চাটগাঁইয়া পোয়া, মেডিত ফইরলে লোয়া। এ কথা আবারও প্রমাণ করলেন চট্টগ্রামের দুই সহোদর ইয়ামিন ইকবাল ও মোহাইমিন ইকবাল। চট্টগ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই দুই তরুণ তাঁদের মেধা, অধ্যয়ন ও প্রচেষ্টায় এখন দুই বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। বিশ্বের লাখ লাখ তরুণ যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার স্বপ্ন দেখে, সে রকম দুটি প্রতিষ্ঠানে ইয়ামিন ও মোহাইমিন কাজ করার সুযোগ পেয়ে প্রমাণ করেছেন বিশ্বমানের প্রযুক্তি–দুনিয়ায় জায়গা করে নেওয়া কেবল স্বপ্ন নয়, বাস্তবও হতে পারে। বড় ভাই ইয়ামিন এখন গুগলে সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, আর ছোট ভাই মোহাইমিন এ বছর ফেব্রুয়ারিতে যোগ দিয়েছেন বিশ্বের সেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠান মেটায়। মেটার অধীন চারটি প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও থ্রেডে প্রতি মাসে ৪০০ কোটি ব্যবহারকারী নিয়মিত সক্রিয় থাকে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই নেট–দুনিয়ায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশের তরুণদের এক বিরাট অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হলেন দুই ভাই।
চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ পাহাড়তলীর চৌধুরীহাট এলাকার সাধারণ পরিবারে বেড়ে উঠেছেন দুই ভাই। শুরু থেকেই তাঁরা ভাবতে শুরু করেছেন, পড়ালেখা মানে শুধু স্কুল–কলেজে যাওয়া–আসা নয়, প্রতিদিনের পাঠাভ্যাস থেকে যে জ্ঞান অর্জন করা যায়, তাকে কাজে লাগাতে হবে। কিছু একটা করতে হবে। অনেক বড় কিছু করার স্বপ্ন তাঁদের সব সময় ছিল। ইয়ামিন ইকবাল পড়েছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট), বিভাগ—কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনের শুরু থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল প্রোগ্রামিং ও সমস্যা সমাধানে। সেই আগ্রহই তাঁকে নিয়ে যায় এক প্রতিযোগিতামূলক পথে, যার শেষপ্রান্তে অপেক্ষা করছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি কোম্পানি গুগল। ২০২০ সালে ইয়ামিন গুগলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। এটি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং বাংলাদেশের প্রযুক্তি শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন দরজা খুলে দিয়েছিল—সেই একই পথে হাঁটলেন ছোট ভাই মোহাইমেন।
মোহাইমিন ইকবাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করেছেন ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে। বড় ভাইয়ের সাফল্য তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। বড় ভাইয়ের দেখাদেখি তাঁরও আগ্রহ জন্মে প্রোগ্রামিংয়ের ওপর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই নিয়মিত প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন এবং নিজের দক্ষতা বাড়তে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কোনো পুরস্কার পাব কি পাব না, জিতব কি না—এসব নিয়ে মোটেও ভাবতেন না। তিনি শুধু চেষ্টা করে গেছেন। এভাবে নিয়মিত সাধনার ভেতর দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্নাতক পাস করে বসে থাকার পাত্র নন তিনি। নিজ প্রচেষ্টায় উচ্চশিক্ষার চেষ্টা করতে থাকেন। অবশেষ যুক্তরাষ্ট্রের সান হোসে স্টেট ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান। বিদেশের মাটিতে গিয়ে অচেনা পরিবেশে শুরু করলেন এক নতুন জীবন। এক নতুন সংগ্রাম। শিক্ষার পাশাপাশি তাঁকে করতে হয়েছে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। করতে হয়েছে চাকরির সন্ধান। সে এক কঠিন সময়। চাকরি পাওয়া খুব একটা সহজ নয়। কারণ, সে সময় বিশ্বজুড়ে টেক কোম্পানিগুলো ছাঁটাই আর নিয়োগ স্থগিত করছিল।
মোহাইমিন বলেন, ‘এই কঠিন মার্কেটে ইন্টার্নশিপ পাওয়া খুবই টাফ ছিল। টেক কোম্পানিগুলো তখন ছাঁটাই করছিল, হায়ারিং প্রায় বন্ধ। হাজার হাজার আবেদনকারীর ভিড়ে মে ২০২৪-এ স্নোফ্লেক এ ইন্টার্নশিপ পেয়ে গেলাম। এটা আমার জন্য বিশাল জয় ছিল।’ সেই ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। চৌকস সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ শেখার সুযোগ পেলেন আর সময়কে কাজে লাগিয়ে পরিশ্রমের বিপরীতে কীভাবে কিছু অর্জন করতে হয় তা শিখলেন। এভাবে ইন্টার্নশিপও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু কোম্পানিগুলো নিয়োগ বন্ধ রাখায় কোথাও থেকে পূর্ণকালীন চাকরির সুযোগ পাচ্ছিলেন না। তবে হতোদ্যম হয়ে পড়েননি। আর যাই হোক নিজের জীবনবৃত্তান্তে স্নোফ্লেকের নামটা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটা তাঁর অনেক বড় সঞ্চয়। আশায় দিন কাটাচ্ছিলেন। আর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন বিভিন্ন কোম্পানিতে। একের পর এক বড় কোম্পানিগুলো তাঁর প্রোফাইলের দিকে নজর দিতে শুরু করে। এরপর এল সেই শুভক্ষণ। অক্টোবর ২০২৪-এ মাইক্রোসফট এবং নভেম্বরেই মেটা থেকে আসে পূর্ণকালীন চাকরির প্রস্তাব। অবশেষে এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি যোগ দেন মেটায়।
মোহাইমিন তাঁর ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন, ‘বিশ্বের দুই টেক জায়ান্ট মেটা ও মাইক্রোসফটে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেয়েছি। আমি মেটার অফার গ্রহণ করেছি। আমার আশা একদিন বাংলাদেশের নিজস্ব টেক জায়ান্ট থাকবে, যা সারা বিশ্ব ব্যবহার করবে।’ মোহাইমিনের সাফল্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড.
মায়ের এই বিশ্বাসই দুই সন্তানকে সাফল্যের এমন শিখরে নিয়ে গেছে। অগ্রজ ইয়ামিন সব সময় ছোট ভাইকে পথ দেখিয়েছেন। একসঙ্গে প্রোগ্রামিং নিয়ে আলোচনা, সমস্যা সমাধান ও কোড রিভিউ করা ছিল তাঁদের নিত্যদিনের কাজ। ইয়ামিন বর্তমানে গুগলে সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন, আর তাঁর অভিজ্ঞতাগুলো ছোট ভাইকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
এই দুই ভাইয়ের গল্প সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের প্রযুক্তি-প্রজন্মের গল্প। প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চাকরির সাক্ষাৎকার—সবকিছুই তাঁদের জন্য ছিল শেখার সুযোগ। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, দেশের বাইরে গিয়ে বড় কিছু করার আগে নিজের ভেতরের সক্ষমতাকে জাগানোই আসল বিষয়।
মোহাইমিন তরুণদের উদ্দেশে বলেন, ‘যারা গুগল, মেটা বা মাইক্রোসফটে কাজ করতে চায়, তাদের প্রোগ্রামিং মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অন্য বিভাগ থেকেও যদি প্রোগ্রামিংয়ে দক্ষতা থাকে, তবু সম্ভব।’
ইয়ামিন আর মোহাইমিনের সাফল্য বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে নতুন বিশ্বাস জাগিয়েছে। তাঁরা জানিয়ে দিলেন—সাফল্য কেবল বিদেশি নয়, দেশীয় মেধা দিয়েও সম্ভব। তাঁরা দুজনই বিশ্বাস করেন, একদিন বাংলাদেশের নিজস্ব প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নেবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ন ইকব ল কর র স স ফল য কর ছ ন চ কর র ক জ কর র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
সফটওয়্যার কোম্পানির টাকায় যক্ষ্মা সম্মেলনে
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিদেশি সফটওয়্যার কোম্পানির কাছে অর্থ চেয়েছে। ওই কোম্পানির সঙ্গে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লেনদেন আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা ক্রয় আইনের লঙ্ঘন। চারজন বিদেশগামী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁরা নিজের অর্থে সম্মেলনে যাচ্ছেন।
যক্ষ্মা ও ফুসফুসের রোগের আন্তর্জাতিক বার্ষিক সম্মেলন ইউনিয়ন কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হবে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। সম্মেলন শুরু হচ্ছে ১৮ নভেম্বর, শেষ হবে ২১ নভেম্বর। সারা বিশ্বের যক্ষ্মা ও ফুসফুসের রোগবিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা এই সম্মেলনে যোগ দেবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সদ্য সাবেক উপপরিচালক জোবায়দা নাসরিন ভারতের সফটওয়্যার কোম্পানি কিউর এআই-কে ৫ অক্টোবর চিঠি দিয়ে অর্থসহায়তার অনুরোধ করেন। বর্তমানে তিনি যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার উপপরিচালক।
এটি স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়। যে কোম্পানির সঙ্গে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ব্যবসা আছে, তার কাছে অর্থসহায়তা চাওয়া অনৈতিক। এটা সরকারি ক্রয়বিধির পরিপন্থী। আইনের লঙ্ঘন। এটা ভবিষ্যৎ ক্রয়প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে। এটা গ্রহণযোগ্য না, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবিচিঠিতে বলা হয়, কোম্পানিটি যেন যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পাঁচ কর্মকর্তাকে ওই সম্মেলনে যোগদান নিশ্চিত করতে অর্থসহায়তা দেয়। কোম্পানিটির কাছে অর্থসহায়তা বাবদ ২২ হাজার ২৭০ ডলারের (প্রায় ২৭ লাখ টাকা) একটি বাজেটও দেওয়া হয়।
সফটওয়্যার কোম্পানির কাছে পাঁচজনের একটি নামের তালিকা পাঠানো হয়। তাঁরা হচ্ছেন যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপপরিচালক মো. শাফিন জব্বার, জাতীয় কর্মসূচি সমন্বয়ক রূপালি শিশির বাণু, যক্ষ্মা ল্যাবরেটরি বিশেষজ্ঞ উম্মে তাসনিম মালিহা, বিভাগীয় যক্ষ্মাবিশেষজ্ঞ (ঢাকা উত্তর) ফারজানা জামান এবং সহকারী পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ এফ এম মনিরুল হক। প্রথমজন সরকারি কর্মকর্তা। বাকি চারজন দাতা সংস্থা গ্লোবাল ফান্ডের কর্মকর্তা। এই চারজন জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অফিসে বসে কাজ করলেও তাঁদের বেতন–ভাতা দেয় গ্লোবাল ফান্ড।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এর আগে ২০২১–২২ ও ২০২২–২৩ অর্থবছরে কিউর এআইয়ের কাছ থেকে সফটওয়্যার কিনেছে। এই সফটওয়্যার কেনা হয় গ্লোবাল ফান্ডের টাকায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সফটওয়্যার যক্ষ্মা শনাক্তের কাজে ব্যবহৃত হয়।
সংশ্লিষ্ট একজন সরকারি, তিনজন বেসরকারি ও একজন দাতা সংস্থার প্রতিনিধি প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, আরও সফটওয়্যার কেনার প্রক্রিয়া চলমান। কোন কোম্পানির কাছ থেকে তা কেনা হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে একটি কোম্পানির কাছে অর্থসহায়তা চেয়ে জোবায়দা নাসরিনের এই চিঠি নানা সন্দেহ তৈরি করেছে।
তাঁরা কিছুই জানতেন নাযক্ষ্মা একটি সংক্রামক রোগ