Prothomalo:
2025-11-15@07:57:08 GMT

রুনা বদলে দিলেন ৪০০ নারীর জীবন 

Published: 15th, November 2025 GMT

টাকার অভাবে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। বাল্যবিবাহ হয়েছিল। স্বামীর সংসারে গিয়েও অভাব দূর হয়নি; বরং ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা। দুঃখ-কষ্টে যখন দিন কাটছিল, তখন এক মামার কাছ থেকে এক হাজার টাকা ধার নিয়ে কাপড়-সুতা কিনে শুরু করেন নকশিকাঁথা সেলাই।

পসার বাড়ে, বদলে যায় জীবনও। এখন তাঁর অধীনে কাজ করছেন অন্তত ৪০০ নারী। পরিশ্রম আর একাগ্রতায় অভাব দূর করা সেই নারী হলেন রুনা বেগম (৩৭)। 

রুনার বাসা সিলেট নগরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের শাহি ঈদগাহ হাজারীবাগ এলাকায়। অভাব তাড়াতে ২০০৮ সালে ছোট পরিসরে কাঁথা সেলাইয়ের যে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, দেড় দশকের ব্যবধানে তিনি এখন সফল নারী উদ্যোক্তা। অন্যদের কাছে তিনি এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, এমন মত সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি লুবানা ইয়াসমিনের।

তিনি ৪৫০ টাকায় কাঁথাটি বিক্রি করেন। এরপর তাঁর মনে হলো, এভাবে কাঁথা সেলাই করেই তো অভাব দূর করা সম্ভব!যেভাবে শুরু

২০০৫ সালে রুনা বেগমের বিয়ে হয়। স্বামী মো.

আবদুল্লাহ টাইলস বসানোর কাজ করতেন। এক দিন কাজ পেলে পরের দিন বেকার। একদিন বাসার দাওয়ায় বসে নকশিকাঁথা সেলাই করছিলেন রুনা। শৈশবে মায়ের কাছ থেকে সেলাই শিখেছিলেন। ওই কাঁথা দেখে এক ব্যক্তি সেটা কিনে নেওয়ার আগ্রহ দেখান। তিনি ৪৫০ টাকায় কাঁথাটি বিক্রি করেন। এরপর তাঁর মনে হলো, এভাবে কাঁথা সেলাই করেই তো অভাব দূর করা সম্ভব!

অনেক ভেবেচিন্তে এক মামার কাছ থেকে এক হাজার টাকা ধার নেন। সে টাকায় সুতা-কাপড় কিনে শুরু করেন নকশিকাঁথা সেলাই। প্রথম দফায় তৈরি কাঁথা বিক্রির টাকা দিয়ে আবার সুতা-কাপড় কিনে কাঁথা সেলাই শুরু করেন।

যখন ব্যবসার উদ্দেশ্যে রুনা কাঁথা সেলাই শুরু করেন, তখন ছিল ২০০৮ সাল। শুরুর দিকে সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকার একটি দোকানে নকশিকাঁথা পাইকারি দরে বিক্রি করতেন। পরে সেসব কাঁথা নগরের লালদীঘির পাড়, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার দোকানে সরবরাহ করতে থাকেন। বড়দের ও বাচ্চাদের নকশিকাঁথার পাশাপাশি বিছানার নকশি চাদর ও মেয়েদের জামাও তৈরি করতে থাকেন। অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর নিজস্ব নকশায় তৈরি কাপড়ের বড় বাজার তৈরি হয়।

সফলতা আসায় সবাই সম্মান করেন, সমীহ করেন। যাঁরা আগে বাঁকা চোখে দেখতেন, এখন তাঁরাও প্রশংসা করেনরুনা বেগমবন্ধুর পথ পাড়ি

রুনা বেগম বললেন, অনেক কঠিন ও বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে তিনি ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন। কাঁথা সেলাই করে, সেসব কাঁথা হাতে-কাঁধে করে বিভিন্ন দোকানে পাইকারি দরে বিক্রি করতেন। টাকা বাঁচানোর জন্য তিনি বাসা থেকে হেঁটে কয়েক কিলোমিটার দূরের পথগুলোতে যেতেন। ব্যবসা বড় হলে ২০১৮ সালে তিনি একটি স্কুটি কেনেন। এখন সেই বাহনে করে তিনি পণ্য নিয়ে দোকানে দোকানে যান।

রুনা বলেন, ‘আমি নারী হয়ে যখন কাঁথা নিয়ে দোকানে দোকানে যেতাম, তখন পাড়া-প্রতিবেশীসহ আশপাশের মানুষেরা নানা কটূক্তি করতেন। নিজে যেহেতু মার্কেটে গিয়ে কাঁথা বিক্রি করি, সেটাকে মানুষ ভালো চোখে নিতেন না। পরে যখন মোটরসাইকেল চালাইয়া কাঁথা দোকানে দেওয়া শুরু করি, তখনো কত প্রশ্ন। এসব শুনে আমি বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই।’ এখন অবশ্য দিন বদলেছে—জানিয়ে রুনা বলেন, ‘সফলতা আসায় সবাই সম্মান করেন, সমীহ করেন। যাঁরা আগে বাঁকা চোখে দেখতেন, এখন তাঁরাও প্রশংসা করেন।’

স্বাবলম্বী ৪০০ নারী

রুনা বেগমের নকশিকাঁথাগুলো নিজস্ব নকশায় করা। ভালো কাপড়ে ভালো নকশায় কাঁথা সেলাই করায় বাজারে তাঁর পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়। আগে তিনি সিলেটের ছোট ছোট দোকানে বড় ও ছোটদের নকশিকাঁথা দিতেন, পরে বড় দোকানেও পণ্য দিতে থাকেন।

পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রুনা একা আর সামলাতে পারছিলেন না। তখন সহযোগী হিসেবে আরও নারীদের যুক্ত করেন। এসব নারীকে তিনি কাপড়ে নকশা করে দেন। তাঁরা সেই নকশা অনুযায়ী কাঁথার কাপড় বাসায় নিয়ে সেলাই করে রুনাকে দেন। বিছানার চাদর ও জামার মধ্যেও নকশি করার কাজ একইভাবে করা হয়। এখন রুনার অধীনে প্রায় ৪০০ নারী সেলাইয়ের কাজ করছেন।

রুনা জানান, প্রতিটি নকশিকাঁথার জন্য তিনি তাঁর এখানে কাজ করা নারীদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেন। চারজন নারীকে তিনি স্থায়ী চাকরি দিয়েছেন। এ চারজনের দুজন কাপড়ে নকশা তৈরি করেন এবং অন্য দুজন সেলাই মেশিন দিয়ে কাঁথা ও বিছানার চাদরের কাপড় জোড়া দেন।

সরেজমিনে একবেলা

রুনা বেগমের বাসায় গেলে দেখা হয় তারা বানুর (৫০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০০৮ সাল থেকে তিনি রুনার নকশায় কাঁথা সেলাই করে আসছেন। একেকটা কাঁথা সেলাইয়ের জন্য তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পান। মাসে তিনি ৫ থেকে ৬টি কাঁথা সেলাই করতে পারেন। এ থেকে উপার্জিত টাকা তাঁর সংসারে ব্যয় হয়।  নাসিমা আক্তার (২৭) নামের এক নারী রুনা বেগমের এখানে সেলাই মেশিনে কাপড় জোড়া দেওয়ার কাজ করেন। তিনি বলেন, স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। পরিবারের খরচ মেটাতে স্বামীকে সহযোগিতার জন্য তিনি কাজ খুঁজছিলেন। আগে তাঁর মা রুনা বেগমের নকশায় কাঁথা সেলাই করতেন। সেটা মাথায় রেখেই তিনি রুনার এখানে সেলাই করার কাজ নেন। এতে তাঁর অভাব এখন অনেকটাই দূর হয়েছে।

রুনা বেগম জানান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে তাঁর নকশিকাঁথা বিক্রি হচ্ছে। তিনি চাহিদা অনুযায়ী পণ্য ক্রেতাদের কাছে বিদেশে কুরিয়ারে পাঠান। ভারতে একাধিকবার আন্তর্জাতিক মেলায় অংশ নিয়েছেন।পণ্য যাচ্ছে বিদেশেও

নগরের হাজারীবাগ এলাকায় রুনা বেগম সম্প্রতি একটি শোরুম চালু করেছেন। নাম ‘নকশিকাঁথা সিলেট’। আগে থেকেই অনলাইনে তাঁর পণ্যের একটা বাজার তৈরি করেছেন। প্রতিদিনই অনলাইনে দেশ-বিদেশের নকশিকাঁথাপ্রেমীরা তাঁর কাছ থেকে পণ্য কিনে নিচ্ছেন। 

রুনা বেগম জানান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে তাঁর নকশিকাঁথা বিক্রি হচ্ছে। তিনি চাহিদা অনুযায়ী পণ্য ক্রেতাদের কাছে বিদেশে কুরিয়ারে পাঠান। ভারতে একাধিকবার আন্তর্জাতিক মেলায় অংশ নিয়েছেন।

রুনার বানানো ছোটদের নকশিকাঁথা আকার ও নকশাভেদে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা। বড় নকশিকাঁথা বিক্রি করেন ৮৫০ থেকে ৭ হাজার টাকায়। এ ছাড়া নকশি বিছানার চাদর ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা এবং হাতে তৈরি নকশি জামার পিস ১ হাজার ১০০ থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

রুনা জানালেন, সিলেট শহরের প্রায় ৫০টি কাপড়ের দোকানে তিনি নকশিকাঁথা, বিছানার চাদর ও জামা সরবরাহ করেন। প্রতি মাসে তিনি ৫০০ থেকে ৬০০ নকশিকাঁথা, ২ থেকে ৩ হাজার বাচ্চাদের কাঁথা এবং ৩০০ থেকে ৪০০ হাতের তৈরি বিছানার নকশি চাদর সরবরাহ করেন। বছরে তাঁর ব্যবসার পরিধি এখন ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা।

আছে উদ্যোগ-স্বীকৃতি

রুনা তাঁর স্বামী মো. আবদুল্লাহকে সাত বছর আগে একটি মুদিদোকান করে দেন। হাজারীবাগ এলাকার মুদিদোকানে বসে আবদুল্লাহ বলেন, তাঁদের মেয়ে লুৎফা খাতুন নার্সিংয়ে পড়াশোনা করছে। ছেলে জাবের বিন আবদুল্লাহ পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। একসময় মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, এখন ব্যবসার আয় দিয়ে ৪ শতাংশ জায়গা কিনে তাঁরা বাড়ি করেছেন।

রুনা বেগম কোনো নারী মারা গেলে স্বেচ্ছায় মৃতের গোসল করান। নিজে রক্ত দেওয়ার পাশাপাশি অন্যকেও রক্ত দিতে উৎসাহিত করেন। অসংখ্য নারীকে তিনি মোটরসাইকেল চালানো শিখিয়েছেন।

সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য রুনা বেগম। তিনি নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা ও স্বীকৃতি পেয়েছেন।

রুনা বেগম বলেন, ‘সৎভাবে উপার্জন করতে পারছি। প্রায় ৪০০ নারীর কর্মসংস্থান তৈরি করতে পেরেছি। এর চেয়ে বড় আনন্দের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে এখন যেখানেই যাই, মানুষ সমীহ করেন। এটাও তো জীবনে অনেক বড় পুরস্কার।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ছ ন র চ দর র জন য ত ন আবদ ল ল হ স ল ই কর র নকশ ক ৪০০ ন র নকশ য় ক ক জ কর য ক তর হ কর ন ব গম র ব যবস করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

২০১৪, ’১৮ ও ’২৪ সালের মতো নির্বাচন হলে চরম দুর্ভোগ নেমে আসবে: গোলাম পরওয়ার

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সর্বশেষ তিনটি (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) বছরের মতো হলে জাতির ভাগ্যে চরম দুর্ভোগ নেমে আসবে। আজ শনিবার সকাল সোয়া নয়টার দিকে খুলনার জিরো পয়েন্ট এলাকায় এক পথসভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।

প্রশাসনের প্রতি নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়ে জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘আপনারা আগামী নির্বাচন স্বচ্ছ করুন। প্রত্যেক প্রার্থী যেন সমান সুযোগ পেয়ে নির্বাচনী কাজ করতে পারেন। অতীতে যারা কোনো বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করেছেন, সেসব ওসি ও এসপি পালিয়ে গেছেন। তাঁরা এখন ট্রাইব্যুনালে হাজির। প্রধান বিচারপতি, বায়তুল মোকাররমের খতিব, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনারও পালিয়ে গেছেন। ওসিরা চাকরি ছেড়ে বর্ডার দিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছেন। আপনাদের বিরুদ্ধেও যদি সেই অভিযোগ আসে, আপনারা কিন্তু পালানোর পথ পাবেন না।’

গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘৫৪ বছরে অনেক দল ও মার্কা দেখেছি। নৌকা, লাঙ্গল, ধানের শীষ দেখেছি। প্রতিটি শাসনে দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে; ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অন্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়নি। সুতরাং মানবরচিত বিধান দিয়ে দেশ পরিচালিত হলে দেশে শান্তি আসতে পারে না, এটি প্রমাণিত। তাই আসুন ভবিষ্যতে পবিত্র কোরআনের রাষ্ট্র গড়ি।’

জামায়াতে সেক্রেটারি জেনারেল আরও বলেন, ইতিমধ্যে নতুন প্রজন্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তন এনেছে। এর ধারাবাহিকতায় জাতি আগামী নির্বাচনেও দেশে একটি পরিবর্তন আনবে ইনশা আল্লাহ।

খুলনা-৫ আসনের (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে ওই পথসভার পর মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শোভাযাত্রাটি খুলনার জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে গুটুদিয়া, ডুমুরিয়া, খর্ণিয়া, চুকনগর, আঠারোমাইল, রুদাঘরা, রঘুনাথপুর, শাহপুর, ধামালিয়া, জামিরা, ফুলতলা, দামোদর হয়ে শিরোমণি শহীদ মিনার চত্বরে গিয়ে সংক্ষিপ্ত পথসভার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

খুলনার জিরো পয়েন্টের পথসভায় সভাপতিত্ব করেন হরিণটানা থানার আমির জি এম আবদুল গফুর। সেখানে বক্তৃতা দেন খুলনা-১ আসনের জামায়াতের প্রার্থী শেখ মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, খুলনা জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি মুন্সি মিজানুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি মুন্সি মঈনুল ইসলাম, খুলনা জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ইউসুফ ফকির ও সেক্রেটারি ইলিয়াস হোসাইন, ডুমুরিয়া উপজেলার আমির মোক্তার হোসেন, ফুলতলা উপজেলার আমির আবদুল আলিম, খানজাহান আলী থানার আমির সৈয়দ হাসান মাহমুদ, হরিণটানা থানার সেক্রেটারি ব ম মনিরুল ইসলাম প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ