতে লবণাক্ততা এতটাই বেড়েছে যে পানীয় জলের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে এবং কৃষকেরা পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, উপকূলের মানুষ দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিয়ে শহরে ভিড় করায় যানজট, বস্তি ও নাগরিক দুর্ভোগ বাড়ছে। বরিশাল শহরের রিকশাচালকদের বড় অংশই এর উদাহরণ। তৃতীয়ত, নদীভাঙন, খালের পলি ভরাট ও দুর্বল স্লুইসগেটের কারণে সামান্য বৃষ্টি বা জোয়ারেই শহরগুলো তলিয়ে যায়। মোরেলগঞ্জ বাজার দিনে দুবার পানির নিচে থাকে। চতুর্থত, কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার অভাব জলাবদ্ধতাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে, যা স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যাহত করে।

একদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারেন। অন্যদিকে উপকূলীয় শহরগুলোর এ দুর্বলতা টেকসই নগর অর্জনের পথে বড় বাধা। গবেষণায় চালনা, পাথরঘাটা, মোরেলগঞ্জ ও কুয়াকাটার মতো শহরগুলো ‘অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের সমাধান খুঁজতে হবে।

সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে বহুমাত্রিক কৌশল নিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোতে বসবাস উপযোগিতা খুঁজে বের করতে হবে। বিকল্প কৃষিব্যবস্থা ও পেশার সুযোগ তৈরি করতে হবে। জলবায়ু-সহনশীল জীবিকাব্যবস্থা উন্নয়ন, নগরে সঠিক বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং বেড়িবাঁধের সুরক্ষার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কেবল তখনই এই শহরগুলো জলবায়ু উদ্বাস্তুদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে পারবে, অন্যথায় জননিরাপত্তা ও উন্নয়ন—দুটোই মুখ থুবড়ে পড়বে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ