নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক, এখন উপায় কী
Published: 16th, November 2025 GMT
গত ১৩ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা ‘শার্প গ্লোবাল রেইজ ইন অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট ইনফেকশন ইন হসপিটালস, ডব্লিউএইচও ফাইন্ডস’ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক অনুসন্ধানে দেখতে পেয়েছে, বিশ্বব্যাপী হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট সংক্রামক রোগ তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে) শীর্ষক এক উদ্বেগজনক সংবাদ প্রচার করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী যেসব সাধারণ সংক্রামক রোগ প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকে সহজে সারানো যেত, তা এখন আর সারানো যাচ্ছে না। চিকিৎসকেরা আতঙ্কের সঙ্গে বলছেন, সামনের দিনগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধির ফলে সাধারণ সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।
২০২৩ সালের এক জরিপে বলা হয়, পরীক্ষাগারে নিশ্চিত হওয়া ছয়টির মধ্যে একটি সংক্রামক রোগ অ্যান্টিবায়োটিকে সারানো যাচ্ছে না। রক্ত, অন্ত্র, মূত্রনালি এবং যৌন সংক্রমণের মতো সাধারণ সংক্রামক রোগে ৪০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর। সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ হলো, গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে বেশির ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা দেখাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০৫০ সাল নাগাদ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ৭০ শতাংশে পৌঁছাবে।
২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একইভাবে উদ্বেগজনক সংবাদ প্রচার করেছিল। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ রানিং আউট অব অ্যান্টিবায়োটিকস’ শিরোনামের খবরে বলা হয়, অতি দ্রুত পৃথিবী থেকে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক নিঃশেষ হচ্ছে। ‘অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্টস ইন ক্লিনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট পাইপলাইন ইনক্লুডিং টিউবারকিউলোসিস’ শীর্ষক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্টে বলা হয়, বাজারে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আসা স্থবির হয়ে গেছে।
বাজারে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রচলিত আছে, তার বেশির ভাগই এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যে হারে জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হচ্ছে, সে হারে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হচ্ছে না। যে গতিতে পৃথিবী থেকে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক নিঃশেষ হচ্ছে, তাতে অচিরেই চিকিৎসকদের সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে।
রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু সংক্রমণের ভয়ে অতি ছোট সার্জারি করতেও চিকিৎসকেরা সাহস পাবেন না। বর্তমানে বাজারে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যাচ্ছে, তা পুরোনো বা প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের সংক্ষিপ্ত রাসায়নিক রূপান্তরমাত্র। এসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সাময়িক সুবিধা পাওয়া গেলেও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না বা পারবে না।
অ্যান্টিবায়োটিক-সম্পর্কিত সংকট নিয়ে মানুষ এখনো পুরোপুরি অবহিত ও সচেতন হচ্ছে না। যখন অবহিত হবে, তখন সম্ভবত অনেক দেরি হয়ে যাবে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট সংক্রামক রোগ মানবসভ্যতার জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে যাচ্ছে। এই বিপর্যয়ের মাত্রা অনিশ্চিত, ভেদাভেদ অনির্ধারিত, ধনী-গরিব, শিশু-বয়স্ক, সুস্থ, প্রতিরোধক্ষমতাবিহীন রোগী—কেউই এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে না। তখন বুক চাপড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না।বর্তমান বিশ্বে কয়েকটি জীবাণু ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এসব জীবাণুর মধ্যে রয়েছে ই.
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বিশ্বব্যাপী এক মহাসংকট সৃষ্টি করেছে, যা আধুনিক ওষুধ ও চিকিৎসাব্যবস্থাকে বিপন্ন করে তুলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক জানান, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ঠেকানোর জন্য নতুন নতুন কার্যকর ওষুধ আবিষ্কারে পর্যাপ্ত অর্থ বিনিয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। নয়তো নতুন নতুন জীবাণু সংক্রমণ থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা দুরূহ হয়ে পড়বে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৫১টি পরীক্ষাধীন অ্যান্টিবায়োটিক চিহ্নিত করেছে, যা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ও যক্ষ্মার বিরুদ্ধে কার্যকর হবে বলে দাবি করা হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র আটটি সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস, গ্রাম নেগেটিভ প্যাথেজেন ক্লেবসিলা ও ই. কোলাই চিকিৎসায় কার্যকর কোনো অপশন চিকিৎসকদের হাতে নেই।
এসব জীবাণু সংক্রমণ অনেক সময় হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলোতে মানুষের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। পাইপলাইনে খুব বেশি ওরাল বা মুখে খাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক নেই। ওষুধ কোম্পানি ও গবেষকদের প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ বিভাগের পরিচালক ড. সুজান হিল। তিনি বলেন, ‘এসব ভয়াবহ সংক্রামক রোগের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার মতো আমাদের তেমন কোনো প্রতিরক্ষাব্যূহ নেই।’
যক্ষ্মার গবেষণায় খুব বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট যক্ষ্মার চিকিৎসায় গত ৭০ বছরে মাত্র দুটো ওষুধ বাজারে এসেছে। যক্ষ্মাকে সমূল বিনাশ করার জন্য এবং যক্ষ্মার চিকিৎসার ওষুধ উদ্ভাবনে অন্তত ৮০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ দরকার। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট মোকাবিলায় নতুন ওষুধ বা চিকিৎসা এককভাবে কার্যকর হবে না। চিকিৎসার সঙ্গে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। তারপর রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিকের যুক্তিসংগত ব্যবহার। যুক্তিসংগত ব্যবহার শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়, এটি পশু ও কৃষিক্ষেত্রেও নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্বখ্যাত ল্যানসেট জার্নালে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স—নিড ফর গ্লোবাল সলিউশন’ শীর্ষক একটি বিশ্লেষণধর্মী দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছাপা হয় কিছুদিন আগে। বিশ্বের ২৬ জন বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও ওষুধবিশেষজ্ঞ প্রবন্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যে হারে বাড়ছে, তাতে হয়তো দুই থেকে তিন দশকের মধ্যে মানুষ সংক্রামক রোগে অসহায় মৃত্যুবরণ করবে।
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণজনিত মৃত্যুহার বিংশ শতাব্দীর পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সে সময় কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক ছিল না। কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে অতি সাধারণ অস্ত্রোপচার অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। প্রবন্ধটি প্রকাশের পর বিশ্বব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলেও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ঠেকানোর ব্যাপারে বিশ্বে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
কিছুদিন আগে আমার হাতে একটি নামকরা হাসপাতালের জীবাণু কালচারের একটি রিপোর্ট আসে। এক বছরের এক শিশুর ঘায়ের পুঁজ কালচার করে ই. কোলাইয়ের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। জীবাণু কালচারে দেখা গেছে, ই. কোলাইয়ের বিরুদ্ধে বহুল ব্যবহৃত সব অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। যার মধ্যে রয়েছে অ্যামোক্সিসিলিন, সেপ্টাজিডিম, জেন্টামাইসিন, কোট্রাইমোক্সাজল, অ্যামিকাসিন, ন্যালিডিক্সিক অ্যাসিড, সেফুরক্সিম, সেফোটেক্সামিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, অ্যাজট্রিওনাম, নেটিলমাইসিন ও সেফট্রিয়াক্সন।
শুধু একটিমাত্র অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর বলে পরীক্ষায় দেখা গেছে আর তা হলো মেরোপেনেম। আমি রিপোর্টটি দেখে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেছি। ১৩টি অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে শুধু একটি অ্যান্টিবায়োটিক ই. কোলাই জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর, বাকি সব রেজিস্ট্যান্ট। এই রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমরা বিপদে আছি, যে বিপদের ভয়াবহতা কল্পনাশক্তিরও বাইরে।
এখনই বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সব বয়সের সব মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের শিকার হওয়ার প্রবল হুমকির মধ্যে রয়েছে।উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক র যকর অ য ন ট ব য় ট ক সব অ য ন ট ব য় ট ক ব শ বব য প স ক রমণ র জন য ব যবহ
এছাড়াও পড়ুন:
এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাক্টিকা তৈরির পরিকল্পনা ইলন মাস্কের
মানবসভ্যতার সামষ্টিক জ্ঞানকে মহাকাশে সুরক্ষিত রেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করার এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন ইলন মাস্ক। স্পেসএক্স ও এক্সএআইয়ের প্রধান নির্বাহী বলেন, উইকিপিডিয়ার বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলা তাঁর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইনির্ভর প্ল্যাটফর্ম গ্রোকিপিডিয়া একটি অস্থায়ী নাম। প্ল্যাটফর্মের সক্ষমতা আরও বাড়লে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হবে এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাক্টিকা। চিরায়ত বিজ্ঞান কল্পকাহিনির প্রতি সম্মান জানিয়ে নেওয়া এই নাম মানবজ্ঞান রক্ষার মহাজাগতিক ভান্ডারের ধারণা বহন করবে।
গত মঙ্গলবার এক্সে দেওয়া বার্তায় মাস্ক জানান, গ্রোকিপিডিয়া যখন যথেষ্ট উন্নত অবস্থায় পৌঁছাবে, তখন এর নাম বদলে রাখা হবে এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাক্টিকা। নামটির উৎস আইজ্যাক অ্যাসিমভের বিখ্যাত ফাউন্ডেশন সিরিজ। এ সিরিজে এক সাম্রাজ্যের সময়ে মানবজ্ঞান ধরে রাখতে গড়া হয়েছিল এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাক্টিকা নামে এক বিশাল তথ্যভান্ডার। ২০২৫ সালের অক্টোবরে চালু হওয়া গ্রোকিপিডিয়া এক্সএআইয়ের নিজস্ব ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল গ্রোক ব্যবহার করে তৈরি করা অনলাইন বিশ্বকোষ। নিরপেক্ষ তথ্যসূত্র হিসেবে এটি উইকিপিডিয়ার বিকল্প হতে পারে বলে দাবি করে আসছেন মাস্ক। প্ল্যাটফর্মটিতে ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নিবন্ধ যুক্ত হয়েছে। এগুলোর বড় অংশই এআই দিয়ে লেখা বা সম্পাদিত।
তবে মাস্কের সর্বশেষ ঘোষণা প্ল্যাটফর্মটিকে ধাপে ধাপে নতুন পরিচয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, গ্রোকিপিডিয়া কেবল সার্ভারে রাখা অনলাইন তথ্যভান্ডার হয়ে থাকবে না; এটি মানুষের মহাকাশ অভিযানের সঙ্গীও হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিশ্বকোষের স্থায়ী কপি পাঠানো হবে চাঁদ, মঙ্গল গ্রহ এবং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য আরও দূরবর্তী মহাজাগতিক গন্তব্যে। যেন মানবসভ্যতা কোনো সংকটে পড়লেও জ্ঞান হারিয়ে না যায়।
মাস্কের প্রযুক্তিগত কর্মযজ্ঞে সায়েন্স ফিকশনের প্রভাব নতুন নয়। স্টারশিপের নকশা থেকে শুরু করে সাইবারট্রাকের বাহ্যিক অবয়ব কিংবা টেসলার হিউম্যানয়েড রোবট ‘অপ্টিমাস’—তাঁর এমন অনেক প্রকল্পেই সায়েন্স ফিকশনের ছাপ স্পষ্ট। এবার অ্যাসিমভের কল্পনা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি মানবসভ্যতাকে অন্য গ্রহে বিস্তারের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করতে চাইছেন জ্ঞান সংরক্ষণের এই উদ্যোগকে।
তবে ঠিক কোন প্রযুক্তিতে এই মহাজাগতিক তথ্যভান্ডার সংরক্ষিত হবে, কীভাবে বিভিন্ন গ্রহে আপডেটের সমন্বয় করা হবে—এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো জানা যায়নি। মাস্ক এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দেননি।
সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে